কোটা পদ্ধতি বাতিল নয়, সংস্কার চাই

লিখেছেন লিখেছেন এস এম মাহবুব হোসেন ২৬ এপ্রিল, ২০১৮, ০১:৫৪:০৯ দুপুর

মুক্তিযুদ্ধ করা হয়েছিল একটি বৈষম্যহীন রাষ্ট্র সৃষ্টির উদ্দেশ্যে। চাকরি, অর্থনৈতিক, রাজনৈতিক বৈষম্যেসহ বিভিন্ন ধরনের বৈষম্যের নিরসন ছিল আমাদের স্বাধীনতা সংগ্রামের মূল লক্ষ্য। জাতি মুক্তিযোদ্ধাদের প্রতি গভীর শ্রদ্ধাবনত। কেননা তারা জাতির শ্রেষ্ট সন্তান। আজ অত্যন্ত দুঃখের সাথে বলতে হচ্ছে স্বাধীন বাংলাদেশের করুণ ইতিহাস, স্বাধীনতার দীর্ঘ ৪৭ বছর পরও বৈষম্য দূর হয় নাই আমাদের এই স্বাধীন দেশে। সরকারি চাকুরির ক্ষেেত্র কোটা পদ্ধতির মাধ্যমে মেধাবীদের মূখে লাথি মারা হচ্ছে। এদেশের মেধাবীরা ছিটকে পড়ছে। মেধাবীদের প্রতিনিয়ত হার মানতে হচ্ছে কোটাদারীদের কাছে। যেদেশে মেধার মূল্যায়ন নেই, সেদেশে সুশিক্ষা আসবে কোথা থেকে? যে দেশের গুরুত্বপূর্ণ পদগুলো কোটাদারীদের দখলে, সেদেশের মেধাবী ছাত্রছাত্রীরা লেখাপড়া শেষে কি করবে? তাই মেধার মূল্যায়ন দিয়ে কোটা সংস্কার করা এখন সময়ের দাবি।

গত আট এপ্রিল রোববার বেলা আড়াইটায় পাবলিক লাইব্রেরির সামনে বাংলাদেশ সাধারণ ছাত্র অধিকার সংরক্ষণ পরিষদের ব্যানারে হাজার হাজার শিক্ষার্থী ও চাকরি প্রত্যাশীরা সমাবেত হয়ে সরকারি চাকরিতে কোটা পদ্ধতির সংস্কারে পাচ দফা দাবিতে শাহবাগ মোড়ে অবরোধ করে বিক্ষোভ শুরু করলে পুলিশ জলকামান নিয়ে ঘটনাস্থলে অবস্থান নেয়! এমতাবস্থায় শাহবাগ মোড়ে যান চলাচল পুরোপুরি বন্ধ হয়ে যায়।

বিকাল ৫টার দিকে ঢাকা মহানগর পুলিশের রমনা জোনের সহকারী উপকমিশনার (এডিসি) আজিমুল হক বিক্ষোভকারীদের ‘জনদুর্ভোগ’ সৃষ্টি না করে রাজপথ থেকে সরে যেতে বলেন। ছাত্র অধিকার সংরক্ষণ পরিষদের আহ্বায়ক ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষার্থী হাসান আল মামুন মহানগর পুলিশের রমনা জোনের সহকারী উপকমিশনার (এডিসি) আজিমুল হককে বলেন, আমাদের আন্দোলন সম্পূর্ণ অহিংস, কেউ যদি আমাদের বুকে গুলিও চালায় আমরা কিছু করব না। এসময় বিক্ষোভকারী ছাত্রছাত্রীদের দিকে পুলিশ তেড়ে আসলে বেশকয়েকজন বিক্ষোভকারী ছাত্র হাতে গোলাপ নিয়ে পুলিশের দিকে এগিয়ে গেলে, আমাদের পুলিশ ভাইদের বিবেক নাড়া দেয়, পুলিশ ভাইদের মনুষ্যত্ব বাধা দেয় বিক্ষোভকারী ছাত্রছাত্রীদের ওপর আত্রমণ করতে। তাই পুলিশ ভাইয়েরা বাধ্য হয়ে ঘটনাস্থল ত্যাগ করে।

কোটা সংস্কারের দাবিতে বিক্ষোভকারীরা শাহবাগ মোড় প্রায় সাড়ে চার ঘণ্টা অবরোধ করে রাখার পর গত আট এপ্রিল রোববার রাত ৮টায় উপরের নির্দেশে বিক্ষোভকারীদের ওপর লাঠিপেটাসহ রাবার বুলেট ও কাঁদানে গ্যাস ছোড়া শুরু ‍করে পুলিশ। এসময় ঘটনাস্থলে থাকা সাংবাদিকদের ওপর আক্রমণ করে ছাত্রলীগ। বিডিনিউজ টোয়েন্টিফোর ডটকম- এর প্রতিনিধিও এসময় আহত হন। ভেঙ্গে ফেলা হয় তার ক্যামেরা।

