মানুষ মানে মানুষ।
লিখেছেন লিখেছেন তানভীর তুর্য্য ১৭ সেপ্টেম্বর, ২০১৮, ১০:১৩:৩১ রাত
মানুষ বলতে যদিও একজনকে বুঝানো হয়, তথাপি মানুষ মানে প্রাণীজগতের একটি প্রজাতি। মানুষ জাতি ও রাজনৈতিক পরিচয়ের পরেও একটি মহামানবজাতির অংশ। বিশ্বের সকল মানুষই তার স্বজন। সমগোত্রীয়। এমন বৈজ্ঞানিক সত্য জানার পরেও মানুষে মানুষে মৈত্রী সব সময় সম্ভব হয় না। প্রধানত রাজনৈতিক ও জাতিগত হিংসার কারণে মানব সমাজের একটি অংশ আরেকটি অংশকে হনন করতে চায়। শক্তি ও ক্ষমতার বলে হত্যা ও নিধনের চেষ্টা চালায়। রাজনৈতিক ও মতাদর্শগত পার্থক্যের কারণে ফাঁসি দেয়, জেলে পাঠায়, দেশ থেকে তাড়িয়ে দেয়। এমনটি যে কেবল আদি বা মধ্যযুগে হয়েছে, তা নয়, অতি আধুনিক বর্তমানকালেও বিশ্বের দেশে দেশে ঘটছে। আমাদের চারপাশে এবং চোখের সামনেই ঘটছে। অথচ এমনটি ঘটা মোটেও উচিত নয়; এমনটি ঘটার কথাও নয়। কিন্তু উগ্র রাজনীতিবিদগণ প্রতিনিয়ত হিংসা, বিদ্বেষ প্রচার করে জনগণকে বিষাক্ত করে ফেলে। জনগণকে উগ্রতার দিকে ঠেলে দেয়। মানুষকে বাধ্য করে প্রতিপক্ষ নিধনে। এসবই করা হয় এমন একটি রাজনৈতিক ফন্দিতে যে মানুষ ন্যায়-অন্যায় বোধ হারায়। হত্যা ও নিধনকেই মনে করে বৈধ। অপরাধকে মনে করে পুণ্য। এক বারও চোখ খুলে প্রকৃত ঘটনাটি দেখতে চায় না বা দেখতে চাইলেও কর্তৃপক্ষ মানুষকে সব দেখতে বা জানতে দিতে চায় না। একটা প্রচ্ছন্ন গুজব, প্রচারণার প্রবল আচ্ছন্নতা ইত্যাদির দ্বারা এমনই একটি পরিবেশ আরোপ করা হয় যে, যুক্তি বোকা ও বোবা হয়ে যায় আবেগের তীব্রতার সামনে। নৈতিকতার কথা বলতে ভয় পায়। ন্যায়-অন্যায় বোধ বলতে কিছুই অবশিষ্ট থাকে না। এক প্রবল উন্মাদনায় সবাই তখন উগ্রতারই অনুসরণ করে। মানুষের আর্তনাদ শুনতে পায় না। সত্যের পরাজয় দেখতে পায় না। এ রকম অস্বাস্থ্যকর পরিস্থিতি ও পরিবেশে প্রতিপক্ষের ক্ষুদ্র জাতি, দল বা ব্যক্তিকে নিধন ও নির্মূল করার উৎসব চলে।
এ রকম উগ্রতার বিকাশ, পৃষ্ঠপোষকতা ও চর্চার কিছু সুনির্দিষ্ট কারণ আছে। প্রথমত ও প্রধানত যে কারণটির কথা বলা যায়, তা হলো, নিজের অপরাধ ও অপকর্মকে আড়াল করার প্রবণতা। মানুষের দৃষ্টি ও আগ্রহ সরিয়ে দেয়ার জন্য এমন উগ্রতা ও সেনসেশন তৈরি করা হয়। এর ফলে দুর্নীতি, অপকর্ম, স্বৈরতা চাপা পড়ে। মানুষ যুক্তিবাদী মনে নানা বিষয় ও কার্যক্রম বিচার-বিশ্লেষণ করার সুযোগ পায় না। সবাই তখন লেলিয়ে দেয়া ইস্যুর পেছনে পাগলের মতো ধাওয়া করে। হিটলার তার স্বৈরতা ও একনায়কত্ব কায়েমের প্রয়োজনে প্রবল জাতিগত বিদ্বেষ সৃষ্টি করেছিল। জার্মান জাতি উন্মাদের মতো প্রতিপক্ষের ওপর ঝাঁপিয়ে নিধনযজ্ঞে লিপ্ত হয়েছিল। হিটলারের কুকর্মের দিকে নজর দেয়ার সুযোগ পায় নি। তলে তলে হিটলার যে দানবের মতো পুরো দেশ ও জাতিকে গ্রাস করছে এবং সমগ্র বিশ্বকে একটি ভয়াবহ বিপদের মধ্যে