যৌতুকের বিষাক্ত ছোবলে বিষন্ন জনজীবন।

লিখেছেন লিখেছেন রায়হান আযাদ ২৯ সেপ্টেম্বর, ২০১৬, ০৭:২৮:০৪ সন্ধ্যা

যৌতুক মানব সমাজে বিরাজমান এক ঘাতক ব্যাধি। যা সমাজের শান্ত পরিবেশ নষ্ট করে বিশৃংখলা সৃষ্টি করে, কিছু অনাকাংখিত ঘটনার জন্ম দেয়। যৌতুকের প্রভাবে প্রভাবিত আজ সমাজের উঁচু-নীচু সকল শ্রেণী পেশার মানুষ। হিন্দু সমাজ থেকে এ প্রথার আবির্ভাব, বাংলাদেশে হিন্দু-মুসলিম পাশাপাশি বসবাস থেকেই মুসলিম সমাজেও যৌতুক প্রথা অনুপ্রবেশ ঘটেছে। জানা থাকা দরকার হিন্দু সমাজে বিয়ের পর মেয়েদের মা-বাবার সম্পত্তিতে তাদের কোন অধিকার থাকে না,তাই বিয়ের সময় মেয়ের বাবা সাধ্যানুযায়ী প্রয়োজনীয় সামগ্রি যৌতুক হিসেবে একেবারে দিয়ে দিত। এর প্রসারতা এত ব্যাপক আকার ধারণ করেছে, যা প্রতিটি মানব সমাজের সাথে মিশে তাদের সংষ্কৃতিতে স্থান করে নিয়েছে, যৌতুকের প্রধান আক্রমনের শিকার হত দরিদ্র, নিম্নবিত্ত, মধ্যবিত্ত পরিবার।

অশিক্ষা,ধর্মান্ধতা,বেকারত্ব,লোভ,হীনমন্যতা,কৃপনতা,সন্তানের জন্য ব্যয়কৃত অর্থ পুষিয়ে নেয়ার প্রবণতা থেকে যৌতুকের সৃষ্টি।সমাজের কিছু উচ্চ বিলাসী ধনী লোকেরা স্ব-ইচ্ছায় বর পক্ষকে যৌতুক দিলেও, গরীবদের তা দিতে বাধ্য করা হচ্ছে। যা দিতে অপারগ হলে, তার বিবাহযোগ্য মেয়েকে পাত্রস্ত করতে পারছেন না, ফলে অনিচ্ছা সত্বেও বাধ্য হয়ে যৌতুক দিতে হয়। অনেক মেয়ের বাবা মেয়ের সুখের জন্য নিজের শেষ সম্বল বাপ-দাদার ভিটে মাটি বিক্রি করে বর পক্ষের চাহিদা মিটায়। তবুও মেয়ে শশুড় বাড়িতে সুখী হতে পারে না, কারণ তাদের চাওয়ার কোন শেষ নেই, বর পক্ষ যৌতুককে তাদের অধিকার মনে করে, শুধু বিয়ের সময় যৌতুক দিলে শেষ হয়ে যায় না।বিশেষ করে বিয়ের ১ম বছর সারা বছর বিভিন্ন সময় ভিন্ন ভিন্ন জিনিস দ্বারা যৌতুক দেয়া হয়,যেমন ঈদের সময় মেয়ের শশুর বাডির লোকদের জন্য নতুন জামা-কাপড় (মেয়ে-মেয়ের জামাই,মেয়ের শশুর-শাশুড়ি,দেবর-ননদ,বরের বড় ভাই-ভাবী,তাদের ছেলে-মেয়ে,এমনকি বরের বোন-ভগ্নিপত্নীসহ সবাইকে) দিতে হয়, ইফতার সামগ্রী,কুরবানের ঈদের সময়, গরু-ছাগল,মহিষ,ভেড়া ইত্যাদি দিতে হয়,বছরের বিভিন্ন ফলের মৌসুমে ফল-ফলাদি (আম,জাম,কাঁঠাল,লিচু,

আনারস,তরমুজ,বাকী ইত্যাদি) দিতে হয়। ১ম সন্তান হলে আকিকা সহ যাবতীয় খরচ (বর্তমানে হাসপাতালে সন্তান প্রসব হলে হাসপাতালের বিল) মেয়ে পক্ষকে দিতে হয়। প্রত্যেকের জানা দরকার সন্তানের আকিকা পিতা-মাতার দায়িত্ব(অনেকের ধারনা ননার বাড়ি থেকে দিতে হয়)।

