জনসাধারণের ওপর নজরদারী ও সন্ত্রাসদমনে এর কার্যকারীতা

লিখেছেন লিখেছেন শাহরিয়ার অর্ণ ২৮ অক্টোবর, ২০১৬, ০৮:৪৭:০৪ রাত

আমাদের সবার কাছেই সন্ত্রাস একটি আতঙ্কের বিষয়।বিশেষ করে সেটা যখন বিদেশের পরিবর্তে নিজ দেশেই সংঘটিত হয়ে থাকে। কোনো মানুষই নিরাপত্তাহীনতায় ভুগতে চায়না এবং সর্বোচ্চ চেষ্টা করে নিজের নিরাপত্তা নিশ্চিত করার।আর এজন্য তারা দারস্থ হয় রাষ্ট্রের কাছে।ফলস্বরুপ সাম্প্রতিক সময়ে রাষ্ট্র কর্তৃক নাগরিকদের গতিবিধি লক্ষ্য করার প্রবণতাও বৃদ্ধি পেয়েছে।আপনি ডানপন্থী বা বামপন্থী যেটাই হোন না কেন,এটা যে আমাদের দৈনন্দিন জীবনে নেতিবাচক প্রভাব ফেলছে তা অনস্বীকার্য।অথচ রাষ্ট্রের বক্তব্য অনুসারে এটা করা হচ্ছে নাগরিকদের নিরাপত্তার জন্যই! তাই আসুন সাম্প্রতিক তথ্য বিশ্লেষণ করে দেখা যাক,এটা কি আসলেই আমাদের নিরাপত্তা নিশ্চিত করেছে?'

~

৯/১১ এর ঘটনার পর যুক্তরাষ্ট্রের সরকার এই সিদ্ধান্তে উপনীত হয় যে, তাদের বিদ্যমান আইন আধুনিক প্রযুক্তির সাথে সামঞ্জস্যপূর্ণ নয়। তাই তারা তৈরী করলো Terrorist Surveillance Program যার মূল উদ্দেশ্য ছিলো আল কায়েদার সাথে সংশ্লিষ্ট যোগাযোগকে প্রতিহত করা। আমেরিকান সরকারের মতে এই ব্যবস্থা আগে প্রণয়ন করা হলে প্লেনের হাইজ্যাকারদের ঘটনার পূর্বেই আটক করা যেতো।কিন্তু পরবর্তীতে দেখা গেলো এ ব্যবস্থা যেই উদ্দেশ্যে প্রণয়ন করা হয়েছিলো বাস্তবে তা করা হচ্ছেনা।

~

এর পরিবর্তে এফবিআই যা করেছিলো তা হলো, রাষ্ট্রের ইমিগ্রেশন ডকুমেন্টস থেকে পাওয়া লিস্ট হতে যুক্তরাষ্ট্রে অবস্থানরত আরবদেশীয় নাগরিক ও মুসলিমদের খুঁজে বের করা। অত:পর এদের মধ্য হতে ৮০০০০ নাগরিকের নিবন্ধন করানো হয়,৮০০০ জনকে এফবিআই জিজ্ঞাসাবাদ করে এবং ৫০০০ জনকে গ্রেপ্তার করে জেলে পাঠানো হয়। অথচ এদের মধ্যে সন্ত্রাসীর সংখ্যা ছিলো ০ জন।

~

যুক্তরাষ্ট্রের গভর্নমেন্ট এজেন্সিগুলো কতোটা সহজে নাগরিকদের ব্যক্তিগত তথ্য সংগ্রহ করে সেটা সকলের দৃষ্টিগোচর হয় ২০১৩ সালে এডওয়ার্ড স্নোডেনের ফাঁস করা ডকুমেন্টস হতে। তারা জানতে পারে কিভাবে এনএসএ গুগল ও মাইক্রোসফটের মতো প্রতিষ্ঠানের কাছ থেকে তাদের ইউজারের ইমেইল হিস্টোরি, ইন্টারনেট ব্রাউজিং হিস্টোরি,কন্টাক্ট লিস্ট সংগ্রহ করে।

