নবীজির গোলাম বা পীরের গোলাম বলা শিরক?

লিখেছেন লিখেছেন গোলাম হাসনাইন আসাদুজ্জামান ১৭ ফেব্রুয়ারি, ২০১৮, ১০:০৫:১০ সকাল

প্রশ্ন : নিজেকে নবীজির গোলাম বলা কিংবা নিজ পীরের গোলাম বলা কি জায়েজ? অনেকে বলেছেন এটা নাকি শিরক!

উত্তর প্রদানে,প্রিন্ট মিডিয়া উপস্থাপক ও ব্লগার

গোলাম হাসনাইন আসাদুজ্জামান।

বিসমিল্লাহির রাহমানির রাহিম।

আলহামদুলিল্লহ,

অাচ্ছালাতু ওয়া-চ্ছালামু আলা নাবিয়্যিল মোজতবা।

গোলাম ( غلام ) শব্দের আরবী প্রতিশব্দ হল, خادم (সেবক), عامل (কর্মচারী) প্রভৃতি। অতএব রাসূলের গোলাম বা পীরের গোলাম বা খাদেম, কর্মচারী, সেবক বলাতে কোন আপত্তি নেই। যেমন, মুসলিম শরীফের ২য় খন্ডের كتاب الالفاظ من الادب -এ বর্ণিত হয়েছে যে-

لايقولن احدكم عبدي وامتي كلكم عبيد الله وكل نساءكم اماء الله ولكن ليقل غلامي وجاريتي

অর্থাৎ, নবীজী ইরশাদ করেছেন, তোমাদের কেউ عبدي (আমার বান্দাহ) বলোনা। তোমরা সবাই আল্লাহ’র বান্দাহ এবং তোমাদের সকল মহিলারা আল্লাহ’র বান্দী। কিন্তু আমার গোলাম আমার চাকরানী বলতে পার।

— মুসলিম

এখানে সরাসরি গোলাম শব্দটিই ব্যবহার হয়েছে এবং তা ব্যবহারের বৈধতাও দেয়া হয়েছে। সুতরাং কেউ যদি নিজেকে খাদেম বা চাকর বা কর্মচারী অর্থে পীরের গোলাম বলে তা অবশ্যই জায়িয।

প্রসংগত, হাদীস শরীফে عبدي (আমার বান্দাহ) বলতে নিষেধ করা হয়েছে। কাজেই শরয়ী পরিভাষায় ইবাদাতকারী হিসেবে কেউ তার গোলামকে বা কর্মচারীকে বা খাদেমকে কিংবা কোন মুরীদ নিজেকে পীরের عبد (আবদ তথা বান্দাহ) বলতে পারবে না। কেননা ইবাদতের একমাত্র মালিক আল্লাহ পাকই; এতে সন্দেহ নেই। অন্য যে কাউকেই হোক না কেন, ইবাদাত পাওয়ার যোগ্য বা ইলাহ মনে করলে শিরক হবে; তবে এ অর্থ ছাড়া গোলাম অর্থে যদি عبد (বান্দাহ) শব্দটি কেউ তার কর্মচারী বা খাদেমকে বলে কিংবা কোন মুরীদ নিজেকে গোলাম অর্থে পীরের عبد (বান্দাহ) বলে এতে সমস্যা নেই। বরং পীরের প্রতি তা মুরীদের আদব ও ভক্তিরই বহিঃপ্রকাশ। আর কোন সহীহ মুসলমান যখন নিজেকে নবীর বা পীরের عبد (বান্দাহ) বা গোলাম বলে, নিশ্চয় সে কখনো এটা মনে করে না যে, নবী বা পীর ইবাদাতের মালিক বা আল্লাহ হয়ে গেছেন। গোলাম অর্থে আব্দ এর ব্যবহারের বৈধতার ব্যাপারে স্বয়ং কুরআন শরীফেই এসেছে। আল্লাহ বলেন-

قل ياعبادي الذين اسرفوا علي انفسهم لاتقنطوا من رحمة الله

অর্থাৎ, হে নবী! আপনি তাদেরকে সম্বোধন করুন, হে আমার বান্দাহগণ, তোমরা যারা নিজেদের প্রতি অবিচার করেছ, আল্লাহ’র অনুগ্রহ হতে নিরাশ হয়ো না।

