ভালোবাসার কষাঘাত, তবুও ভালোবাসা...

লিখেছেন লিখেছেন যথাযথ ১৫ নভেম্বর, ২০১৬, ০৭:২০:৪৫ সন্ধ্যা

অনন্য ছুটেছে শিকারী বাঘের মতো আর তার সামনে দূরে বহু দূরে অনেক দূরত্বে ছু্টেছে নীলা ভীত-বিহবল হরিণীর মতো। যখন থেকে ওদের মধ্যে প্রেমের বন্ধন সৃষ্টি হয়েছে, অনন্য সবসময় নীলার আঁচলে আঁচলে লেগে থাকতেই স্বাচ্ছন্দ্যবোধ করেছে। একজন আরেকজন থেকে একটু দূরে গেলেই, একটু চোখের আড়াল হলেই অনন্যের বুক খচ্‌ খচ্‌ করে। কিন্তু বাস্তব জীবনের প্রয়োজন আর প্রাত্যহিক দিনচলা তো মানুষকে সারাদিন সারাক্ষন একসাথে থাকতে দেয়না। অনন্যকে যেমন মাঝেমধ্যে দূরে যেতে হয়, নীলাও তার প্রেমময় জীবনসঙ্গীর মায়া কাটিয়ে প্রয়োজনের তাগিদে দূরে যায়, যেতে হয়। এমন ক্ষনিকের দূরে যাওয়া ক্ষনিকের জন্য দুজনের বুকে বিরহের অস্বস্তিকর গরম বাতাস ছুয়ে গেলেও বরং এ দূরত্বই তাদেরকে পরক্ষনে আরও বেশী কাছে টানে, আরও বেশী তাদেরকে গভীর ভালোবাসার বন্ধনে আবদ্ধ করে। কিন্তু নীলা যে দূরে গেলো তা এখনও ফিরছে না কেনো? ও কি ভুলেই গেলো যে অনন্য ওর জন্য পেছনে প্রতীক্ষায় ছট্‌ফট্‌ করছে। ও তো ভালো করেই জানে, যে মানুষটা সারাক্ষন ওর আঁচলে লেগে থাকে সে এতোক্ষনে ওর অনুপস্থিতিতে আত্মারাম খাঁচাছাড়া হয়ে যাবে! তার পরও কেনো নীলার এতোক্ষন দূরে থাকা, কেনো এই নিষ্ঠুরতা? নীলাকে কাছে পাওয়ার এক অদম্য বাসনায় অনন্যের বুক ভেঙ্গে যাচ্ছে। তাই অনন্যের এই ছুট্‌, টর্পেডোর বেগে তার জীবনসঙ্গিনীর দূরে চলে যাওয়া পথে। অনন্য যেনো এরই মাঝে দৌড়ে শত শত মাইল অতিক্রম করেছে। এখন সে এক অজানা অচেনা জনপদে বিশাল এক জনমানবহীন মাঠের মাঝে তৃষ্ণার্ত পথিকের মতো ছুট্‌ছে দেহের সবশক্তি ব্যয় করে। তার এ তৃষ্ণা পানির জন্য নয়, নীলাকে কাছে পাওয়ার জন্য। প্রচন্ডবেগে দৌড়াতে দৌড়াতে দিগন্তসীমা পর্যন্ত যতোদূর দৃষ্টি যায় অনন্য তার প্রেয়সীকে খুঁজছে।

