শিলালিপি
লিখেছেন লিখেছেন জলখাসি ২০ জুলাই, ২০১৭, ১১:২০:২১ রাত
শিলালিপি -৪
১৮ ই অক্টোবর, ২০১৩ দুপুর ২:২৩
মেঝো ভাই, বাবা এমনকি মা’ও আমাকে সহ্য করতে চাইছিল না যেন । মা বাবা কেন যে তাদের নষ্ট সন্তানদের সবচে বড় প্রশ্রয়দাতা হয় কে জানে? প্রায় প্রতিটি পরিবারেই দুই একটা জানোয়ার জন্মে। তাদের সব অন্যায় অনাচার পিতামাতার কানে যেন ওহী নাজিল হবার মত আনন্দময়। ফলে স্বাভাবিক ভাবেই ওদের এড়িয়ে চলতে শুরু করলাম । দুপুরে ভাত খাবার পর পরই দু’ভাই এয়ার গান নিয়ে বেড়িয়ে পরি । সন্ধ্যা পর্যন্ত পাখির পেছনে ছুটি । মজার ব্যাপার হল, আমরা কেহই কোন পাখি মারতে পারিনি জীবনে। সন্ধার পর প্রতিদিনই কিছু না কিছু বাজার সদাই করি । এতে দুটো ঘটনা ঘটল। আমি লিকার খাওয়া প্রায় ছেড়েই দিলাম অন্যদিকে আমার পড়াশোনা গোল্লায় গেল। তবে মনের জোর ফিরে পাতে শুরু করলাম । আম তাহলে একা নই। একই সাথে ঘরে পরিবর্তন শুরু হল। আপা তার প্রাইমারি স্কুলের চাকরি ছেড়ে বিসিএস-এ জয়েন করে চুনারুঘাট চলে গেল অবিবাহিত থেকেই । এই বঙ্গ নারীর বয়স তখন ৩১ পার হয়ে গেছে । আমার পরীক্ষার বাকি ৬ মাসেরও কম । আব্বা সহকারী অধ্যাপক হিসেবে এল পি আর-এ চলে এসেছেন । এই অবস্থায় তাঁর কর্মকাণ্ড সীমা ছাড়িয়ে গেল । দুই তিনটা পেয়ারা গাছে ১ম বারের মত হাজার হাজার পেয়ারা এসেছিল । পিঁপড়া তাড়ানোর নামে সব গুলো গাছের গোঁড়ায় কেরোসিন তেল ঢেলে দিলেন । পেয়ারা সমেত গাছ গুলো মরে গেল । অথচ প্রতিদিন আমি এগুলোয় এরোসল দিতাম, গোঁড়ার মাটি আলগা করে দিতাম, মানে যা কিছু করনীয় তাঁর সবই করতাম । মনে খুব কষ্ট পেলেও কিছু বলার নেই । একদিন ঘুম থেকে উঠে দেখি আব্বা আম্মা বাসায় নেই । গেল কই ? কাউকে কিছু না জানিয়ে কোন এক মহিলা কবিরাজের কাছে আম্মাকে নিয়ে গেছে একুশ দিনের জন্য । খুব টেনশন হতে থাকলো আম্মার জন্য । যেখানে পিজি হসপিটালের ডাক্তাররা আম্মার কিছু করতে পারেনা সেখানে............