এ আয়াতেقل ياعبادي (হে আমার বান্দাগণ) এর দু’টি অর্থ প্রকাশ পায়।

এক, আল্লাহ বলেন- ওহে আমার বান্দাহগণ;দুই, হুযুর পাককে নির্দেশ দেওয়া হয়েছে যে, হে নবী আপনি বলুন, হে আমার (অর্থাৎ, আপনার) বান্দাহগণ। এ দ্বিতীয় অর্থে রাসূলুল্লাহ’র বান্দাহ বুঝানো হয়েছে, অর্থাৎ নবীজীর গোলাম এবং উম্মত।

অনেক বুযুর্গানে দ্বীন দ্বিতীয় অর্থটি গ্রহণ করেছেন। আল্লামা রুমী মসনবী শরীফে বলেছেন -

بندہ خود خواند احمد در رشاد * جملہ عالم را بخوان قل یا عباد

অর্থাৎ, সমগ্র জগতবাসীকে হুযুর স্বীয় বান্দাহ বলেছেন। কুরআন শরীফে দেখুন قل ياعبادي বলা হয়েছে।

ইযালাতুল খফা গ্রন্থে শাহ ওলী উল্লাহ সাহেব রাহিমাহুল্লাহ আর রিয়াযুন নফরা ইত্যাদি কিতাবের উদৃতি দিয়ে বলেছেন যে, হযরত উমর রাদ্বিয়াল্লাহু আনহু মিম্বরে দাঁড়িয়ে খুতবা দিতে গিয়ে বলেছিলেন-

قد كنت مع رسول الله صلي الله عليه وسلم فكنت عبده وخادمه

অর্থাৎ,আমি হুযুর সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম-এর সাথে ছিলাম। তখন আমি তাঁর বান্দাহ ও খাদেম ছিলাম।

অতএব, প্রমাণিত হল যে, عبد (বান্দাহ) শব্দটি গোলাম অর্থে আল্লাহকে ছাড়াও ব্যবহার করা যায়।

ইযালাতুল খফা গ্রন্থে শাহ ওলী উল্লাহ রাহমাতুল্লাহি আলাইহি আর রিয়াযুন নফরা ইত্যাদি কিতাবের উদৃতি দিয়ে বলেছেন যে, হযরত উমর রাদ্বিয়াল্লাহু আনহু মিম্বরে দাঁড়িয়ে খুতবা দিতে গিয়ে বলেছিলেন-

قد كنت مع رسول الله صلي الله عليه وسلم فكنت عبده وخادمه

অর্থাৎ,আমি হুযুর ছল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া ছাল্লাম-এঁর সাথে ছিলাম। তখন আমি তাঁর বান্দাহ ও খাদেম ছিলাম।

অতএব, প্রমাণিত হল যে,

عبد

(বান্দাহ) শব্দটি গোলাম অর্থে আল্লাহকে ছাড়াও ব্যবহার করা যায়।

আল্লাহ পাক সুরা তাহরীমের ৪ নং আয়াতে সুস্পষ্টভাবে ‘মাওলা’ শব্দটি নিজেই অন্যদের জন্য ব্যবহার করেছেন।

যেমন,আল্লাহ পাক ইরশাদ করেছেন…



فَاِنَّ اللهُ هُوَ مَوْلَاهُ وَجِبْرِيْلُ وَصَالِحُ الْمُؤْمِنِيْنَ وَالْمَلَا ئِكَةُ بَعْدَ ذٰلِكَ ظَهِيْر-

অবশ্যই মহান আল্লাহ তাঁর [প্রিয় নবী ছল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া ছাল্লামা’র] ‘মাওলা’।হযরত জিব্রাঈল আলাইহিস সালামও তাঁর ‘মাওলা’ এবং নেককার ঈমানদারগণও তাঁর ‘মাওলা’।এছাড়া ফিরিশতাগণও তাঁর সাহায্যকারী।

