শিলালিপি
লিখেছেন লিখেছেন জলখাসি ১৯ জুলাই, ২০১৭, ০৫:৩২:৫৪ সকাল
শিলালিপি ২য় কিস্তি
১৫ ই অক্টোবর, ২০১৩ রাত ১১:১২
১৯৯৫ সনের পহেলা মে বাসা বদল করে পাশের একটা জরাজীর্ণ একতলা বাড়িতে ভাড়া উঠে পরলাম। একে জরাজীর্ণ বাড়ি না বলে জংগলে পরিত্যাক্ত বাড়ি বললেই বুঝি ভাল হয়। চারিদিকে বাউন্ডারি দেয়াল, রাস্তার লেভেল থেকে এক ফুট নিচে প্রবেশপথের উপরের রড। অপরিচিত কেউ আসলে অবধারিত ভাবে কপাল ফাটিয়ে এখানে প্রবেশ করে। জংলায় কলমি লতা আর সেই লতায় পাতায় পেচিয়ে বসে থাকে অসংখ্য সাপ। ডোবায় কচু অফুরন্ত । প্রকৃতি যাকে দান করে সেখানে অফুরন্ত পরিমানেই করে, আর যার দিকে ফিরে তাকায় না নিরপেক্ষ আচরন টুকুও সে পায়না মহান খেলোয়াড়ের কাছ থেকে । হয়তো এটাই প্রকৃতির নিয়ম । আব্বা শিঘ্রই অবসরে যাবেন। তখন আমাদের বাবুগিরি!!!!?? মার্কা জীবন থাকবে না। ২৪০০ টাকার বিলাসী বাসা ছেড়ে ১১০০ টাকার প্রাসাদে উঠলাম। এই বাসায় আসার পর নতুন করে বুঝতে পারলাম মে-জুন মাসের গরম কি জিনিস!! একদিন সকালে সবার চোখের সামনে ছোটখাটো একটা মুরগি গিলে ফেলল চক্করওয়ালা ছয় হাত লম্বা এক কাল নাগ। আমরা কিছুতেই বিশ্বাস করতে পারছিলাম না, চোখের সামনে এতবড় আর বিষাক্ত সাপ কি অবলীলায় ঘুরে বেড়াচ্ছে। পরদিন সকালে ৬০০ টাকার চুক্তিতে বেদেদল সেই সাপ ধরে নিয়ে গেল। তার আগে সাপের মুখে মুখ লাগিয়ে চুষে কিছুটা বিষ খেয়ে নিল অপেক্ষাকৃত যুবক বেদেটা। আমার দিকে তাকিয়ে হাসিমুখে বলে গেল-এইটা হইল মরন নেশা ভাইজান। যে একবার সাপের বিষের মজা পাইছে তার কাছে হীরা মানিক তুইচ্ছ। অভিভুত হয়ে তার দিকে তাকিয়ে রইলাম। সেদিন বুঝতেও পারিনি এক চক্করওয়ালাকে বিদেয় করে কোন চক্করওয়ালার মুখের সামনে দুধের বাটি তুলে দিলাম। ( সে গল্প যথাসময়ে বলা হবে )।
কিছুদিনের মধ্যেই বড় আপাও তাঁর পড়াশোনার পাঠ চুকিয়ে হাজির হল ডক্টরস হাউস নামক এই নরকে । মাসে মাসে আরও ৮০০ টাকার দুশ্চিন্তা দুর হল। আপা মাসে দুইশ টাকা কম পেত, কারন সে মেয়ে। আপা এতটাই অপুষ্টিতে ভুগছিলেন যে, তাকে চেনা যাচ্ছিল না। অসুস্থ শরীর নিয়েও আম্মা আপাকে খুকু খালার বাসায় রেখে আসলেন। ওই বাসায় ভালমন্দ খেয়ে যদি কিছুটা সুস্থ হয়ে উঠে এই আশায়। আমরা গোপন সূত্রে জানতে পারলাম ৫৬ বৎসর বয়সে হলেও এইবার আমার বাবা নামক লোকটার প্রমোশন হবে, সহকারী অধ্যাপক হয়ে এলপি আর এ যাবেন। তখন চাকরির বয়সসীমা ৫৭ পর্যন্ত