সাম্প্রদায়ীকতা। I

লিখেছেন লিখেছেন ইবনে মুরতাযা ০৫ অক্টোবর, ২০১৬, ০৩:৩৯:২৮ দুপুর



ভারত-বাংলার সাম্প্রদায়িকতার গুরুত্বপূর্ণ সময় ও ক্ষেত্রে হিন্দু নেতা ও কর্মীদের (যারা সরাসরি সাম্প্রদায়িক রাজনীতি/ হিন্দু জাতীয়তাবাদী রাজনীতি করত, কংগ্রেস বা তার বাইরে) ভূমিকা কি ছিল তা বিচ্ছিন্নভাবে এখানে রাখলাম। এখানকার তথ্যসংকলন কিছুটা “Selective” , এই সন্দেহ থাকলেও তথ্য ও তথ্য উৎসের সঠিকটা নিয়া আশা করি কারো সন্দেহ হবে না।

-------------------------------------

ক.

১. আমি জানিনা ভারতে কখনো পাকিস্তান-প্রভাবিত রাজনীতির উত্থান হবে কিনা। তবে আমি এ ব্যাপারে নিশ্চিত, যেভাবে হিন্দু সম্প্রদায়ের লেখক-সাহিত্যিকেরা এবং সরকারের শিক্ষা বিভাগ বাঙলার সংখ্যাগরিষ্ঠ মুসলমানের মুখের ভাষাকে তাদের সাহিত্যকর্মে এবং পাঠ্যপুস্তকে উপেক্ষা করে যাচ্ছেন তাতে এখানকার সাহিত্যজগতে একটি পাকিস্তানের জন্ম হবে, (আবুল মনসুর আহমদ, ১৮৯৮-১৯৭৮) পূর্ববঙ্গ ও পশ্চিমবঙ্গের মানুষ একরকম নয়। পশ্চিমবঙ্গের মানুষজন, যারা সংস্কৃত ভাষার প্রভাব থেকে কখনো বেরিয়ে আসতে পারেনি, পূর্ববঙ্গের মানুষের ভাষার শব্দ, উচ্চারণ ভঙ্গি এবং এখানকার নানাবিধ রীতিনীতি নিয়ে উপহাস করতো। আবার এখানকার লোকজনও একইরকমভাবে এসবের জবাব দিত। (কামরুদ্দীন আহমদ)।

২.মনে রাখা দরকার ব্রিটিশ ঔপনিবেশিক শাসকদের দ্বারা ভাগ হওয়া এই বাঙলার রাজনৈতিক অস্তিত্ত্বের আবির্ভাব হয় ১৩ শতকে মুসলিম শাসনের সময়। বাঙলার সামাজিক ইতিহাসের ওপর বিশেষজ্ঞ দুর্গাচন্দ্র সান্যাল সঠিকভাবেই চিহ্নিত করেছেন যে, বর্তমানের সম্পূর্ণ বাঙলা ভূখন্ড মুসলিমদের আগে হিন্দু শাসনের সময় কখনো এক দেশ হিসেবে রাজনৈতিকভাবে আবির্ভূত হয়নি।

৩.পশ্চিমবঙ্গের একজন ইতিহাসবিদ জয়া চ্যাটার্জিও লিখেছেন, ‘কংগ্রেস এবং হিন্দু মহাসভার প্রাদেশিক শাখাগুলোর মদদে পশ্চিমবঙ্গের বিরাট সংখ্যক হিন্দু ১৯৪৭ সালে বাঙলা ভাগ করে ভারতের অধীনে আলাদা একটি হিন্দু প্রদেশ সৃষ্টির জন্য ব্যাপকভাবে প্রচারণা চালায় [জয়া চ্যাটার্জি, ‘বেঙ্গল ডিভাইডেড: হিন্দু কম্যুনালিজম এন্ড পার্টিশন: ১৯৩২-১৯৪৫’, ক্যামব্রিজ ইউনিভাসির্টি প্রেস, নিউ দিল্লি, ১৯৯৬, পৃষ্ঠা ২২৭]।

৪.১৯৪৭ সালের ৪ এপ্রিল মহাসভা নেতা এনসি চ্যাটার্জি পশ্চিমবঙ্গের হোগলী জেলার তারকেশ্বরে অনুষ্ঠিত প্রাদেশিক বাঙলা হিন্দু সম্মেলনে বলেন, ‘পুরানো কিছু স্লোগানকে বারবার কপচানো এবং কিছু আকর্ষনীয় শব্দের দাস হয়ে থাকার নাম দেশপ্রেম নয়। বাঙলার ইতিহাসের সবচেয়ে মহিমান্বিত অধ্যায় ছিল ব্রিটিশ সাম্রাজ্যবাদের দ্বারা আরোপিত বিভাজনের বিরুদ্ধে রুখে দাঁড়ানো। কিন্তু আমরা যদি পুরানো স্লোগানের চুড়ান্ত পরিণতি না বুঝে সেগুলো আওড়াতে থাকি তাহলে আমাদেরকে মাতৃভূমির বিরুদ্ধে বিদ্রোহ করার অপরাধে অপরাধী হতে হবে। স্বদেশী আন্দোলনের সময় বিভাজনের বিরোধিতা ছিল সাম্রাজ্যবাদের বিরুদ্ধে লড়াই, যারা চেয়েছিল বাঙলাকে ভাগ করে উভয় প্রদেশে হিন্দুদেরকে সংখ্যালঘুতে পরিণত করার মাধ্যমে (ভারতের) স্বাধীনতার জন্য কাজ করা সবচেয়ে প্রভাবশালী জাতীয়তাবাদী শক্তিটিকে দুর্বল করে ফেলতে। আর আজকে আমরা বিভাজন দাবি করছি জাতীয়তাবাদী শক্তির বিচ্ছিন্ন হয়ে যাওয়া ঠেকাতে এবং বাঙলার সংস্কৃতিকে রক্ষা করে বাঙলার হিন্দুদের জন্য একটি আলাদা ভূখন্ড- অর্জন করতে যেটি একটি জাতিরাষ্ট্র হিসেবে ভারতের অংশ হবে’ [জয়া চ্যাটার্জি এভাবে এনসি চ্যাটার্জিকে উদ্ধৃত করেছেন প্রাগুক্ত, পৃষ্ঠা ২৪১]।

৫.[জয়া চ্যাটার্জি, উপরে উল্লিখিত, পৃষ্ঠা, ২৫০]প্রধানত কলকাতা ভিত্তিক হিন্দু অভিজাত শ্রেণী, যারা ‘ভদ্রলোক শ্রেণী’ বলেও পরিচিত ছিল, তখনকার মুসলিম লীগ শাসিত বাঙলাকে ভাগ করার পেছনের আন্দোলন রচনায় মূল চালিকা শক্তি হিসেবে কাজ করেছে। ভাগ হওয়াতে এই অভিজাত শ্রেনীর বিশেষ রাজনৈতিক এবং অর্থনৈতিক সুবিধা ছিল। এ বিষয়ে জয়া চ্যাটার্জি লিখেছেন, ‘জমিদারি প্রথা দ্রুত ভেঙ্গে পড়ার কারণে এবং ক্ষমতা হারানোর পর হতাশাগ্রস্ত ভদ্রলোক শ্রেনী মূলধারার জাতীয়তাবাদী রাজনীতিতে থেকে সরে এসে তাদের ঐতিহ্যগত সুবিধাদি রক্ষায় নিজেদের সর্বশক্তি নিয়োগ করে। ভাগ হয়ে গেলে বিভিন্নভাবে প্রদেশটির ওই অংশের যেসব এলাকায় হিন্দু সংখ্যাগরিষ্ঠতা আছে সেগুলোতে তাদের রাজনৈতিক প্রভাব পূনপ্রতিষ্ঠিত হওয়ার সম্ভাবনা নিশ্চিত ছিল। ওইসব এলাকায় ‘মুসলিম শাসনের’ সম্ভাবনা এবং অভিজ্ঞতা সবচেয়ে বেশি তিক্ততার সৃষ্টি করে এবং ওই এলাকাগুলোতেই ভাগ হওয়ার পক্ষে আন্দোলন সবচেয়ে বেশি সমর্থন পেতে থাকে’ [প্রাগুক্ত , পৃষ্ঠা ২৫৩]।হিন্দু ভদ্রোলোক শ্রেনীর অর্থনৈতিক সুবিধার বিষয়ে চ্যাটার্জি লিখেছেন, ‘প্রচারণায় ব্যক্তিস্বার্থের শক্তিশালী হিসেব নিকেশ উপস্থিত ছিল যা শুধু চমৎকারভাবে উপস্থাপনই করা হয়নি, বরং এর পেছনে ভাল পরিমাণ অর্থও ঢালা হয়েছিল।

খ.

