ছোট গল্প, “বিবেকের সাজা”
লিখেছেন লিখেছেন এম আর তালুকদার ০৮ নভেম্বর, ২০১৭, ০৩:১২:০৯ দুপুর
“বিবেকের সাজা”
______এম, আর, তালুকদার
প্রথম দৃশ্যঃ
এক প্রাচীন জনপদ, সবুজে ঘেরা চারিদিক। এই সবুজের মাঝে হেসে খেলে একসাথে বেড়ে উঠেছে তিন শিশু। আজ তারা শৈশব কৈশর পেরিয়ে এখন যুবক। একজন পেশাদার চোর এবং মাদকাসক্ত, সে বিভিন্ন অপরাধে প্রায়ই শাস্তি ভোগে অভ্যস্ত। বাবা মা জন্মের পরে নাম রেখেছে মোস্তাফিজুর রহমান টুলু, আজ সবাই তাকে টুলু চোরা নামেই ডাকে। দ্বিতীয়জন শ্রমিক, সে শ্রমের বিনিময় উপার্জন করে কিন্তু বর্তমানে শ্রমের বাজার খুবই মন্দা। সারাদিন খেটে শরীরের সব রক্ত ঘামের সাথে বেরিয়ে গেলে পেটের ক্ষুধা মেটানোর মত সুস্বাদু দামী খাবার জোটেনা। তার পৈতৃক নাম কবির হলেও সবাই তাকে কাউয়া কবির বলেই ডাকে। তৃত্বীয় যুবক শিক্ষিত। মেধার বিনিময়ে এখন চাকুরী হয় না, দরকার টাকা বা মামার জোর কিন্তু এগুলো তার নেই। প্রাতিষ্ঠানিক শিক্ষার সনদের সাথে তার আর একটি সনদ যোগ হয়েছে, সনদে লেখা আছে সে উচ্চ শিক্ষিত বেকার। বাবার আদরের একমাত্র পুত্র। বাবা আদর করে নাম রেখেছিলেন মাহফুজুর রহমান তুষার সবাই তাকে তুষার বলেই ডাকে। সকলেরই পেট আছে, তাতে আহার চায় কিন্ত অর্থ ছাড়া আহার কে দেবে!!!
টুলু চোরা চুরি করার জন্য সঙ্গী খুঁজছে। ওদের পেয়ে বিভিন্ন ভাবে ওদের বুঝালো, বললো এ ব্যাডা এরহম না খাইয়া মরার চাইতে একদিন একটা কিছু কইররা অইলেও জীবনে পরিবর্তন আনা উচিত। টুলু চোরার প্ররোচনায় অর্থের অভাবে দিকশূণ্য যুবকদ্বয় চুরি করতে রাজি হয় তবে শর্ত থাকে তাদের যতটুকু প্রয়োজন তার বেশি চুরি করবেনা তারা। কিন্ত টুলু চোরা দুই জনের শর্ত মন থেকে মেনে নিতে না পারলেও রাজি হয়।
টুলু চোরা অনেক সন্ধান করে এক শিক্ষকের বাড়ি চুরির সিদ্ধান্ত নিল কিন্তু তুষার তাতে রাজি হল না কারন শিক্ষক জাতি গড়ার কারিগর, শিক্ষকের বাড়িতে তার পক্ষে চুরি করতে যাওয়া সম্ভব না। টুলু চোরা আবার সন্ধান শুরু করলো, অনেক দিন সন্ধান করে এমন এক বাড়ির সন্ধান পেল যেখানে প্রচুর অর্থকড়ি পাওয়া যাবে। বাড়ির মালিক এক সময় শ্রমিক ছিলেন অনেক কষ্টে তিল তিল করে জমিয়ে আজ প্রচুর ধন সম্পদের মালিক। এবার বাধ সাজলো কবির, সে বললো মুই জানি শ্রমে কত কষ্ট, এই কষ্টের ধন মুই চুরি করতে পারমু না। টুলু চোরা রেগে গিয়ে তাদের সাথে চুরির সিদ্ধান্ত বাতিল করতে চাইলো তাতে কবির ও তুষার বিচলিত হল না, পরক্ষনে টুলু চোরা তাদের আবার বললো এক শর্তে মুই