ফল ভারে বৃক্ষ নত

লিখেছেন লিখেছেন মারুফ আহাম্মদ ২৪ এপ্রিল, ২০১৮, ০৩:৫৬:৫৩ রাত

স্বদেশী একজন নতুন ফরাসি ভাইয়ের সাথে দেখা হলো আজ। মাস-দুই হলো ওনি কমিশন থেকে রিফিউজি মর্যাদা পেয়েছেন। বেশ কয়েক ঘন্টা আমি ওনার সাথে বা ওনি আমার সাথে ছিলেন। বিচিত্র অভিজ্ঞতায় ঝোলা পরিপূর্ন করার স্বাধ থাকলে এই জাতীয় ঘটনাও অনেক সময় উপাদেয় হয়ে উঠে। যাই হোক গোটা দুনিয়ার সমস্ত মানুষকে যদি দুই ভাগে ভাগ করে ফেলা হয় তাইলে এক ভাগে নিশ্চিত ভাবে যারা ফরাসি (ওনার ভাষায়) অর্থাৎ যাদের ফ্রান্সে রিফিউজি স্ট্যাটাস আছে তারা আর অন্য ভাগে যাদের এই জিনিস নাই তারা -- এই মহান তত্বের আবিষ্কার কিছুক্ষনের জন্য হলেও বিচলিত করে তুলেছিল আমাকে। এইটা শুধু ওনার অভিমতই নয়, পরনের পোশাক, পায়ের জুতো, হাতের ব্রেসলেট, চুল কাটার ধরণ, সিগারেট খাওয়ার ভঙ্গি এই সব কিছু দিয়ে সার্বক্ষণিক সেটার প্রমান দিতেও তিনি সর্বান্তকরণে সচেষ্ট। বেশিরভাগ সময়ই আমি ওনার শ্রোতা ছিলাম, কখনো কখনো প্রশ্ন করেছি কিন্তু তর্ক হতে পারে এমন কোন যুক্তিতে যাই নাই। ভদ্রলোক কথাবার্তার ফাঁকে ফাঁকে মাঝে মাঝেই বিলাতি উচ্চারণে ইংরেজি বলার আপ্রাণ চেষ্টা করে যাচ্ছেন, যদিও সেটা পুরোপুরি হয়ে উঠছেনা বিধায় প্রতিবারেই কথাগুলো একধরণের হাসি উদ্রেককারী শব্দদূষণের মতো আমার কানে বেজেছে কিন্তু আমি হাসিনাই।

ওনার ভাষ্য মতে উকিল-টুকিল কিছুইনা কেইস পেতে যেই জিনিসটা বেশি করে দরকার তার নাম স্মার্টনেস। ওনি স্বয়ং যেখানে জীবন্ত স্মার্টনেসের বর্ণনা হিসাবে আমার সামনে বসে আছেন আমার আর তাই জিজ্ঞেস করতে হলনা স্মার্টনেস বলতে আসলে ওনি কি বুঝাচ্ছেন। যাই হোক এই জিনিসের চরম আতিশয্য কিভাবে ওনাকে কেইস পেতে সহযোগিতা করেছিল এবং বিপরীত ক্রমে একই জিনিসের অপর্যাপ্ততায় ওনার অতি নিকটজন কেমন করে কমিশন থেকেও রিফিউজ্ড হয়ে এখন কাগজহীনদের কাতারে পরে গেছেন, বহুক্ষণ ধরে সেই বিষয়ের চুলচেরা বিশ্লেষণ ওনি আমার কাছে তুলে ধরেছেন, শুনেগেছি আমি, সবকিছুতেই একধরণের প্রচ্ছন্ন আত্মসিদ্ধির ছাপ। আমি অবাক হয় নাই, কারণ দীর্ঘ আলাপ-চারিতায় যেটা বুঝা গেল তাতে মনে হয় যেই অবস্থান থেকে উঠে এসে ভদ্রলোক কাগজ হাতে পেলেন সেটা কাগজধারীদের তুলনায় যোজন দূরত্বের নিম্নতর কোন স্থান। সুতরাং, কাগজ পেয়ে ওনি আজ পৃথিবীতে দাঁড়িয়ে চাঁদ ছুতে পাড়ার আনন্দে আত্মহারা এবং অহংকারে দিশেহারা। চৌকিদারের চাকুরী করে জীবন সায়াহ্নে চলে আসা কারো হঠাৎ করে পুলিশের এস আই পদে পদোন্নতির আনন্দ এইটা। কাজেই অমূলক কিছু নয়। কিন্তু শ্রুতি কটু লেগেছে ওনি যখন কাগজহীনদের ব্যাপারে কাগজ নাপাওয়ার কারণ হিসাবে কিছু অযৌক্তিক বিষয়কে দ্বায়ী করে গায়ের জামা এবং গলায় ঝুলানো মাফলারকে প্রধান অন্তরায় বলে অশালীন বক্তব্য দিয়ে যাচ্ছিলেন তখন। ভাববেননা ওনি বোকা কিংবা পাগল। আর এই চরিত্রে তিনি একা অভিনয় করছেন এমনটিও কিন্তু নয়। আশেপাশে তাকিয়ে দেখেন এমন অনেককেই পাবেন যারা কাগজ পেয়ে যাবার পর কিছুটা অহমিকায় ভোগেন আর যারা পেলেননা তাদের প্রতি এক ধরণের তাচ্ছিল্য প্রদর্শন করে বেড়ান। বুঝাতে চান যে কাগজ প্রাপ্তি ওনার একচ্ছত্র কৃতিত্ব এবং টনটনে স্মার্টনেসের ফসল, কাজেই তারা সুপেরিয়র ! কে কি বলেন জানিনা কিন্তু আমি কখনো এই হিসাব মিলাতে পারিনা যে গায়ের জামা-কাপড় কিংবা শুদ্ধ করে বাংলায় কথা বলতে না পারা কিভাবে কাগজ না পাওয়ার কারণ হতে পারে।