এসময় অর্ধশতাধিক ছাত্রছাত্রীকেও আহত হতে দেখা যায়।

পুলিশের অতর্কিত হামলায় অবরোধকারীরা ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের টিএসসির দিকে পিছু হটলে তাদের ওপর চড়াও হয় ছাত্রলীগ নেতা-কর্মী। পুলিশকে সাহায্য করার লক্ষে বাংলাদেশ সরকার ছাত্রলীগ বাহিনীকে সুপ্রিম পাওয়ার দিয়ে গঠন করেছে। এই বাহিনীটি দেশের ডিজিটাল উন্নয়নে ব্যাপক অবদান রেখে চলেছে। যেমনটা করেছে কোটা সংস্কারের দাবিতে বিক্ষোভকারী ছাত্রছাত্রীদের ওপর চড়াও হয়ে।

বিক্ষোভকারী ছাত্রছাত্রীদের ওপর পুলিশ ও ছাত্রলীগ বাহিনীর হামলার প্রতিবাদে সারাদেশের বিশ্ববিদ্যালয় শিক্ষার্থীরা ক্ষোভে ফুঁসে ওঠেন। ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় ক্যাম্পাসে কোটা সংস্কারের দাবিতে বিক্ষোভরত শিক্ষার্থীদের সঙ্গে পুলিশ ও ছাত্রলীগ কর্মীদের রোববার রাতভর সংঘর্ষ হয়। একই রাতে বিক্ষোভ দেখায় দেশের প্রতিটি বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষার্থীরা।

পুলিশ ছাত্রছাত্রীদের ওপর কাঁদানে গ্যাস ও রাবার বুলেট ছুড়তে থাকলে ছাত্রছাত্রীরাও ইট পাটকেল ছুড়ে তার জবাব দেয়। বোববার রাত সাড়ে ১০টার দিকে টিএসএসির রাজু ভাস্কর্যে জড়ো হয়ে সমাবেশ করে বিক্ষোভকারীরা। এসময় পরিষদের আহ্বায়ক হাসান আল মামুন সোমবার থেকে সারাদেশের শিক্ষা প্রতিষ্ঠানে অনির্দিষ্টকালের ধর্মঘটের ডাক দেন এবং দাবি আদায় না হওয়া পর্যন্ত সোমবার থেকে লাগাতার কর্মসুচির ঘোষণা দেন। সোমবার সকালে প্রতিবাদ কর্মসূচিতে যোগ দেয় সারাদেশের প্রতিটি বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষার্থীরা। এ পরিস্থিতিতে 'সাধারণ ছাত্র অধিকার সংরক্ষণ পরিষদ’ ব্যানারে আন্দোলনরতদের প্রতিনিধিদের সঙ্গে সেতুমন্ত্রী ওবায়দুল কাদেরের নেতৃত্বে ক্ষমতাসীন আওয়ামী লীগের একটি প্রতিনিধি দলের বৈঠক হয় গত সোমবার বিকালে।

গত ৯ এপ্রিল সোমবার একদিকে আন্দোলনকারী 'সাধারণ ছাত্র অধিকার সংরক্ষণ পরিষদের’ প্রতিনিধিদের সঙ্গে সেতুমন্ত্রী ওবায়দুল কাদেরের নেতৃত্বে ক্ষমতাসীন আওয়ামী লীগের একটি প্রতিনিধি দল বৈঠকে বসে। অন্যদিকে সংসদ অধিবেশনে অনির্ধারিত আলোচনায় আন্দোলনকারী ছাত্রছাত্রীদের নিয়ে সমালোচনা করা হয়।

জাতীয় সংসদে কৃষিমন্ত্রী মতিয়া চৌধুরী বলেন, “মুক্তিযোদ্ধাদের সন্তানেরা সুযোগ পাবে না, রাজাকারের বাচ্চারা সুযোগ পাবে? তাদের জন্য মুক্তিযোদ্ধা কোটা সংকুচিত হবে? ‘মতলববাজদের’ প্রতি কোনো শৈথিল্য না দেখানোর বিষয়েও অবস্থান জানান আওয়ামী সরকারের এই বর্ষীয়ান মন্ত্রী।

আমি রাজাকারের বাচ্চা কৃষিমন্ত্রী মতিয়া চৌধুরীর কাছে জানতে চাই, মুক্তিযুদ্ধ করা হয়েছিল একটি বৈষম্যহীন রাষ্ট্র সৃষ্টির উদ্দেশ্যে। “বর্তমান কোটা ব্যবস্থা কি মুক্তিযুদ্ধের চেতনার পরিপন্থী নয়? বর্তমানে স্বাধীন বাংলাদেশে কোটা পদ্ধতির মাধ্যমে আবারও কি বৈষম্যের সৃষ্টি করা হচ্ছে? মুক্তিযোদ্ধা ছাড়া বাংলাদেশের বাকি সব মানুষেই কি রাজাকার বা রাজাকারের বাচ্চা? ৫৬% কোটা পদ্ধতার মাধ্যমে আমাদের প্রিয় দেশটাকে মেধা প্রতিবন্ধী করা হচ্ছে কার ষড়যন্ত্রে? ৭১ নামক স্বাধীনতা যুদ্ধের ট্যাবলেটটি শুধুমাত্র ক্ষমতার জন্য ব্যবহার করবেন না। একটু গভীরভাবে লক্ষ করে দেখুন, “বর্তমান কোটা ব্যবস্থা মুক্তিযুদ্ধের চেতনার পরিপন্থী। ৭১ এ ৩০ লক্ষ বাঙ্গালী জীবন দিয়েছি, একটি বৈষম্যহীন রাষ্ট্র সৃষ্টির উদ্দেশ্যে।