১. ....কিন্তু পরদিন ১৩ মে ইন্ডিয়ান ন্যাশনাল কংগ্রেসের সভাপতি জেবি কৃপালিনী বাঙলা ঐক্য রক্ষার আবেদনকে নিঃশর্তভাবে উড়িয়ে দেন। আশরাফুদ্দীন চৌধুরী নামে একজন বর্ষীয়ান মুসলিম জাতীয়তাবাদী এবং কৃষকনেতার আবেদনের জবাবে কৃপালিনী লিখেন, কংগ্রেস সর্বশক্তি দিয়ে যা চায় তা হচ্ছে পাকিস্তান এবং লীগের (মুসলিম লীগ) অধিকার থেকে যতটুকু পারা যায় এলাকা উদ্ধার করা। এই দল (কংগ্রেস) চায় একটি স্বাধীন ইন্ডিয়ান ইউনিয়নের জন্য বর্তমান পরিস্থিতিতে যতটুকু পারা যায় এলাকা রক্ষা করা। ফলে আমরা দাবি জানাচ্ছি যেন বাঙলা ও পাঞ্জাবকে ভাগ করে এলাকাগুলোকে হিন্দুস্তান ও পাকিস্তানের মধ্যে চিহ্নিত করে দেয়া হয়। [সুজাতা বসু, অ্যাগ্রারিয়ান বেঙল: ইকোনোমি, সোশ্যাল স্ট্রাকচার এন্ড পলিটিক্স: ১৯১৯-১৯৪৭, ক্যামব্রিজ ইউনিভার্সিটি প্রেস, প্রথম ভারতীয় সংস্করণ, হায়দরাবাদ, ১৯৮৭, পৃষ্ঠা ২৩০-২৩১]

২.বাঙলা ভাগের বিরুদ্ধে জিন্নাহর এই অবস্থান লুইস মাউন্ট ব্যাটেন কর্তৃক বাঙলা ও পাঞ্জাব ভাগ করার পরিকল্পনার বিরোধিতায় জিন্নাহর অবস্থানকেই প্রমাণ করে। (ব্যাটেনের) বিভাজন পরিকল্পনার বিরুদ্ধে যুক্তি দিয়ে জিন্নাহ বলেছিলেন, ‘পাঞ্জাব একটি জাতি। বাঙালীও একটি জাতি। মুসলিম অথবা হিন্দু পরিচয়ের আগে এখানকার বাসিন্দাদের পরিচয় হচ্ছে তারা ‘পাঞ্জাবী’ এবং ‘বাঙালী’। আপনি যদি এই দুই প্রদেশকে আমাদের (পাকিস্তানের সাথে) দিতে চান তাহলে তা কোনোভাবেই ভাগ করতে পারেন না। এমন বিভক্তি দীর্ঘমেয়াদে রক্তক্ষয় ও সমস্যার কারণ হবে। [ল্যারি কলিন্স এবং ডমিনিক লেপিরি, মাউন্ট ব্যাটেন এন্ড দ্য পার্টিশন অব ইন্ডিয়া, বিকাশ পাবলিশিং হাউজ প্রাইভেট লিঃ, নিউ দিল্লী, ১৯৮৩, পৃষ্ঠা ৬৩]।

৩.হিন্দুপ্রধান জেলাগুলোর আইনপ্রণেতাদের বৈঠকে সভাপতিত্ব করেন বর্ধমানের মহারাজাধিরাজ। তাদের মধ্যে ৫৮ জন বিভাজনের পক্ষে ভোট দেন এবং বাকি মুসলিম লীগের ২১ জন বিপক্ষে ভোট দেন। ৫৮ জনের সংখ্যাগরিষ্ঠ পক্ষ আরো সিদ্ধান্ত নেয় যে, হিন্দু সংখ্যাগরিষ্ঠ এলাকাগুলো ভারতে যোগদান করবে। অন্যদিকে, মুসলিমপ্রধান জেলাগুলোর আইনপ্রণেতাদের মধ্যে ১০৬ জন (যার ১০০ জনই মুসলিম লীগের) বাঙলা ভাগের বিপক্ষে ভোট দেন। বাকি ৩৫ জন পক্ষে ভোট দেন।

গ.

১.এটা এখন সার্বজনীনভাবে স্বীকৃত যে, ইন্ডিয়ায় সর্বশেষ ব্রিটিশ ভাইসরয় লর্ড লুইস মাউন্টব্যাটেন, যিনি ব্রিটিশ সরকারের পক্ষ থেকে উপমহাদেশের রাজনীতিবিদদের কাছে ক্ষমতা হস্তান্তরে নেতৃত্ব দিয়েছেন, তিনি জিন্নাহর চেয়ে নেহরুর প্রতি বেশি বন্ধুত্বভাবাপন্ন ছিলেন। এ বিষয়ে ব্রিটিশ সাংবাদিক ও ইতিহাসবিদ এইচভি হডসন লিখেছেন, “যদিও ভাইসরয় নেহরুর মতের বিরোধিতা এবং সমালোচনা করার সব দুয়ার খোলা রাখার ব্যাপারে সচেতন ছিলেন, তবু ১৯৪৭ এর এপ্রিল এবং মে মাসের সমঝোতা বৈঠকগুলোর সময় তাদের উভয়ের মধ্যে অন্য হিন্দু, মুসলিম বা শিখ যেকোনো নেতার চেয়ে বেশি ঘনিষ্ট ব্যক্তিগত সম্পর্ক তৈরি হয়” [এইচভি হডসন, দ্য গ্রেট ডিভাইড: ব্রিটিশ-ইন্ডিয়া-পাকিস্তান, হুচিনসন এন্ড কো., অক্সফোর্ড ইউনিভার্সিটি প্রেস, করাচি, ১৯৬৯, পৃষ্ঠা ২১৪]।

২.১৯৭১ থেকে ১৯৭৩ সালের মধ্যে ল্যারি কলিন্স এবং ডমিনিক ল্যাপিয়েরেকে দীর্ঘমেয়াদে দেয়া সিরিজ সাক্ষাৎকারে ক্ষমতা হস্তান্তরের বিষয়ে কথা বলতে গিয়ে মাউন্টব্যাটেন নেহরুর ব্যাপারে নরম এবং জিন্নাহর ব্যাপারে কঠোর ভাষায় কথা বলেছেন। একটি বিশেষ গুরুত্বপূর্ণ মিটিংয়ে জিন্নাহর উপস্থিত হওয়ার বিষয়ে তিনি নিশ্চিত ছিলেন কিনা এমন এক প্রশ্নের জবাবে মাউন্টব্যাটেন কলিন্স ও ল্যাপিয়েরেকে বলেছিলেন, ‘জিন্নাহ যে ধরনের ‘বাস্টার্ড’ ছিল তাতে সে মিটিংয়ে আসবে কিনা তা নিয়ে আমি মোটেও উদ্বিগ্ন ছিলাম না। তোমরা জানো সে সত্যিই একটা ‘বাস্টার্ড’ ছিল’ [ল্যারি কলিন্স এন্ড ডমিনিক ল্যাপিয়েওে, মাউন্টব্যাটেন এন্ড দ্য পার্টিশন অব ইন্ডিয়া, বিকাশ পাবলিশিং হাউজ প্রাইভেট লিমিটেড, নিউ দিল্লী, ১৯৮৩, পৃষ্ঠা ৬৯]।

