স্মৃতির দর্পণে, ঐতিহাসিক কালো রাত।
লিখেছেন লিখেছেন Ruman ০৫ মে, ২০১৮, ০৬:১৫:৪৫ সন্ধ্যা
যখনই এই বিষয়টি নিয়ে লিখতে বসি, তখনই নিজের অজান্তে চোখে পানি জমা হয়ে যায়। নিজেকে খুব ছোট মনে হয়। কবে হবে এই ফরিয়াদের মাকবুলিয়াত! কবে শাপলার শহীদের প্রকাশ্যে বিচার হবে বাংলার মাটিতে। এই দিনটির অপেক্ষায় অপেক্ষমান..!
মাগরিব নামাজের পর, সকলেই ক্লান্ত শ্রান্ত। মঞ্চে বক্তব্য হচ্ছিলো আর মাইকের লাইন একে একে অফ করে দিচ্ছিলো। মঞ্চের সামনে ছাড়া দূরে কোনো আওয়াজ যাচ্ছিলোনা। শাপলা চত্বরের চারিদিকে হাজার হাজার পুলিশ ঘেরাও করে রাখে, একের পর এক গুলি ছুরছিলো আর সামনের দিকে এগুনোর চেষ্টা করছিলো।
বাট তাওহীদি জনতা যে যেভাবে পেরেছে শিশাঢালা প্রাচীরের ন্যায় প্রতিরোধ গড়ে তুলেছিলো। আর মঞ্চে একের পর এক লাশ আসছিলো। আওয়ামী পুলিশ একটু পর পর হামলে পরছিলো, তখন হামলাটা মূলত বেশি রুপ নিচ্ছিলো দৈনিক বাংলা মোর থেকে।
আস্তে আস্তে রাত গভীর হচ্ছিলো, মঞ্চে জিকির চলছিলো। হঠাৎ হঠাৎ সংবাদ আসছিলো পুলিশ নটরডেম কলেজের মোর দিয়ে হামলা করছে। তখন মাইকে ঘোষণা করা হচ্ছিলো আপনারা ঘাবড়াইবেননা, এখন অমুক শায়েখের নেতৃত্বে প্রতিরোধের জন্য যাবে আপনারা ও শরীক হোন।মানুষ ও একসাথে গিয়ে প্রতিরোধ সৃষ্টি করছিলো।
এভাবে বিভিন্ন পয়েন্টে কয়েকবার বড় বড় উলামায়ে কেরামের নেতৃত্বে প্রতিরোধ গড়ে তোলা হয়। যদি ও সবসময় হাজার হাজার প্রতিরোধকারি প্রতিটি পয়েন্টে জানপ্রান দিয়ে চেষ্টা চালিয়ে যাচ্ছিলো যেহেতু পুলিশ বিশাল বাহিনী নিয়ে বড় বড় হামলার জন্যা প্রস্তুত হচ্ছিলো।
শরীরটা খুব ক্লান্ত লাগছিলো তাই একটু রেস্ট এবং নামাজের জন্য অজু ইস্তেঞ্জা করতে চলে গেলাম, শাপলা চত্বরের খুব কাছেই দারুল উলুম মতিঝিল মাদরাসা। ঐখানে পৌঁছে অজু ইস্তেঞ্জা করে ইশার নামাজ আদায় করলাম। তারপরে ঐখানে ও দেখতে পেলাম দুটি লাশ এসেছে, একটি দেখতে যুবক অন্যজনের বয়স হয়তো ৪০/৪৫ হবে।
আহ..!কিভাবে ব্যাক্ত করবো সেই করুন ইতিহাস!!