ঐ যে দূরে বহুদূরে নীলাকে দেখা যাচ্ছে, যেনো এক আলোকবর্তিকা হয়ে সেও ছুটছে সামনের দিকে অনন্যকে ঠিক পেছনে ফেলে। “নীলা......, এই যে আমি তোমার অনন্য এখানে, তুমি পিছে তাকাও, পিছে ফিরে এসো, আমি আর দৌড়াতে পারছিনা, তুমি থামো আমি এখনই তোমার কাছে পৌঁছে যাবো” – ছুটন্ত অনন্যের গলা ফেটে বেরিয়ে এলো। এ কী, নীলা কেনো আরও দ্রুতবেগে তার থেকে দূরে সরে যাচ্ছে, কেনো তার কথা শুনে থাম্‌ছে না, পিছে ফিরছে না! অনন্য আরও পথচলার গতি আর গলার স্বর বাড়িয়ে নীলাকে ডাকতে ডাকতে সামনে চলতে থাকে। নীলাকে যেনো এক আলোকিত পরী মনে হচ্ছে। পরী হয়ে সে যেনো ডানা মেলে উড়াল দিচ্ছে। এমন পরী হয়ে ডানা মেলে উড়াল দিয়ে অনন্যের কাছে এসে হঠাৎ তার মাথায় বসলে হয়তো অনন্য এক স্বর্গীয় সুখ অনুভব করতো, তাদের দীর্ঘদিনের প্রেমের ভুবনে এ হতো এক রোমাঞ্চকর অনুভূতির সময়। কিন্তু না, নীলা সামনেই ছুটে চলেছে, অনন্যের কণ্ঠস্বর ও পদধ্বনি তার গতিবেগকে আরো বাড়িয়ে দিচ্ছে দূর দিগন্তের অভিযানে। আহ্‌হা, নীলা কেনো অনন্যের আকাশ-বাতাস বিদীর্ণকারী আর্তচীৎকার শুনেও না শোনার ভান করছে??? ওটা কি দূরে বহুদূরে, নীলার সামনে? নীলা তো ওদিকেই ছুটে চলেছে। আহ্‌হা, ওটাতো একটা ছায়ামূর্তি, ওদিকে কেনো নীলা ছুটেছে? “নীলা......, এই যে আমি, তোমার অনন্য, তোমার পেছনে; তুমি আমাকে ছেড়ে ওই ছায়ামুর্তির দিকে আর অগ্রসর হয়োনা”। কিন্তু কে শোনে কার কথা! চোখের সামনেই একপলকে অনন্যের নীলা আজ আলোকবর্তিকার রূপ নিয়ে পরীর মতো ছুটে গিয়ে একাকার হয়ে গেলো ছায়ামূর্তির সাথে। তারপর অনন্যের কানে ভেসে এলো ছায়ামূর্তির নিবেদনে নীলার মধুময় কণ্ঠের ঝংকৃত গানঃ