৩.নেহরুর সাথে ব্রিটিশ ভাইসরয়ের ভাল সম্পর্কের পেছনে আরো একটি কারণ ছিল। সেটা হচ্ছে ব্রিটিশ সাম্রাজ্যের প্রতি নেহরুর ‘আনুগত্য’। ১৯৪৭ সালের ১৫ আগস্ট ভারতের ক্ষমতা হস্তান্তর উপলক্ষ্যে আয়োজিত অনুষ্ঠানে নেহরু যে আনুগত্য প্রদর্শন করেছিলেন মাউন্টব্যাটেন তা আনন্দের সাথে স্বরণ করেছেন। বলা হয় নেহরু ‘রাজা ষষ্ঠ জর্জের সুসাস্থ্য কামনা করেছিলেন শুধু ইংল্যান্ডের রাজা’ হিসেবে নয় (বরং পুরো ব্রিটিশ সাম্রাজ্যের রাজা হিসেবে)।এ থেকেই মাউন্টব্যাটেন সাম্রাজ্যের প্রতি নেহরুর আনুগত্যের প্রমাণ পান। তার পর্যবেক্ষণে ‘এটা একটা গুরুত্বপূর্ণ পার্থক্য। সে (নেহরু) ছিল রাজার প্রতি অনুগত একজন নেতা [পূর্বোল্লেখিত, পৃষ্ঠা ১১৭]।

৪.স্বাধীনতা পরবর্তী ভারতের গভর্নর জেনারেল হিসেবে কংগ্রেস মাউন্টব্যাটেনকে প্রস্তাব করেছিল। ব্যাটেন নিজে নতুন জন্ম নেয়া পাকিস্তানেও একইরকম পদে আসীন হওয়ার খায়েশ পোষণ করতেন। কিন্তু জিন্নাহ এক্ষেত্রে বাধা হয়ে দাঁড়ান। তিনি মাউন্টব্যাটেনকে বলেন, ‘আমি আপনাকে বরং যৌথ প্রতিরক্ষা পরিষদের চেয়ারম্যান হিসেবে গ্রহণ করতে পারি’ [পূর্বোল্লেখিত, পৃষ্ঠা ৭০]। মাউন্টব্যাটেন পরে জিন্নাহর প্রস্তাবের কথা স্বরণ করে বলেছিলেন, ‘পরবর্তীতে সমস্যা সৃষ্টি না হওয়া পর্যন্ত ওই প্রস্তাব বলবৎ ছিল।’

৫.ব্রিটিশদের ‘বাঙলা ভাগ’ নীতি নেহরু এবং তার দলের রাজনৈতিক উদ্দেশ্য হাসিলে বেশ সহায়ক ছিল। ব্রিটিশরা ১৯৪৭ এর মে মাসে বাঙলা ভাগের সিদ্ধান্ত নেয়, যা এখন প্রতিষ্ঠিত সত্য। বাংলাদেশি গবেষক এইচআর তালুকদার লিখেছেন, ‘মাউন্টব্যাটেন, তার স্টাফদের মধ্যে থাকা একমাত্র ভারতীয় ভিপি মেনন এবং কংগ্রেস নেতৃবৃন্দ, বিশেষ করে পন্ডিত নেহরু ও সরদার প্যাটেলের সাথে পরামর্শ করে মে মাসের মাঝামাঝিতে বাঙলা ভাগের সিদ্ধান্ত পাকাপাকি করেন’ [মোহাম্মদ এইচআর তালুকদার, মেমোয়ার্স অব হোসেইন শহীদ সোহরাওয়ার্দী উইথ অ্যা ব্রিফ অ্যাকাউন্ট অব হিজ লাইফ এন্ড ওয়ার্ক, ইউপিএল, ঢাকা, ১৯৮৭, পৃষ্ঠা ২৮]।

তালুকদার আরো লিখেছেন যে, প্যাটেল পরবর্তীতে ‘ভাইসরয় মাউন্টব্যাটেনের সাথে তার গোপন চুক্তির কথা প্রকাশ করেন। এবং একই সাথে স্বীকার করেন তিনি ভারত ভাগ এবং পাকিস্তান সৃষ্টির প্রস্তাবে রাজি হয়েছিলেন এই শর্তে যে, বাঙলা ভাগ হবে এবং কলকাতা পশ্চিমবঙ্গের মধ্যে থাকবে যেটি ভারতে যোগ দেবে [পূর্বোল্লেখিত, পৃষ্ঠা ৩০]।

ঘ.

১.শেখ মুজিবুর রহমান বিশ্বাস করতেন, জিন্নাহর উপর অসন্তুষ্টি থেকে মাউন্টব্যাটেন শুধু ভারতকে কলকাতার অধিকার দিয়ে ক্ষান্ত হননি, বরং পূর্ববঙ্গকে কয়েকটি নিশ্চিত মুসলমান সংখ্যাগরিষ্ঠ অঞ্চল থেকেও বঞ্চিত করেছেন । “নদীয়া মুসলমান সংখ্যাগরিষ্ঠ অঞ্চল হওয়া স্বত্বেও, তিনি কৃষ্ণনগর এবং রানাঘাট জংশন পশ্চিমবঙ্গের (ভারতের) অধিভুক্ত করেন। একইভাবে, হিন্দুদের চেয়ে মুসলমানের সংখ্যা বেশি হওয়া স্বত্বেও পুরো মুর্শিদাবাদ জেলা তিনি ভারতকে দিয়ে দেন। মালদহে হিন্দু ও মুসলমানের সংখ্যা সমান সমান হওয়ায় তিনি এই জেলাকে আধাআধি ভাগ করেন। কিন্তু দিনাজপুর মুসলমান সংখ্যাগরিষ্ঠ হলেও, তিনি বালুরঘাট কে দুই ভাগে ভাগ করেন যাতে, জলপাইগুড়ি এবং দার্জিলিং ভারতের সাথে যেতে পারে, এবং দেশের বাকি অংশের সাথে আসামের একটা সরাসরি লিংক হয়। এই সবকয়টা জেলা পাকিস্তানের অধিকারে আসা উচিত ছিল। পূর্ববঙ্গে, রেফারেন্ডাম পাকিস্তানের পক্ষে গেলেও মুসলমান সংখ্যাগরিষ্ঠ করিমগঞ্জের উপ–বিভাগ ভারতে চলে গেল [প্রাগুক্ত, পৃষ্ঠা ৮৩]।

২.বাংলার মুসলমানদের বঙ্গভঙ্গের বিপক্ষে নিষ্ক্রিয় থাকার অনেকগুলো কারণের মধ্যে অন্যতম হচ্ছে চল্লিশের দশকে কংগ্রেস এবং মহাসভার মাত্রাতিরিক্ত সাম্প্রদায়িক রাজনৈতিক আধিপত্য, হিন্দু স্বার্থান্বেষী সাম্প্রদায়িক বিভক্তিকরণ, ১৯৪৩ এ দুর্ভিক্ষের তাজা স্মৃতি যার মূল শিকার ছিল দরিদ্র বাঙ্গালী মুসলমানেরা, সর্বোপরি ভাষাগত সাম্প্রদায়িক সাহিত্য শ্রেণী, যা কলকাতা কেন্দ্রিক অভিজাত হিন্দুদের দ্বারা তৈরি হয়েছিল ।

৩.সামাজিক বিভিন্ন ক্ষেত্রে হিন্দু সম্প্রদায়ের সমান অধিকার প্রতিষ্ঠায় সচেষ্ট শিক্ষিত মুসলমানরা এ বিষয়ে ওয়াকিবহাল ছিলেন যে, ১৯০১ সালে তৎকালীন বাঙলার সরকারের অধীনে উচ্চ পর্যায়ের নিয়োগের ক্ষেত্রে মুসলিমরা মাত্র ৪১টি পদ পেয়েছিল। অন্যদিকে মুসলিম জনসংখ্যার তিনভাগের একভাগ হয়েও হিন্দুরা নিয়োগ পেয়েছিল ১২৩৫টি উচ্চপদে [পূর্বোল্লিখিত, পৃষ্ঠা ৩১৭]।