দোকান থেকে হালকা নাস্তা করে আবারো চলে আসলাম মঞ্চের কাছে, তখন রাত হয়তো ১টা বাজে। মঞ্চে বয়ান করছিলেন মাওলানা যুবায়ের আহমাদ আনছারি সাহেব। স্রোতারা প্রায় ঝিমু ঝিমু ভাব হটাত হটাত জোরে নারায়ে তাকবীরের আওয়াজে প্রকম্পিত করা হতো যেনো না ঘুমায় এবং স্পটগুলোতে প্রতিরোধ গড়ে তোলা হয়।
পাঠকের সুবিধার্তে আমি স্পটগুলো এই জন্যই উল্লেখ করতে চাচ্ছি যা আমার আক্রমনের সময় বর্ণনা করতে প্রয়োজন হবে। সন্ধের আগে স্পট অনেকগুলোই ছিলো, রাতে এসে এটি তিনটি স্পটে ভাগ হয়ে যায়। (১)নাম্বার স্পট ছিলো 'দৈনিক বাংলা মোড়' (২) নাম্বার স্পট ছিলো 'নটরডেম কলেজের ' পর দেওয়ানবাগ শরীফের আগের মোড়টি। (৩) নাম্বার ছিলো ইত্তিফাক মোড়।
রাত তখন হয়তো ২টা বাজে এতোটাই ক্লান্ত লাগছিলো নিজের অজান্তেই জায়নামাজের উপর সাময়িকের জন্য ঘুমিয়ে পরলুম। বার বার মঞ্চ থেকে ঘোষণা করা হচ্ছিলো আপনারা উঠোন। আর আল্লাহু আকবর ধ্বনিতে প্রকম্পিত করা হচ্ছিলো পুরো মতিঝিল এলাকা। মনে হচ্ছিলো শকুনের দল বুঝি এখনই হামলে পরবে।
আমার এই একটি জিনিস বদ্ধমূল হচ্ছিলো, এতো লক্ষ মানুষ এখানে একসাথে একত্রিত হয়েছে, এখানে মনে হয়না ঐভাবে কাপুরুষোচিত হামলা হবে। চারদিকে ঘুট ঘুটে না হলে ও কিছুটা অন্ধকার ছিলো। যেহেতু মঞ্চের নিকটে অল্প কিছু বিকল্প লাইট ব্যাতিত সব অফ ছিলো।
রাত তখন ৩.৩০ হয়তোবা, যেহেতু মোবাইলের চার্জ শেষ হয়ে গিয়েছিলো তাই টাইম দেখার ও কোনো উপায় ছিলোনা। মঞ্চে জিকির হচ্ছিলো আর স্রোতারা মোটামুটি ৬৫%ঘুমোচ্ছিলো, আর বাকিরা তন্দ্রা তন্দ্রা ভাব, ঠিক এমন মূহুর্তেই বিকট আওয়াজে গুলাবর্ষন শুরু হলো। দেখতে পেলাম নটরডেমের ঐ দিক থেকে গরম পানি মারছিলো পানির স্পিড এতোটাই বেশিছিলো যা বর্ণনাতীত।
কিন্তু এতে তারা সফল হতে না পেরে বোমা বিস্ফোরণ শুরু করলো। প্রথমেই একটি বোমা নিক্ষেপ করলো তাও মঞ্চে, সাথে সাথে মাইকের সাউন্ড অফ হয়ে গেলো। মাইকের সাউন্ড অফ হওয়াতে আর মঞ্চ ভেঙ্গেচুরে যাওয়াতে দৌড়াদৌড়ি শুরু হয়ে গেলো। আর নটরডেম কলেজের গলি থেকে গুলি করতে করতে পুলিশ মঞ্চের খুব কাছাকাছি চলে আসলো।
এবার মানুষ জীবন বাঁচাতে যে যেভাবে পারে পাগলের মত দৌড়া শুরু করলো, আর তার ভয়াবহতা এতোটাই ছিলো যে আমার নিজের কাছে মনে হচ্ছিলো আমি পায়ের তলে পিষ্ট হয়েই মারা যাবো। আল্লাহ জানে কতোজন পায়ে পিষ্ট হয়েই মারা যায়..!