“আমরা এমন দৃঢ়ভাবে আঁটসেঁটে থাকবো যেনো

আমরা নিখুঁতভাবে একাকার হয়ে যাওয়া লিপিকলার দু’টি সরু রেখা।

আমরা হয়তো ভূপৃষ্ঠে, পানিতে কিংবা পাথুরে পাহাড়ে নীড় বানাবোনা।

আমরা বরং হৃদয়ের বিশুদ্ধতা ও ভালোবাসার কোমলতা দিয়ে রচনা করবো জ্ঞান,

নির্ভেজাল সংকল্প, ধৈর্য, আলাপ-বিভোরতা আর সহমর্মিতাপূর্ণ এক জগত।

আমরা হয়তো কোথাও উড়াল দিয়ে দ্রুত আলো হয়ে

মোমবাতির মতো জ্বলে উঠবো।

অবিচ্ছিন্নভাবে একসূত্রে গ্রথিত হয়ে তুমি আমার হৃদয়ে দিবে প্রশান্তি

রোমাঞ্চকর আবরনে আমি আচ্ছাদিত করবো তোমাকে, তুমি আমাকে।

আমার বিশ্বস্ত অনুভূতি নিষ্কপটভাবে বলছে যে

নিয়তি আমাদের মাঝে প্রীতি-ভালোবাসা ও করুণার প্রাসাদ গড়েছেন।

স্তুতি সেই মহান স্রষ্টার যিনি তোমাকে সৃষ্টি করেছেন

কারণ তুমি আমার কাছে সকল সৌন্দর্যের প্রতীক।

আমরা এমন দৃঢ়ভাবে আঁটসেঁটে থাকবো যেনো

আমরা নিখুঁতভাবে একাকার হয়ে যাওয়া লিপিকলার দু’টি সরু রেখা।

যা আমাদের পরস্পরকে আকৃষ্ট করেছে, একীভূত করেছে

তার সাথে বিধির বিধানের কোনো মিল নেই।

অবিসংবাদিত সত্য হলো, আমার হৃদয়ের তালা খোলার চাবি একমাত্র তুমিই।


হে প্রীতির রাজাধিরাজ

সবেগে ছুটন্ত আকাশের সর্বোৎকৃষ্ট উল্কাপিন্ডের মতোই

আমি সজোরে নিক্ষিপ্ত হয়েছি তোমার গভীর ভালোবাসার ভজনালয়ে।

আর আমি জানি আমার একাকিত্বের যাতনা তুমি বুঝতে পারো

আমি জানি তুমি আমার হৃদয়ের তলদেশে প্রবেশ করতে পারো।

আমি তালাশ করে ফিরেছি তোমার মৃদুহাসির ঝলক থেকে একটু সান্ত্বনার।

আহা তোমার মৃদুহাস্য চাঁদ বদন আর নক্ষত্রতুল্য চোখের চেয়ে

এ বসুধায় আমার কাছে আর কোনো মোহাচ্ছন্নতা নেই।

ত্বরা এসো আমার পিছে পিছে,

চাঁদোয়া রাতের আলো নিরুপমভাবে প্রস্ফুটিত করেছে

আমার জন্য তোমার হৃদয়ের স্পন্দনকে।

আর এটাই আমার সার্বক্ষনিক মগ্নতা যা চিত্রিত হয়েছে আমার আচরনে,

প্রকাশিত হয়েছে সর্বদা আমার কথায়-

আমরা একদিন সব বাঁধা মাড়িয়ে দাঁড়াবো একে অপরের মুখোমুখি।

সেই প্রতীক্ষিত মূহুর্তে আমি তোমাকে সম্মোহনের চাদর দিয়ে আচ্ছাদিত করবো।

কেবলই শর্ত তুমি আমাকে তোমার দৃশ্যপটে ঝাঁপিয়ে পড়ে অবগাহন করতে দিবে,

তুমি আমাকে দিবে আমাদেরই স্মৃতির অতীত সমূদ্রে পাল তুলে বিচরন করতে।

আমার অযাচিত স্বকীয় বৈশিষ্ট্যের মূল্য যদি আমাকে না দিতে হয়

তাহোলে আমি উৎসর্গ করে দিবো আমার জীবন, শুধু তোমারই জন্য।

যা আমাদের পরস্পরকে আকৃষ্ট করেছে, একীভূত করেছে

তার সাথে বিধির বিধানের কোনো মিল নেই।

অবিসংবাদিত সত্য হলো, আমার হৃদয়ের তালা খোলার চাবি একমাত্র তুমিই।

আমাদের এ ভালোবাসায় আছে অবশ্যম্ভাবী প্রজ্ঞার ছাঁপ।

তোমার জন্য আমার প্রতিটা পয়সা খরচ জগতে সব সুখকর খরচের চেয়েও সুখকর।

দেখো, ধৈর্যই হচ্ছে বহমান সুখ ও তৃপ্তির সর্বোৎকৃষ্ট চাবি।

তুমি এতোই সুন্দর, মুক্তাও হতে চায় তোমার মতো।

যতোক্ষন আমরা দ্রাক্ষালতার মতো বিজড়িত, অপেক্ষায় থাকবো আমি।

তুমিই আমার শান্তি তুমিই আমার গর্ব।

এটাকে তুমি প্রেমের কবিতা মনে করোনা

এটাই হলো হৃদয়ের একান্ত সহজ সরল অভিব্যক্তি।

জানি আমার প্রতিটা পদক্ষেপে তোমার সাহায্যের উপর আমি ভরসা রাখতে পারি।

ভালোবাসা শুধু হঠাৎ প্রজাপতির উড়াল কিংবা যৌনতার শিহরনের মতো সীমিত নয়।

ভালোবাসা হলো একে অপরের ধিশক্তির স্বীকৃতি ও সম্মান দেখানো।

অনেক অনুশোচনা, অনেক কিছুই আমাদের বলা বা করা ঠিক হয়নি,

কিন্তু এসবকিছুই জীবন চলার পথে সঙ্গী আর জীবন তো কেবলই শুরু।

সৌন্দর্যের অনুরাগী হও, কারন চোখের দর্শনীয় সজীবতা একদিন ম্রিয়মান হয়ে যাবে

কিন্তু একটা সুন্দর হৃদয় বার্ধক্যেও চিরতরুন রয়ে যাবে।