১৯০৫ সালের বঙ্গভঙ্গ কার্যকরের পর পূর্ববাঙলা সরকার দেখলো মন্ত্রনালয়, বিভাগ, জেলা এবং সাবডিবিশনের গুরুত্বপূর্ণ পদগুলোর মাত্র ছয় ভাগের এক ভাগের মতো মুসলমানদের অধীনে আছে, যদিও এখানে মুসলমানদের সংখ্যা হিন্দুদের চেয়ে দ্বিগুন। আর পুলিশ বিভাগে মুসলমানদের উপস্থিতি আরো খারাপ। শতকরা ৫৯ ভাগ মুসলমান জনসংখ্যা থাকার পরও তখন ‘ইস্টার্ন বেঙ্গল রেঞ্জ’ নামে পরিচিত পুলিশ বিভাগে মোট ৫৪জন ইনস্পেক্টরের মধ্যে চারজন, ৪৮৪ জন সাব–ইনস্পেক্টরের মধ্যে ৬০ জন, ৪৫০ জন হেড–কনস্টেবলের মধ্যে ৪৫ জন এবং ৪৫৯৪ জন কনস্টেবলের মধ্যে মাত্র ১০২৭ জন কনস্টেবল ছিলেন মুসলমান [পূর্বোল্লিখিত]।

জন আর ম্যাকলেইন লিখেছেন যে, ‘হিন্দুদের এমন প্রভাব বিদ্যমান ছিল আইন-আদালত সংক্রান্ত সবক্ষেত্রে। সেটা গ্রামের পঞ্চায়েত থেকে শুরু করে আদালতের সামনে হাজির হওয়া ব্যারিস্টার পর্যন্ত। প্রভাব ছিল শিক্ষাব্যাবস্থায়ও। একদম গ্রামের স্কুলশিক্ষক থেকে শুরু করে সচিবালয় পর্যন্ত যেখানে হিন্দু ইতিহাস, রূপকথা এবং মূল্যবোধকে পাঠ্যবইয়ে গুরুত্ব দেয়া হতো। ভূমিব্যবস্থাপনায়ও গ্রামে জমিদারের কাচারি থেকে জেলার ভূমিরেকর্ড অফিস পর্যন্ত ছিল হিন্দুদের প্রভাব [পূর্বোল্লিখিত, পষ্ঠা ৩১৮]। এমতাবস্থায় ঢাকাকে রাজধানী করে পূর্ববঙ্গ ও আসাম প্রদেশের জন্ম কোনঠাসা মুসলমানদের জন্য ক্রমশ তাদের বিপরীতে থাকা হিন্দু জনগোষ্ঠির সমান অধিকার প্রাপ্তির সুযোগ করে দিয়েছিল। এ কারণে মুসলমানদের মধ্যে শিক্ষিত অংশ বঙ্গভঙ্গের ব্যাপারে সন্তুষ্টই ছিল।

ঙ.

১.বঙ্গভঙ্গ বাঙলার হিন্দুদেরকে মারাত্মকভাবে ক্ষুব্ধ করে তোলে, বিশেষ করে উচ্চবর্ণের হিন্দু যেমন- জমিদার, ব্যবসায়ী, সরকারি কর্মকর্তা, আইনজীবী এবং বুদ্ধিজীবীরা- যারা মূলত ব্রিটিশ ইস্ট ইন্ডিয়া কোম্পানি এবং সরকারের দ্বারা রাজনৈতিক, ব্যবসায়ীক এবং বুদ্ধিবৃত্তিক পৃষ্ঠপোষকতা পেয়ে আসছিল। বঙ্গভঙ্গকে তারা কেন অপছন্দ করতো তার কারণ হিসেবে জন আর ম্যাকলেইন লিখেছেন, ‘অনেক শিক্ষিত হিন্দু যৌক্তিক কারণেই মনে করতেন যে বিভক্তির মানে হচ্ছে তাদের প্রাপ্ত বিভিন্ন সুযোগসুবিধা কমে যাওয়া’ [পূর্বোল্লিখিত]।

২.ই শপথ গ্রহণ প্রক্রিয়ার মতো করে শপথবাক্যগুলোও ছিল হিন্দুধর্মীয় নানা প্রবচনে ভরপুর। প্রথমত, তাদেরকে শপথ নিতে হত ‘ভগবান’ বা ‘অগ্নি’ ইত্যাদির নামে এবং সেটাও হতো হিন্দুী দেবী কালীর মুর্তির সামনে দাঁড়িয়ে। এখানে উল্লেখ্য, অরবিন্দ ঘোষ ‘জাতীয়তাবাদ’কে ‘ধর্ম’ হিসেবে মনে করতেন। ১৯০৯ সালে আলীপুর বোমা হামলা মামলায় জেল খেটে অরবিন্দ বের হওয়ার পর পরিস্থিতি আরো খারাপ হয়। তখন অরবিন্দ নিবেদিতাকে বলেন তিনি মনে করেন সনাতন ধর্মই (হিন্দুধর্ম) হবে ‘জাতীয়তাবাদ’ এর ভিত্তি [মনি বাগচী, স্বদেশী আন্দোলন নিবেদিতা এন্ড শ্রী অরবিন্দ’, বিশ্বনাথ দেবের সংকলন, অরবিন্দ স্মৃতি, পূনমুদ্রণ, সাহিত্যম, কলকাতা, ১৯৭৮, পৃষ্ঠা ২০৫]।

চ.

১.রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর তার ‘ব্যাধি ও প্রতিকার’ নামে একটি প্রবন্ধে ১৯০৭ সালে লিখেছেন, ‘এটা সবাই জানে যে বাংলার অনেক জায়গায় হিন্দু ও মুসলমানরা একই কার্পেটে বসেনা, যখন কোন মুসলমান কোন হিন্দুর ঘরে প্রবেশ করে তখন কার্পেটের এক প্রান্ত গুটিয়ে রাখা হয়।’ পরে রবীন্দ্রনাথ স্বদেশী আন্দোলনে মুসলমানদের একাত্বতা প্রসঙ্গে বলেন, ‘হঠাৎ করে যখন ইংরেজী শিক্ষিত শহুরেরা অশিক্ষিত গ্রাম্য লোকদের কাছে গিয়ে বলল ”আমরা সবাই ভাই ভাই”, তখন গ্রামের দরিদ্র মানুষেরা ”ভ্রাতৃত্ব” শব্দের অর্থ বুঝতে পারেনি। আমরা সবসময় গ্রামের লোকজনকে ”গেঁয়ো” বলে অভিহিত করেছি, তাদের সূখ-দুঃখ আমাদের কাছে কমই পার্থক্য করতো, এখনও তাদের অবস্থা জানতে আমাদের বিভিন্ন অফিসিয়াল পরিসংখ্যানের সাহায্য নিতে হয়, এবং তাদের দূরবস্থায় আমরা কখনোই তাদের পাশে দাড়াইনি। এখন ব্রিটিশদের মোকাবেলা করতে গিয়ে আমরা যদি আচমকা ভ্রাতৃত্বের কথা বলে সেসমস্ত মানুষদেরকে ডাকি এবং উচ্চমূল্যে নিত্যপ্রয়োজনীয় দ্রব্য কিনতে ও পুলিশের নির্যাতন সহ্য করতে বলি তখন তাদের জন্য আমাদের উদ্দ্যেশ্য নিয়ে সন্দেহ হওয়াটা খুবই স্বাভাবিক। একজন বিখ্যাত স্বদেশী আন্দলনকারীর কাছ থেকে আমি শুনেছি স্বদেশী আন্দোলনের বক্তৃতা শোনার পর পূর্ববাংলার মুসলমানরা একে অপরে কাছে বলছিল যে ”বাবুরা নিশ্চয়ই কোন ঝামেলায় পড়েছেন”(রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর, ইকবাল ভূঁইয়ার রবীন্দ্রনাথ ও মুসলিম সমাজে, ২য় সংস্করন, প্রথমা প্রকাশন, ঢাকা, ২০১২, পৃষ্ঠা ২১৭-২১৮)।

