রূপাই
লিখেছেন লিখেছেন মহাকালের অসুখী ০৪ সেপ্টেম্বর, ২০১৬, ১২:৩৩:১৪ রাত
রাতের বেলা ঘুম না আসলেই আমি হাটি। তবে হিমু হব
বলে হাটিনা। হাটলে ভাল্লাগে তাই হাটি। হিমুর কিছু
আমার মাঝে নেই আর কোনদিন ছিলোওনা।
হাটতে হাটতে বাসা থেকে বেশ দূরে চলে এসেছি।
ঘেউ ঘেউ করে একটা কুকুর হঠাৎ রাতের
নিস্তব্ধতা গিলে খেলো। আমাকে যেন জানান দিল এই
নিশাচর প্রকৃতিতে আমার মত
সেও একজন। কুকুরটা আমার কাছেই ছিল তাই
জানতে চাইলাম - কিরে একলা একলা কি করিস?
ঘুমাসনাই।
ব্যাটা কোন উত্তর দিলনা। আমারে পাত্তাই দিচ্ছেনা।
এবার একটু ধমকে বললাম -কথা কানে যায়না কি জিগাই
‚বেদ্দপ। যা ভাগ।
-ঘেউ ঘেউ।
সর্বোনাস। ব্যাটার ইগো আছে দেখি। ধমকাতেই
ক্ষেপে গেছে। যেনো বললো -আমি না ঘুমাইলে তোর
কি ব্যাটা? নিজে আইছস কোন আকাম করতে‚তুই ভাগ।
ভেগে যাওয়াটাই উত্তম। কুকুরের কামড়
খেলে নাকি ১৪টা ইঞ্জেকশন দিতে হয়। ইঞ্জেকশন
জিনিসটা খুব ভয় পাই। এত্ত বড় একটা সুই ঠাস
করে শরীরে ঢুকিয়ে দেয়া। এর কোন মানে হয়।
দূর থেকে একটা একটা গাড়ীর উজ্জল হেডলাইট
চোখে লাগলো। টহল পুলিশের গাড়ী নিশ্চিত।
এরা রাতের
বেলা ছিনতাইকারীর চাইতে কম ভয়ংকর না। জিলাপীর
প্যাঁচ নিয়ে ঘুরে। বিপদে পরে সাহায্য
চাইলে আরো তিরষ্কার করে বেশী। এরা যে কেন
টহলে বাইর হয় বুঝিনা। এদেরকে যদি আমি এখন বলি ভাই
আমাকে ছিনতাইকারী ধরেছিলো। টাকা পয়সা সব
নিয়ে গেছে। প্রথমেই বলবে-এত রাইতে বাইর হইছেন
ক্যান?
অর্থাৎ রাতের বেলা ছিনতাই করা জায়েয আছে।
আপনি বের হয়েছেন তাই ছিনতাইকারী ধরেছে।
এখানে অভিযোগের কিছু নাই।
তারপর জিজ্ঞেস করবে আপনার ডিটেইলস।
অবশেষে জানতে চাইবে -কি কি খোয়া গেছে?
যদি সামান্য কিছু বলেন তাহলে তাদের মুখ
কালো হয়ে যাবে। নিজেকেই অপরাধী মনে হবে। ঈশ
ছিনতাইকারীদের লস হয়ে গেল বুঝি! আর যদি বলেন অনেক
টাকা পয়সা জিনিসপত্র নিয়ে গেছে তাহলে দেখবেন
তারা কত কর্মঠ। সেগুলি উদ্ধারে ব্যাস্ত হয়ে যাবে।
জ্বী না আপনাকে এনে ফিরিয়ে দিতে নয়
ছিনতাইকারীর
কাছ থেকে তা পূণরায় ছিনতাই
করে নিজেরা ভাগবাটোয়ারা করে নিতে।
বলতে না বলতেই পুলিশ ভ্যানটা আমার কাছে এসে ব্রেক
চাপলো। জানালা দিয়ে একজন মুখ বের করলো।
ঠোঁটে সিগ্রেট। এইরেহ আমিতো সিগ্রেট ভুলে বাসায়
ফেলে এসেছি। এতক্ষন খেয়াল ছিলোনা। জ্বলন্ত সিগ্রেট
দেখে নেশা চাগিয়ে উঠলো। আচ্চা আমি যদি এখন
পুলিশের
ঠোঁট থেকে সিগ্রেটটা টান দিয়ে দৌড় দেই কেমন হয়?
একটা সিগ্রেটের জন্য নিশ্চই
গুলি করে দেবেনা বা গাড়ী ঘুরিয়ে আমার পিছু
নেবেনা!
নাকি চেয়ে নেব দুই একটা?
-এত রাইতে এইখানে কি করেন?
এরা সাধারণত আপনি দিয়ে শুরু করেনা। তুমি আর তুই
তাদের
পছন্দের সম্বোধন। পুলিশটাকে ভদ্রই মনে হচ্ছে। দুই
একটা সিগ্রেট চাইলে পাওয়া যেতে পারে।
-জ্বী আমার বিড়ালটা খোঁজে পাচ্ছিনা।
কেন যে বিড়ালের কথা মনে আসলো আল্লাহ জানেন।
তবে পুলিশ বেচারা খুব অবাক হলো।
-বিড়াল খোঁজতে বের হয়েছেন না অন্য কিছু?
