ইদ পোশাক
লিখেছেন লিখেছেন তানভীর জনি ২৩ জুন, ২০১৭, ০২:০২:৪৫ দুপুর
ইদ মানে আনন্দ, ইদ মানে খুশি। ইদের দিন নতুন পোশাক পরে আত্মীয়-স্বজনদের বাসায় বেড়ানো এবং পায়েশ-শেমাই-পিঠা খাওয়া আমাদের সংস্কৃতির অংশ। আমলা থেকে কামলা, ধনী থেকে গরিব, ফকির থেকে অভিজাত শ্রেণী সকলেই ইদের দিন নতুন পোশাক পরিধান করে ঘুরে-বেড়ায়। দীর্ঘ ১মাস সিয়াম সাধনার পর ইদের আনন্দের মধ্য দিয়ে তার পরিসমাপ্তি ঘটে।
ইদকে উপলক্ষ্য করে ঢাকাসহ দেশের সমস্ত শপিংমল আর মার্কেটগুলো চাঙ্গা হয়ে ওঠে, কেনা-বেচার হিড়িক পরে যায়। শপিংমলগুলো লাল-নীল-সবুজ-হলুদ বাতিতে নবধূর ন্যায় রূপসজ্জা ধারণ করে। আলোকিত থাকে রাস্তা-ঘাট,ছোটখাটো দোকানপাটগুলোও। নতুন পোশাক ছাড়া ইদ হয়না এবং ইদের আনন্দও মাটি হয়ে যায়। আবাল-বৃদ্ধ-বনিতা সবারই নতুন পোশাকের প্রতি থাকে অন্যরকম আকর্ষন। ইদের আনন্দ ছুঁয়ে যায় সবাইকে।
ছোটবেলায় ইদের পোশাকের জন্য অধীর আগ্রহ অপেক্ষা করে থাকতাম কবে ইদের সেই নতুন পোশাকের গন্ধ শুকবো, চোখ-মন ভরে দেখবো। আর পোশাক হাতে পাবার পর প্যাকেটের ভিতর থেকেই দেখতাম আর নিজেকে কল্পনা করতাম এই পোশাকে আমাকে কেমন দেখাবে। কাউকে দেখাতাম না এমনকি প্যাকেট খুলে দেখারও সাহস করতাম না পাছে ইদ পুরনো হয়ে যাবে, কাপড়ের ভাঁজ নষ্ট হয়ে, আনন্দটাও অর্ধেক হয়ে যাবে। নতুন জুতা কিনে আনার পর ট্রায়াল হিসেবে পলিব্যাগ বা জুতার বাক্সের ভিতর রেখেই পরতাম যেন ময়লা না লাগে। জুতা পরে বিছানার উপর হাটতাম কারন নিচে নামলেই জুতায় ময়লা লাগবে এবং ইদ পুরনো হয়ে যাবে।
আমি গ্রামে বড় হয়েছি জীবিকার চাহিদায় আব্বা ঢাকায় ব্যবসায় শুরু করেন। প্রতি সপ্তাহে সে বাড়িতে আসলেও ইদের ছুটিতে আসার ব্যপারটা আমাদের কাছে ছিল অন্যরকম। কিন্তু ইদের ছুটিতে তিনি চাঁদ রাতে বাড়ি আসতেন যার ফলে আমাদের ইদের পোশাক পছন্দ-অপছন্দ করার সুযোগ কমই ছিল। পোশাক ছোট-বড় বা রঙ পছন্দ না হলেও আমাদের তা-ই গ্রহন করতে হতো। কিন্তু আব্বার পছন্দ ভালো ছিল তাঁর কেনা পোশাক আমাদের কারো অপছন্দ হয়নি কখনো। কিন্তু বিপত্তি ঘটতো পোশাকের সাইজের ক্ষেত্রে তাঁর ছেলে-মেয়েরা যে প্রতি বছর বেড়ে ওঠছে সেটা মনে হয় তিনি মানতেন না। বরাবরই পোশাক ছোট হতো আমরাও তা মেনেজ করে নিতাম। সঙ্গত কারণেই ইদের সময় ট্রেন সঠিক সময়ে ছাড়ে না যার ফলে সঠিক সময়ে গন্তব্যেও পৌঁছায় না। তখন ফোনের প্রচলন