বৃদ্ধাশ্রম এবং এক মা

লিখেছেন লিখেছেন মহাকালের অসুখী ০৮ সেপ্টেম্বর, ২০১৬, ০৫:৩৩:২১ সকাল

মাগো তোমরা এত উদার হও কেন? আসলে এতটা উদার হয়া উচিৎ না তোমাদের। তোমাদের উদারতার সুযোগ নিয়েইতো আমরা এমন অমানুষ হই। বৃদ্ধাশ্রমে থাকা প্রতিটা মা বাবার কাছে ক্ষমা চেয়ে আমার এই গল্প।

মা

-তুমি তোমার মাকে বৃদ্ধাশ্রমে পাঠাবে নয়ত আমাকে বাপের বাড়ী রেখে আসবে। দুইটা অপশন দিলাম তোমাকে। ইউ হ্যাভ টু চুজ ওয়ান। তুমি প্রতিদিন এড়িয়ে যেতে পারনা।

-আহ সুমা। আস্তে কথা বল। মা শুনতে পেলে কষ্ট পাবে।

-পেলে পাবে সেটা আমার বিষয় না। তোমার মায়ের পিছে খেটে মরার জন্য আমি তোমাকে বিয়ে করিনি।

-শ্বশুড় শ্বাশুড়ীর পিছে মানুষতো খুশী হয়ে খাটে।

-আমি পারবনা। ব্যাস।

-আচ্ছা আজ যদি তোমার ভাবী তোমার মাকে বৃদ্ধাশ্রমে পাঠিয়ে দিতে বলে তখন কি করবে?

-আমার মা এত ঝামেলা করেনা কিংবা এত আনকালচার্ড না যে ভাবী এমন চাইবে।

শফিকের আর ভাল্লাগেনা। এই বিষয় নিয়ে সুমা খুব বেশী প্রেসার ক্রিয়েট করছে ইদানীং।

জাহানারা বেগম আচলে চোখ মুছলেন। স্পষ্ট শুনা যাচ্ছে তার একমাত্র ছেলে শফিক আর পূত্রবধূ সুমার ঝগড়া। নিজেকে খুব অসহায় লাগছে তার। ছেলের জন্য কষ্ট হচ্ছে। ছেলেটা তাকে ভালবাসে তিনি জানেন। আর ভালবাসবেই বা না কেন? সেই ছোটবেলা শফিকের বাবা ফিরোজ সাহেব মারা যান। তখন থেকেই বাবা মা দুজনের আদর সোহাগ দিয়ে শফিককে মানুষ বানিয়েছে। সে এখন সরকারী একটি ব্যাংকের সিনিয়র অফিসার। তবে চাকরী আর এই আলীশান ফ্লাটের পেছনে শফিকের শ্বশুড়ের অনেক অবদান। সেজন্যই বউয়ের এত তেজ। জাহানারা বেগম ছেলের অবস্থা বুঝতে পারছেন ভালো ভাবেই। মনে মনে নিজেকে দোষারোপ করলেন। "আল্লাহ আমাকে আগেই কেন উঠিয়ে নিলেনা ওর বাবার মত। মা হয়ে ছেলের বোঝা হয়ে থাকতে কি মন চায়?" স্মৃতির পাতা ঘেটে অনেক পেছনে চলে গেলেন তিনি। শফিক তখন প্রাইমারীতে পড়ত। ফিরোজ সাহেব চাকরী করতেন একটি বীমা অফিসে। একদিন শফিক পাশের বাসার জানালার থাই গ্লাস ভেঙ্গে ফেলে ঢিল ছুড়ে। তারপর বাবার ভয়ে মাকে জড়িয়ে ধরে খুব কান্নাকাটি করে। ফিরোজ সাহেব রাগী মানুষ ছিলেন। তিনি আসতেই পাশের বাসা থেকে কাচ ভাঙ্গার নালিশ আসে শফিকের নামে। সারাদিন কাজ করে এমনিতেই ক্লান্ত ছিলেন ফিরোজ সাহেব। তার উপর ঘরে আসতেই এমন নালিশ। শফিককে ঢেকে আনলেন তিনি। কোমড় থেকে আগেই বেল্ট খুলে রেখেছিলন। শুরু করলেন মাইর। জাহানারা বেগম তখন দৌড়ে গিয়ে জড়িয়ে ধরেন শফিককে। বেল্টের দু -তিনটা ঘা তার শরীরেও লেগেছিল সেদিন। প্রাণের প্রিয় সন্তানকে সেদিন আড়াল করে রক্ষা করেছিলেন জাহানারা বেগম। আরেকবার স্কুল পালিয়েছিল শফিক। সেদিন বাবা তাকে সারারাত বারান্দায় থাকার শাস্তি দেন।

