গল্পঃ পরবর্তী অপারেশন

লিখেছেন লিখেছেন স্বপ্নের ঘুড়ি ২৩ ফেব্রুয়ারি, ২০১৮, ০৪:১৯:৪৬ বিকাল



গাড়িটি এগিয়ে চলছে সামনের দিকে। প্রচন্ড গতিতে। শীততাপ নিয়ন্ত্রিত মাইক্রোবাসটির চারপাশে কালো গ্লাস লাগানো। ড্রাইভারের পেছনের সারির একটি সিটে আয়েশ করে বসে আছে ইন্সপেক্টর রকিবউদ্দিন রঞ্জু। তার স্থির দৃষ্টি পর্যবেক্ষন করে যাচ্ছে গাড়ির ফ্লোরের উপর বসে থাকা হাত পা বাঁধা ছেলেটিকে। ছেলেটির হালকা ফর্যা চেহারাকে আরো মনোরম করে তুলেছে ছোট ছোট দাড়িগুলো। গাঢ় সবুজ পাঞ্জাবির কয়েক জায়গায় রক্তের লাল দাগ। পাঞ্জাবির পেছনের দিকে বেশ খানিকটা জায়গা ছিড়ে গেছে। সেখান থেকেও রক্তের ধারা গড়িয়ে পরছে। চশমার নিচে থাকা চোখগুলো বেশ বুদ্ধিদীপ্ত মনে হল ইন্সপেক্টর রঞ্জুর কাছে। ছেলেটি ভাল করেই জানে আর মাত্র কয়েক ঘন্টা পরেই তাকে পৃথিবী থেকে বিদায় নিতে হবে। কিন্তু আশ্চার্য! একটু চিন্তার ছাপও নেই ছেলেটির চেহারায়। নিশ্চিন্তমনে কি কি যেন পড়ে যাচ্ছে বিড়বিড় করে। রঞ্জু সাহেব শুনেছে ছেলেটি না কি একজন তরুন লেখক।

হটাৎ একটু স্মৃতিকাতর হয়ে পরলেন তিনি। ফিরে গেলেন নিজের কলেজ জীবনে। হ্যা, রঞ্জু সাহেবও অনেক সুন্দর কবিতা লিখতে পারতেন। বন্ধুমহলে কবি হিসাবেই পরিচিত ছিলেন তিনি। আচ্ছা, ছেলেটির কাছেও কি তার বন্ধুরা গল্প শোনার জন্য ভীড় করে। আগামীকাল যখন ছেলেটির বন্ধুরা তাকে দেখতে না পাবে তখন কি তাদের চেহারায় বিষাদের কালো ছায়া নেমে আসবে? আচ্ছা, ছেলেটির মা এখন কি করছে? বাড়ি থেকে বিশ্ববিদ্যালয়গামী একটি দূরপাল্লার রাতের বাস থেকে আটক করা হয়েছে ছেলেটিকে। ক্যাম্পাসে পৌছে নিশ্চই মাকে ফোন দিয়ে জানাত ছেলেটি? নিজের অজান্তেই ঘড়ির দিকে তাকালেন রঞ্জু সাহেব। রাত দেড়টা। আরো অনেক আগেই ক্যাম্পাসে পৌছানোর কথা ছিল ছেলেটি। ফোন বন্ধ পেয়ে নিশ্চই তার মা এতক্ষনে ব্যকুল হয়ে গিয়েছে? হয়ত বিভিন্ন জায়গায় ফোন দিয়ে খোজ নেয়ার চেষ্টা করছে।

বেশ মায়াবী ছেলেটির চেহারা। তাছাড়া ভীষন ধিরস্থির ছেলেটিকে দেখলেই বুঝা যায় খুবই ব্যক্তিত্বসম্পন্ন ছেলেটি। আচ্ছা তার এ ব্যক্তিত্বে মুগ্ধ হয়ে কি কোন মেয়ে ছেলেটির অজান্তেই তাকে ভালবাসে?? হয়ত। ছেলেটির অজান্তেই হয়ত কেউ তাকে ভালবাসে। গোপনে নিয়মিত খোজ খবর রাখে ছেলেটির।

কাল মিডিয়ার কল্যানে যখন ছেলেটি মারা যাওয়ার খবর ছড়িয়ে পরবে তখন কি এ ধরনের সাজানো বন্দুকযুদ্ধের খবর সবাই বিশ্বাস করবে?? অনেকেই হয়ত করবে। কিন্তু ছেলেটির মা?? সে তো ভালভাবেই জানে যে তার ছেলেটি সামান্য জামাকাপড় সাথে নিয়ে ক্যম্পাসের উদ্দেশ্যে দূরপাল্লার বাসটিতে উঠেছিল। যখন এ তরুন ছেলেটি নিহত হওয়ার সংবাদ তার মায়ের কাছে যাবে তখন তার মা কি করবে? পারবে এ সংবাদ মেনে নিতে?? আচ্ছা। রঞ্জু সাহেবের নিজের সন্তানের ক্ষেত্রে যদি এমন ঘটনা ঘটত তাহলে কি হত??