যাকগে সে সব জটিল হিসাব, ভদ্রলোককে স্টেশনে পৌঁছে দিয়ে বাসায় ফিরছিলাম, হাটতে হাটতে লোকটার কথা গুলোই ঘুরপাক খাচ্ছিলো মাথায়। কথার সূত্রে কথা, এভাবে করে নানা বিষয় মনে পড়ছিলো। মনে পড়লো মুসা বিন শমসেরের কথা এবং ডাচ টেলিভিশনের সংবাদকর্মীর কাছে করা তার সেই কুখ্যাত দম্ভোক্তি যে, দারিদ্রের কারণে যারা খেতে পাচ্ছেনা তারা সবাই ইডিয়ট। আরো একটা কথা মনে পড়লো, আমার জীবনের কয়েকটা অভূতপূর্ব অভিজ্ঞতার মধ্যে সেটা একটা; পোশাক-আশাকে যে মানুষ চেনা যায়না তারই এক প্রত্যক্ষ এক্সপেরিয়েন্স, ধৈর্য্যচ্যুতি না ঘটলে পড়ে যেতে পারেন। বহুদিন আগে ফেইসবুকে করা পোস্ট থেকে কপি করে বসিয়ে দিলাম।

হারলোতে আমার নতুন জব। কাজ শেষে ছয়টা বাজার আগেই বাস স্ট্যান্ডে এসে দাড়িয়েছি, হারলো শপিং সেন্টার বাস স্ট্যান্ড। আসতে হন্ত-দন্ত, চলে এসে পায়্চারিই সার হলো, কারণ স্টেশন-মুখো বাস আসতে আরো প্রায় আধাঘন্টা। এলাকাটা লন্ডন থেকে খানিকটা দূরে, অতয়েব, জনবসতি কম হওয়ায় পাবলিক ট্রান্সপোর্টও লেস ফ্রিকোয়েন্ট; বোধ করি একই কারণে দেশীঘোচের কোন চেহারাও খুব একটা চোখে পরছেনা। যাইহোক দিনভর মনে মনে বাজতে থাকা হেমন্তের 'অকৃতি অধম' গান খানি এবার কন্ঠ পর্যন্ত চলে এল, গুনগুনাতে গুনগুনাতে বাস স্ট্যান্ডের এমাথা ওমাথা করছিলাম। স্টেশন গন্তব্যে বাস ছাড়ে স্টপ ইলেভেন থেকে। ওদিকেই হাটছিলাম, মাঝখানে স্টপ নাইনে বিপরীত ডিরেকশনে যেতে জটলা পাকানো জনা কয়েক লোকের মধ্য থেকে দৃষ্টি কাড়লো একজন, সাবকন্টিনেন্টাল চেহারা, দু'হাত ভর্তি বাজারের বেগ। এদিকেই তাকিয়ে ছিলেন ভদ্রলোক, চোখাচোখি হওয়াতে একটু এগিয়েই আসলেন, এবারে খাটি বাংলা,

--- বাংলাদেশী নাকি?

হাসতে হলো জবাব দিতে।

--- হ্যা ভাই।

--- নতুন মনে হয় এই দিকে?

--- আজকেই প্রথম। আপনি?

--- কয়েকদিন হলো কিন্তু কিছুই চিনিনা।

যদিও শুদ্ধ বাংলা বলছেন কথায় চট্টগ্রামের টান ছিল স্পষ্ট। বুঝতে পেরে বদ্দা সম্বোধন করে বসলাম।

--- বদ্দার বাড়ি চিটাগং এর কোন এলাকায়?

--- রাউজান। চিনেননাকি?

বলতে বলতে হাত থেকে বেশ কয়েকটা নীল পলেথিনে করা বাজারের পুটলি নিচে নামিয়ে রেখে আবার বললেন,

--- ব্যথা হয়ে গেছে হাত, এক সপ্তাহের বাজার ভাই, একেতো পুরা সপ্তাহে সময় পাইনি তার উপরে কাছাকাছি কোথাও হালাল মাংসের দোকান নেই। বউতো মহা বিরক্ত। বিশাল লিস্ট ধরিয়ে দিয়ে বললেন সব লাগবে। বাধ দেইনি কিছুই, সবই নিয়ে এসেছি। বলে হাত কচলাতে কচলাতে হাসতে লাগলেন।

আমিও হাসলাম, কিন্তু এক ধরনের দুঃখও বোধ করলাম। গেটআপ দেখে কিচেন পর্টারের বেশি কিছু চিন্তা করতে পারিনি। জিজ্ঞেস করলাম ---

--- ভাবি কাজ করেন?