২.বাংলার মুসলমানরা, বিশেষ করে পূর্ব বাংলার মুসলিমরা এই আন্দোলনকে ভালোভাবে নেয়নি, কারন যেমনটা স্বঘোষিত একজন রক্ষণশীল হিন্দু নীরদ সি চৌধুরী তার জীবনীতে বলেছেন যে, ‘The Swadeshi movement of 1905 was mainly an assertion of the nationalism of the new Hindu school অর্থাৎ, ১৯০৫ সালের স্বদেশী আন্দোলন ছিল মুলত নব্য হিন্দুদের জাতীয়তাবাদী দাবী (নীরদ সি চৌধুরী, এন অটোবায়োগ্রাফী অফ এন আননোন ইন্ডিয়ান, ৮ম প্রকাশ, জ্যাকব পাবলিশিং হাউস, বোম্বে, ১৯৮৮, পৃ-৪৩৯)। যদিও পরে লর্ড হার্ডিঞ্জের নেতৃত্বাধীন ব্রিটিশ সরকার অকস্মাৎ স্বদেশী ‘সন্ত্রাসবাদী বিপ্লবীদের’ কাছে নতি স্বীকার করে এবং ১৯১১ সালের ২০ আগস্ট বঙ্গভঙ্গ বাতিল করে। এছাড়াও ব্রিটিশরা ১৯১২ সালে তাদের রাজধানী কলকাতা থেকে দিল্লীতে স্থানান্তর করে।যাইহোক, ১৯১১ সালের আগস্টে বঙ্গভঙ্গের রদের সাথে সাথে বাংলায় উপনিবেশবিরোধী জাতীয়তাবাদী আন্দোলন থেমে যায়(সুপ্রকাশ রায়, পৃ-১৪৪)। এর দ্বারা একটা ধারণা জন্ম নেয় যে নাগরিক ও সন্ত্রাসবাদী উভয় আন্দোলনই বঙ্গভঙ্গ রদের জন্য হয়েছিল যদিও নাম দেয়া হয়েছিল জাতীয়তাবাদী আন্দোলন হিসেবে। আর এর লক্ষ্য ছিল হিন্দুদের, বিশেষ করে বর্ণ হিন্দুদের রাজনৈতিক ও অর্থনৈতিক স্বার্থ হাসিল করা। তদূর বোঝা যায় তথাকথিত স্বদেশী আন্দোলন ‘জাতীয়তাবাদে’র রাজনৈতিক তাৎপর্য ধারণ করেনি যা প্রকৃত প্রস্তাবে ধর্মনিরপেক্ষ হওয়ার কথা। বরং এটি বাংলার মানুষকে ধর্মীয়ভাবে আরো ভাগ করে দেয়। নীরদ চৌধুরী যথার্থই লিখেছেন, ‘জাতীয়তাবাদী আন্দোলন হিন্দু-মুসলিম বিরোধের এক নতুন স্বীকৃতি দিয়েছে। তাত্বিকভাবে এটি হিন্দু-মুসলিম ঐক্যের কথা প্রচার করেছে। কিন্তু এর বিপরীতে মুসলিম বিরোধী ধারাবাহিক প্রচারণাও চলেছিল(নীরদ সি চৌধুরী, পূর্বোল্লিখিত, পৃ-২৩৭)। পরবর্তীতে মি. চৌধুরী বিপিন চন্দ্র পালকে উদ্ধৃত করে বলেন, ‘ক্রমশ জাতীয়তাবাদী আন্দোলনকারীদের একটা অংশের মধ্যে ভারতে একটি একক হিন্দু রাষ্ট্র বা রাষ্ট্রসংঘ প্রতিষ্ঠার আকাঙ্খা জেগে ওঠে’ (পূর্বোল্লিখিত)। অনেক ক্ষেত্রে এর বেশীও ছিল। নীরদ চৌধুরী বলেনঃ ‘স্বদেশী আন্দোলনের মাধ্যমে হিন্দু-মুসলিম বিদ্বেষের সবচেয়ে বিপদজনক রূপ ছিল এই যে এই বিরোধীতা ঐতিহাসিক বিষয় থেকে সমসাময়িক সময়ে নিয়ে আসা হয়েছিল এবং অতীত ঘৃণা থেকে বর্তমান ঘৃণাতে রূপান্তরিত হয়েছিল’ (পূর্বোল্লিখিত)।

৩.রতের মুসলিম নেতাদের যেখানে ভারতীয় জাতীয় কংগ্রেস থেকে স্বাধীনভাবে মুসলিমদের স্বার্থ উপস্থাপনের সাধারন একটি রাজনৈতিক উদ্দেশ্য ছিল, সেখানে নব্য প্রতিষ্ঠিত মুসলিম সংখ্যাগরিষ্ঠ পূর্ব বাংলায় স্থানীয় মুসলিমদের, বিশেষ করে অভিজাতদের সুযোগ সুবিধা সম্প্রসারণ ও সুদৃঢ়করনের নবাব সলিমুল্ল্যাহর পৃথক একটি উদ্দেশ্য ছিল। এজন্য পূর্ব বাংলার হিন্দুরা তার প্রতি বিরূপ মনোভাবাপন্ন ছিল এবং তাকে কালো জানোয়ার বলে অভিহিত করত।নীরদ চৌধুরী মুসলমানদের বড় অংশের অপছন্দের স্বদেশী আন্দোলন পূর্ব বাংলার তার শহরের একটি স্কুলের ছাত্রদের কচি মনে কিরকম তীব্র সাম্প্রদায়িক বিদ্বেষ সৃষ্টি করেছিল তার একটি উদাহরণ দিয়েছেন, ‘মুসলমানদের সাথে আমাদের আন্তরিক সম্পর্কের অবসান ঘটিয়ে তাদের প্রতি আমাদের মনে এক নীরব বিদ্বেষ জন্ম নিল। আশ্চর্যের বিষয় সেই সাথে সাথে কিশোরগঞ্জের ছেলেদের মধ্যে স্পষ্ট বিভাজন তৈরী হল। ক্লাসে দুটি ভাগ হয়ে গেল, একটি অংশ শুধু হিন্দুদের সমন্বয়ে, আর অপরটি শুধু মুসলিমদের সমন্বয়ে গঠিত। মুসলিম ছাত্ররা আমাদের সাথে বসার ইচ্ছা পোষণ করুক বা নাই করুক, আমরা হিন্দু ছাত্ররা সেসময় চিৎকার করতাম যে আমরা মুসলিমদের সাথে বসতে চাইনা কারন তাদের সাথে পেঁয়াজের গন্ধ থাকত‘ (পূর্বোল্লিখিত, পৃ-২৪২)।

ছ.