~

অর্থাৎ দেখা যাচ্ছে যে,শুধু সন্ত্রাসীদের প্রতি দৃষ্টি দেবার পরিবর্তে রাষ্ট্রসমূহ সবার দিকেই নজর রাখছে। অথচ এটা খড়ের গাদায় সূঁচ খোজার মতো। অপরদিকে বর্তমানে যেসকল সন্ত্রাসীদের আটক করা হচ্ছে তার সবগুলোই Classic Target Surveillance প্রোগামের। যেখানে শুধুমাত্র সন্দেহভাজন ব্যক্তিদের ওপরেই গোয়েন্দা কার্যক্রম চালানো হয়। সুতরাং এটা স্পষ্ট যে রাষ্ট্রের সাধারণ নাগরিকদের ওপর নজরদারি করার মাধ্যমে সন্ত্রাসীদের প্রতিহত করা যাচ্ছেনা। উদাহরণস্বরূপ : বোস্টন ম্যারাথনে হামলাকারীদের মধ্যে একজন এফবিআইয়ের টার্গেট লিস্টে অনেক আগে থেকেই ছিলো।

~

অামাদের প্রকৃতপক্ষে যা প্রয়োজন তা হলো প্রাপ্ত তথ্যকে সঠিকভাবে কাজে লাগানো। অপ্রয়োজনীয় তথ্য সংগ্রহ করা নয়। তাছাড়া গভর্নমেন্ট স্পাইয়িং আমাদের যোগাযোগব্যবস্থার এনক্রিপশন সিস্টেমকেও দুর্বল করে ফেলছে।যেমন: ২০১৬ সালের শুরুর দিকে এফবিআই অ্যাপলকে বলেছিলো তাদের আইফোনে স্পেশাল ব্যাকডোর প্রোগাম এপ্লাই করতে যার মাধ্যমে সন্ত্রাসীদের ফোনের ডেটা এনক্রিপশন বন্ধ করে দেয়া যাবে। অ্যাপল অবশ্য জনসম্মুখেই এ প্রস্তাব নাকচ করে দেয় তাদের গ্রাহকদের প্রাইভেসির গুরুত্বের কথা ভেবে। এর কয়েকসপ্তাহ পর এফবিআই জানালো আইফোনগুলোতে এ সিস্টেম তারা নিজেরাই এপ্লাই করেছে। এরপর থেকে রাষ্ট্রীয় গোয়েন্দাসংস্থার বিশ্বস্ততা নিয়ে সকলেই সন্দিহান। যেমন: এনএসএ এখন চাইলেই আপনার ফোনের মাইক্রোফোন বা আপনার ল্যাপটপের ওয়েবক্যাম অন করার ক্ষমতা রাখে।

~

এসব কাজকে প্রায়শই একটি কমন অজুহাতের মাধ্যমে ডিফেন্ড করার চেষ্টা করা হয়।তা হলো,আপনি যদি কোনো অপরাধ না করে থাকেন তাহলে আপনার কোনো ভয় নেই। কিন্তু এটা বিতর্কটাকে আরো উসকে দেয়।কারণ আপনার জীবনের কিছু বিষয়কে গোপন রাখার মানে এই নয় যে আপনি কোনো অপরাধের সাথে জড়িত।আর আমাদের এটাও ভেবে দেখা উচিত যে আমাদের ব্যক্তিগত তথ্য ভুল ব্যক্তির হাতে গেলে কি হতে পারে।

~

এন্টি টেরোরিজম ল আইন রক্ষাকারী বাহিনীকে সন্ত্রাসের সাথে সম্পৃক্ততাহীন অপরাধকে আরো আক্রমণাত্মকভাবে এপ্রোচ করার সুযোগ করে দেয়।আর আপনি কাউকে অতিরিক্ত ক্ষমতা দিলে এর অপব্যবহার হওয়াটাই স্বাভাবিক। একারণেই গণতান্ত্রিক দূরদৃষ্টি অত্যন্ত প্রয়োজনীয়।কেননা আজকে আপনার ওপর এ ক্ষমতা প্রয়োগ করা না হলেও আগামীতে ঠিকই করা হতে পারে।

