প্রসঙ্গঃ আন্তর্জাতিক মাতৃভাষা দিবসের সংক্ষিপ্ত ইতিহাস, সর্বক্ষেত্রে বাংলা ভাষার যথাযথ ব্যবহার ও প্রবাসী নতুন প্রজন্মের মাঝে বাংলা ভাষা শিক্ষা ও প্রসারে প্রবাসী কমিউনিটি নেতৃত্বের করণীয়।
লিখেছেন লিখেছেন সেইন তীরের বাসিন্ধা ২১ ফেব্রুয়ারি, ২০১৭, ১০:৩২:১৪ সকাল
মহান একুশে ফেব্রুয়ারি, শহীদ দিবস বা 'আন্তর্জাতিক মাতৃভাষা দিবস' যে নামেই সম্বোধন করি না কেন আমাদের জাতীয় জীবনে এটি একটি ঐতিহাসিক ও গৌরবোজ্জল দিন। ভাষার জন্য বাঙ্গালীর আত্মদান বিশ্ব মানচিত্রে এক বিরল ইতিহাস। ভাষা আন্দোলনের মাধ্যমে বাংলাকে মাতৃভাষার স্বীকৃতি থেকে শুরু করে 'আন্তর্জাতিক মাতৃভাষা দিবস' স্বীকৃতি প্রাপ্তি পর্যন্ত আমাদের অগ্রজদের যে অসামান্য অবদান তথা যে স্বপ্ন সাহস ও প্রত্যয় বুকে লালন করে সেই ১৯৫২'র ভাষা আন্দোলনে আব্দুস সালাম, আবুল বরকত, রফিক উদ্দিন আহমদ, আব্দুল জব্বার, শফিউর রহমানরা তাঁদের বুকের তাজা রক্তে তথা নিজের জীবন বিলিয়ে দিয়ে আমাদের বাংলা ভাষাকে রাষ্ট্রভাষা/মাতৃভাষার স্বীকৃতি আদায় করেছিলেন এবং আরেক রফিক ও সালাম অক্লান্ত পরিশ্রম ও মেধার সমন্বয়ে বাংলাকে বিশ্বব্যাপী 'আন্তর্জাতিক মাতৃভাষা দিবস' হিসাবে পালনের স্বীকৃতি আদায় করে দিয়েছিলেন তাঁদের এই মহান আত্মদান ও ত্যাগের প্রতি স্বপ্রণোদিত বিনম্র শ্রদ্ধা জানানোর বহিঃপ্রকাশ তখনই সফল হবে যখন আমরা সর্বক্ষেত্রে বাংলা ভাষার ব্যবহার করতে পারবো ও আমাদের উত্তরসুরীদের মধ্যে বাংলাভাষার ব্যাপক প্রচার এবং প্রসার ঘটানোর মাধ্যমে বিশ্বের সর্বত্র ছড়িয়ে ছিটিয়ে দিতে পারবো।
১. আন্তর্জাতিক মাতৃভাষা দিবসের সংক্ষিপ্ত ইতিহাসঃ
১৯৯৮ সালের ৯ই জানুয়ারী কফি আনান জাতিসংঘের মহাসচিব থাকাকালীন কানাডার ভ্যাঙ্কুভার শহরে বসবাসরত দুই কৃতি বাঙ্গালী রফিকুল ইসলাম এবং আবদুস সালাম প্রাথমিক উদ্যোক্তা হিসেবে একুশে ফেব্রুয়ারিকে 'আন্তর্জাতিক মাতৃভাষা দিবস' হিসেবে ঘোষণার লিখিত আবেদন জানিয়েছিলেন। যদিও দীর্ঘ প্রায় ২টি বৎসরের পথ পরিক্রমায় বাঙ্গালীর এই দুই কৃতি সন্তান হাসান ফেরদৌসের পরামর্শে "এ গ্রুপ অব মাদার ল্যাংগুয়েজ অফ দ্যা ওর্য়াল্ড” নামে একটি সংগঠন দাঁড় করান। এতে একজন ইংরেজীভাষী, একজন জার্মানভাষী, একজন ক্যান্টোনিজভাষী, একজন কাচ্চিভাষী