আন্তর্জাতিক মাতৃভাষা দিবসের 'মোড়কদাতা'
লিখেছেন লিখেছেন নমানুষ ১১ ফেব্রুয়ারি, ২০১৭, ১০:৫৮:০৮ সকাল
২১ শে ফেব্রুয়ারি, একসময় ছিলো 'শহীদ দিবস' পরে 'ভাষা দিবস' এবং বর্তমানে 'আন্তর্জাতিক মাতৃভাষা দিবস'।
তবে সবগুলোর প্রেক্ষাপটই এক, ১৯৫২ সালের রাষ্ট্র ভাষা বাংলার দাবিতে ভাষা আন্দোলন।
প্রায় ৪৭ বছর ধরে একুশে ফেব্রুয়ারি 'শহীদ দিবস/ভাষা দিবস' হিসেবে এদেশের বর্ডারের মধ্যেই সীমাবদ্ধ ছিলো,এদেশের মধ্যেই রাষ্ট্রীয়ভাবে পালিত হতো।
২০০০ সাল থেকে অদ্যাবধি ২১ শে ফেব্রুয়ারি কেবল বাংলাদেশেই পালন করা হচ্ছেনা,বরং জাতিসংঘের সদস্য সকল দেশই তা পালন করছে।
এ দিবসটির নাম দেওয়া হয়েছে 'আন্তর্জাতিক মাতৃভাষা দিবস'।
এদেশের পাহাড়ি অঞ্চলে (বিশেষত: সিলেট,চট্রগ্রাম) চা উৎপাদিত হয়। প্রায় ১৬০ টির মতো চা বাগান রয়েছে।
ক্রেতা বা ভোক্তা যখন চা কিনতে যান(সাধারণত দোকান বা শপিংমল থেকে) তখন চায়ের বিভিন্ন কোম্পানির নাম (যেমন: তাজা,ইস্পাহানী, সিলন) বলে চা কিনেন।
তখন জিজ্ঞেস করার দরকার হয়না, ঐ চা কোন বাগান থেকে সংগ্রহ করা হয়েছে।
বরং যারা চায়ের 'মোড়কীকরণ' করেছে তাদের নাম বলে চা ক্রয় করা হয়।
২১ শে ফেব্রুয়ারি আমরা গর্ব করে বলি, এটা আন্তর্জাতিক মাতৃভাষা দিবস। সমগ্র বিশ্ব একই সাথে পালন করছে।
তারপরের লাইনে আমরা চলে যাই ১৯৫২ সালের ইতিহাসে(!) আর বক্তব্যের শেষাংশে অনুষ্ঠানের আয়োজকদের ধন্যবাদ জানিয়ে শেষ করি সংক্ষিপ্ত বক্তব্য!
যখনই আপনি শহীদ দিবস বা ভাষা দিবসের কথা বলছেন তখন আপনি ১৯৫২ সালের ইতিহাস বলে বক্তব্য শেষ করতে পারেন।
কিন্ত,যখনই 'আন্তর্জাতিক মাতৃভাষা দিবসের' কথা বলছেন তখন আপনাকে ৫২'র সাথে আরেকটি প্রেক্ষাপট ও তুলে ধরতে হবে।
সেটা হলো : কিভাবে একুশে ফেব্রুয়ারি আন্তর্জাতিক মাতৃভাষা দিবস হিসেবে স্বীকৃত পেলো।
২১ শে ফেব্রুয়ারিকে 'আন্তর্জাতিক মাতৃভাষা' দিবস করার পথিকৃৎ কানাডা প্রবাসী মরহুম রফিকুল ইসলাম এবং উনার সহযোগী আব্দুস সালাম।
তাঁরা একুশে ফেব্রুয়ারির ইতিহাস বিশ্ব মণ্ডলে তুলে ধরেন।
তাঁদের কল্যাণে বিশ্ব জানে 'বাংলা' নামে এক ভাষার নাম।
তাঁদের কল্যাণে বিশ্ব জানলো মায়ের ভাষা রক্ষার জন্য কোনো জাতি জীবনোৎসর্গ করতে পারে।
তাঁরাই মূলত আন্তর্জাতিক অঙ্গনে 'বাংলা' ভাষাকে পরিচয় করিয়ে দিয়েছেন।
১৯৫২'র ভাষা শহীদদের তুলনায় তাঁদের অবদান কোনাংশেই কম নয়।
যেভাবে বাংলা আজ আন্তর্জাতিক মাতৃভাষা দিবস :