কি পরিমান গুলাবারুদ ব্যবহার করা হয়েছিলো তা আল্লাহই ভালো জানে। তখন গুলাবারুদের আওয়াজে মনে হচ্ছিলো আমি বুঝি বয়রা হয়ে যাবো। দেয়ালের উপর থেকে পিছনে ফিরে কিছুটা অবলোকন করার চেষ্টা করলাম, যা দেখলাম আল্লাহু আকবার তা বলার মতো নয়।
আমার মাথাও ঘোরা শুরু করলো, মানুষ এতোটা পাষন্ড কিভাবে হতে পারে?? বুকে বন্দুকের নল ঠেকিয়ে এভাবে জঘন্য কায়দা মানুষ হত্যার নির্লজ্য পৈশাচিক উল্লাস পৃথিবী এর পূর্বে দেখেছে কিনা আল্লাহই ভালো জানে! সিনেমার অভিনয় যেটাকে হার মানায় এর চেয়ে জঘন্য পাশবিক কায়দায় মানব হত্যার উল্লাসে মেতে উঠে আওয়ামী গুন্ডাবাহি
তিনটি স্পটের মধ্য থেকে, দৈনিক বাংলার মোড় আর নটরডেমের দুপাশ থেকে যৌথবাহিনী নামের জানোয়াররা হামলা শুরু করলো। আর ইনকিলাবের মোড়টিকে খালি রাখা হলো মানুষ যাওয়ার জন্য। এখন কেহতো জানেনা কোন স্পটটিতে পুলিশ নেই, তাই অনেকে দৈনিক বাংলার মোড়ের দিকে যাওয়া শুরু করেছে, যারাই এই স্পটটির দিকে গিয়েছে তারাই সবচেয়ে বেশি আক্রমণের সম্মুখিন হয়েছে।
ঘটনাক্রমে আমি ও ছিলাম ঐ দলের অন্তর্ভূক্ত বাট আমি দৈনিক বাংলাতে না গিয়ে এর আগেই দেয়াল টপকিয়ে ঐপাশে যাই ঐখানে যাওয়ার পর গ্যারেজে অনেকগুলো বাস দেখতে পাই তখন মানুষগুলোকে দেখতে ছিলাম বাসের ভিতরে লোকানোর চেষ্টা করছিলো।
আমি ডিসেশন নিলাম যে মরি বা বাঁচি সবার সাথেই মরবো সবার সাথেই বাঁচবো। তাই ঐখান থেকে প্রস্থান করে দেয়াল টপকিয়ে বঙ্গভবনের পাশে গিয়ে বের হলাম।বশির মিলনায়তনের সামনে দিয়ে একটি রাস্তা খুলা ছিলো ঐ রাস্তা দিয়ে সকলের সাথে বের হলাম।
দেখলাম সবাই যাচ্ছে যাত্রাবাড়ীর দিকে, আর আমাকে যেতে হবে ফরিদাবাদ। এতো রাতে একা একা যাবো পথিমধ্যে আর তিনজন বলল 'আমরা গ্রাম থেকে ঢাকা শহরে আসছি কিছু চিনিনা' আমি বললাম চলেন ফরিদাবাদ যাই। তাদেরকে নিয়ে যাওয়ার পথে ইংলিশ রোডের মোড়ে আসার পর এক পুলিশের গাড়ি আমাদেরকে থামালো জিজ্ঞেস করলো কোথায় যাবেন??
আমি বললাম ফরিদাবাদ। উনি বললেন, এই রাস্তা দিয়ে যদি আপনারা যান তাহলে জগন্নাথ বিশ্ববিদ্যালয়ের ছাত্রলীগ এর কর্মীরা উতপেতে আছে, যেকোনো বড় ধরনের হামলা আপনাদের উপর করতে পারে অতএব অন্য রাস্তা দিয়ে যান। তারপরে জিন্দাবাজার মাসজিদের গলি দিয়ে ইসলামপুর হয়ে সদরঘাট দিয়ে নদীর কুল ঘেঁষে চলে গেলাম প্রিয় মাদরাসায়..!
তারপরে কী হয়েছে! মাদরাসার অবস্থা আর নিজের ও পরিবারের অবস্থা তা নিয়ে লিখবো শেষ লেখাটি ইনশাআল্লাহ।
লিখা অনেক বড় হয়ে গিয়েছে তাই এখানে শেষ করতে একধরনের বাধ্য হচ্ছি বাট হাজারো কথা এখনো জমাট বেঁধে রয়েছে এই হ্রদয়ে। এ ব্যথা শেষ হবার নয়।
বিষয়: বিবিধ
৭৮০ বার পঠিত, ০ টি মন্তব্য
পাঠকের মন্তব্য:
মন্তব্য করতে লগইন করুন