সদস্য ছিলেন। তারা আবারো কফি আনানকে "এ গ্রুপ অব মাদার ল্যাংগুয়েজ অফ দ্যা ওর্য়াল্ড"-এর পক্ষ থেকে একটি দরখাস্ত লেখেন, এবং দরখাস্তের একটি কপি ইউএনও'র কানাডিয়ান এম্বাসেডর ডেভিড ফাওলারের কাছেও প্রেরণ করেন। ইতিমধ্যে অনেকগুলি নাম এখানে যুক্ত হয়ে পড়ে। যথা-তৎকালীন শিক্ষামন্ত্রী এ এস এইচ কে সাদেক এবং শিক্ষা সচিব কাজী রকিবুদ্দিন, অধ্যাপক কফিলউদ্দিন আহমেদ, মশিউর রহমান (প্রধানমন্ত্রীর সেক্রেটারিয়েটের তৎকালীন ডিরেক্টর), সৈয়দ মোজাম্মেল আলি (ফ্রান্সে বাংলাদেশের রাষ্ট্রদূত), ইকতিয়ার চৌধুরী (কাউন্সিলর), তোজাম্মেল হক (ইউনেস্কোর সেক্রেটারি জেনেরালের শীর্ষ উপদেষ্টা) সহ অন্য অনেকেই জড়িত হয়ে পড়েন। তারা কঠোর পরিশ্রম করেন আরো ২৯ টি দেশকে প্রস্তাবটির স্বপক্ষে সমর্থন আদায়ে। বিশেষ করে যে নামগুলিকে শ্রদ্ধার সাথে স্মরণ করতে হয় তারা হলেন--হাসান ফেরদৌস(সে সময় জাতিসংঘের মহাসচিবের প্রধান তথ্য কর্মচারী হিসেবে কর্মরত), ইউনেস্কোর ভাষা বিভাগের জোশেফ পড এবং আনা মারিয়া যাদের আন্তরিক সহযোগীতায় কাজটি সফল হয়েছে। অনেক ছড়াই উৎরাই পেরিয়ে তৎকালীন প্রধানমন্ত্রীর স্বাক্ষরের মধ্যদিয়ে অবশেষে ১৯৯৯ সালের ১৭ই নভেম্বর ফ্রান্সের প্যারিসে অবস্থিত জাতিসংঘের অঙ্গ সংস্থা ইউনেস্কোর সদর দপ্তরে অনুষ্ঠিত অধিবেশনে বিশ্বের ১৮৮টি দেশের সর্বসম্মতিতে একুশে ফেব্রুয়ারিকে 'আন্তর্জাতিক মাতৃভাষা দিবস' হিসেবে ঘোষণা করা হয় এবং ২০০০ সালের ২১ ফেব্রুয়ারি থেকে দিবসটি জাতিসংঘের সদস্য দেশসমূহে যথাযথ মর্যাদায় পালিত হয়ে আসছে। ২০১০ সালের ২১ অক্টোবর বৃহস্পতিবার জাতিসংঘ সাধারণ পরিষদের ৬৫তম অধিবেশনে 'আন্তর্জাতিক মাতৃভাষা দিবস' পালনের প্রস্তাবটি উত্থাপন করে বাংলাদেশ। প্রস্তাবটি সর্বসম্মতভাবে পাস হয়। এই ধারাবাহিকতায় মে মাসে ১১৩ সদস্য বিশিষ্ট জাতিসংঘের তথ্যবিষয়ক কমিটিতে প্রস্তাবটি সর্বসম্মতভাবে পাস হয়। সেই থেকে জাতিসংঘ কর্তৃক গৃহীত সিদ্ধান্ত মোতাবেক প্রতিবছর একুশে ফেব্রুয়ারি বিশ্বব্যাপী 'আন্তর্জাতিক মাতৃভাষা দিবস' হিসেবে পালিত হয়ে আসছে।
২. মাতৃভাষার যথাযথ ব্যবহার ও প্রবাসী নতুন প্রজন্মের মাঝে বাংলা ভাষা শিক্ষা ও প্রসারে কমিউনিটি নেতৃত্বের করণীয়ঃ