১.১৯০৫ সালের বঙ্গভঙ্গ যে পূর্ব বাংলার মানুষের, বিশেষ করে এর সংখ্যাগরিষ্ঠ মুসলমানদের অন্তত শিক্ষাক্ষেত্রে উপকার হয়েছিল এটা ১৯১১ সালে বঙ্গভঙ্গ রদের পর ১৯১২ সালে একটি মুসলিম ডেলিগেশনের কাছে দেয়া ভাইসরয় লর্ড হার্ডিঞ্জের অফিসিয়াল বিবৃতিতে স্পষ্ট হয়। পরিসংখ্যান প্রদানের মাধ্যমে লর্ড হার্ডিঞ্জ বলেনঃ ‘১৯০৬ সাল থেকেই পূর্ব বাংলা ও আসাম সামনের দিকে এগিয়েছে। সে বছর পূর্ব বাংলা ও আসামে ১৬৯৮ জন কলেজিয়েট ছাত্র ছিল, আর কলেজ শিক্ষায় ব্যয় ছিল ১৫৪৩৫৮ রুপি। আর বর্তমানে সমসংখ্যক প্রতিষ্ঠানে ছাত্রের সংখ্যা ২৫৬০ জন, আর ব্যয় ৩৮৩৬১৯ রুপি। উন্নতি শুধু কলেজ এর ক্ষেত্রেই হয়নি। স্থানীয় অবস্থার প্রেক্ষিতে শিক্ষায় শ্রেণী ও পরিকল্পনা প্রনীত হয়। ১৯০৫ থেকে ১৯১০-১১ তে সরকারী প্রতিষ্ঠানে লোকের সংখ্যা ৬৯৯০৫১ থেকে ৯৩৬৬৫৩ তে উন্নীত হয়, প্রাদেশিক রাজস্ব থেকে খরচের পরিমাণ ১১০৬৫১০ থেকে ২২০৫৩৩৯ রুপিতে উন্নীত হয়, যেখানে স্থানীয় ব্যয় ৪৭৮১৮৮৩ থেকে ৭৩০৫২৬০ রুপিতে উন্নীত হয়’‘ (এম এ রহিম, দ্যা হিস্ট্রি অফ দ্যা ইউনিভার্সিটি অফ ঢাকা, ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়, পুনঃমুদ্রন ১৯৯২ (১৯৮১), পৃ-৪)। পরিসংখ্যান থেকে বুঝা যায় কেন পূর্ব বাংলার মুসলমানেরা বাংলাকে দুভাগ করে মুসলিম সংখ্যাগরিষ্ঠ একটি নতুন প্রদেশ গঠনকে স্বাগত জানিয়েছিল।

২.১৯১২ সালের ১৬ ফেব্রুয়ারী রাশ বিহারী ঘোষের নেতৃত্বে এক প্রতিনিধি দল ভাইসরয়ের সাথে দেখা করে ঢাকায় পৃথক বিশ্ববিদ্যালয় স্থাপিত হলে বাংলার অভ্যন্তরীন বিভাজন হবে বলে তাদের মত প্রকাশ করেন। তারা যুক্তি প্রদর্শন করেন যে পূর্ব বাংলার মুসলমানদের অধিকাংশ কৃষক এবং বিশ্ববিদ্যালয় প্রতিষ্ঠার মাধ্যমে তারা কোনভাবেই উপকৃত হবেনা‘ (এম এ রহিম, পূর্বোল্লিখিত, পৃ-৫)

৩.অবশেষে ১৯২১ সালের জুলাই মাসে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় প্রতিষ্ঠা হয়। শুরুর দশকগুলতে এর ছাত্র ও শিক্ষকদের অধকাংশই ছিল হিন্দু। তখনো কলকাতা ভিত্তিক অভিজাত হিন্দুরা ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়কে ব্যঙ্গ করে ‘মক্কা বিশ্ববিদ্যালয়’ ডাকত এবং ইঙ্গিত করত এই বিশ্ববিদ্যালয় বিশেষভাবে মুসলমানদের জন্য প্রতিষ্ঠা হয়েছে।

৪.সেসকল অভিজাত হিন্দুরাই যারা তাদের সাম্প্রদায়িক স্বার্থে ১৯০৫ সালের বঙ্গভঙ্গের বিরোধীতা করে সফলভাবে নাগরিক ও সন্ত্রাসবাদী আন্দোলন পরিচালনা করেছিল তারা ১৯৪৭ সালে বাংলার বিভক্তির জন্য উঠেপড়ে লাগে, সেসকল অভিজাত হিন্দুরাই পরবর্তী দশকগুলোতে ক্রমাগত মুসলমানদের প্রতি বিরোধীতা করেছিল, সেসকল স্বার্থান্বেষী সাম্প্রদায়িক হিন্দুরাই ১৯৪৭ সালে আবারো তাদের সাম্প্রদায়িক স্বার্থ রক্ষার্থে বাংলার বিভক্তির জন্য সব রকম প্রচেষ্টা করে। নীরদ সি চৌধুরীও এর সমর্থনে বলেন, ‘লর্ড কার্জনের বাংলা বিভক্তির বিরোধীতা করেছিল যারা সেসকল হিন্দুরাই এখন দেশের ২য় বিভক্তি নিয়ে আসে‘ (নীরদ সি চৌধুরী, পূর্বোল্লিখিত, পৃ-২২৭)।

৫.রবীন্দ্রনাথ ঠাকুরের স্নেহধন্য বাঙ্গালী মুসলমানদের একজন ড. মুহম্মদ কুদরত-ই-খোদা ১৯৩৬ সালে কবিকে জিজ্ঞাসা করেছিলেনঃ ‘আপনি কেন হিন্দু-মুসলিম বন্ধুত্বের উপর আরো লিখেননি যেটি দেশের স্বাধীনতার জন্য গুরুত্বপূর্ণ ছিল?’ জবাবে রবীন্দ্রনাথ বলেছিলেন, ‘হিন্দু-মুসলিম বন্ধুত্ব অসম্ভব। হিন্দু সমাজকে আমি যতটা জানি তুমি ততোটা জানোনা।’ উদ্বিগ্ন কুদরত-ই-খোদা জিজ্ঞাসা করেনঃ ‘তাহলে সমাধান কি?’ রবীন্দ্রনাথ বলেনঃ ‘স্বাধীনতা তখনই আসবে যখন পুরো দেশ হয় হিন্দু না হয় মুসলমান হবে।’ (মুহাম্মদ কুদরত-ই-খোদা, ‘কবি স্মৃতি’, ইকবাল ভুইয়া, পূর্বোল্লিখিত, পৃ-৩৬১)।

জ.

১.কলকাতার দাঙ্গায় মুসলিম লীগের কোনো হাত ছিল না, এই কথা বেঙ্গল মুসলিম লীগের তৎকালীন সাধারণ সম্পাদক আবুল হাশিম জোরের সাথেই বলেন।

তারা বলেন যে, ‘সকালে শুরু হওয়া নজিরবিহীন সংঘাত সম্পর্কে মুসলিমলীগের কোন পূর্বধারনা ছিলনা, যা ১৬ আগস্ট বিকেল পর্যন্ত চলছিল, যখন আমরা সবাই অখটরলনি মনুমেন্টের পাদদেশে অনুষ্ঠিত মিটিংয়ে ছিলাম’ [পূর্বোল্লিখত, পৃষ্ঠা ১৩২]। তার দাবির সমর্থনে, হাশিম দুর্দান্ত প্রমাণ পেশ করেন: ‘মানুষ মিথ্যা বলতে পারে কিন্তু পরিস্থিতি কখনো মিথ্যা বলেনা। কলকাতায় প্রত্যাশিত মহাসমাবেশ দেখাতে আমি দুই ছেলে, ১৫ বছরের বদরুদ্দিন মোহাম্মদ উমর এবং ৮ বছরের শাহাবুদ্দিন মোহাম্মদ আলীকে বর্ধমান থেকে আমার সঙ্গে নিয়ে এসেছিলাম। আমি আমার ছেলেদেরকে এবং ফরিদপুরের লালমিয়া তার ছয় কি সাত বছরের নাতিকে নিয়ে ময়দানের দিকে গেলাম।আমরা যদি কোন ধরনের বিপদের আশংকা করতাম তাহলে নিশ্চয় আমাদের সন্তান এবং নাতিদেরকে ময়দানে নিয়ে যেতাম না [পূর্বোল্লিখত]।