কি সব বাজে চিন্তা করছেন জনাব রঞ্জু। নড়ে চড়ে বসলেন তিনি। কখনও নয়। তার ছেলের ব্যাপারে এমন হবে কেন? তার ছেলে তো এদের মত নয়। অত্যন্ত আধুনিকমনা সে। মুক্ত সম্পর্কে বিশ্বাসী। তাই তার ছেলের ক্ষেত্রে এমনটি ঘটবে না।

আজেবাজে চিন্তা থেকে ফিরে আসার চেষ্টা করেন জনাব রঞ্জু। যদিও ছেলেটির নিস্পাপ আর নিশ্চিন্ত চেহারা বারবারই হাতছানি দিচ্ছে তাকে। তাছাড়া এটি তো নতুন কোন ঘটনা নয়। এ ধরনের অনেকগুলো অপারেশন সফলভাবে সম্পন্ন করেছেন তিনি। আর মাত্র ছয়টি মাস। এরপরই প্রমোশন দিয়ে তাকে নিয়ে যাওয়া হবে রাজধানীতে। দেয়া হবে বিজস্ব গাড়ি। শর্ত শুধু একটা। তা হল এ ছয়টি মাসের মধ্যে তাকে এ ধরনের কয়েকটি নাইট অপারেশন সফলভাবে সম্পন্ন করতে হবে। লোভে চকচক করে উঠল তার চোখ দুটি।

ভাবনার জগত থেকে বাস্তবে ফিরে এলেন রঞ্জু সাহেব। আর অল্প কিছুক্ষন বাকি গন্তব্যে পৌছতে। দ্রুত সিদ্ধান্ত নিতে হবে তাকে। পেছনে বসা কনেস্টবলরা কি নিয়ে যেন চাপা কন্ঠে আলাপ করছে। মাঝে মাঝে মৃদু হেসেও উঠছে। কথার এ ক্ষীন শব্দও বিরক্তিকর মনে হচ্ছে রঞ্জু সাহেবের কাছে।



নির্দিষ্ট জায়গায় এসে থামল গাড়িটি। জায়গাটি একটি ধানক্ষেত। আশেপাশে কোন বাড়িঘর নেই। আমেরিকান তৈরি অত্যাধুনিক পিস্তলটি আবার দেখে নিলেন রঞ্জু সাহেব। সব ঠিকই আছে। কোন সমস্যা নেই। নিজে গাড়ি থেকে নেমে বাকিদের নামতে ইশারা করলেন তিনি। সবাই আনত মস্তকে নির্দেশ পালন করল। একজন টেনে হিচরে নামাল হাত পা বাধা ছেলেটিকে। ছেলেটি নির্বিকার। চাঁদের আলোতে আবার রঞ্জু সাহেবের চোখের সামনে পরল ছেলেটির বুদ্ধিদীপ্ত চেহারা। হঠাৎ চাঁদের আলোও অসহ্য লাগল রঞ্জু সাহেবের কাছে। ইস! আজ যদি আমাবস্যা হত!! কিন্তু অপরাধ বিজ্ঞান পড়তে গিয়ে তো রঞ্জু সাহেব দেখেছেন যে আলোকে শুধু মাত্র অপরাধীরাই ভয় পায়। শুধুমাত্র অপরাধীরাই খোজে নিকশ কালো আঁধার। তাহলে সত্যিই কি রঞ্জু সাহেব আজ একজন অপরাধী??

ধুর!! এসব কি ভাবছেন তিনি। তিনি অপরাধী হতে যাবেন কেন? তিনিতো খোদ আইন শৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনীর একজন অফিসার।

“আমাকে দুরাকাআত নামাজ পড়ার সুযোগ দিন।” স্থির কিন্তু দৃঢ় কন্ঠে বলে উঠল ছেলেটি।

পেছন থেকে ধেকিয়ে উঠল কনেস্টবল সুবিন মন্ডল। প্রচন্ড এক লাথি মারল ছেলেটির বুক বরাবর।

“শালা মৌলবাদী! মরার সময়ও নামাজের চিন্তা যায় না। নামাজ দিয়ে কোন *** ছিড়বি?? বাচবি তো আর এক মিনিট”

অফিসারকে ওভারটেক করে এ ধরনের আচারন কিছুটা অসঙ্গতিপূর্ন মনে হল ইন্সপেক্টর রঞ্জুর কাছে। কিন্তু কিছুই করার নেই। কারন সুবিন মন্ডল প্রধানমন্ত্রীর নিজস্ব এলাকার লোক। তাই সব সময়ই একটু বেশি লাফালাফি করে সে। অফিসারদেরও সহজে কেয়ার করতে চায় না।