প্রবাসে আমাদের নতুন প্রজন্ম বাংলা ভাষা কেমন শিখছে এবং শেখার পরিবেশ কতটুকু তৈরী আছে কিংবা না থাকলে আমাদের কী করণীয় তা নিয়ে ভাববার সময় এসেছে বলে আমি মনে করি। কেননা যখন দেখি বিদেশী ভাষা ব্যবহারে আমাদের নতুন প্রজন্ম অতি উৎসাহী কিংবা দু'চারটা লাইন ইংলিশ অথবা ফ্রেঞ্চ বলে নিজেকে খুব জাহির করেন অথচ শুদ্ধ ভাবে নিজের মাতৃভাষায় কথা বলতে পারেন না তখন বিষয়টি আমাকে অত্যন্ত পীড়া দেয়।
ইউরোপের প্রতিটি দেশেরই রয়েছে নিজস্ব মাতৃভাষা ও সংস্কৃতি বিশেষ করে আমি/আমরা যে দেশে বাস করছি এই ফরাসী জাতি তাদের মাতৃভাষার জন্য মরিয়া ও অত্যন্ত নিবেদিতপ্রাণ। কিন্তু আমাদের ক্ষেত্রে ফ্রান্সে যে বিষয়টি চোখে পড়ে তা হলো এখানে অধিকাংশ অভিভাবকদের মধ্যে তাদের সন্তানদের বাংলা ভাষা শেখানোর ব্যাপারে বিশেষ কোনো আগ্রহ, উৎসাহ বা উদ্দিপনা চোখে পড়েনা বা বাংলা ভাষা শিক্ষাদানের প্রয়োজনীয়তা গুরুত্বের সাথে প্রাধান্য পাচ্ছে না। বিষয়টি সচেতন মহলের মধ্যে যতদিন না গুরুত্ব পাবে আমাদের নতুন প্রজন্মের মধ্যে এক সময় হয়তো বা বাংলা ভাষার প্রতি অনীহা দেখা দিতে পারে। এ ব্যাপারে আমাদের সজাগ বা সুদৃষ্টি দেয়া অবশ্যম্ভাবী হয়ে পড়েছে।
ফ্রান্সে আমাদের ছেলে মেয়েরা ফ্রেঞ্চ ভাষা শেখার জন্য নিয়মিত স্কুলে যাতায়াত করে তথা খুব ব্যস্তই থাকে তা সত্য কিন্তু স্বভাষার ব্যাপারে সে রকম কোন সচেতনতা লক্ষ্য করা যায় না। জানি এবং মানি যে ফ্রেঞ্চ ভাষা পৃথিবীর কঠিন এবং জঠিলতমদের একটি এবং এখানে ফরাসীদের নিজস্ব ভাষা ছাড়া অন্য কোন ভাষার ব্যবহার চলে না বললেই চলে। আপনি ফ্রেঞ্চ ভাষা জানেন না কিন্তু ইংলিশ জানেন অথচ অফিসারও ইংলিশ জানেন তথাপি অফিস আদালতে গেলে আপনার সাথে ইংলিশ কথা বলা হবে না বরং কিছু কিছু ক্ষেত্রে ট্রান্সলেটর বরাদ্ধ রাখা হয়। সেজন্য যে দেশে আপনি বসবাস করবেন সে দেশের ভাষা অবশ্যই আয়ত্ত্ব করবেন এবং পুরোপুরি শিখবেন কিন্তু নিজের মাতৃভাষাকে অবজ্ঞা করে নয়।
আমাদের নতুন প্রজন্ম যদি বিদেশী ভাষার প্রতি মাত্রাতিরিক্ত আসক্ত হয়ে পড়ে আর স্বভাষার সাথে পরিচিতই না হয় এবং আমরা নির্বিকার হয়ে চেয়ে থেকে বিদেশী ভাষার কাছে আত্নসমর্পণ করি তবে আমাদের মাতৃভাষা কি ধুকে ধুকে কাঁদবে না ? নতুন প্রজন্মের কাছে বাংলাভাষা কি একটি বিদেশী ভাষায় রুপ নেবে না ?