২২ তম দিনে এক পা এবং কোমর ভেঙ্গে আম্মা ফেরত এলেন চির পঙ্গু হয়ে । আগে যাও কিছুটা হাঁটতে পারতেন এখন তাও শেষ হয়ে গেল । নিরব দর্শকের মত দেখে গেলাম । সারা রাত পশুর মত ঘো ঘো করে আম্মা চিৎকার করে কাঁদে । আমরা দৌড়ে গিয়ে লাইট জালালে সব শান্ত । লাইট নিভালে আবার শুরু । শেষ রাতের দিকে শুরু হত আব্বার মারপিট । কি ভয়ঙ্কর ভাবে মোটা বাঁশ দিয়ে আম্মাকে পেটাত যে, কেউ না দেখলে তা বিশ্বাস করা অসম্ভব । একসময় সবাই মোটামুটি অভ্যস্ত হয়ে পড়ল কিন্তু আমি পারলাম না । আম্মা জেগে থাকে শারীরিক কষ্টে আর আমি জেগে থাকতে শুরু করলাম ভয়ে । এ জাতীয় অমানুষিক নির্যাতন আম্মা কমপক্ষে আরও ১৫ বছর সহ্য করে অবশেষে মৃত্যু বরন করলেন আমার কোলে মাথা রেখে । এটা আমার চোখে এক প্রকার হত্যা কাণ্ড। আম্মা মারা গেলেন গলায় শুকনো চিড়া আটকে। মৃত্যুর একেবারে আগ মুহুর্তে আম্মাকে উলটো করে ঝুলিয়ে বুকে গলায় থাপ্পর মেরে তার শ্বাস নালী খুলে দেই। তিনি স্পষ্ট উচ্চারনে আমার সাথে কথা বলতে বলতেই মারা গেলেন। আব্বা অবশ্য এই সুযোগে আমার দিকে আঙ্গুল তোলার চেষ্টা করে ছিলেন কিন্তু সফল হননি ।
আম্মাকে এতো এতো খারাপ নির্যাতনের কারন শুরুতে আমি জানতাম না । সে আসলে ২য় বিয়ে করতে চাইছিল । এই আধা মরা মহিলার সারা গায়ে কালো কালো দাগ জমাট বেঁধে থাকতো । নির্যাতনের চিহ্ন । একদিন শিতের দুপুরে আম্মা আমাকে ডেকে বললেন, আজ সন্ধায় ঘরে নতুন বউ আসবে । তোর সৎ মা । কোন রকম ঝুট ঝামেলা বাঁধাবি না কিন্তু । আমরা পাঁচ ভাই বোন, একটা চাচাত বোন ( সে আমাদের সংসার মেনটেইন করত ) , দুইটা কাজের লোক থাকতে বিয়ের প্রয়োজন টা কি ? আম্মা বললেন, শুধু আমার সেবার জন্য তাকে আনা হচ্ছে । বড় আপা বললেন, এইটা আব্বার ফাণ্ডামেন্টাল নিড । মেঝো ভাই বললেন, আব্বা অবশ্যই বিয়ে করবে । ( সেঝ ভাই, সে-ই এই গল্পের গুরুত্তপূর্ণ অঙ্গ হয়ে উঠবে এক সময় ) বলল, আব্বার সমস্যাটা আমাদের সবারই বোঝা উচিত । দেখা গেল আমি আর বড় ভাইয়া ছাড়া সবাই মোটামুটি বিষয়টা সম্পর্কে জানে । সন্ধ্যায় সবাইকে অবাক করে দিয়ে মোটা, কালো, ডিভোর্সি নোংরা চেহারার এক মহিলা কে সাথে নিয়ে বাবা সাব উপস্থিত । সাথে যথারীতি ১৫-২০ জনের এক দঙ্গল বন্ধু বান্ধব যেন এদের সামনে আমি কিছু বলতে না পারি । রাত দশটা পর্যন্ত রাস্তায় হাঁটাহাঁটি করে কাটালাম । বড় ভাইয়া এসেই জানতে চাইল আমাদের এই মুহূর্তে করনীয় কি ? বললাম, আমি তুমি এই বিয়ের স্বীকৃতি দেব না কিন্তু বাস্তবতা মেনে কাউকে কিছু বলবও না । ভাইয়া এই কথা মেনে নিলেন।
আব্বা এলপি আর এ চলে যাবার পর খেয়াল করলাম বড় ভাইয়া আমার সাথে শোয় কিন্তু ঘুমায় না। সারা রাত প্রায় জেগে থাকে। মাঝে মাঝে জিজ্ঞেস করি কিন্তু কোন উত্তর নেই। আপার বিসিএস হবার আগে বা পরে তারও সরকারী চাকরি হয়ে গেল। আমি ভাবছিলাম, এই বুঝি ভাইয়া চলে গেল। তার পোষ্ট গ্র্যাজুয়েশন, বিয়ে কত কি বাকি। আমি বললাম, ভাইয়া তুমি ঢাকা চলে যাও পরাশোনা করতে। তোমার ভাল লাগবে। আমরা এতটা বছর খেয়ে না খেয়ে কাটিয়েছ। এখনো পারব। তুমি বরং চলে যাও। এক গভীর রাতে সে অদ্ভুত অসম্ভব এক স্বপ্নের কথা শোনাল। আমি স্তম্ভিত হয়ে গেলাম।
১৮ ই অক্টোবর ২০১৩ রাত ২ টা ২৫ মিনিট ।
বিষয়: বিবিধ
৭০৮ বার পঠিত, ০ টি মন্তব্য
পাঠকের মন্তব্য:
মন্তব্য করতে লগইন করুন