--- নাহ।

এইবারে সহানুভুতি। সচেতন মানবমন উপস্থিত পরিস্থিতিতে কখনো কখনো তত্ক্ষনাৎ নেপথ্যের চিত্রও অঙ্কন করে নিতে পারে। পেলাম সে চিত্র, পুরো সপ্তাহে সময় না পাওয়ার স্বীকারোক্তি এবং মুখোমন্ডল ভর্তি খোচা খোচা দাড়িতে মিলে এমন এক অসহায় অবয়বের চিত্র সেটা, যা কিনা দীর্ঘকাল ক্ষৌরস্পর্শহীন মুখোমন্ডলের শির্ণতাই শুধু নয়, গায়ের জেকেট, পরনের জিন্স এবং পায়ের কেডসে চরম সঙ্গতিহীনতায় পূর্ণ এক জীবন্ত দীনতারও মূর্তি। আজকের পরিস্থিতিতে ইংল্যান্ডে নতুন আসা একজন মানুষ যার ভালো জব নাই এবং সাথে পরিবার আছে কতটা সহানুভুতির পাত্র তিনি হতে পারেন তা কেবল ইংল্যান্ড প্রবাসী কারো পক্ষেই অনুমান করা সম্ভব। যাই হোক, পরবর্তী সঙ্গত প্রশ্ন ছিল কবে আসছেন ? জবাবে তিনি আমাকে পাল্টা প্রশ্ন করে বসলেন

--- এখানে, না ইংল্যান্ডে ?

--- ইংল্যান্ডে।

--- সে অনেক দিন, বিশ বছরের বেশি হলো।

আকাশ থেকে পরলাম ! কিন্তু বুঝতেও পারলামনা যে তার চেয়ে দশ গুন উপর থেকে পরার তথ্যও রয়ে গেছে সামনে।

--- কি করছেন এইখানে ?

--- এইখানে আমি ব্রিটিশ নিউক্লিয়ার পাওয়ার রিসোর্স সেন্টারে সাইন্টিস্ট হিসাবে কাজ করছি।

--- তাই? দ্যাটস গুড! বললেন যে এখানে নতুন এসেছেন, এর আগে কোথায় ছিলেন?

--- আমি কেমব্রিজ ইউনিভার্সিটির প্রফেসর ছিলাম, ওখান থেকে পি. এইচ. ডি. করে ঐখানেই শিক্ষকতা শুরু করি বহু বছর আগে। গভার্নমেন্ট আমাকে এখানে নিয়ে এসেছে।

যদি কেউ বিশ্বাস করেন, মাথাটা আমার ঘেমে ভিজে গিয়েছিল কিছুক্ষণের মধ্যে!

বাস চলে এসেছে ওঁনার, বললেন --- আপনার নাম্বারটা আমাকে দেন। বাজারের বেগ গুলা বাসে উঠাতে সাহায্য করতে করতে নাম্বারটা বললাম আর অনুরোধ করলাম আমকে যেন একটা টেক্সট করা হয় কারণ আমার মোবাইলটা চার্জ শেষ হয়ে বন্ধ হয়ে গিয়েছে ততক্ষণে। আশ্বস্থ করে নাম্বার সেইফ করতে নাম জিজ্ঞেস করলেন। নিজের নাম বলে ওঁনার নাম জানতে চাইলাম। বললেন

--- ড. এম. হাসান।

এম তে কি বুঝায় জিজ্ঞেস করার আগেই দরজা বন্ধ হয়ে গেল। হাত নেড়ে বিদায় জানালাম। বাস আসলো। হারলো রেইল স্টেশনে নেমে স্ট্রাটফোর্ড গামী ট্রেন ধরলাম। পঞ্চাশ মিনিটের পথ, তন্দ্রা আসে নাই একটুও। ধুমকেতুর তড়িত প্রস্থানে তার বিশাল পুচ্ছের আঘাত প্রাপ্ত নিহারিকা কনা গুলো যেমন বহুকাল ধরে ছুটাছুটি করতে থাকে মহাশুন্যে, তেমনি একধরনের ব্যস্ততার অনুভব করছিলাম মস্তিষ্কের নিউরন কনা গুলোর মধ্যে। চমক ভাঙ্গা এনাউন্স শুনে বাইরে তাকিয়ে দেখি স্ট্রাটফোর্ড। ড্রাইভারের ফাইনাল এনাউন্সমেন্ট "This train will now terminate here, all change please".

বিষয়: বিবিধ

৭০৫ বার পঠিত, ০ টি মন্তব্য


 

পাঠকের মন্তব্য:

মন্তব্য করতে লগইন করুন




Upload Image

Upload File