প্রাচীন সমাজ থেকে আজ পর্যন্ত যৌতুক একই প্রকৃতির নই, যুগের সাথে তাল মিলিয়ে এর পরিবর্তন সাধিত হয়েছে।আগে যৌতুক হিসেবে উপঢৌকন নেয়া হতো রেডিও,চার্জ লাইট,লেপ-তোষক,ঘড়ি,গরু-ছাগল,নগদ ১/২ হাজার টাকা ইত্যাদি। যুগ পাল্টানোর সাথে সাথে রঙিন টেলিভিশন , ফার্নিচার , ৫০/৬০ হাজার টাকা দাবি উঠে। কিন্তু বর্তমানে যৌতুক প্রথা এমন এক পর্যায়ে পৌঁছেছে যে তা আজ আর ঐ সনাতন দাবি দাওয়ার মধ্যে সীমাবদ্ধ নেই। এখন যৌতুক হিসেবে চাওয়া হয় গাড়ি,বাড়ি,৫/১০ লক্ষ নগদ টাকা,স্বর্ণালংকার,ফ্রিজ, এয়ার কন্ডিশন,সরকারী/বেসরকারি চাকুরী,বিদেশ গমনের খরচ।অনেক কন্যার দায়গ্রস্থ পিতাকে দেখেছি তার কন্যাকে বিয়ে দেওয়ার জন্য মানুষের দ্বারে দ্বারে সাহায্যের হাত পাততে। এর চেয়ে লাজ্জা  একজন পিতার জন্য আর কি হতে পারে ?

পুত্র সন্তানকে লালন-পালন করতে যেই কষ্ট হয়, একই কষ্ট হয় কন্যা সন্তানকে লালন-পালন করতে। কন্যা সন্তানকে শিক্ষিত করতে, পুত্র সন্তানের চেয়ে খরচ ও কষ্ট বেশি হয়,কারণ মেয়েদের চলাফেরা করতে নিরাপত্তা দিতে হয়। একজন পিতা ইচ্ছা করলে তার কন্যা সন্তানকে সুশিক্ষিত বা উচ্চশিক্ষিত করতে পারে কিন্তু দিতে পারেনা যোগ্যপাত্র বা সুখের সংসারের গ্যারান্টি। কিছু কিছু পরিবারে দেখা যায়,ধনী পিতার অযোগ্য কন্যাকে মোটা অংকের টাকা নিয়ে বিয়ে করে যোগ্যপাত্র। পিতা যত বেশি টাকা দিতে পারে,তত বেশি কন্যার  দোষ ঢেকে গিয়ে গুনবতী হয়ে যায়।কিন্তু সেই গুনবতী স্ত্রীর গুন থাকে যতক্ষণ টাকা গুলো পকেটে থাকে ততক্ষণ। যৌতুকের টাকা শেষ হয়ে গেলে শুরু হয় সংসারে অশান্তি। এর মধ্যে বেশি আহত  হয় যোগ্য ছেলেটা। যোগ্যপাত্র হয়েও অযোগ্য স্ত্রী নিয়ে জীবন কাটাতে হয়। সে যৌতুকের লোভের কারণে সংসারে সুখের প্রদীপ জ্বালাতে পারেনা।একজন পিতা বরপক্ষকে মোটা অংকের টাকা দিয়েও কন্যার  সুখের গ্যারান্টি দিতে পারেনা। একজন পিতার কাছে এর চেয়ে বেশি দুঃখ কি  আর হতে পারে?

কিছু কিছু লোভী মানুষ আছে,যারা বউকে মনে করে টাকার ব্যাংক, যখন চাইবে তখনই টাকা উঠাতে পারা যাবে। সময়ে অসময়ে তারা বউকে চাপ দিতে থাকে নতুন নতুন বাজেটের। বউ বাপের বাড়ি থেকে বাজেট অনুমোদন করাতে পারলেই ভালো, আর না করাতে পারলে শুরু হয় নির্যাতন। অনেক সময় দেখা যায়  হত্যা করে আত্মহত্যা বলে ফ্যানের সাথে বা গাছে ঝুলিয়ে রাখে। যদি কন্যার পক্ষে মামলা করতে চায়, তাহলে আরো নতুন নতুন নির্যাতনের স্বীকার হয়। বিচারতো দূরের কথা মামলা করাও তখন জীবনের ঝুঁকি হয়ে দাড়ায়। একজন পিতা আদরের কন্যার এই রকম নির্মম ও করুন  মৃত্যুর যন্ত্রণা সইবে, নাকি  সমাজে  বিচার চাইতে গিয়ে নিজেকে জীবনের ঝুঁকিতে রাখবে ?