ছিল। বেতন বেড়ে একলাফে বেড়ে দাঁড়াবে ৫৬০০ টাকায় । আমাদের বাসা টাকার খনি হয়ে যাবে । লিকারে আসক্তি আমার খুব সামান্য পরিমানে বাড়তে থাকল। মেঝো ভাই পড়াশোনা, প্রেম, রক্তে লেখা চিঠি, কাফনের কাপড় ছেড়ে মিউজিকে বুদ হয়ে পড়ল । প্রতি মাসেই কোন না কোন বাদ্য যন্ত্র কেনা হচ্ছে । বাবা তাঁর ছেলের মেধায় মুগ্ধ। এখন সারাদিনই সিগ্রেট চলে। অন্যদিকে মা বিছানায় শুয়ে শুয়ে তাল দেয় । আহা কি আনন্দ! কি আনন্দ!! আমরা কচু ঘেচু ছেড়ে কলমি লতায় মন দিলাম । ভাজা শাক সাথে ভাজা মরিচ । এমন সু-খাদ্য বুহুদিন খাইনি । এক মাসের মধ্যেই জংলি শাক, কলমি সব সাবার। বাড়ির চারিদিকে কয়েক’শ কলা গাছ। কলার মোচা থেকে শুরু করে ভেতরের নরম বগুলি না কি যেন, সেসবও খেয়ে সাবার করে জংলা পরিস্কারে মন দিলাম। একটি বাড়ি একটি খামার টাইপ প্রকল্প যেন। আত্মীয় স্বজনদের কাফেলা বর্ষার ঢলের মত আসতে শুরু করল । একটা কাঁঠাল কিংবা একটা হাঁস অথবা সামান্য কিছু চালের গুড়ি নিয়ে পাঁচ সাত জনের একেকটা দল গড়ে দশদিন করে বেড়ায় । আমরা সবাই লাইন দিয়ে ফ্লোরে ঘুমাই ঠিক কমলাপুর রেলওয়ে ষ্টেশনের মত । মাথার কাছে কয়েল জ্বলে । আমার আবার ঘুমাতে দেরি হত । নিঃশব্দে কয়েলটা টেনে আমার মাথার পাশে নিয়ে আসতাম। পরদিন সকাল থেকে অবধারিত ভাবে মাথা ব্যাথায় ভুগতাম কয়েলের বিষাক্ত ধোঁয়ার কারনে
ফজরের আগেই একে একে সবাই একমাত্র বাথরুমটাও নোংরা করে ফেলত । গন্ধে ধারে কাছে পর্যন্ত যাওয়া যায়না অথচ এদের যেন কোন বিকার বিবেচনা পর্যন্ত নেই । আমি মগে পানি নিয়ে উঠানে মুখ ধুতাম । শুধু বেড়ানোতেই এরা ক্ষান্ত থাকতো না । নানান তুচ্ছ যত কারন আছে তার প্রায় সবই প্রয়োগ করে আমাদের ব্যাতিব্যাস্ত রাখত। ভাত খাবনা, আর আসব না, আক্কেল হইছে, নিজের কপালে পিছা মারি জাতীয় হুমকি দিত প্রায় প্রতিদিন । ঘরের সদস্যদের মধ্যে এ নিয়ে বিবাদ হত। আমরা যত বেশি হাংগামায় জড়িয়ে পরতাম তাদের বেড়ানোর স্থায়িত্ব ততই বাড়ত। এরা যেন কিছুতেই আমাদের আভ্যন্তরীণ সদ্ভাবকে সহ্য করতে পারত না।
