কিসের জন্য এই কপটতা ?

লিখেছেন লিখেছেন মারুফ আহাম্মদ ২৬ এপ্রিল, ২০১৮, ০৬:১১:৪২ সকাল

একটা নববর্ষের কথা খুবই মনে পরে, চারিদিকে বোশেখি আমেজ যখন আসতে শুরু করে, প্রতি বছর প্রায় নিয়ম করেই ঐ সময়টাতে সেই ফিলিংসগুলিও মনে আসে। ফরমালিন যুগের আগের কথা, পঞ্চবিংশ-বর্ষ পূর্বেকার স্মৃতি। পঞ্জিকায় সেই বছর চৌদ্দ শত অব্দের সূচনা ঘটে। কাজেই উৎসবে কিছুটা ব্যতিক্রমতো ছিলই। ইন্টারমিডিয়েটে পড়া বড় ভাইরা রবীন্দ্রনাথের কবিতা আওড়াচ্ছেন --- আজি হতে শত বর্ষ পরে, কে তুমি পড়িছ বসি আমার কবিতা খানি, আগ্রহ ভরে। রেডিও বাংলাদেশ সাত দিন ব্যাপী আনন্দ অনুষ্ঠান প্রচার করেছে। পেপারে পত্রিকায় নানা রকমের সংখ্যা। সেই সাথে প্রকৃতির নিয়মিত আয়োজন। আমি তখন কৈশোরে, ভুলে কিছুই যাইনি। ঘাস-লতা-তরু সব কিছুতে নিরেট সবুজের ঝালর; দিগন্ত বিসতৃত কচি পাটের ক্ষেত, তার উপর দিয়ে দৃষ্টি নন্দন তরঙ্গে হু-হু করে বয়ে আসা দক্ষিণের শীতল হওয়া। আরো কত কী! চারিদিকে তাকালেই মনে হয় প্রকৃতি যেন সর্ব শেষ টুকু দিয়ে অপরূপ সাজে প্রস্তুত হয়ে বসে আছে, একটা উৎসব চায়। অতয়েব, উৎসব হয় এই বাংলায়। নানা আনুষ্ঠানিকতায় পরিপূর্ণ উৎসব। পুরো বৈশাখ জুড়ে মেলা। আর মেলা ঘিরে আনন্দ করার রকমারি প্রদর্শনী। লাঠি খেলা আর গরুর দৌড় ছাড়াতো মেলাই জমতনা। হাজার হাজার দর্শক উপভোগ করত সেসব বিষয়। সমগ্র বাংলাদেশ মাতিয়ে তুলে বৈশাখ গুলি তখন জানিয়ে দিতো নতুন বৎসর আগমনের খবর। ছোট্ট দোকান থেকে বড় বড় ব্যবসা প্রতিষ্ঠান, সর্ব ক্ষেত্রে চলত হালখাতা কেন্দ্রিক আয়োজন। সেই উৎসবের কি মাত্রা ব্যাখ্যা করে বুঝানো কঠিন, মাস জুড়ে মিষ্টি খাওয়ার ধুম। আনন্দ আর আনন্দ। এইতো বাংলার প্রাণের উৎসব ! প্রতি বছর একই চিত্র; তবে চৌদ্দশতে উৎসবে বাড়তি প্রাবল্য ছিল বিধায় স্থায়ী ছাপ রয়ে গেছে আজো।

ভ্রান্ত হলেও একটা ধারণা গ্রামে গ্রামে প্রচলিত ছিল, ঐ দিন যা করা হয় পুরো বৎসর তা করা যায়, যা খাওয়া হয় বৎসর ধরে তা খাওয়া যায়। কাজেই কষ্ট করে হলেও একটুখানি ভালো রান্নার বন্দবস্ত হতো প্রায় সবার ঘরেই। বড় বোনের সাথে আড়ি করে মাংসের চর্বি খেতাম, সারা বছর চর্বি ওয়ালা মাংস খেতে পারার আশায়। তবে পান্তা কখনো খাইনাই। বছর ধরে পান্তা খেয়ে যেতে হবে সেই ভয়ে ঠিক নয়, এই কাস্টমসটাই প্রচলিত ছিলনা। তার পরেও সময় যায়, পরিবর্তনের ছোয়া লাগে সব কিছুতে। কিন্তু কিছু কিছু পরিবর্তন কেমন যেন কষ্ট দিয়ে ফেলে। মনে হয় সহস্র বৎসর ধরে এগুলো অপরিবর্তিত থেকে যেতে পারাতেই সার্থকতা ষোল কলায়। আর সেই পরিবর্তনটা যদি হয় নিয়মের বিপরীতে জবরদস্তি কিংবা অভিসন্ধির ফলশ্রুতি হিসাবে, কষ্টের সাথে তখন বিচার বোধও কথা বলে। মা যত দরিদ্রই হোক, সন্তানকে তাঁর জীর্ন ক্রোড়ই পারে স্বর্গ-সুখ দিতে। কাজেই মায়ের কোল থেকে শিশুকে বিচ্ছিন্ন করার পক্ষে যত মজবুত যুক্তিই থাক, আমার বিচার বোধ কেবলই বলতে থাকে সেটা অন্যায়, সে অপরাধ। সিকি শতাব্দী পর আজকের দিনে নববর্ষ উয্যাপনের দৃশ্যে বুকের ভিতরটা কেমন হা হা করে উঠে। শুধুই বলতে ইচ্ছে করে এ অন্যায়, এ ক্ষমার অযোগ্য অপরাধ। বক্তব্যে বিস্মিত হওয়া যেতে পারে, কিন্তু মনে যেন কিছু করা না হয়, কারন অধিকার হারা হৃদয়ের অশ্রুপাত এগুলো।

