"ও ডাক্তার সাব"
লিখেছেন লিখেছেন নির্বাক নিশাচর ১৭ জুন, ২০১৭, ০৬:১৬:৩২ সকাল
-স্যার।
-বলো।
-এইমাত্র নতুন একটা আসছে।
-আমার একটু জরুরি কাজ আছে,শনু।তুমি করে ফেলতে পারবা না?
-ছেড়ির পেটটা কেমন বেমক্কা ফুইলা রইসে।আমি বুঝতেসিনা কি করাম।
-আচ্ছা যাও,আমি আসছি।
একটা মুহুর্তের ফুসরৎ নেই।দু বছর আগে যখন প্রথম এসেছিলাম,ভেবেছিলাম এই গ্রাম টাইপের শহরে আর কিসের চাপ থাকবে! তখন কে জানতো যে আশপাশের একটা বিশাল অংশের লোকজন চিকিৎসা করাতে এই একটা হসপিটালেই আসে।ডাক্তার নার্স মিলিয়ে সংখ্যাটা নেহায়েত কম হবে না।তবে হসপিটালে মেডিক্যাল এক্সামিনার বলতে একমাত্র এই আমি শর্মাই আছি।তাই ডাক্তারির পাশাপাশি ময়নাতদন্তের কাজটাও আমাকেই সারতে হয়।
সর্বক্ষণ মৃত মানুষের আশেপাশে থাকতে থাকতে মাঝেমধ্যে আমার নিজেকেও কেমন যেন মৃত মনে হয়।শনু ডোমটাও কেমন যেন মরা ধরণের মানুষ।বিশ বছর ধরে নাকি সে লাশ কাটছে,অনুভূতিগুলোর মৃত্যু তো তবে অবশ্যম্ভাবীই!তবে দুঃখের কথা হচ্ছে,এতদিন ধরে এত লাশ কেটেও অপদার্থ লোকটা এখনো কাজটা আয়ত্ত করতে পারেনি।
স্যার,পুলিশ তো তাড়া দিতাসে।
-আসছি আসছি।
লাশকাটা ঘরেই আমার প্রতিদিনের কাজ।তবুও প্রতিদিন যখন ঘরটায় ঢুকি,আমার ঘাড়ে কেমন যেন একটা শিরশির করে ওঠে।মৃত্যুর গন্ধ ঘরটার দেয়ালে দেয়ালে লেপ্টে থাকে,বাতাসে ভাসে নাম না জানা হাহাকার।টেবিলের দিকে এগুলাম,মেয়েটার লাশ ওখানেই শুইয়ে রাখা হয়েছে।
এ যে সদ্য শৈশব ফেলে আসা এক কিশোরী! ঘরের উঠোনে এক্কাদোক্কা খেলে যার দিন কাটানোর কথা,সে আজ শুয়ে আছে লাশকাটা ঘরের হিমশীতল টেবিলে! একটা দীর্ঘশ্বাস ছেড়ে রক্তশূণ্য ফ্যাকাসে মুখটা থেকে চোখ ফিরিয়ে নিচের দিকে তাকালাম।একনজরেই বুঝতে পারলাম মেয়েটা প্রেগন্যান্ট ছিল।মনে হচ্ছে একেবারে শেষ স্টেজ ছিল।আচ্ছা,বাচ্চাটা বেঁচে আছে কি? শুনেছি গর্ভবতী মা মারা গেলেও অনেক সময় নাকি বাচ্চা বেশ কিছুক্ষণ জীবিত থাকে।যা করার তাড়াতাড়ি করতে হবে!
স্যার,কিছু বুঝলেন?
-আমাদের এখন একটা ডেলিভারি করতে হবে।
-মানে বুঝলাম না স্যার!
শনুকে সব কিছু বুঝিয়ে বলার মতো সময় নেই।তাই ওকে হতভম্ব রেখেই তাড়াতাড়ি ডেলিভারির সবকিছু প্রস্তুত করে ফেললাম।আমাকে এখন একটা মৃত মায়ের জরায়ু থেকে তার বাচ্চাকে টেনে বের করে আনতে হবে।মৃত মেয়েটার পেটে জমে থাকা গ্যাসগুলো এক্ষেত্রে আমাকে সাহায্য করবে বাইরের দিকে বাচ্চাটাকে ঠেলে দিতে।হে সৃষ্টিকর্তা,বাচ্চাটা যেন বেঁচে থাকে!
প্রায় এক ঘণ্টা পর।
আমি এই মুহূর্তে রক্তাক্ত একটা মানবশিশু হাতে নিয়ে দাঁড়িয়ে আছি।আমার সব চেষ্টা বৃথা গেছে।বাচ্চাটা বেঁচে নেই।আমি পারিনি বাচ্চাটাকে বাঁচাতে।কেন যেন মনে হচ্ছে বাচ্চাটা বেঁচে ছিল।মনে হচ্ছে যেন আমি ডেলিভারি করার সময় কোন ভুলচুক করে ফেলেছি যার কারণে বাচ্চাটা মারা গেছে।
স্যার...ও স্যার...
শনু ডাকছে।ডেকেই যাচ্ছে।তবে তার ডাক ছাপিয়ে যেন একটা পনের-ষোল বছরের কিশোরী ডাকছে।আমি স্পষ্ট শুনতে পাচ্ছি কণ্ঠটা বলছে -" ডাক্তার সাব...ও ডাক্তার সাব...আমার মনাটারে বাঁচাইতে পারলেন না সাব?"
ডাক্তার হিসেবে আমাকে শিখতে হয়েছে ভোকাল কর্ডের অস্বাভাবিক কোন কম্পন ছাড়াই কিভাবে একটা মানুষের মৃত্যু সংবাদ তার আত্মীয়স্বজনদের দেয়া যায়।আমাকে শিখতে হয়েছে হাতের একটা পেশি না কাঁপিয়েও কিভাবে একটা মানুষের পুরো দেহ কাঁটাছেঁড়া করা যায়।তবে আমাকে শেখানো হয়নি একটা মৃত মায়ের পাশে তার মৃত সন্তানকে শুইয়ে কিভাবে সব ভুলে হাসিমুখে সেখান থেকে চলে যাওয়া যায়।
আমার হাত কাঁপছে...সাথে কাঁপছে রক্তমাখা একটা শিশু।দৃষ্টি ঝাঁপসা হয়ে আসছে।শনু...লাশঘর...মৃত কিশোরী সব কেমন যেন ঘোলাটে হয়ে যাচ্ছে।শুধু কানে বাজছে একটা কণ্ঠ।পনেরো-ষোল বছরের একটা কিশোরী যেন বলছে - "ডাক্তার সাব...ও ডাক্তার সাব...আমার মনাটারে বাঁচাইতে পারলেন না সাব?"
বিষয়: বিবিধ
৫৯০ বার পঠিত, ০ টি মন্তব্য
পাঠকের মন্তব্য:
মন্তব্য করতে লগইন করুন