তোগো লগে থাকতে পারি, এরপরে মুই যে বাড়ির সন্ধান আনমু তাতে তোরা না করতে পারবি না। যুবকদ্বয় একে অপরের মুখের দিকে তাকিয়ে বললো সন্ধন কর। টুলু চোরা যুবকদ্বয়ের পূর্বের আপত্তির কথা মাথায় রেখে এবার কাসু মিয়া নামের এক ঘুষখোর অফিসার যিনি সুদের ব্যবসাও করেন তার বাড়িতে চুরির প্রস্তাব দিলে যুবকদ্বয় রাজি হল এবং চুরির দিনক্ষন ঠিক করলো।
দ্বিতীয় দৃশ্যঃ
চুরি করতে যাওয়ার পূর্বে টুলু চোরাকে বারবার শর্তের কথা মনে করিয়ে দিল “ তাদের যতটুকু প্রয়োজন তার বেশি চুরি করবেনা তারা ”। চুরি করতে ঠুকে তারা পর্যাপ্ত টাকা পয়সা নিয়ে যখন চলে আসবে তখন টুলু চোরা আপত্তি করলো, সে বললো তোমরা যাও আমি যতটা পারি নিয়ে যাব। তার কথা শুনে কবির ও তুষার চলে আসলো কিন্তু অতি লোভের কারনে টুলু চোরা ধরা পড়লো। তাকে সারা রাত গাছের সাথে বেঁধে রেখে সকালে বিচারের জন্য গ্রামের মোড়ল, স্কুলের প্রধান শিক্ষক ও সমাজের মাথা তোলা কর্তাব্যাক্তিদের ডাকা হল। বিচার শুরু হল --
সরদার সাহেব : এই চোরা তোর সাথে আর কে কে ছিল ?
টুলু চোরা : আমি চুরি করতে চাই নাই। আমি ভাল হতে চাইল্লাম কিন্তু ওরা কইলো মোরা আছি হেইতে মুই রাজি হইছি।
সরদার সাহেব : ওরা কারা ?
টুলু চোরা : কাউয়া কবির ও তুষার।
উপস্থিত সকলের বিশ্বাস করতে খুব কষ্ট হচ্ছে। এত ভাল দুটি ছেলে এমন কাজ করবে ভাবা যায় !!! তবুও ওদের ডাকা হল। ওরা উপস্থিত হল। সবাই জানে তুষার অন্যায় থেকে দুরে থাকে এবং মিথ্যা বলতে পারে না।
মোড়ল সাহেব : কিরে কবির এ কাজ করলি কেন !
কবির : হুজুর মোরে ক্ষমা করেন, মুই আর তুষার রাজি আল্লাম না। ঐ চোরার কথা শুনে কি করেছি বুঝতে পারি নাই, অভাবের তাড়না আর সইতে পারতে ছিলাম না। মোর যহন আল্লে তহন হক্কলে নেছে আজ মুই না খাইয়া খাকলেও কেউ দুইমুট খাওন দেয় না। কাম করে ঠিক মত মায়না পাইনা। মোরে ক্ষমা করেন।
মাষ্টার সাহেব : কিরে তুষার আমার শিক্ষা কি মিথ্যা ছিল। তুই তো স্কুলের সবচেয়ে ভাল ছেলে ছিলি! তোর বাবাও তো শিক্ষক ছিল, ছিঃ ছিঃ ছিঃ !!!
তুষার কিছু বলার ভাষা হারিয়ে ফেলেছে, লজ্জা আর অনুতাপে তার চোখ দিয়ে জল গড়িয়ে পরছে। তুষারের মনে হচ্ছে এখন এই মুহুর্তে যদি আমার মরণ হত তাহলে বেঁচে যেতাম। পাথরের মত দাড়িয়ে আছে তুষার। সবাই তার দিকে তাকিয়ে ফিস ফিস করে অনেক কিছু বলছে। এই ফিস ফিস শব্দ তুষারের কাছে মৃত্যু যন্ত্রনার চেয়েও যন্ত্রনাময় মনে হচ্ছে।
সরদার সাহেব মোড়ল সাহেবকে উদ্দেশ্য করে বললো সবই তো শুনলাম আর দেরি করে লাভ কি!