ফিরোজ সাহেব খুবই কড়া প্রকৃতির মানুষ ছিলেন। তার কথা অমান্য করার সাহস হতনা কারো। জাহানারা বেগম সেদিন স্বামীর কথা উপেক্ষা করে মাঝরাতে উঠে গিয়ে শফিকের সাথে বারান্দাতেই রাত কাটিয়েছেলেন। এইভাবে জীবনে বহুবার ছেলের ত্রাণকর্তা হয়েছিলেন তিনি। স্মৃতির মণিকোঠা থেকে নীরবে অশ্রু বিসর্জন দিতে দিতে আবার বাস্তবে ফিরে এলেন জাহানারা বেগম। সেই ছেলে আজও বিপদে পড়েছে আর তিনি সাহায্য করবেননা তাতো হয়না। তিনি ছেলেকে ডাকলেন। স্বামী স্ত্রীর ঝগড়া চলছিলো তখনো।

মায়ের ডাকে ঝগড়ার মাঝপথে ছুটে আসে শফিক আর সুমা এসে আড়ি পাতে দরজার ওপাশে।

-মা ডেকেছ আমাকে? মাথা নীচু করে প্রশ্ন করে শফিক।

-এদিকে আয় বাবা। আজকাল তকেতো পাওয়াই যায়না। তোর কাজের এত চাপ। মায়ের পাশে একটু বস দুটো কথা বলি।

শফিক যেন মায়ের দিকে চোখ তুলে তাকাতে পারছেনা। সে স্পষ্ট বুঝতে পারে মা তাদের ঝগড়া শুনেছেন। না শুনার কথাও না। সুমাতো প্রায় চেচামেচিই করছিলো।

- হে মা। ব্যাংকের কাজ খুব ঝামেলার। সময় দিতে পারিনা তোমায়।

-সেসব আমি বুঝিরে বাবা। তা খাওয়া দাওয়া করেছিস?

-করেছি মা।

-শুন বাবা‚তোকে কিছু কথা বলার ছিলো।

-কি মা?

-আমারনা এই বাসায় ভাল্লাগেনা। ভীষণ একা লাগে। তুই চলে যাস অফিসে আর বৌমা থাকে তার কাজ নিয়ে। আমি একা একা পড়ে থাকি। রাতুলটারও পড়ার অনেক চাপ। ক্লাস ফাইভে পড়ে। চাপতো থাকবেই। সেও আর আমাকে সময় দিতে পারেনা।

শফিক মায়ের চোখের দিকে এতক্ষণে তাকালো। ওখানে জল টলমল করছে বুঝতে পারে সে। মায়ের কথার উত্তরে কি বলবে খোঁজে পাচ্ছেনা। মা আবার শুরু করলেন।

-শুনেছি আজকাল বৃদ্ধাশ্রম না কি যেন বের হয়েছে। যেখানে আমার বয়সী অনেক মানুষ একসাথে থাকে। দলবেঁধে আড্ডা দেয় আরো কত আনন্দ ফূর্তি করে। আমাকে বাবা তুই ওরকম কোন জায়গায় পাঠিয়ে দেনা। আমার সত্যি এখানে আর ভাল্লাগছেনা। মাঝে মাঝে না হয় সময় সুযোগ পেলে তোরা যাবি আমাকে দেখতে বা আমাকে নিয়ে আসবি দুই একদিনের জন্য।

