শিশুস্বার্থ রক্ষায় রসুলুল্লাহ (সা.)
লিখেছেন লিখেছেন Ruman ২৭ এপ্রিল, ২০১৭, ০৬:৪১:১৭ সকাল
জুলুম-নির্যাতন মানব সভ্যতার আদিম বিষফোঁড়া হলেও প্রাক-ইসলাম যুগে এর প্রাদুর্ভাব ছিল নজির বিহীন। হেন অত্যাচার নেই যে সে যুগে হয়নি। সাধারণত দুর্বল মানুষ সবলের হাতে নির্যাতিত হয়। কিন্তু প্রতিরোধের কোনো ক্ষমতা বা এর বোধশক্তিই যার নেই সেই নবজাতক শিশুর ওপরও তখন নির্যাতনের খড়্গ নেমে এসেছিল। আর সেই খড়্গধারী মৃত্যুদূত অন্য কেউ ছিল না। স্বয়ং পিতাই নিজ ঔরসজাত শিশুকে হত্যা করত। দারিদ্র্যের শঙ্কা বা সমাজের চাপের মুখে পিতা নিজ কন্যাশিশুকে সাজিয়ে-গুছিয়ে নিয়ে যেত মরুপ্রান্তরে। গর্ত খুঁড়ে বলত, ‘দেখ তো মা গর্তটা কেমন হলো’। শিশু সেদিকে ঝুঁকতেই ধাক্কা দিয়ে ফেলে দিয়ে মাটি দেওয়া শুরু করত। শিশুকন্যার আকুতি বা চোখের জল পাষাণ বাবার হৃদয়ে এতটুকু মমতার উদ্রেক ঘটাতে পারত না। তাই কন্যাকে বেড়াতে নিয়ে যাওয়ার কথা বললে মায়েদের কলিজার পানি একেবারে শুকিয়ে যেত।
রসুলুল্লাহ (সা.) ঘুণেধরা ফোকলা একটি জাতির আমূল সংশোধন করে সেটিকে পৃথিবীর একটি আদর্শ জাতিতে উন্নীত করতে সক্ষম হয়েছেন। একটি বর্বর সমাজের প্রতিটি ব্যাধি চিহ্নিত করে সেগুলোর মূলে প্রতিষেধক প্রয়োগ করে ধীরে ধীরে সমাজের অবক্ষয় ও নীতি-নৈতিকতার ধস রোধ করেছেন। শিশু নির্যাতনের বেলায়ও এর ব্যত্যয় ঘটেনি। জাহিলি যুগে অন্যান্য অপরাধের পাশাপাশি শিশু নির্যাতনও ব্যাপকতা পেয়েছিল। কেবল কোরাইশ ছাড়া সব গোত্রের প্রায় প্রতিটি পরিবারেই ব্যাধিটি সংক্রামিত হয়েছিল। (আততাহরির ওয়াত তানভির : ৩০/১৪৬)। শিশু নির্যাতন প্রতিরোধ এবং শিশুস্বার্থ রক্ষায় রসুল (সা.)-এর আদর্শ বিশ্লেষণ করলে আমরা দেখতে পাই, জঘন্য এই অপরাধটি নির্মূল করার লক্ষ্যে তিনি আইনানুগ কঠোর শাস্তির ব্যবস্থার সঙ্গে সঙ্গে নানামুখী সামাজিক সচেতনতামূলক পদক্ষেপ গ্রহণ করেছিলেন।
শিশু নির্যাতন রোধে রসুলুল্লাহ (সা.) আইনি ব্যবস্থা গ্রহণের পাশাপাশি গড়ে তুলেছেন সামাজিক সচেতনতা। এজন্য গ্রহণ করেছেন নানামুখী কর্যকর পদক্ষেপ। বর্তমান সমাজে বাসার কাজের ছেলে বা মেয়ে নির্যাতনের ঘটনা অংখ্য। অথচ ঘরে কাজ করা শিশুসেবকদের ক্ষেত্রে রসুলুল্লাহ (সা.)-এর আদর্শ দেখুন। তিনি এ-জাতীয় শিশু নয়, বরং শিশু ক্রীতদাসকেও সন্তানের মর্যাদায় উন্নীত করে আমাদের জন্য অনুপম আদর্শ স্থাপন করে গেছেন।