বৈশাখী নববর্ষের শিকড় বাংলার হৃৎপিণ্ডের পড়তে পড়তে গ্রথিত, অবারিত বাংলার কোল জুড়েই কেবল তার সৌন্দর্য্য। মাঠ চিড়ে কাঁচা রাস্তা, দুইধারে সবুজ শস্যের ক্ষেত, সেঁতসেঁতে ধান ক্ষেতের আইল, দিন ভর আম পাকানি পোকার ঝিনঝিনানি, ফাঁকে ফাঁকে কুকিল পাখির ডাক, এই সব কিছুতে মিশে আছে বৈশাখ। অন্যথা করে গ্রামের জিনিস শহরে টেনে নিয়ে যাওয়া যেতে পারে, কোট-প্যান্ট পড়িয়ে সাহেবও বানিয়ে ফেলা যেতে পারে, তাতে হয়তো মাতৃ-নেত্র অশ্রুসিক্ত হয়ে উঠবে বেশি হলে। কিন্তু সমগ্র বাংলার নাড়ির সাথে যা অবিচ্ছেদ্য বন্ধনে বাঁধা এবং সকল মানুষের অধিকার যাতে অভিন্ন বলে শতাব্দী পরম্পরায় স্বীকৃত হয়ে আসছে, জবরদস্তি করে যদি তাকে ধর্মের পোশাক পড়িয়ে একটা বিশেষ ধর্মীয় আচারে পরিণত করে ফেলা হয়, বিচার বোধ কিন্তু তখন কথা না বলে আর থাকতে পারেনা। সার্বজনীন উৎসব বাংলাদেশে দুটো খুঁজে পাওয়া যাবেনা। ক্ষতি কি হতো সেটা যেভাবে চলে আসছিল সেভাবে সবার জন্য উন্মুক্ত রেখে দিলে?

মঙ্গল শোভাযাত্রা হিন্দু সম্প্রদায়ের একটা বিশেষ ধর্মীয় আচার। এটা যে না জেনে তর্ক করে তাকে ভালো করে জেনে নিতে উপদেশ দেয়া যায়, কিন্তু যে জেনে বুঝে সেটা করে তাকে কি বলা যায়? আমি বলি সে ইতর, ভন্ড, কপট। পহেলা বৈশাখ কখনো ধর্মীয় অনুষ্ঠান হতেই পারেনা। বাংলাদেশে ধর্মীয় বিচারে সংখ্যাঘরিষ্ঠের পক্ষ থেকে কখনো যদি এই দাবি আসে যে আগামী বছর পহেলা বৈশাখের উৎসব হিসাবে সবাইকে পাঞ্জাবি পাজামা টুপি পড়ে মাঠে গিয়ে দুই রাকাত নামাজ পড়তে হবে, নামাজ শেষে পুরো বিকেল জিকির-আসগারে কাটাতে হবে এবং রাতভর চলবে ওয়াজ মাহফিল! আমি তখন তাকে ধৃষ্টতা বলব। যেমনটা আজকে নববর্ষকে মঙ্গল শোভাযাত্রায় বিলীন হতে দেখে বলি।

কাজেই দাবি জানাই, বাংলার সকল মানুষের প্রাণের উৎসব আবারও সকলের কাছে ফিরিয়ে দেওয়া হোক। আনন্দে আনন্দে ভরে উঠুক বৈশাখ। শুভ কামনা।

বিষয়: বিবিধ

৬৪২ বার পঠিত, ১ টি মন্তব্য


 

পাঠকের মন্তব্য:

385178
২৭ এপ্রিল ২০১৮ রাত ০৮:৩২
শেখের পোলা লিখেছেন : বড়ই সে কেলে বা প্রোগতির বিপক্ষে বলে গালি খাওয়ার ভয় নিয়েও সহমত হলাম।

মন্তব্য করতে লগইন করুন




Upload Image

Upload File