-কিন্তু মা... কিছু বলতে চাইছিলো শফিক।

-কিন্তু ফিন্তু না বাবা। কদিন আর আছি বল? একটু হইহুল্লোড়ের মাঝে থাকি না। তুই ব্যবস্থা কর। আমার জন্য একদম ভাবিসনা। আমি ভালোই থাকব। আর এখন আমি অজু করব। পরে কথা বলব। যা তুই ঘরে যা। বউ মা হয়ত অপেক্ষা করছে।

কথাগুলো বলে শফিককে আর কিছু বলার সুযোগ দেননা জাহানারা বেগম। বাথরুমের দিকে হাটা ধরেন। মার চলে যাওয়ার দিকে ফ্যালফ্যাল করে তাকিয়ে থাকে শফিক। ভালবেসে বিয়ে করেছিলো সুমাকে। সুমার বাবার অবদানেই আজ সে এত ভাল একটা চাকরী করে আর এই ফ্লাটে থাকছে। ফ্লাটের মেক্সিমাম টাকাই দিয়েছেন সুমার বাবা। সবকিছু মিলিয়ে সুমার কাছে সে বাধা পড়ে আছে ভালোবাসা‚ ভালবাসা এবং ক্যারিয়ার সবকিছুতেই। একমন বলছে মা নিয়ে কোন আপোষ না অন্য মন বুঝাচ্ছেন মাতো আর খারাপ থাকবেনা। সবাই যদি শান্তিতে থাকি আর মাও ভালো থাকেন তবে বৃদ্ধাশ্রমে গেলে ক্ষতি কি? তাছাড়া বৃদ্ধাশ্রমতো খোলাই হয়েছে এজন্য। মানুষইতো থাকে সেখানে।

মা বাবাকে বৃদ্ধাশ্রমে পাঠানোর আগে সাধারণত এই কথাগুলো ভেবেই নিজের উপর থেকে দোষ নামায় নিষ্ঠুর সন্তানেরা। শফিকও ব্যাতিক্রম নয়। কেউ কেউ নিজেই বয়োবৃদ্ধ মা বাবাদের উপর বিরক্ত হয়ে এই কাজ করে আর কেউ করে প্রিয়তমা স্ত্রীর সন্তুষ্টির জন্য। তবে এরকম সন্তানের স্থান জাহান্নামের কোন ভয়াবহ পর্যায়ে হবে তা আল্লাহই ভালো জানেন। আমি মনে প্রাণে দোয়া করি এইরকম পরিস্থিতির সামনে ফেলার আগে যেনো আল্লাহ আমাকে পৃথিবী থেকেই উঠিয়ে নেন আর যারা এমন করে তারাও যেনো বৃদ্ধাশ্রমের হাওয়া বাতাস আর অসহায় মূহুর্তগুলির স্বাদ নিয়েই পৃথিবী ছাড়ে।

এদিকে জাহানারা বেগম বাথরুমে গিয়ে পানির টেপ ছেড়ে কাদতে লাগলেন। আনন্দের কান্না। তার আবার কষ্ট কিসের? ছেলের কি সুন্দর একটা সমস্যার সমাধান করে দিলেন। মায়েরাতো এমনই হয়। জগতের সকল কষ্ট‚অবহেলা আর অবজ্ঞা হাসিমুখে সহ্য করে যান সন্তানদের জন্য। তিনি হয়ত ভাবছেন‚এ আর এমন কি? প্রসব বেদনার চাইতেতো আর বেশী যন্ত্রণাদায়ক হবেনা বৃদ্ধাশ্রম যাত্রা।

লেখা ঃ সৈয়দ মাহফুজ শিপলু

বিষয়: বিবিধ

১১৭০ বার পঠিত, ০ টি মন্তব্য


 

পাঠকের মন্তব্য:

মন্তব্য করতে লগইন করুন




Upload Image

Upload File