পাক শাসকদের বৈষম্যের বিরুদ্ধে। কিন্তু দুঃখজনক বিষয় হলেও সত্য যে, বর্তমানে স্বাধীন বাংলাদেশে কোটা পদ্ধতির মাধ্যমে আবারও বৈষম্যের সৃষ্টি করা হচ্ছে।

কোটা পদ্ধতি কি?

কোনো দেশের পিছিয়ে পড়া জনগোষ্টিকে এগিয়ে নেওয়ার জন্য কোটার প্রচলন করা হয়।

বর্তমানে আমাদের দেশে ৫ শতাংশ কোটা রাখা হয়েছে ক্ষুদ্র নৃ-গোষ্ঠীর জন্য। প্রতিবন্ধীর জন্য রাখা হয়েছে ১ শতাংশ, মুক্তিযোদ্ধার সন্তানদের জন্য রাখা হয়েছে ৩০ শতাংশ, নারী ও জেলা কোটা ১০ শতাংশ করে। সব মিলিয়ে কোটার জন্য বরাদ্দ ৫৬ শতাংশ। ফলে এই কোটার মধ্যে যারা পড়েন না, তাদের প্রতিযোগিতা করতে হচ্ছে বাকি ৪৪ শতাংশের জন্য। আমাদের দেশের মতো অন্য কোনো দেশে এতো সংখ্যক কোটা নেই। কোটা সংস্কারে আন্দোলনকারীরা কিন্তু কোটার বিরুদ্ধে নয়। তারা বরং কোটা পদ্ধতিকে সীমিত পর্যায়ে নিয়ে আসার জন্য দাবি জানাচ্ছে।

অধ্যাপক জাফর ইকবালের মতে, দেশের মানুষ মুক্তিযোদ্ধাদের ভালোবাসে, সম্মান করে। মুক্তিযোদ্ধা কোটা যদি সীমিত পর্যায়ে থাকত তাহলে মুক্তিযোদ্ধারা এত অসম্মানিত হতেন না। মুক্তিযোদ্ধাদের সম্মান ‘অক্ষুণ্ন রাখতেই’ কোটা সংস্কার করে একটি ‘যৌক্তিক মাত্রায়’ নিয়ে আসা দরকার।

কোটা সংস্কারের দাবিতে টানা চারদিন ধরে লক্ষ লক্ষ শিক্ষার্থী ও চাকরি প্রত্যাশীদের আন্দোলন চলাকালে আজ ১১ এপ্রিল জাতীয় সংসদে প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা ঘোষণা দিলেন, সরকারি সব চাকরিতে কোটা পদ্ধতি বাতিল। মাননীয় প্রধানমন্ত্রী, দেশের লক্ষ লক্ষ শিক্ষার্থী ও চাকরি প্রত্যাশীরা তো কোটা সংস্কারের জন্য আন্দোলন করেছে। বাতিলের জন্য নয়। গত ৯ এপ্রিল কৃষিমন্ত্রী মতিয়া চৌধুরী যখন আন্দোলনরত লক্ষ লক্ষ শিক্ষার্থীদের রাজাকারের বাচ্চা বললেন, সেই কৃষিমন্ত্রী মতিয়া সম্পর্কে তো কিছু বললেন না? আন্দোলনরত শিক্ষার্থীরা চাইল কোটা সংস্কার। অথচ আপনি দেশে প্রচলিত সব কোটা পদ্ধতিই বাতিল বলে ঘোষণা দিলেন? এ যেন মেঘ না চাইতেই বৃষ্টি।

আমরা চাইলাম কোটা সংস্কার। শুনলাম সব কোটাই বাতিল করা হয়েছে। একটু ভাবি ঘটনা কি হতে পারে? এখন কোটার দাবীতে মুক্তিযোদ্ধা, প্রতিবন্ধী ও উপজাতিরা মাঠে নেমেছে। কৌশলে এদের আন্দোলনে কঠিন ভাবে সাইজ করা শুরু করেছে। তারপর দোষ চাপাচ্ছে, কোটা সংস্কার আন্দোলনে জড়িত ছাত্র-ছাত্রীদের উপর।

কোটা পদ্ধতি বাতিল নয় সংস্কার চাই। মুক্তিযোদ্ধা, প্রতিবন্ধী ও উপজাতিরা অবশ্যই কোটার আওয়তাভুক্ত থাক। তবে সেটা সহনীয় মাত্রায়।

বিষয়: রাজনীতি

৫০৯ বার পঠিত, ০ টি মন্তব্য


 

পাঠকের মন্তব্য:

মন্তব্য করতে লগইন করুন




Upload Image

Upload File