চারদিকে চোখ বুলিয়ে নিলেন রঞ্জু সাহেব। সব ঠিক আছে। ছেলেটিকে হাত পা বাধা অবস্থায় রেখেই সবাইকে দূরে সরে যেতে নির্দেশ দিলেন। তার হাতে উঠে এল আমেরিকান তৈরি শক্তিশালী পিস্তলটি। আর সামনে হাত পা বাধা অবস্থায় পরে আছে ইসলামী আন্দোলনের নিরাপরাধ একজন অস্ত্রহীন কর্মী। তার অপরাধ একটাই সে বাতিলের বিরুদ্ধে কলম ধরেছে। তাই মাত্র কয়েক মুহূর্তের মধ্যেই তীক্ষ্ণ বুলেট এফোড় ওফোড় করে ফেলবে তার প্রশস্ত বুক।

ট্রিগারে আঙ্গুল রাখলেন রঞ্জু সাহেব। ছেলেটি একের পর এক কুরআনের আয়াত তেলাওয়াত করে যাচ্ছে। এসবের এক বর্নও বুঝতে পারছেন না রঞ্জু সাহেব। ভাবনার জগত থেকে বেড়িয়ে ট্রিগারে চাপ দিলেন তিনি। প্রচন্ড শব্দে আকাশ বাতাস প্রকম্পিত হল। ফিনকি দিয়ে রক্ত বেরুতে লাগল হাত পা বাধা এক নিরাপরাধ তরুনের প্রশস্ত বুক থেকে।

সবাইকে গাড়িতে উঠতে ইশারা করে নিজেও গাড়ির দিকে এগিয়ে গেলেন রঞ্জু সাহেব। কিন্তু কোথাও যেন একটু খটকা রয়ে গেল। মৃত্যুর আগ মুহুর্তে ছেলেটির তেলাওয়াত করা আয়াতটি খুব পরিচিত মনে হল রঞ্জু সাহেবের কাছে। তার মনে হল অর্থটিও জানে সে। হঠাৎ আয়াতের অর্থসহ ছোটবেলার স্মৃতিটি মনে পরল রঞ্জু সাহেবের। আয়াতটির অর্থ হল, “হে আল্লাহ! আমাদের উপর সবরের শান্তিধারা বইয়ে দাও এবং খাটি মুসলিম হিসাবে আমাদের মৃত্যু দান কর।”

রঞ্জু সাহেবের মনে পরল ছোটবেলায় শোনা এক ওয়াজের কথা। হুজুর ফেরাউনের ঘটনা বর্ননা করতে গিয়ে বলেছিলেন যখন যাদুকরগুলো ঈমান আনল তখন ফেরাউন তাদের শুলে চড়িয়ে হত্যা করার সিদ্ধান্ত নিল। সেই সিদ্ধান্তের কথা জেনেই সদ্য ঈমান আনা যাদুকরেরা এ আয়াত পরেছিল। রঞ্জু সাবেবের কেন যেন মনে হতে লাগল। আসলেই কি তিনি ফেরাউনের মত কাজই করলেন তাহলে? ফেরাউনের মত কি তার ধ্বংসও তাহলে অনিবার্য? কি করবেন বুঝে উঠতে পারলেন না রঞ্জু সাহেব।

হঠাৎ মোবাইলের রিংটোনের শব্দে ঘোর কাটল রঞ্জু সাহেবের।

“অপারেশন সাকসেফুল??”

“জ্বী স্যার। আমরা থানার দিকে রওনা দিয়েছি”

“এক্সেলেন্ট!! আর শোন, এ অপারেশনের জন্য এক লক্ষ টাকা সম্মানী পাবে তুমি। কাল সকালে দলের পার্টি অফিস থেকে চেক বুঝে নিও। আর প্রস্তুত থেক পরের অপারেশনের জন্য। বাই। গুড নাইট”

আবার লোভে চকচক করে উঠল তার চেহারা। একটু আগে তারা করতে থাকা বিবেকের দংশন নিমিষেই পরাজিত হল অর্থের লোভের কাছে। ইস! এভাবে একটি অপারেশন থেকেই যদি এক লক্ষ টাকা পাওয়া যায় তাহলে তো কথাই নেই।

তাই একবুক আশা নিয়ে তিনি অপেক্ষা করতে লাগলেন পরবর্তী অপারেশনের জন্য।

<এভাবেই ইসলামী আন্দোলনের নিরাপরাধ ভাইদের একের পর এক বন্দুকযুদ্ধের নাটক সাজিয়ে হত্যা করে জালিমরা। আর সামান্য দুনিয়াবি স্বার্থের জন্য তাদের পায়রুবি করে যায় রঞ্জু সাহেবরা। মাঝে মাঝে বিবেকের উদয় হতে নিয়েও অর্থের লোভের সাথে প্রতিযোগিতায় টিকতে পারে না বিবেক। তাই মানুষের চরিত্র বদলিয়ে হায়ানার রূপ ধারন করে রঞ্জু সাহেবরা>

বিষয়: বিবিধ

৫১১ বার পঠিত, ০ টি মন্তব্য


 

পাঠকের মন্তব্য:

মন্তব্য করতে লগইন করুন




Upload Image

Upload File