→ ১৯৯৮ সালের ৯ ই জানুয়ারি, রফিকুল ইসলাম জাতিসংঘের তৎকালীন মহাসচিব কফি আনানকে একটি চিঠি পাঠান।
চিঠিটিতে ১৯৫২ সালের ভাষা আন্দোলনে বাঙ্গালীর আত্মত্যাগের কথা তুলে ধরেন।
এই মর্মে প্রস্তাব করেন যে, এই ইভেন্টটিকে আন্তর্জাতিক স্বীকৃতি দেবার জন্য।
→ জাতিসংঘের অফিস থেকে রফিকুল ইসলামকে জানানো হয় যে, জাতিসংঘের অন্য কোন সদস্য রাষ্ট্রের কারো কাছ থেকে একই ধরনের প্রস্তাব আনার ব্যবস্থা করেন।
→ তারপর রফিকুল ইসলাম তার সহযোগী আব্দুস সালামকে নিয়ে 'A Group of Mother Language of the World' গঠন করেন।
এতে, ইংরেজীভাষী, জার্মানভাষী, ক্যান্টোনিজভাষী, একজন কাচ্চিভাষী সদস্য ছিলেন। তারা আবারো কফি আনানকে “মাদার ল্যাংগুয়েজ লাভারস অফ দ্যা ওর্য়াল্ড”(Mother Language Lovers of the World)-এর পক্ষ থেকে একটি চিঠি লেখেন, এবং চিঠির একটি কপি ইউএনওর ক্যানাডিয়ান এম্বাসেডর ডেভিড ফাওলারের কাছেও প্রেরণ করেন।
→ এই সংস্থাটি এবং বাংলাদেশের তৎকালীন শিক্ষামন্ত্রনালয়, দিন রাত পরিশ্রম করে ২৯ টি দেশকে এ প্রস্তাবের স্বপক্ষে সমর্থন আদায়ে সচেষ্ট হয়।
→১৯৯৯ সালের ৯ ই সেপ্টেম্বর, প্রস্তাবটি উত্থাপনের শেষদিন।
প্রধানমন্ত্রীরর সই বাকি থাকার কারণে প্রস্তাবটি উত্থাপনে বিলম্ব হচ্ছিলো।
তখন রফিকুল ইসলাম ও আব্দুস সালাম প্রধানমন্ত্রীকে সই সহ প্রস্তাবটি ফ্যাক্সে পাঠাতে অনুরোধ করেন।
অফিস সময় শেষ হবার ঘন্টাখানেক পূর্বে, জাতিসংঘের অফিসে প্রস্তাবটি পৌঁছাতে সক্ষম হোন এই দুই ভাষাসৈনিক।
→ ১৭ নভেম্বর ১৯৯৯, জাতিসংঘের সাধারণ অধিবেশনে ২১ শে ফেব্রুয়ারিকে আন্তর্জাতিক মাতৃভাষা দিবস হিসেবে স্বীকৃতি দেবার জন্য প্রস্তাব করা হয়।
প্রস্তাব উত্থাপনের সাথে সাথে ১৮৮ টি দেশ এর স্বপক্ষে মত দেয়; এমনকি পাকিস্তান ও।
→২০০০ সালের ২১ শে ফেব্রুয়ারি, জাতিসংঘের সদস্য সকল দেশ এক সাথে আন্তর্জাতিক মাতৃভাষা দিবস পালন করে।
১৯৫২ সালে রাষ্ট্রভাষা বাংলার জন্য জীবন দিয়েছিলেন এক সালাম আর রফিক।
আর ১৯৯৯ সালে তাদের অবদানকে বিশ্ব দরবার থেকে স্বীকৃতি এনে দেন আরেক সালাম আর রফিক।
ভাষাসৈনিক রফিকুল ইসলাম মৃত্যুবরণ করেন ২৯ নভেম্বর ২০১৩ সালে।
২০১৬ সালের ২৬ মার্চ তাঁকে মরণোত্তর স্বাধীনতা পদকে ভূষিত করা হয়। যা বাংলাদেশের সর্বোচ্চ বেসামরিক পুরস্কার।
বিষয়: বিবিধ
৭৩৫ বার পঠিত, ০ টি মন্তব্য
পাঠকের মন্তব্য:
মন্তব্য করতে লগইন করুন