মোড়ল সাহেব : কাসু মিয়াকে তার সবকিছু বুঝিয়ে দিয়ে ওদের শাস্তি দিয়ে সভা শেষ করে আমার ঐ পাড়ায় গিয়ে আরেকটা সালিশী করতে হবে। মাষ্টার সাহেব আজকে আপনিই বিচার করুন।
মাষ্টার সাহেব : আপনারা সবাই যেহেতু আমার উপর বিচারের ভার দিয়েছেন সেহেতু আমি আমার জ্ঞান দিয়ে যথাযথ বিচারের চেষ্টা করবো। তা প্রথমে তুষারকে দিয়েই শুরু করি। তা তুমি লেখা পড়া শিখেছো কি জন্যে? চুরি করতে তো লেখাপড়া শেখার প্রয়োজন হয়না। কবে থেকে এই কাজ করতেছো ! পাড়লে ভাল হয়ে যাও। এবারের মত দশবার কান ধরে ওঠবস করে এখান থেকে বিদায় হও।
সরদার সাহেব : মাষ্টার সাহেব, এটা কি করলেন! এইটুকু সাজা দিলে তো পরে পুকুর চুরি করতেও দ্বিধা করবে না।
মাষ্টার সাহেব : তাহলে আপনিই বিচার করুন।
সরদার সাহেব : না না। সবাই যখন আপনার উপর বিচারের ভার দিয়েছে তখন আপনিই করুন।
মাষ্টার সাহেব : কবির । তুই তো শ্রমিক, তোর গায়ে শক্তি আছে। মানুষ কত বিশ্বাস করে তোকে কাজে নেয় আর তুই এটা কি কাজ করলি ! তুই শুধু কাসুর ঘর চুরি কর নাই তোর প্রতি আমাদের যে বিশ্বাস ছিল তাও নষ্ট করেছিস। তোকে শাস্তি পেতে হবে। তুই পঞ্চাশবার কান ধরে ওঠবস কর আর সাথে মুখে বলবি আমি আর চুরি করবো না তারপর চোখের সামনে থেকে বিদায় হ।
কাসু মিয়া : মাষ্টার সাব আগেরটারেও এই এক শাস্তি দিলে মনে রাখতো, ও তো খানিক বাদেই ভুলে যাবে।
মাষ্টার সাহেব : কাসু মিয়া তাহলে তো তুমিই বিচার করতে পারতে আমাকে ডাকলে কেন ?
কাসু মিয়া : মাষ্টার সাব ভুল হয়ে গেছে, আপনে বিচার করেন।
মাষ্টার সাহেব : টুলু চোরা তো জুয়ারী, মাদকাসক্ত, পেশাদার চোর। ওর চামড়া তুলে লবনে ডুবিয়ে রাখলেও ওকে কতটা কম শাস্তি দেয়া হল বোঝা ভার।ওর জন্য এলাকার দশটা ছেলে নষ্ট হচ্ছে।
টুলু চোরা : মাষ্টার সাব কাসু মিয়া ঘুষ খায় সুদ খায় তাতে দোষ নাই আর মুই একটু এটা সেটা খাইলে করলেই দোষ! মুই তো ভাল মানষের ধন চুরি করি নাই, ঘুষখোরও তো মোর নাহান এক ধরনের চোর। তাকেও শাস্তি দেন।
কাসু মিয়া : ঐ চোরা চুরি করছো আবার কতা কও !
মাষ্টার সাহেব : থামেন সবাই। চোরে শোনেনা ধর্মের কাহিনী। টুলু চোরা খারাপ বলে নাই, তবুও এখন যে জন্যে আমরা বসছি সেই বিচার কাজ শেষ করতে চাই। টুলু চোরা অপরাধ করছে ওর মাথা ন্যাড়া করে দেয়া হোক আর পঞ্চাশটা জুতাপেটা করা হোক।
বিচার শেষ, রায় কার্যকর করে সবাই চলে গেলে বিচারকদের জন্য চা নাস্তার ব্যবস্থা করা হল। বিচারকেরা নিজেদের মধ্যে কথা শুরু করলো।
সরদার সাহেব ; মাষ্টার সাহেব আমি বিচারটা বুঝলাম না একই অপরাধে তিনজনকে তিন ধরনের সাজা দেয়া হল !