ছিলনা তাই তাঁর অবস্থান সম্পর্কেও জানতে পারতাম না। অপেক্ষা করা ছাড়া আমাদের আর কোন পথ খোলা থাকতোনা। আমরা ভাই-বোনেরা অধীর হয়ে বসে থাকতাম নতুন পোশাক দেখার আশায় আর আম্মা অধীর হয়ে বসে থাকতেন আব্বার জন্য। তখন বিষয়গুলো বুঝতাম না, কেন আম্মাকে বারবার আব্বার অবস্থান সম্পর্কে জিজ্ঞেস করলে রাগারাগি-বকাবকি করতেন। আমাদের ধারণা আম্মাদের কাছে দুনিয়ার সব তথ্য থাকে এবং তাঁরা ছেলে-মেয়েদের সকল প্রশ্নের উত্তর জানেন। ইদের পোশক হাতে পাওয়ার অপেক্ষায় থেকে থেকে রাত গভীর হয় আম্মা বকাবকি শুরু করে ঘুমানোর জন্য ঐদিকে আম্মার দুশ্চিন্তা বাড়ে আব্বার জন্য। আমরা মনের মধ্যে রাজ্যের দুঃখ-কষ্ট নিয়ে বিছানায় শুতে যেতাম এবং ঘুমহীন চোখে কল্পনা করতাম আমার পোশাকে কি রঙের হবে, কি ঢঙের হবে, আমাকে কেমন মানাবে ইত্যাদি ইত্যাদি। অপেক্ষারত চোখ দু’টো একসময় ঘুমে বন্ধ হয়ে আসতো এবং হয়তো তখনই আব্বা ঘরে ঢুকতেন। আমি ঘুমালে মৃতপ্রায় ব্যক্তি হয়ে যায় আশেপাশে শত বোমা ফাটানো শব্দ হলেও আমার ঘুম সহজে ভাঙেনা। যার ফলে আমার ভাই-বোনেরা সেই আনন্দটা উপভোগ করতে পারলেও আমি কোনদিন পারিনি। সকাল বেলা উঠেই নতুন পোশাকের গন্ধ নিতে হতো। আমাদের দুই ভাইয়ের জন্য হুবহু দেখতে একই পোশাক আনা হতো পার্থক্য শুধু থাকতো সাইজের ক্ষেত্রে। অন্যদিকে আমাদের কাজিনদের ইদ পোশাক অনেক আগেই এসে পরতো তাদের হাতে কারণ তারা এলাকা থেকেই শপিং করতো। আমরা তখন মনের দুঃখে মরতাম। সান্ত্বনাস্বরূপ, সবাই বলতো তোদের পোশাক আসবে ঢাকা শহর থেকে যেগুলো এলাকার কারো সাথেই মিলে যাওয়ার কোন সুযোগ নেই। এই পোশাককে ঘিরেই শত আনন্দ ছিল। আজ শত শত স্মৃতি তৈরী হলো। ইদের পোশাক শুধু পোশাক নয়, আমাদের আনন্দ, আমাদের স্মৃতি, আমাদের আবেগ, আমাদের অনুভূতি, আমাদের স্বপ্ন।
সময়ের সঙ্গে তাল মিলিয়ে আমরা বড় হয়েছি সে সঙ্গে পরিবর্তিত হয়েছে আমাদের চারপয়াশের পরিবেশ-পরিস্থিতি।পরিবর্তন এসেছে সমাজ-সংস্কৃতিতে, আমাদের পছন্দে-অপছন্দে। শৈশব পেরিয়ে গিয়েছে তাই এখন নিজের জন্য পোশাক বা কিছু কিনে সুখ পাইনা, বরং বাবা-মায়ের জন্য কিনে সুখ এবং আনন্দ পাই। ইদের পূর্ণতা আসে তাঁদের জন্য পোশাক কেনার মধ্য দিয়েই। এখন অপেক্ষায় থাকি নতুন পোশাকগুলো কখন আব্বা-আম্মার হাতে তুলে দিব।
তানভীর জনি
বিষয়: বিবিধ
৫৫১ বার পঠিত, ০ টি মন্তব্য
পাঠকের মন্তব্য:
মন্তব্য করতে লগইন করুন