২.এই ব্যাপারে জয়া চ্যাটার্জি লিখেছেন, ‘হিন্দু মহাসভা স্বেচ্ছাসেবকগণ তাদের নেতাদের পরামর্শ অনুযায়ী কাজ করতে খুবই উৎসুক ও প্রস্তুত ছিল। এমনকি বাঁশের বুহ্য, ছোড়া এবং দেশীয় পিস্তল ব্যবহার করতেও তারা প্রস্তুত ছিল। আগস্ট মাসের ১৬ তারিখে হিন্দু ও মুসলিম দুইপক্ষই লড়াইয়ের জন্য প্রস্তুত ছিল; উভয় পক্ষ অস্ত্রসজ্জিত এবং হিন্দুরা বিশাল বাহিনী নিয়ে অবস্থান নিয়েছিল’ [জয়া চ্যাটার্জি, বেঙ্গল ডিভাইডেড, পূর্বোল্লেখিত, পৃষ্ঠা ২৩৮]।

দাঙ্গার আলামত পর্যালোচনা করে চ্যাটার্জি লিখেছেন, ‘মুসলমান দাঙ্গাকারীদের বেশিরভাগ ছিল গ্রাম থেকে শহরে আসা জনগোষ্ঠি কিন্তু আশ্চর্য্যজনকভাবে দাঙ্গার অভিযোগে গ্রেফতার হওয়া বিশাল সংখ্যক হিন্দুরা ছিল অভিজাত শ্রেণীর’ ……বাঙ্গালী হিন্দু ছাত্র এবং অন্যান্য পেশাজীবী, বিশেষ করে মধ্যবিত্ত শ্রেণীর মানুষ বেশি তৎপর ছিল…… একটি বড় অংশ জুড়ে ছিল শিক্ষিত তরুণরা, যাদের হাতে নিহত হয়েছিলেন প্রখ্যাত চক্ষুবিশেষজ্ঞ ডা. জামাল মোহাম্মদ।’ [পূর্বোল্লেখিত, পৃ. ২৩৯]।

হিন্দুদের পক্ষে আরও জড়িত ছিল মুক্তিপ্রাপ্ত আইএনএ সৈন্য ও মাড়োয়ারি ব্যবসায়ীরা। চ্যাটার্জির গবেষণা থেকে দেখা যায়, ‘এটি ছিল হিন্দু ছাত্র, পেশাজীবী, ব্যবসায়ী, সাবেক কর্মচারি ও কর্মকর্তা, কংগ্রেস ও মহাসভার সদস্য, দোকানদার, এবং আশে পাশের মাস্তান ছেলেদের একটি জোট, যারা ১৯৪৬ সালে কলকাতার রাস্তায় হিন্দু দাঙ্গাকারীদের নিষ্ঠুর ও রক্তাক্ত বিজয়ে নেতৃত্ব দিয়েছিল’ [পূর্বোল্লেখিত]। ফলশ্রুতিতে, “দাঙ্গায় হিন্দুদের চেয়ে মুসলিমদের নিহতের সংখ্যা ছিল অনেক বেশি, এবং প্যাটেল তাঁর স্বভাবসুলভ, শীতল ও ভীতিকর কণ্ঠে এই পাশবিক ঘটনাকে ‘হিন্দুদের শ্রেষ্ঠত্ব’ বলে অভিহিত করেছিলেন” [পূর্বোল্লেখিত, পৃ. ২৩৩]।

কেন এই নৃশংসতায় হিন্দু অভিজাত শ্রেণী অংশ নিয়েছিল, তাঁর একটা উত্তর পাওয়া যায় বর্ধমানের বিশিষ্ট চিকিৎসক মাহেন্দ্রনাথ সরকারের ভাষ্যে। দাঙ্গা পরবর্তী সময়ে মুসলিমদের সমাবেশে বোমা নিক্ষেপের কারণে তাঁকে গ্রেফতার করা হয়েছিল। তিনি বলেছিলেন, “আমি এখন কংগ্রেসের সদস্য। পূর্বে আমি হিন্দু মহাসভার সদস্য ছিলাম। বাংলাকে বিভক্ত করার মানসে আমি দাঙ্গায় যোগ দিয়েছিলাম” [পূর্বোল্লেখিত]।

দাঙ্গার সময় মুসলিমদের উপর হিন্দুদের নৃশংসতা এতোই পাশবিক ও বর্বর ছিল যে, অনেক ইতিবাচক চিন্তাসম্পন্ন হিন্দু মানসিক বিপর্যয়ের শিকার হয়েছিল। এই প্রসঙ্গে মনসুর আহমদ আলীগড় কোর্টে একজন তরুণ ব্রাহ্মণ মুনসেফের কথা উল্লেখ করেন। হিন্দু ধর্মান্ধদের নির্দয় তান্ডবলীলা দেখার পর সে তরুণ ব্রাহ্মণকে মানসিক হাসপাতালে কিছুকাল চিকিৎসা নিতে হয়েছিল। সেই তরুণ দেখেছিল, ‘কিভাবে উচ্চ শিক্ষিত ও সংস্কৃতিবান হিন্দুরা, বিশেষ করে অবসরপ্রাপ্ত বিচারক এবং সিনিয়র আইনজীবীরা তরবারি ও রামদা দিয়ে তাদের আশেপাশের বস্তিবাসী মুসলিম পুরুষ, মহিলা ও শিশুদের হত্যা করেছিল’ [আবুল মনসুর আহমেদ, আমার দেখা রাজনীতির পঞ্চাশ বছর, পৃ. ১৯৬]।

ঝ.

১. পুলিশের ইংরেজ মহাপরিদর্শক মুখ্যমন্ত্রী সোহরাওয়ার্দীকে বলেন, চরমপন্থী হিন্দুদের দ্বারা সংগঠিত দাঙ্গার প্রস্তুতি সম্পর্কে তিনিও জানতেন না কারন পুলিশের সব গোয়েন্দা শাখা শুধু হিন্দু সদস্যদের দ্বারা গঠিত এবং তারা সরকারের সাথে বিশ্বাসঘাতকতা করছে [কামরুদ্দিন আহমদ, পৃ ৭১]। পরবর্তীতে কলকাতা দাঙ্গা তদন্ত কমিশনের একজন সদস্য ফ্রান্সিস টুকার তাঁর স্মৃতিকথায় লিখেছেন, ‘হিন্দু মহাসভা ছিল দাঙ্গার জন্য দায়ী, কিন্তু হিন্দু পুলিশ প্রভাবিত পুলিশের গোয়েন্দা শাখা এবং অপরাধ তদন্ত শাখা সরকারকে এ ব্যাপারে অন্ধকারে রেখেছে [টুকার থেকে উদৃত করেছেন কামরুদ্দিন আহমদ, উপরেল্লিখিত,পৃ ৭২]

২. কলকাতায় পৌঁছার পর তাঁকে বিহারের হত্যাযজ্ঞ সম্পর্কে অবগত করে একদল মুসলিম যুবক আগে সেখানে পরিদর্শন করার আহবান জানায়। গান্ধী তাঁদের আহবান প্রত্যাখ্যান করেন এই যুক্তিতে যে, ‘তিনি যখন দিল্লী থেকে নোয়াখালীর উদ্দেশে যাত্রা শুরু করেন, তখন বিহারে কোন দাঙ্গা ছিল না, সুতরাং মাঝপথে এসে তিনি পূর্বে মনঃস্থির করা গন্তব্য পরিবর্তন করতে পারবেন না’[পূর্বোল্লেখিত]। কামরুদ্দিন আহমদ এ বিষয়ে লিখেন যে, বিহার যাওয়ার প্রস্তাব প্রত্যাখ্যান করায় মুসলিম যুবকরা মনে করেছিল গান্ধী বিশ্বের দৃষ্টি বিহারের হত্যাযজ্ঞ থেকে সরিয়ে নোয়াখালীর দিকে নিতে চাচ্ছেন।

৩.কলকাতা ভিত্তিক সাম্প্রদায়িক হিন্দু সংবাদপত্র নোয়াখালীতে ঘটে যাওয়া মর্মান্তিক হত্যাকান্ডকে এত ফলাও করে এবং ঘটনার সাথে কাল্পনিক গল্প জুরে দিয়ে এমনভাবে প্রকাশ করে যে এর ফলে বিহারের পাটনায় হিন্দুদের দ্বারা ব্যাপক মুসলমান হত্যাকান্ডকে উস্কে দেয়। সোহরাওয়ার্দী তাঁর স্মৃতিকথায় লিখেন: ‘অমৃত বাজার পত্রিকা এবং কংগ্রেসের অন্যান্য পত্রিকাগুলো বঙ্গীয় প্রাদেশিক পরিষদের সম্পাদকের নামে অকস্মাত একটি বিবৃতি ছাপে যে, ৫০,০০০ হিন্দুকে হত্যা করা হয়েছে এবং অগণিত নারীকে অপহরণ করা হয়েছে। এ খবরে উত্তেজিত হয়ে, যুক্ত প্রদেশের গারমুখতেশ্বারে হিন্দুরা মুসলিমদের লাঞ্ছিত করে এবং গণহত্যা চালায় এবং বিহার প্রদেশের সর্বত্র ১০০,০০০ মুসলমান নারী, পুরুষ ও শিশুকে অবিশ্বাস্য বর্বরতার সঙ্গে হত্যা করা হয়েছে বলে বিশ্বাস করা হয়।

ঞ.