ফেলে দিচ্ছে, সেটা অনুধাবণ করার মতো পরিস্থিতি ছিল না; মানুষের মানসিকতাও ঠাণ্ডা মাথায় ভাবার স্তরে ছিল না। একই কাণ্ড করেছিল স্বৈরশাসক স্ট্যালিন। রাশিয়ায় সমাজতন্ত্রের উন্মাদনায় মানুষকে প্রচ-ভাবে ক্ষেপিয়ে দেয়া হয়েছিল। হাজার হাজার মানুষকে নির্যাতন শিবিরে পাঠিয়ে হত্যা করা হয়েছিল সমাজতন্ত্রের শত্রু নাম দিয়ে। বিরুদ্ধবাদী লিও ট্রটস্কিকে দূরদেশে হাতুড়ি দিয়ে মাথা থেঁতলে মেরেছিল ভাড়া করা হন্তারক পাঠিয়ে। তাৎক্ষণিকভাবে মানুষ ভেবেছিল সব কিছু ভালোর জন্যই করা হচ্ছে। মানুষের মধ্যে এমনই একটি বোধ ও ধারণাই প্রচার করেছিল স্বৈরশাসক। কিন্তু অচীরেই দেখা গেল, রাশিয়ায় মানুষ না খেয়ে মারা যাচ্ছে। আমলা ও সেনাপতিরা ফুলে-ফেঁপে ওঠছে এবং সমাজতন্ত্রের নাম ভাঙিয়ে স্ট্যালিন পূর্ব ইউরোপের দেশগুলো যথা, চেকোস্লাভাকিয়া, হাঙেরি, বুলগেরিয়া ইত্যাদিতে সেনাবাহিনী পাঠিয়ে দখল করে নিয়েছে। প্রবল অগণতান্ত্রিক ও অমানবিক কাজকেও এক ধরনের উন্মাদনার মোড়কে চালিয়ে দেয়া হয়েছিল। অতএব মানুষ সাময়িকভাবে বোধ ও বিবেচনা শক্তি হারিয়েছিল এবং হত্যা-নির্যাতন, খুন-গুম, প্রতিপক্ষ নিধনকে মনে করেছিল বৈধ ও যৌক্তিক। পরবর্তীতে উত্তেজনা থিতিয়ে এলে সত্য উদ্ভাসিত হয়। স্ট্যালিন স্বৈরতন্ত্রের প্রয়োজনে অন্যায়ভাবে বহুজনকে নিধন করেছে মানুষের ভাবাবেগকে কৌশলে প্রভাবিত করে।
হিটলার বা স্ট্যালিনের মতো এমন কুকর্ম এখনো চলছে বিশ্বের বিভিন্ন স্থানে। বহু শাসক সে পথ খুবই কৌশলে অবলম্বনও করছে। প্রতিপক্ষের ব্যক্তি, দল ও মানুষকে মারা হচ্ছে মানুষকে ভুল বুঝিয়ে বা ভুল ব্যাখ্যা দিয়ে। ভুল ভাবে প্রভাবিত করার রাজনীতির আসল লক্ষ্য অবশ্যই মহৎ নয়, ব্যক্তি-দল বা গোষ্ঠীগত স্বার্থের কুমতলবে পূর্ণ। যুক্তির বদলে জাতিগত, ধর্মগত, রাজনৈতিক আবেগগত উন্মাদনা সৃষ্টি গণতান্ত্রিক সুশাসনের সম্পূর্ণ পরিপন্থী। বরং সংখ্যালঘু বা ভিন্নমতের মানুষ ও দলকে নিধনের একটি বহু-ব্যবহৃত ও বহু-চর্চিত অপকৌশল মাত্র। এই কৌশল অবশ্যই নিন্দনীয় এবং অকল্যাণকর। এই কৌশল কখনোই স্থায়ীভাবে কাজে লাগে না। সাময়িক ফায়দা এনে দেয় কুশাসকদের। মানুষের মানবিক চোখ এবং অন্তর্গত বিবেক জাগ্রত হলে পুরো কৌশলটিই পরাজিত হয়। মানুষ যখন দেখতে পায় তথাকথিত গণতন্ত্র, উন্নয়ন ইত্যাদি আসলে ছিল বাগাড়ম্বর এবং মিথ্যাচার, তখন কৌশলী স্বৈরশাসকদের পতন ঘটে। মানুষ যখন টের পায় যে, অপকর্ম আড়ালের জন্য আবেগ, উচ্ছ্বাস ও উন্মাদনা সৃষ্টি করা হয়েছে এবং প্রতিপক্ষকে অন্যায়ভাবে নিধন করা হচ্ছে, তখন রুখে দাঁড়ায়। মানুষ যে আসলেই শান্তি চায়, আইন চায়, নীতি চায়, সত্য চায় এবং দ্বন্দ্ব-সংঘাত-হানাহানি ও অন্যায় আক্রমণকারী হতে চায় না; এটাই পরম সত্য।
বিষয়: বিবিধ
৪৫০ বার পঠিত, ০ টি মন্তব্য
পাঠকের মন্তব্য:
মন্তব্য করতে লগইন করুন