মোড়ল সাহেব : হ, মাষ্টার সাহেব আমি সরদার সাহেবর কথার সাথে একমত।
মাষ্টার সাহেব : মোড়ল সাহেব আপনি আগামীকাল পর্যন্ত অপেক্ষা করুন আর খবর নিন তিন অপরাধী কে কি করতেছে।
মোড়ল সাহেব : নিতাই ।
নিতাই : জ্বী হুজুর।
মোড়ল সাহেব : ওরা কে কি করে কোথায় থাকে খবর নিয়ে আগামীকাল সন্ধায় আমাকে জানাবে। আজ তাহলে উঠি আগামীকাল সন্ধায় আমার কাঁচারীতে সকলের নিমন্ত্রন রইলো।
শেষ দৃশ্যঃ
আজ সন্ধায় সবাই মোড়ল সাহেবের কাঁচারীতে এসেছে। মোড়ল সাহেব এখানে বসেই বিচার সালিশী করেন। সন্ধার পরে কাজ না থাকলে গ্রামের গণ্যমান্য সবাই এখানেই ভিড় করে আড্ডা দেয়। সারাদিন কোথায় কে কি করেছে তা নিয়ে জমে উঠে আড্ডা। তবে আজ সবাই বসে আছে নিতাইয়ের অপেক্ষায়। মাষ্টার সাহেবকে একটু চিন্তিত মনে হয়। হঠাৎ নিতাইয়ের আগমন। নড়েচড়ে বসে সবাই।
হেমন্ত বাবু : কিহে নিতাই কি খবর আনলে তাড়াতারি বল।
মোড়ল সাহেব : হ্যা বল, আজ আমরা সবাই তোমার জন্যই অপেক্ষা করতেছি।
নিতাই : হুজুর কি আর কমু দুই চোরের কোন খবর নাই আর টুলু চোরা আগের নাহানই আছে।
সরদার সাহেব : (রাগের স¦রে) হেয়ালি না করে খুলে বল।
মাষ্টার সাহেব ; (কৌতুহলি দৃষ্টিতে) কে কি করছে ! কোথায় আছে ! পরিষ্কার করে বল নিতাই।
নিতাই : হুজুর তুষার শিক্ষিত ছেলে এত লোকের মাঝে কান ধরার অপমান সইতে না পাইররা সে কোথায় গ্যাছে হ্যারে খুইজ্জা পাওয়া যাইতাছে না। হ্যার বাপে আর বুইনে হ্যারে পাগলের নাহান খোজতে আছে, হ্যাগো পরিচিত হগল জায়গায় খোজজে। হ্যারা ধারনা করতেছে সে আত্মহত্যা করেছে।
হেমন্ত বাবু : বলিস কি !
মোড়ল সাহেব : (গম্ভীর স্বরে) কবিরের কি খবর ?
নিতাই : মাষ্টার সাব, কবির গতকাইল এইহান দ্যা যাইয়া ঘরে ঢোকছে হ্যারপর থেকে বাতাসও ওরে দ্যাখছে বলে সাক্ষ্য দিতে পারবে না। মুই আওয়ার আগে দেইখ্যা আইছি ওরে বাইর করার চেষ্টা চলতেছে।
মাষ্টার সাহেব : বেঁচে আছে তো !
নিতাই : হ বাইচ্চা আছে।
সরদার সাহেব : তা টুলু চোরার কথা কি জানি বললি নিতাই !
নিতাই : ও গতকাল বিচারের পর পূব পাড়ায় যাইয়া জুয়া খ্যালেছে হ্যারপর শেষ রাইতে ভাঙ খাইয়া বউরে পিডাইছে। আইজ ব্যানে বউ বাপের বাড়ি চইল্লা গ্যাছে। আজ বিয়ালে দেখলাম উত্তর পাড়ায় কিছু জুয়ারিদের লগে বইয়া জুয়া খ্যালতেছে আর গাঁজা খাইতেছে।
সরদার সাহেব : (রাগত স্বরে) এখনকার শিক্ষা শুধু সনদেই শেষ। পোলাপানে কিছু শিখে না তাহলে তুষার এমন হত না। আমরা পড়েছি অ - অসৎ সঙ্গ ত্যাগ কর আর এখন পড়ে অ - অজগর আসছে তেড়ে উঠে পর বই ছেড়ে।
হেমন্ত বাবু : শিক্ষক আপনি ন্যায় বিচারক
জাগ্রত করেন জাতির বিবেক,
প্রকৃত জ্ঞান বিতরন করে
বিবেকবান জাতি গড়েন।
সরদার সাহেব : শিক্ষার নামে ব্যাবসা চলে
শিক্ষা এখন ডুবছে জলে,
ভাওতাবাজি বন্ধ করেন
আলোকিত সমাজ গড়েন।
মোড়ল সাহেব : ( দীর্ঘশ্বাস ছেড়ে)
হায়রে পৃথিবী হায়রে সমাজ!
নানান রুপে নানান সাঁজ,
অপরাধীর সাজা হয় অপরাধের নয়
অপরাধী বিলীন হলেও অপরাধ রয় !
http://www.somewhereinblog.net/blog/mrttalukder/30217128
বিষয়: সাহিত্য
৬৬৬ বার পঠিত, ০ টি মন্তব্য
পাঠকের মন্তব্য:
মন্তব্য করতে লগইন করুন