আধুনিক যুগের শুরুতেই 'বেগম রোকেয়া শাখাওয়াত হোসেন', 'ইশ্বরচন্দ্র বিদ্যাসাগর', 'রাজা রামমোহন রায়' প্রমুখ নারীর মুক্তির জন্য আন্দোলন করেছেন। তাদের মত আমাদেরকেও সেই আন্দোলনে শরীক হতে হবে। আমরা জানি, আন্দোলন করতে, কিন্তু নারীকে মুক্তি দিতে পারিনা। হয়তোবা অনেকে বলবেন নারী এখন অনেক স্বাধীন বা নারীরা এখন সমান অধিকার নিয়ে চলে। তাদের সাথে আমিও একমত, তবে তাদের সংখ্যা খুবই কম। অনেক সময় দেখা যায় কিছু কিছু শিক্ষিত হিরুদের অভিনব কান্ড। তারা যৌতুক নেয়ই না, কিন্তু উপহার নিয়ে থাকেন। বই পড়েইতো তারা শিক্ষত হয়েছে। বইতে কি তারা মহিয়ষা-মহিয়ষী বানী গুলো পড়েনি ?

যেমন শরৎচন্দ্র বলেছেন- 'অর্থের বিনিময়ে যারা একজন নারীকে বিয়ে করতে সম্মত হয়, সেই পুরুষ কোনদিন তার স্ত্রীকে ভালোবাসবে না'। তারা ঠিকেই পেরেছে আন্দোলন করেতে, কিন্তু নারীকে মুক্ত করতে পারেনি। কারন তারা প্রতিযোগিতা মূলক জীবন-যাপন করতেছে । তারা পাত্রী দেখার সময় ভাবে, নিজে যখন শিক্ষিত তাহলে শিক্ষিত পাত্রী হতে হবে। এরপর ভাবে অমুকদের কথা, অমুক অমুক বন্ধুর শশুর বাড়ি থেকে দামী ফার্নিচার পেল, এতজন বরযাত্রী খাওয়ালো, তাও আবার যেমন তেমন ক্লাব নয়। তাদের চেয়ে আরো বেশি কিছু পেয়ে বাহাদুরি করতে হবে । এভাবে অমুক অমুক করতে করতে সমুকেরা  বিয়ে করে উপহার নামে অভিনব পদ্ধতিতে যৌতুক নিয়ে। একবারও ভেবে দেখন কি তার কথা ???

যার সাথে উপহার উপহার খেলা খেলতেছেন। তিনি তো কঠোর পরিশ্রম করে আপনাকে শিক্ষিত স্ত্রী ও আপনার সন্তানের জন্য শিক্ষিত মা তৈরী করে দিয়েছেন। এর চেয়ে বড় উপহার আপনার কাছে আর কি হতে পারে ? ভাবে দেখুন, সেই মানুষটিকে আপনি কতটুকু সন্মান দিলেন ? যৌতুক প্রথারোধে প্রয়োজন সমাজ খেকে যৌতুক প্রথার মূল উৎপাটনের জন্য দলমত নিবিশেষ সকল শ্রেণি পেশাও ধর্মের মানুষকে এগিয়ে আসতে হবে সকলের সু্স্থ  মানসিকতা বহু জীবন রোধ এবং সমাজ কল্যাণ মূলক গঠনশীল দৃষ্টিই পারে যৌতুক প্রথা নির্মূল করতে। যৌতুক প্রথারোধে বর্তমান তরুণ সমাজ অগ্রণী ভূমিকা পালান করতে পারে। তরুণরাই পারে যৌতুক প্রথাকে পৃথিবী থেকে চিরতরে মুছে দিতে।

সবাইকে একসাথে একই সুরে বলতে হবে আমরা যৌতুক চাইনা, শিক্ষিত,যোগ্য সঙ্গীনি চাই । আমরা যৌতুক চাইনা, সন্তানের শিক্ষিত মা চাই। আমরা যৌতুক চাইনা,শিক্ষিত জাতি চাই। আমরা যৌতুক চাই না ক্ষণজম্মা এই পৃথিবী সুখের জীবন চাই। হে পুরুষ- আপনারাই পারেন যৌতুক মুক্ত সমাজ গড়তে। একটা অশিক্ষিত  মানুষ এবং শিক্ষিত,সচেতন মানুষের পার্থক্য থাকা দরকার। যৌতুকের কুফলতা সম্পর্কে, সচেতনতা বৃদ্ধি করতে হবে। সচেতনতা বৃদ্ধি করে গড়ে তুলবে প্রতিরোধ। তাই তরুণদের কাছে আমার আহবান মানবতার কল্যানে এগিয়ে আসুন। মানবতার কল্যাণে যৌতুকে না বলুন। আসুন শুধু কথায় নয়,নতুন প্রজন্মকে কলহমুক্ত সুন্দর পরিবার উপহার দিতে যৌতুক মুক্ত সুন্দর মানসিকতাই আমাদের বেশি প্রয়োজন। এ ব্যাধির মূলউৎপাটনে সমাজের আগে পারিবারিকভাবে সবাই প্রতিরোধ গড়ে তুলি।

বিষয়: বিবিধ

৯৮৩ বার পঠিত, ০ টি মন্তব্য


 

পাঠকের মন্তব্য:

মন্তব্য করতে লগইন করুন




Upload Image

Upload File