হজরত জায়েদ ইবনে হারেসা (রা.) ছোটবেলায় মায়ের সঙ্গে বেড়াতে গিয়ে অপহূত হন। দস্যুরা তাকে নিয়ে গিয়ে বিক্রি করে দেয়। হাতবদল হয়ে তিনি ওঠেন পবিত্র মক্কার উকাজ মেলায়। হজরত হাকিম ইবনে হিজাম (রা.) তাকে নিজ ফুফু হজরত খাদিজা (রা.)-এর জন্য খরিদ করে নিয়ে যান। নবীজির সঙ্গে বিয়ের পর খাদিজা জায়েদ (রা.)-কে নবীজির খেদমতে নিয়োজিত করেন। পরে হজরত জায়েদ (রা.)-এর পিতা তার খোঁজে মক্কায় এসে তার সন্ধান পান। তিনি নবীজি (সা.)-এর কাছে মুক্তিপণের বিনিময়ে নিজ সন্তানকে ফেরত চাইলে তিনি বলেন, ইচ্ছা করলে সে আমার সঙ্গে থাকতে পারে, চাইলে আপনাদের সঙ্গেও যেতে পারে। বিনিময়ে আমাকে কিছুই দিতে হবে না। এ কথার পর হজরত জায়েদ (রা.) নবীজি (সা.)-এর সঙ্গেই থেকে যাওয়ার সিদ্ধান্ত নেন। তার বাবা ক্ষুব্ধ হলে তিনি জবাবে বলেন, আমি এই মানুষটির কাছ থেকে এমন আচরণ পেয়েছি যে, তাকে ভিন্ন অন্য কাউকে নির্বাচন করা আমার পক্ষে সম্ভব নয়। এ কথা শুনে নবীজি (সা.) বললেন, তোমরা সাক্ষী থেকো। জায়েদ আমার পুত্র। রসুলুল্লাহ (সা.)-এর এই মহানুভবতায় তার বাবা খুশিমনে ফিরে যান। ইসলাম আবির্ভাবের পূর্ব পর্যন্ত মক্কা নগরীর মানুষ হজরত জায়েদ (রা.)-কে ‘মুহাম্মদ-তনয়’ বলেই ডাকত। (আল ইসাবাহ : ৪/৩৭)।
অন্য পরিবারের শিশুদের প্রতিও রসুলুল্লাহ (সা.)-এর আচরণ ছিল অত্যন্ত কোমল। একজন নবী হিসেবে ধর্মীয় কোনো ব্যাপারে ব্যঙ্গ-বিদ্রূপ তার সহ্য না হওয়াই স্বাভাবিক। কিন্তু ভিন্ন ধর্মের শিশুদের বেলায়ও তিনি তা সহ্য করেছেন এবং সুকৌশলে সংশ্লিষ্ট বালকের সংশোধন করেছেন। একবার কিছু মুশরিক বালক আজান শুনে অনেকটা ব্যঙ্গ করেই শব্দগুলো আওড়াতে লাগল। নবী (সা.) তাদের একজনকে ডেকে এমন আচরণ করলেন যে সে শুধু ইসলাম গ্রহণই করেনি, বরং সময়ে ‘রসুলের মুয়াজ্জিন’ উপাধিতে ভূষিত হয়েছে। (সিয়ারু আলামিন নুবালা: ৩/১১৭)। একবার এক দুস্থ বালিকা গোত্রীয় লোকদের হাতে নিগ্রহের শিকার হয়ে নবী (সা.)-এর কাছে এলে তিনি মসজিদে নববির আঙিনায় তার বাসস্থানের ব্যবস্থা করেন। (ফতহুল কারি : ২/২৮১)। তিনি আনসার সাহাবি সাক্ষাৎকালে তাদের শিশুদের সালাম দিতেন। তাদের মাথায় হাত বুলিয়ে দিতেন। (মুসলিম : হাদিস ৪২৯৭)।