মেঝো ভাই ইন্টার পাশ করে অনার্সে, সেজ ভাই বরিশাল মেডিক্যালে পড়তে চলে গেল । বাসার সবচে নিরিবিলি ঘরটা দখল করে একটা হারমোনিয়াম, তিনটা ছোট বড় কিবোর্ড, একটা ড্রামস সেট, দুইটা হাওয়াই গিটার, দুইটা ইলেকট্রিক গিটার, চারটা স্পিকার দিয়ে প্যানাসিয়া শিল্প গোষ্ঠীর জাঁকজমক উদ্বোধন করলেন মেঝো ভাই । ঘোষণা করে দিলেন ছয় মাসের মধ্যেই যদি টিভিতে শো করতে না পারেন তাহলে নিজের নাম নিজেই কেটে ফেলবেন। এরপর শুয়োর, কুকুর, বিলাই যে কোন নামে তাকে ডাকা যাবে, তিনি আপত্তি করবেন না। কিন্তু এ মুহুর্তে একটা প্রফেশনাল এমপ্লিফায়ার না কিনলেই নয়। তার এমন আশ্বাস বানীতে আব্বা খুশিতে তিনটা লাফ দিলেন । যে ঘর খরচ চালাতে পারবে না বলে আমাকে নটরডেমে পড়াতেই রাজি হল না, যেখানে বছরে একবার মাত্র পেটভরে গরুর গোশত খাওয়ার সুযোগ আসে, যেখানে আমি আমার ১১ বছরের বড় ভাইয়ের সাদা ডোরাকাটা ফুলহাতা শার্ট পরে কলেজ জীবন শুরু করেছি, পুরনো প্যান্ট কেটে তার উপর বড় ভাইয়ের প্যান্ট পরে কলেজে যাই সেখানে এই বিপুল বিলাসিতার জন্যে এতো লাখ টাকা সে পায় কোথায় ? বড় ভাই সবে একটা হাসপাতালে ডিউটি শুরু করেছে, তার একটা প্যান্ট নিয়ে যাওয়াতে দ্বিতীয় শেষ সম্বল পুরনো আরেকটা প্যান্ট পরে সে প্রতিদিন আসা যাওয়া করে। মেট্রিক পরীক্ষার পর এক জোড়া জুতা কিনি জীবনে প্রথমবারের মত। এই জুতা জোড়াটাই ভাইয়ার প্রানে যেন এক ফোটা পানি দিন। আমাদের আইসোমারিজম জীবন শুরু হল। আপাকে খালার বাসা থেকে নিয়ে আসলাম। আজকের দিনে মানুষ প্রথমে গোপনে মেয়ে দেখে যায়। পছন্দ হলে প্রস্তাব পাঠায়। তারপরে দরদাম শুরু হয়। ধবধবে ফর্সা সুন্দর এবং কিছুটা খাটো, রোগা পাতলা এই মেয়েটার কোন বিয়ের সম্বন্ধ আসে না, কেন আসেনা তাও বুঝিনা। বুড়ি হয়ে পেকে যাচ্ছে কিন্তু বিয়ের কোন খবর নেই। নানান জনে নানা রকম পরামর্শ দিতে আসে। সেঝ ভাই মাসে ১৬০০ করে টাকা নেয় আর আমি সবে ভিক্টোরিয়া কলেজের ১ম বর্ষের উঠতি বেয়াদব । কোমরে সব সময় থাকে কারেন্টের তারে বানানো চাবুক, হাঁতে ৫৫৫ সিগ্রেট । বাজেট দৈনিক কুড়ি টাকা সাথে চুরি চামারিতে আগ্রাসী হয়ে পরেছি। বাবার চাকরির মেয়াদ আছে আর মাত্র কয় মাস। যা করার দ্রুত করতে হবে। আম্মা তার এক মামাকে খবর পাঠিয়ে আনালেন। আমি আর সেই নানা গোপনে বিভিন্ন রকম ওঝা, বৈদ্যের দুয়ারে দুয়ারে ঘুরি। এরা প্রতিদিন বান কাটা, তাবিজ তোলা, কালো মুরগি পুড়িয়ে ফেলার জন্যে হাদিয়া নেয়। তন্ত্রে মন্ত্রে জড়িয়ে পড়লাম বোনটাকে বিয়ে দেবার জন্যে । আজ ডিম পড়া তো কাল পানি পড়া পরশু কোমর বন্ধনী ধারন – এই ভাবে কাটতে লাগল আমাদের এইসব দিনরাত্রি । শিলালিপির দিন পঞ্জিকা ।
বিষয়: বিবিধ
৭৭৬ বার পঠিত, ০ টি মন্তব্য
পাঠকের মন্তব্য:
মন্তব্য করতে লগইন করুন