শিলালিপি

লিখেছেন লিখেছেন জলখাসি ১৯ জুলাই, ২০১৭, ০৩:২১:২০ রাত

শিলালিপি-১

১৪ ই অক্টোবর, ২০১৩ রাত ১১:০৯

১৯৯৪ সালের শেষের দিকে ( সেপ্টেম্বর সম্ভবতঃ ) আমাদের সবচেয়ে বড় ভাই সিলেট ওসমানী মেডিক্যাল কলেজ থেকে এমবিবিএস পাশ করে ব্যাগ এন ব্যাগেজ কুমিল্লা চলে আসেন। আমি ক্লাস টেনে পড়ি। টেষ্ট পরীক্ষার প্রস্তুতি নিচ্ছি পুরোদমে। সারাদিন সারাক্ষন মাথা ব্যাথায় অস্থির হয়ে গেছি। মুখে কিছুই রুচে না। যা কিছু খাবার চেষ্টা করি না কেন, সব বমি করে দেই। একদিন খেয়াল করলাম বমির সাথে তাজা রক্ত বের হচ্ছে। চব্বিশ ঘন্টায় অন্তত দশ মগ কালো চা খাই। পেটে আলসার বাধিয়ে ফেলার পর কালো চা যে আগুনে ঘি ঢালে তা কে জানত? চরম দরিদ্র একটা পরিবারের সদস্য হিসেবে শিক্ষিত হয়ে উঠার চেষ্টা করছি। এ জাতীয় পরিবারের ছেলেরা শিক্ষিত হবার স্বপ্ন দেখে টাকা আয়ের আশায়; সে টাকা কোন পথে আসবে তা নিয়ে কেউ মাথা ঘামায় না। এ ব্যাপারে আমার রুচি ভীষন টনটনে। চুরি চামারি, চিটিং বাটপারিতে আমার একেবারেই আগ্রহ নেই, পড়াশোনা করি।