যেহেতু প্রবাসে আমরা ভিনদেশী তাই এখানকার সরকারের এ বিষয়ে প্রকৃত অর্থে তেমন কিছুই করণীয় নেই। তাই এর মূল দায়িত্ব বর্তায় বাঙ্গালী কমিউনিটি নেতৃবৃন্ধের উপর। বর্তমান অবস্থা দৃষ্টে যা দেখছি তাতে মনে হয় আমাদের এ বিষয় আরো অধিকতর ভূমিকা রাখার প্রয়োজনীয়তা আছে। প্রবাসে যে বিষয়টি মূল প্রতিবন্ধকতা হিসেবে মনে হয় তা হলো আমাদের নিজেদের মধ্যে আন্তরিকতা তথা ঐক্যের অভাব। যা কি না আমাদেরকে প্রতিটি বিষয়ে শুধু পিছনেই ঠেলে দিচ্ছে। যার সুরাহা হওয়া খুবই জরুরী বলে আমি বিশ্বাস করি।
প্রবাসে বাংলা ভাষার প্রসার যে গতিতে এগোচ্ছে তা থেকে যদি আমরা বেরিয়ে আসতে না পারি অথবা এর যথাবিহীত ব্যবস্থা না নিতে পারি তবে অদূর ভবিষ্যতে আমাদের নতুন প্রজন্ম তাদের বাপ দাদার ভাষাকে ভুলে গিয়ে ভিনদেশী ভাষা বুকে লালন করে বেড়ে উঠবে আর মায়ের ভাষা শুধু নীরবেই ধুকে ধুকে কাঁদবে। মনে রাখতে হবে শুধু বলতে পারার নাম কিন্তু ভাষা শিক্ষা নয়। একাধারে অন্তত লিখতে, পড়তে ও বলতে পারার নামই ভাষা শিক্ষা। সেজন্য সপ্তাহে অন্ততঃ ১দিন যাতে শিশুরা বাংলা ভাষা শিখতে পারে সেই পরিবেশ আমাদেরকেই তৈরী করে দিতে হবে। এটা খুব জঠিল কোন বিষয় নয়। প্রয়োজন শুধু কমিউনিটি নেতৃবৃন্ধের ঐক্য ও আন্তরিক উদ্যোগ। নতুবা মাতৃভাষা বঞ্চিত প্রবাসী ভবিষ্যত প্রজন্ম এর দায়ভার আপনার/আমার ঘাড়েই যে চাপাবে তাতে সন্দেহের কোনো অবকাশ নেই।
মাতৃভাষা বাংলায় আমরা আমাদের মনের ভাবকে মনের মাধুরী মিশিয়ে যেভাবে ফুটিয়ে তুলতে পারি অন্য কোনো ভাষায় ঠিক সেভাবে তা সম্ভব হয়ে ওঠে না। আমরা এই ভাষাতেই ক্ষুধা, তৃষ্ণা, ভালবাসা মিটিয়ে পরিতৃপ্ত হই, অন্য কোনো ভাষায় নয়। ইংরেজি কিংবা ফ্রেঞ্চ আমার আপনার ভাষা নয়, বাংলা আমাদের ভাষা। বাংলার রয়েছে স্বতন্ত্র বঙ্গলিপি। ২৬টি বর্ণ কখনোই ৫২টি বর্ণের সমতুল্য হতে পারে না। বাংলার ৫২টি বর্ণের প্রতিটি বর্ণই বাঙ্গালীর প্রাণ। যা লিখুন, যেখানেই লিখুন, বাংলা বর্ণে শুদ্ধ করে বাংলায় লিখুন। ভিতরে তৃপ্তির ঢেঁকুর তুলে যারা বলেন, জানেন ভাই ! "আমার মেয়ে/ছেলের বাংলাটা ঠিক আসে না।" সেই সকল অভিভাবকদের মনে রাখা উচিত, বাংলা ছাড়া বাংলাদেশ রাষ্ট্রই জন্মাতো না। তাই বিনয়ের সহিত বলছি, বাংলাকে অবজ্ঞা করবেন না, বাংলার বিপক্ষে যাবেন না। কেননা আমার ভাষা আমার মাতৃতুল্য। তাই কবি যথার্থই বলেছেন--"মাতৃভাষা বাংলা ভাষা খোদার সেরা দান।"
পরিশেষে মহান একুশের সেই চিরচেনা সঙ্গীত দিয়েই শেষ করতে চাই--
"আমার ভাইয়ের রক্তে রাঙানো
একুশে ফেব্রুয়ারি
আমি কি ভুলিতে পারি।
ছেলেহারা শত মায়ের অশ্রু
গড়া এ ফেব্রুয়ারি
আমি কি ভুলিতে পারি।
আমার সোনার দেশের রক্তে
রাঙানো ফেব্রুয়ারি
আমি কি ভুলিতে পারি।"
আ---আ---আ---আ---আ---আ।।
বিষয়: বিবিধ
১২০৬ বার পঠিত, ০ টি মন্তব্য
পাঠকের মন্তব্য:
মন্তব্য করতে লগইন করুন