যা আমাদের পরস্পরকে আকৃষ্ট করেছে, একীভূত করেছে

তার সাথে বিধির বিধানের কোনো মিল নেই।

অবিসংবাদিত সত্য হলো, আমার হৃদয়ের তালা খোলার চাবি একমাত্র তুমিই।“

অনন্য ও নীলার ভালোবাসা এতোই গভীর, এতোই মধুর, এতোই অনুপম যে এমন কবিতা বা গান কিংবা সহজ সরল ভাষায় একে অপরের প্রতি ভাবের অভিব্যক্তি অস্বাভাবিক না। কিন্তু এই মূহুর্তে নীলার মুখ থেকে বেরিয়ে আসা এমন অতুলনীয় প্রেমানুভূতির অভিব্যক্তি অনন্যকে এতো পীড়া দিবে কেনো? অমৃত সুধাময় এসব কথাগুলো শোনার পর অনন্য তো আনন্দে, ভাবাবেগে আত্মহারা হবে, দুনিয়াতে স্বর্গীয় সুখ অনুভব করবে। কিন্তু না, তার সারা শরীর ঘেমে গেছে। বুকে অসহ ব্যথা। সারা দুনিয়ার সব পাহাড় বুকের উপরে চাপালেও এমন কষ্ট হয়না। যখনই এসব সুগভীর ভালোবাসার সুধাবাক্যগুলো অথবা কোনো একটা বিশেষ বাক্য তার মনে অনুরনিত হচ্ছে, তার সারা শরীরে একধরনের যাতনার কষাঘাত অনুভূত হচ্ছে, বেদনার বিদ্যুৎ প্রবাহ ছড়িয়ে যাচ্ছে আপদ-মস্তকে। মাথা ভন্‌ভন্‌ করছে, সারা শরীর শিথিল নিস্তেজ হয়ে আসছে। এমন কঠিন কষ্টময় মূহূর্ত তার জীবনে আর কখনো আসেনি। মৃত্যুদূতের সাথে লড়াইয়ের মতোই কষ্ট। এতোক্ষন যাবত অনন্য মোহান্ধের মতো ছুটছিলো নীলার দিকে, নীলাকে পাওয়ার জন্য, নীলার কোমল স্পর্শের জন্য, নীলাকে চিরাচরিত ভালোবাসার আবেষ্টনীতে আটকানোর জন্য, স্বর্গীয় আলিঙ্গনে পরম প্রশান্তিতে অবগাহন করার জন্য। কিন্তু কেনো সেই চিরচেনা প্রেয়সী জীবনসঙ্গিনী আজ ছুটে গেলো উল্‌টো দিকে। কেনো অনন্যের প্রানপন দৌড়, নৈকট্যে আসার আপ্রাণ চেষ্টা, ভালোবাসার কাকূতি সবকিছু আজ উপেক্ষা করে নীলা ছুটে গিয়ে মিশে গেলো একটা ছায়ামূর্তির সাথে? নাহ্‌ এ কষ্ট সইবার না, সারা দুনিয়ার সব পাহাড়ের চাপ আজ একীভূত অনন্যের বুকের উপর। সে যেনো মারা যাচ্ছে, বুক ফাটিয়ে চীৎকার দিচ্ছে – “নীলা তুমি আরেকবার আমাকে দেখা দাও, ছায়ামূর্তির ভেতর থেকে বেরিয়ে তোমার আলোকির রূপ নিয়ে তোমার জীবনসঙ্গীকে আরেকবার অন্ততঃ দেখা দাও। আমাকে বাঁচাও, তুমি কাছে না এলে আমি বুকের ব্যাথায় মারা যাবো।“

গভীর রাতের ঘোর-কৃষ্ট অন্ধকারের বুক চিরে আকাশ বিদীর্ণকারী সর্বগ্রাসী এক অজানা আর্ত চীৎকারে নীলা হঠাৎ আৎকে ওঠে। তার ঘুম ভেঙ্গে যায়। বিছানায় একান্ত পাশেই শোয়া চিরভালোবাসার মানুষটাকে ঘুমের ভেতর কাতরাতে দেখে, ছটফট করতে দেখে। সে অনন্যের বুকে হাত রেখে বলে, “জানু, তোমার কি হয়েছে; কেনো এতো চীৎকার; এই, তুমি কাঁপছো কেনো; এই, তোমার চোখে পানি কেনো সোনা; আমার জানু, তোমার কি হয়েছে তুমি এতো ঘামছো কেনো???” নীলার অনর্গল শব্দে আর অস্থির আচরনে অনন্যের ঘুম ভেঙ্গে যায়। সে নির্বাক হাঁপাতে থাকে কিছুক্ষন। নীলাকে কিছু বলার আগেই তার মনে এক প্রশ্ন উঁকি দেয়, স্বপ্নের নীলা কী তার কাছে মরীচিকা হয়ে দেখা দিয়েছিলো না কী দীর্ঘদিনের ভালোবাসার জীবনে নীলা ছিলো এক মরীচিকার নাম? সে যা-ই হোক, এমন ব্যথা এমন কষ্ট সে জীবনে আর চায়না। নীলা এখন দানবীয় ছায়ামূর্তির ভেতরে নয়; সে এখন তারই পাশে; যে বুকে সারা দুনিয়ার পাহাড়ের চাপ এতোক্ষন অনুভব করছিলো সে বুকে এখন তার প্রিয়তমা নীলার মাথা। যে দুটি হাত পরীর ডানা বানিয়ে নীলা উড়ে গিয়েছিলো ছায়ামূর্তিটির দিকে সে কোমল হাতের বেষ্টনীতেই এখন অনন্য আবদ্ধ। সে নীলাকে ছাড়া বাঁচবেনা; নীলার আঁচলই তার পরম প্রশান্তির ঠিকানা; নীলাকে সে আর কখনোই দূরে যেতে দিবেনা। মনের অজান্তেই দুজন দুজনকে বুকে জড়িয়ে নির্বাক রাতের বাকী অংশটা কাটিয়ে দেয়।

বিষয়: সাহিত্য

৯১৪ বার পঠিত, ০ টি মন্তব্য


 

পাঠকের মন্তব্য:

মন্তব্য করতে লগইন করুন




Upload Image

Upload File