অভাব অভিযোগ, দুঃখ কষ্ট নিত্য সঙ্গী। যদিও আমার বাবা একটা সরকারি কলেজের সিনিয়র মোস্ট লেকচারার ছিলেন, মাস্টার্সে থার্ডক্লাস থাকার কারনে তার কখনো প্রমোশন হয়নি। এ নিয়ে যতটুকু বিচলিত হবার কথা তার একশ ভাগের এক ভাগ টেনশন করতেও দেখা যেত না লোকটাকে। সে বাসাতেই থাকত না। কোন কিছুর খোজ খবর রাখত না। সংসার যে কি ভয়াবহ একটা ব্যাটল ফিল্ড এটা তিনি জীবনে একবারও অনুভব করেছেন কিনা এখনো বুঝিনা। বিরাট পরিবারের অযোগ্য এক কর্তা যাকে শ্রদ্ধা করার কারন আজও আবিস্কার করতে পারিনি। ঘরের সবচে ছোট হয়েও সংসারের সকল চিন্তা যেন আমাকে একাই করতে হয়। সর্বসাকুল্যে ৪২০০ টাকা মাসিক আয় তার। ২৪০০ টাকা বাসা ভাড়া, ১০০০ টাকা বড় ভাই আর ৮০০ টাকা বড় আপাকে মাসে মাসে দিতে হত। মাসের ১ তারিখে যদি তাঁর কাছে শূন্য টাকা থাকতো ধরি ২ তারিখে সে ৪২০০ টাকা বেতন তুলত এবং ৩ তারিখে তাঁর হাঁতে থাকতো শূন্য টাকা । তখনো আমার ইমিডিয়েট বড় দুই ভাই ইন্টারমেডিয়েটে পড়ছে । সাথে তাদের দুইটা করে প্রাইভেট পড়ার খরচ চালানো এবং চির অসুস্থ মায়ের চিকিৎসা খরচ বাবদ টাকা লাগে নিয়মিত । আমার দুইটা প্রাইভেট পরতে হত অংক আর ইংরেজি। অংকের টিচার নেন দুশো কিন্তু ইংরেজীর শিক্ষক তিনশ টাকার নিচে পড়ান না। যিনি অংক পড়াতেন তিনি টাকা চাইতে চাইতে এক সময় চাওয়া ছেড়ে দিলেন কিন্তু আমার প্রতি স্নেহে তার ঘাটতি দেখা গেল না। যারা হঠাত করে অভাবে পরে তারা খুব ছোটখাটো বিষয়েও লজ্জিত বোধ করে। যারা আমাদের মত সংসারে বেড়ে উঠে তারা জন্মই নেয় নির্লজ্জ হয়ে। আমিও যেন তেমন এক নির্লজ্জ ছেলে হিসেবে বয়সে বাড়ছি সংগে অসুখ হিসেবে চিরসংগী হয়েছে আলসার আর অভিমান। যে অভিমান আমার একেবারেই থাকা উচিত নয় সেটাই কিনা আমার মননে আকাশ পাতাল সম। দুই মাস টাকা বাকি পড়েছে তো তৃতীয় মাসে ইংরেজীর শিক্ষক সবার সামনে জিজ্ঞেস করলেন মাসে মাসে ঘর থেকে টাকা নিয়ে আসলে আমি কি করি? কাল বকেয়া সকল টাকা পরিশোধ করবে নয় তোমার বাবাকে নিয়ে আসবে। আমি নিশ্চিত তোমার বাবা নিয়মিত টাকা দেন, তুমি সে টাকায় দুটি ছবি দেখ। এক টিকেটে দুটি ছবি। লজ্জায় লাল হয়ে গেলাম। শপথ করে ফিরলাম- আজ টাকা না দিলে ঘরের সব ভেংগে চুরমার করে ফেলব। মেঝো যখন তখন প্লেট, গ্লাস ভেংগে ফেলে। এই ভয়ে তাকে কেউ ঘাটায় না। গোপন অদৃশ্য কোন তহবিল থেকে তার সকল বায়না মেটানো হয়। আমি টাকা চাইলে বলা হয় -’তোর স্যারকে বলবি, আমরা কারো টাকা মেরে খাইনা। দিয়ে দিব ইনশাল্লাহ’। এই ইনশাল্লাহ শব্দটা সিম্পলি একটা প্যানিকে পরিনত হয়েছে আমার জীবনে। কোনদিন যদি বেশি বিরক্ত করি, নিজের জিব্বা কামড়ে ধরে আব্বা এমন জোরে থাপ্পর মারে যে, এই লোকটার চেহারা দেখার রুচিও চলে যায় আমার। বাসায় ফিরে দেখি এলাহী কারবার! মেঝো ভাই, ইলেক্ট্রিক পিয়ানো কিনে এনেছে। এডাপ্টারে ভোল্ট এডযাস্ট করা হচ্ছে। কিছুক্ষনের মধ্যেই ‘আমার সোনার বাংলা আমি তোমায় ভালোবাসি’- গান বাজিয়ে এর উদ্বোধন করা হবে। চার বছর আগেই সে অর্ডারি খাসা হারমোনিয়াম কিনে কয়েকমাস কানু দত্তের বাড়িতে গান শিখেছে। তারপর থেকে সে বিভিন্ন ভাবে প্রমান করে দেখিয়েছে এদেশের কোন শিল্পীই গানের বেসিক বলতে অজ্ঞ। আব্বা আম্মা তার সব কথা বিশ্বাস করে। সে নাকি একদলা মাটি মাথায় নিয়ে কসম কেটে বলেছে, এ বছর পিয়ানো কিনে দিলে আগামী বছর টিভিতে সে ছাড়া আর কারো চেহারাও দেখানো হবে না। গানের প্রান থাকে রাগে, আর এই রাগের জনক যদি এদেশে কেউ থাকে তবে সে এই ঘরের সন্তান। তার জন্মই হয়েছে মা বাবার মুখ উজ্জ্বল করার জন্যে- অসুস্থ মা শুয়ে শুয়ে একে তাকে মেঝো ভাইয়ের গল্প শোনায়। স্বপ্নময় আনন্দে শুধু তার চোখ দিয়েই পানি পরে। আমি ছোট মানুষ, বিশ্বাস অবিশ্বাসের দোলাচলে যতটা না ভাবি তারচে বেশি আতংকগ্রস্থ হয়ে পরি এটা বুঝে যে, এ মাসেও ইংরেজি স্যারের টাকা দেয়া হচ্ছেনা। আব্বার পিছে পিছে ঘুরি- আপনি একদিন বলে দিয়ে আসেন। আমার কথা শেষ হবার আগেই সে বত্রিশ দাত ফেলে দিতে আসে। আম্মার পায়ের কাছে গিয়ে বসি। আম্মা জিজ্ঞেস করেন-সকালে কিছু খেয়েছি কিনা। কাল রাতের কড়কড়া ভাত থাকার কথা। যদি না থাকে আমি যেন চারপট চাল চড়িয়ে ঘরগুলো কোনাকাঞ্চি মেরে ঝাড়ু দিয়ে ফেলি। অন্যরা পারেনা, তাই বাধ্য হয়ে তিনি আমাকে বলছেন। সমস্যার কথা আর বলা হয় না। চাল চড়িয়ে খব ভাল করে ঘর ঝাড়ু দেই। দিনে দিনে রান্নাবান্না, ঝাড়পোছ সহ সাংসারিক কাজে আমি পটু হচ্ছি ঠিকই কিন্তু বৈষম্য আমাকে কুড়ে কুড়ে খায়। আমি মেঝোভাই আর আব্বার প্রতি শ্রদ্ধা হারাতে থাকি। এই যে এত এত করি, তাদের কারো কোন বিকার নেই। সারাদিন টেবিলে বসে থাকে পড়ার উসিলায় আর আমার দিকে তাকিয়ে মিটমিটে হাসি হাসে। ঘরে টুথপেস্ট, সাবান কিচ্ছু থাকেনা। কালেভদ্রে যদিও বা কেনা হয়, সে তার লকারে তালা দিয়ে রাখে। পায়ে ধরলেও এক ফোটা পেস্ট দেয়না। সাড়ে ন’টায় সে যখন ঘুম থেকে উঠে ততক্ষনে ঘরের সব কাজ শেষে একটা প্রাইভেট পড়া শেষ হয়ে গেছে আমার। ও আরেকটা কথা বলা হয়নি। ঘরে হাজার মানুষ আসলেও তার ঘরে কেউ প্রবেশ করতে পারবে না, অযথা ডাকাডাকি করলে রামচড় খেতে হবে। আজ এই রাতে যখন শিলালিপি এডিট করতে বসেছি তখন জানি, বাল্মিকীর রামায়নে রামের ছোট ভাই লক্ষন কোন দু:খে পরজনমে অগ্রজ হয়ে জন্মাতে চেয়েছিলেন।