হাদীস শরীফেও রয়েছে,রাসুলুল্লাহ ছল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াছাল্লাম হযরত আলী রাদ্বিয়াল্লাহু আনহু ওয়া কাররামাল্লাহু ওয়াজহাহু এর ফযিলত বর্ণানা করতে গিয়ে ইরশাদ করেছেন,আমি যার ‘মাওলা’ আলীও তার ‘মাওলা’।

*******

হযরত উমর রাদ্বিয়াল্লাহু আনহুর একটা উক্তি দিয়ে লেখাটি শেষ করছি।

খোলাফায়ে রাশেদিনে হযরত উমর রাদ্বিয়াল্লাহু আনহু এর যুগ চলছে। একদিন আব্দুল্লাহ ইবনে উমর রাদ্বিয়াল্লাহু আনহু ও ইমাম হোসাইন ইবনে আলী রাদ্বিয়াল্লাহু আনহু এর মধ্যে কোনো এক ইস্যু নিয়ে শিশুসুলভ তর্ক হয়েছে। তর্কের এক পর্যায়ে ইমাম হোসাইন রাদ্বিয়াল্লাহু আনহু আব্দুল্লাহ ইবনে উমর রাদ্বিয়াল্লাহু আনহুকে বললেন ‘তুমি হচ্ছ আমার নানাজানের গোলামের বাচ্চা’। এতে আব্দুল্লাহ ইবনে উমর রাদ্বিয়াল্লাহু আনহু রাগান্বিত হলেন এবং স্বীয় পিতা আমীরুল মো’মিনীন হযরত উমর রাদ্বিয়াল্লাহু আনহু রাষ্ট্রীয় বিচারের

আয়োজন করলেন। সমস্ত সাহাবায়ে কেরাম সবাই উপস্থিত।

রাষ্ট্রীয় প্রধানের ছেলেকে এত বড় কথা বলে ফেললেন হযরত

ইমাম হুছাইন (রাঃ)! এটা বিনা বিচারে ছাড়া যায়না। তাই

তাঁর বিচার হতে হবে, কিন্তু এতে সবাই হতবম্ভ। ইমাম হুসাইন

(র) বিচারের সম্মুখীন! এই বিচারে সবাই অবাক

নয়নে থাকিয়ে রইলেন,কিযে হয় সেই অপেক্ষায়।

হযরত ইমাম হুছাইন (রাঃ) বিচার- আদালতে হাজির।

বিচারপতি স্বয়ং ওমর ফারুক (রাঃ)।

হযরত ওমর ফারুক (র), হয়রত ইমাম হুসাইন (র) কে জিজ্ঞেস

করলেন,

আপনি কি আমার ছেলে কে গোলামের বাচ্ছা গোলাম

বলেছেন।

দৃঢ় কণ্ঠে বললেন ইমাম, হাঁ আমি বলেছি, “।

হযরত ওমর ফারুক (র) জিজ্ঞেস করলেন,আপনি এই কথা কেন

বলেছেন,

তখন হযরত ইমাম হুসাইন (র) বল্লেন,আমি ভূল কি বল্লাম,

আপনিতো,আমার নানাজানের গোলাম, তাই আপনার

ছেলে,গোলামের বাচ্ছা গোলাম।

এই উত্তর শুনে হযরত ওমর ফারুক (রাঃ) বল্লেন,

আপনি কি এইটা লিখে দিতে পারবেন? হযরত ইমাম হুসাইন

(র) বল্লেন, হাঁ পারবো।

হযরত ওমর ফারুক (রাঃ) এ

লিখা নিয়ে উপস্থিত সকলকে স্বাক্ষী রেখে বললেন,

আপনারা সবাই স্বাক্ষী থাকুন রাসূলের নাতী, জান্নাতের

যুবকগনের সর্দার আমাকে “রাসূলের গোলাম” বলেছেন।

সুতরাং এটাই আমার নাজাতের উছিলা। অতএব

আপনারা আমার ইন্তিকালের পর কাফনের ভেতর এ

লেখাটি দিয়ে দেবেন। এটাই আমার আরজী।

( আল কউলুল বদী -৮৬৫ )

বিষয়: বিবিধ

৭৬১ বার পঠিত, ০ টি মন্তব্য


 

পাঠকের মন্তব্য:

মন্তব্য করতে লগইন করুন




Upload Image

Upload File