~

উদাহরণস্বরূপ ২০১৫ সালের নভেম্বরে প্যারিসে সন্ত্রাসী হামলার পর ফ্রান্স তাদের বিদ্যমান কঠোর এন্টি টেরোরিজম আইনকে আরো সম্প্রসারিত করে। যেখানে আইন রক্ষাকারী বাহিনীকে নাগরিকদের বাসায় তল্লাশি চালানো বা নাগরিকদের গৃহবন্দি করার ক্ষমতা দেয়া হয়। এক সপ্তাহ পর দেখা গেলো এ ক্ষমতা সন্ত্রাসীদের পরিবর্তে জলবায়ু পরিবর্তন আন্দোলনকারীদের ওপর প্রয়োগ করা হচ্ছে। স্পেন, হাঙ্গেরি,পোল্যান্ড ও আমাদের দেশের সরকার তো নাগরিকদের ফ্রিডম ও স্পিচের ওপরেই কতিপয় রেস্ট্রিকশন আরোপ করেছে। এসব করার পিছনের কারণসমূহ ভালো কিংবা আদর্শও হতে পারে।কিন্তু আমরা যদি আমাদের কর্তৃক নির্বাচিত সরকারকে নিজেদের ব্যক্তিগত স্বাধীনতায় হস্তক্ষেপের সুযোগ করে দেই তাহলে আল্টিমেটলি কিন্তু সন্ত্রাসীরাই জিতে যাবে।

~

উপরোক্ত তথ্যসমূহের সবগুলোই সত্যি।আর তা থেকে এটা স্পষ্ট যে মত প্রকাশের স্বাধীনতায় হস্তক্ষেপ, অতিরিক্ত নজরদারি কোনো উপকারেই আসেনি।বরং তা আমাদের সমাজকাঠামোটাকেই পরিবর্তন করেছে। সন্ত্রাসবাদ একটি জটিল সমস্যা এবং এর কোনো সিম্পল সলুশান নেই। কোনো সিকিউরিটি এজেন্সিই সন্ত্রাসীদের তাদের বাসার নিচে বোম বানানো হতে আটকাতে সক্ষম নয়। অনুপাতের মূলনীতিকে অবশ্যই আমাদের মাথায় রাখতে হবে। একটা মাস্টার কী এর মাধ্যমে লাখ লাখ ইলেকট্রিক ডিভাইসে এক্সেস করা আর একটা সন্দেহজনক বাসায় তল্লাশি চালানো এক জিনিস নয়। তাই সন্ত্রাসবাদকে রুখতে হলে আমাদের প্রয়োজন ভালো আন্তর্জাতিক সম্পর্ক এবং সহযোগিতা ।এছাড়াও প্রয়োজন বাস্তবক্ষেত্রে কার্যকরী লোকাল সিকিউরিটি এবং ফরেন পলিসি। আরো প্রয়োজন নতুন নতুন আইন প্রণয়ন করে নাগরিক স্বাধীনতায় হস্তক্ষেপের পরিবর্তে বিদ্যমান পুরনো আইনসমূহের সংশোধন ও পরিমার্জন।

~

আমাদেরকে অবশ্যই মনে রাখতে হবে, ভয়ের কারণে যাতে আমরা গণতন্ত্র এবং নিজেদের সবচেয়ে গর্বের বিষয়: আমাদের মৌলিক অধিকারকে ধ্বংস না করি।

বিষয়: আন্তর্জাতিক

৯৩৬ বার পঠিত, ০ টি মন্তব্য


 

পাঠকের মন্তব্য:

মন্তব্য করতে লগইন করুন




Upload Image

Upload File