চাল, লবন, সামান্য তেল আর অল্প বিস্তর পেয়াজ রসুন ছাড়া বাজার থেকে তেমন কিছু কেনার সামর্থ্য ছিলনা আমাদের। সেও আবার ১২ মাস কিনে খাও। কি ভয়ঙ্কর গোপন অভাব, সর্বদা সতর্ক দৃষ্টি- কেউ কিছু বুঝে ফেলল না তো? মাগরিবের আজানের সময় ছালার ব্যাগ আর কাঁচি নিয়ে ডোবায় নেমে পড়ি কচুর কান্ড কাটার জন্য। এ সময় কেউ কাউকে তেমন একটা খেয়াল করেনা। কচুঘেঁচু সেদ্ধ আর নুন মাখানো ভাতই ছিল বছরের সবচে বেশিদিন খাওয়া মেন্যু। আব্বার চলনে নতুনত্ব এসেছে। ২৪ ঘণ্টার মধ্যে ১৮ ঘণ্টাই পালিয়ে বেড়ায়। লুকিয়ে লুকিয়ে সারাদিন বিড়ি সিগারেট খায়। চলে নিচু শ্রেণীর কুলি মজুরদের সাথে। আমি জানিনা কেন তাঁর লেভেলের লোকেরা কেউ তাঁর বন্ধু ছিলনা। দুইদিন পর পর এর বাড়ি তাঁর বাড়িতে বেড়াতে চলে যায় বিনা নোটিশে। সম্ভবত ভাল খাবারের লোভে। আমরা অনাহারে অর্ধাহারে পরে থাকি। মেঝো সবার অলক্ষ্যে কখন যে একটা হাসের ডিম ভেজে নিয়ে দুয়ার বন্ধ করে দিয়েছে টের পাইনা। সারা ঘর তন্নতন্ন করে খুজেও একটা শুকনো মরিচ পাইনা। হায় আফসোস করি অনেকটা তেল নষ্ট হলো বলে। কত যে এক দুই টাকার তেল কিনতে গিয়ে নাজেহাল হয়েছি তাঁর কোন হিসাব নাই। আমাদের এই অপমানকর জীবনে তাঁর কিছু আসতো যেত না। যেদিন বাসায় থাকত- আব্বা, আমাকে দিয়ে দিব্বি মগে করে দুই টাকার চা আনিয়ে সারাদিন বন্ধু বান্ধব নিয়ে পরে থাকতো। পড়ার যায়গা দখল করে এরাও সারাদিন বসে থাকতো নির্লজ্জের মত। আমি সম্ভবত দিনে দিনে বেয়াদব হয়ে যাচ্ছিলাম। তাই কিছু বললেই গুম্মুর গুম্মুর পিঠে পড়তো। আমাকে ছাড়া মারার মত আর কেউ ছিলনা যেহেতু সবাই বড় হয়ে গেছে। প্রসংগ থেকে সরে অনেক দুর চলে এসেছি, তাইনা? ফিরে যাচ্ছি। বড় ভাইয়া এমন ভয়াবহ একটা পরিবারের পাশে দেব দুতের মত দাঁড়ালেন। বাবার মাসিক খরচ ১০০০ টাকা বাঁচল। কিন্তু অভাব কমল না।

**** ২০১৩ সালের ১৪ ই অক্টোবর থেকে শিলালিপি কয়েক পর্বে প্রকাশ হয় সামুতে। তারপর আর এগিয়ে নিতে পারিনি পারিবারিক চাপে। এখন চাপাচাপির কেউ আর নেই কোথাও। ফলে মুল বক্তব্য অটুট রেখে শিলালিপি লেখা শেষ করব ঠিক করেছি। দেখা যাক, কি আছে কপালে।

বিষয়: বিবিধ

৬৫৮ বার পঠিত, ০ টি মন্তব্য


 

পাঠকের মন্তব্য:

মন্তব্য করতে লগইন করুন




Upload Image

Upload File