আদব-শিষ্টাচার শিক্ষা দেওয়ার ব্যাপারেও রয়েছে রসুলুল্লাহ (সা.)-এর অনুপম আদর্শ। গবেষণায় দেখা যায়, শিশুদের আদব-শিষ্টাচার ও শাসনের ব্যাপারে রসুলুল্লাহ (সা.) ১৮টি ধারা অবলম্বন করেছেন। তাতে শিশুকে প্রহারের কোনো প্রমাণ পাওয়া যায় না। (তাআমুল আররাসুল মাআ আলআতফাল : ১৮৪)। রসুলুল্লাহ (সা.) নিজের বা অন্য পরিবারের কোনো শিশুকে জীবনে কোনো দিন প্রহার করেননি। সবাইকে মমতা দিয়েছেন।
এমনকি নামজের মধ্যেও শিশুরা তাঁর মমতা লাভে ধন্য হয়েছে। পৌত্রী উমামা (রা.)-কে কাঁধে নিয়ে নামাজ আদায় করেছেন। (বুখারি : ৫৯৯৬)। শৈশবে হজরত হাসান (রা.) তাঁর কাঁধে চড়েছেন। (বুখারি : ৩৭৪৯)। তাকে চুমু খেতে দেখে এক ব্যক্তি বলেছিল, আমার দশটি সন্তান। তাদের কাউকে আমি চুম্বন করি না। রসুলুল্লাহ (সা.) এর জবাব, যে মানুষ স্নেহ করে না সে অনুগ্রহ থেকে বঞ্চিত। (বুখারি : ৫৯৯৭)। রসুলুল্লাহ (সা.) দেড় হাজার বছর আগে নিজের অনুপম আদর্শ, কর্মপদ্ধতির আলোকে আগত বিশ্বের জন্য একটি শিশুবান্ধব পৃথিবীর রূপরেখা রেখে গেছেন।
শিশুস্বার্থ রক্ষায় সামাজিক সচেতনতা বৃদ্ধির গুরুত্ব অনস্বীকার্য। চলমান সময়েও বিশেষজ্ঞ মহল বিষয়টি উপলব্ধি করে। এ ক্ষেত্রে সামাজিক দায়িত্বটাই মূল। প্রথমত দায়িত্ব পরিবারের। তাদের শিশুকে যথাযথভাবে লালন-পালন করতে হবে।
নিজেকে একজন মুসলিম হিসেবে পরিচয় দিতে হলে শিশুদের প্রতি স্নেহসুলভ আচরণ ও তাদের স্বার্থ রক্ষা করা আমাদের জন্য অপরিহার্য বৈকি। ছোটকে স্নেহ না করে প্রকৃত মুমিন-মুসলমান দাবি করার অবকাশ নেই। কারণ, প্রিয় নবী মুহাম্মদ (সা.) ছোটদের স্নেহ না করে প্রকৃত মুসলমান হওয়ার অবকাশ রেখে যাননি। তিনি ইরশাদ করেন : ‘যে ছোটদের স্নেহ করে না, সে আমাদের নয়। ’ (সুনানে আবু দাউদ : ৪৯৪৩)। সর্বোপরি একজন আদর্শ মানুষ হতে হলে এবং আগামী প্রজন্মকে একটি সুন্দর পৃথিবী উপহার দিতে হলে শিশুস্বার্থ রক্ষার বিকল্প নেই।
বিষয়: বিবিধ
৭৩৪ বার পঠিত, ০ টি মন্তব্য
পাঠকের মন্তব্য:
মন্তব্য করতে লগইন করুন