১.তবে নেহরু এক্ষেত্রে নিজেকে আলাদা হিসেবে উপস্থাপন করেছেন। তিনি শুধু বিহার সফর করেননি, বরং সেখানে নতুন করে মুসলিম হত্যা বন্ধ করতে নিজের জীবনের ঝুঁকি’ নিয়েছেন। সোহরাওয়ার্দী তার স্মৃতিচারণায় লিখেছেন, এটা পন্ডিত জওহরলাল নেহরুর কৃতিত্ব যে, বিহারে বিক্ষুব্ধ হিন্দুদের সামনে গিয়ে দাঁড়ানোর সাহস তিনি করেছিলেন এবং তাদেরকে সহিংসতা বন্ধের নির্দেশ দিয়ে (বলেছিলেন); অন্যথায় তিনি তাদেরকে গুলি করবেন’ [মোহাম্মদ এইচআর তালুকদার সম্পাদিত, মেমোয়ার্স অব হোসেইন শহীদ সোহরাওয়ার্দী উইথ অ্যা ব্রিফ অ্যাকাউন্ট অব হিজ লাইফ এন্ড ওয়ার্ক, ইউপিএল, ঢাকা, ১৯৮৭, পৃষ্ঠা ১০৫-১০৬]।

২.‘অ্যাগ্রেরিয়ান বেঙ্গল’ নামক বইয়ের লেখক ইতিহাসবিদ সুজাতা বসু লিখেছেন, ১৯৪২ থেকে ১৯৪৫ সালের মধ্যে পূর্ব বাঙলার কৃষক সমাজ এমন খাদ্যাভাবে পড়েছিল যা নিকট ইতিহাসে দেখা যায়নি। অথচ তাদের সামগ্রিক কোনো প্রতিবাদ জানানোর সুযোগ ছিল না। ১৯৪৩ এর শুরুর দিকে দুর্ভিক্ষের প্রথম নিদর্শন ধরা পড়ে চট্টগ্রামের কয়েকটি জেলায়। এর মধ্যে ব্রাহ্মণবাড়িয়া সদর, চাঁদপুরের বিভিন্ন উপজেলা, ফেনীসহ নোয়াখালীর বিভিন্ন উপজেলা সবচেয়ে ভয়াবহভাবে আক্রান্ত হয়েছিল। ফসল উৎপাদনে পিছিয়ে থাকা এসব জেলার ভূমিহীন ও স্বল্প ভূমির মালিক কৃষকরা গণহারে অভুক্ত থেকেছেন। ৪৩ সালের এপ্রিল মাস থেকে তারা লাখে লাখে (লেখকের ভাষায় ইন মিলিয়নস’) মৃত্যুবরণ করতে থাকেন [সুজাতা বসু, অ্যাগ্রেরিয়ান বেঙ্গল: ইকোনোমি সোশ্যাল স্ট্রাকচার এন্ড পলিটিক্স: ১৯১৯-১৯৪৭, কেমব্রিজ ইউনিভার্সিটি প্রেস, অরিয়েন্ট লংম্যানের সাথে প্রথম ভারতীয় সংস্করণ, হায়দরাবাদ, ১৯৮৭, পৃষ্ঠা ২১৮]। বুঝাই যাচ্ছে, ভুক্তভোগীরা বেশিরভাগই দরিদ্র মুসলমান ছিলেন। অন্য আরো বহু ইতিহাসবিদের মতো সুজাতাও উল্লেখ করেছেন, কৃষকদের (পূর্ব বাঙলার) বেশিভাগই ছিলেন মুসলিম’ [প্রাগুক্ত, পৃষ্ঠা ১৮৭]।

৩.যার একদিকে ছিল কক্সবাজার অন্যদিকে ইমফল (মনিপুর রাজ্যের রাজধানী) [এমএএইচ ইস্পাহানী, কায়দে আজম জিন্নাহ: অ্যাজ আই নো হিম, ফরওয়ার্ড পাবলিকেশন ট্রাস্ট, করাচি, ১৯৬৬, পৃষ্ঠা ৯১]। এমতাবস্থায় দিল্লীস্থ ব্রিটিশ সরকার বাঙলার প্রাদেশিক সরকারকে অনুরোধ করলো যাতে, হামলা হলে শত্রুর জন্য যথাসম্ভব কম উপাদান’ বহাল রাখা হয়। এরপরই পূর্ব বাঙলার যোগাযোগের অন্যতম মাধ্যম নৌকা হাজারে হাজারে পুড়িয়ে বা ভেঙে ফেলা হয়। ফলে প্রদেশে প্রয়োজনীয় জিনিসপত্র বহন ও যোগাযোগের ক্ষেত্রে বিরাট বিচ্ছিন্নতা সৃষ্টি হয়’ [প্রাগুক্ত, পৃষ্ঠা ৯২]।

৪.মুসলমানরা দুর্ভিক্ষের কারণে বাংলায় সংখ্যালঘু হয়ে যায়নি কিন্তু দুর্ভিক্ষের সময় তারা তিক্ত সময়ের মধ্য দিয়ে গিয়েছে তাতে হিন্দুদের প্রতি তাদের এক ধরণের সাম্প্রদায়িক বিদ্বেষের জন্ম নিয়েছে। ঐতিহাসিক ও রাজনৈতিক কারণে মুসলমানদের থেকে অর্থনৈতিকভাবে হিন্দুরা অনেক ভালো অবস্থানে ছিল এবং তুলনামূলকভাবে দুর্ভিক্ষের কারণে কম ক্ষতিগ্রস্ত হয়েছিল। ঔপনিবেশিক বাংলার সামাজিক স্তরবিন্যাস তুলে ধরতে গিয়ে আবুল মনসুর আহমেদ বলেছেন, ‘বাংলার জমিদাররা ছিল হিন্দু আর প্রজারা ছিল মুসলিম, ঋণদাতারা ছিল হিন্দু আর গ্রহীতারা ছিল মুসলিম, ডাক্তাররা ছিল হিন্দু আর রোগীরা ছিল মুসলিম, বিচারকরা হিন্দু আর অভিযুক্তরা মুসলিম, খেলোয়াড়রা ছিল হিন্দু আর দর্শকরা মুসলিম, কারারক্ষীরা হিন্দু আর কারাবন্দীরা মুসলিম, এমন আরো অনেক’ (আবুল মনসুর আহমেদ, প্রাগুক্ত, পৃ-১২৫)।

উৎসঃ নুরুল কবির (সম্পাদকঃ নিউ এইজ) এর লেখা “Colonialism, politics of language and partition of Bengal”, এর অনুবাদ থেকে।

বিষয়: রাজনীতি

১২৭৯ বার পঠিত, ০ টি মন্তব্য


 

পাঠকের মন্তব্য:

মন্তব্য করতে লগইন করুন




Upload Image

Upload File