-জ্বী না আর কিছুনা। শুধু বিড়াল। চুরি করে দুধ
খেয়েছিলো তাই মেরেছিলাম। অনেক অভিমান আমার
বিড়ালটার। রাগ করে চলে এসেছে। বড় মায়ার বিড়াল
আমার। মুখটাকে একটু অসহায় বানালাম। যদিও আমার
চেহারা আবছা আলোয় বুঝা যাচ্ছে কি না জানিনা।
তবে নিজের অভিনয়ে নিজেই মুগ্ধ। বিড়ালের
ঘটনা পুলিশ
ভাই পুরাই বিশ্বাস করেছে। অথচ বিড়াল আমার নেই। সেই
ছোটবেলা একটা বিড়াল ছিলো। সাদা ধবধবে ছিল।
মাথায়
ধূসর ছোপছোপ। কিন্তু নাম রেখেছিলাম রূপাই। পুরুষ বিড়াল
হলেও সৌন্দর্য ছিল রূপসী নারীর। সারাক্ষন ঘরের ভেতর
মিউ
মিউ করতো। কিছু ছুড়ে দিলে খেতোনা। রূপাইয়ের
আলাদা একটা প্লেট ছিল। ওর খাবার সেটায়
দেয়া লাগতো।
ক্ষুধা লাগলেই রূপাই তার প্লেটের পাশে ঘুরতো আর মিউ
মিউ করতো। আমরা কোথাও দুই একদিনের জন্য
বেড়াতে গেলে রূপাইর জন্য খাবার রেখে যেতাম।
একবার
প্রচন্ড বন্যা হলো। রূপাইকে খোঁজে পেলামনা কোথাও।
ভাবলাম পানিতে ভেসে গিয়ে রূপাই মারা গেছে।
আমি কান্নাকাটিও করেছিলাম। বন্যার
পানি নামলো দুদিন
পর। খুব ভোরে আমি স্বপ্ন দেখলাম রূপাই এসেছে।
আমাকে ডাকছে। ঘুম ভেঙ্গে গেলো। কিন্তু অবাক হলাম
মিউ
মিউ শুনে। পড়িমরি করে দরজা খুলে দেখি আমার রূপাই
এসেছে। ছোঁ দিয়ে ওকে কোলে নিলাম।
জীবনে এতো আনন্দের মূহুর্ত আমি কম পেয়েছি। কিন্তু সেই
রূপাইকেই একদিন বাড়ীর
সামনে মরে পড়ে থাকতে দেখি।
আর এর পর থেকে আমি কোন পোষা প্রাণী রাখিনা।
-আরে ভাই আপনি কাদতেছেন কেন? একটা বিড়ালের
জন্য
কেউ কান্নাকাটি করে এভাবে? তাও পুরুষ মানুষ।
বিড়ালতো আর মানুষ না রাগ
করে ট্রেনে করে পালিয়ে যাবে। যান যান খোঁজেন।
পুলিশের কথা শুনে আমি অবাক হলাম। গালে হাত
দিয়ে টের
পেলাম নোনা জলের অস্তিত্ব। আসলে পুলিশটা নতুন
সিগ্রেট
ধরাবার জন্য দিয়াশলাইয়ের কাঠি জ্বালাতেই আমার
চোখের জল আবিষ্কার করেছে। আর আমি রূপাইর
কথা ভাবতে ভাবতে সত্যি সত্যি কেদে ফেলেছি। এই
পুলিশটাওতো বুঝতে পারছেনা আজ আমার বিড়াল
হারায়নি। আমি মিথ্যা বলেছি। আমার রূপাই
আমাকে ছেড়ে চলে গেছে তাও প্রায় ১০-১২ বছর হবে।
কিন্তু
আজ কেন জানি আমার রূপাইর কথা বলতে খুব ইচ্ছে করছে।
-জ্বী না ভাই। আমার রূপাই অহ
আপনাকেতো বলিনি আমার
বিড়ালের নাম রূপাই। সে বড্ড বেশী অভিমানী ছিলো।
তাকে মারলে বা জোরে ধমকালে খেতে চাইতোনা।
দূরে দূরে থাকতো। একা একা বসে থাকতো।
দেখে মনে হত
অভিমানী কোন মানুষ গাল ফুলিয়ে কাদছে আর
বলছে আমাকে কেউ ভালোবাসেনা। কেউ আদর করেনা।
-আপনার বিড়ালটা কি মানুষ নাকি? পুলিশটা এবার
বিরক্তই
হল একটু। হবারই কথা। কত মানুষ সেকেন্ডে জীবন
হারাচ্ছে আর
এই পাগল এসেছে বিড়াল হারিয়ে মায়াকান্না করতে।
-মানুষ না হলেও মানুষের মতো ছিল।
-ভালো। আপনি এবার খোঁজেন ওরে। ঐ গাড়ী ছাড়।
-ভাই ভাই একটা কথা।
-কি?
-দুইটা সিগ্রেট দেয়া যাবে আমাকে? আমি বাসায়
ফেলে এসেছি।
লোকটা আরো বেশী বিরক্ত হল। কিন্তু সিগ্রেটের
প্যাকেট
হাতে নিয়ে দুইটা বেনসন বের করে দিলো।
মনে মনে ভাবলাম এত দামী দুইটা সিগ্রেট
দিচ্ছে টাকা অফার করবো নাকি। করেই দেখি।
-ভাই টাকাটা দেই?
-লাগবেনা। জ্বালাবেন কি দিয়ে? ম্যাচ লাগবে?
-জ্বী লাগবে।
বেহায়ার মতো হাসলাম। পুলিশের কাছ থেকে ১৮
টা টাকা খাওয়া চাট্টিখানি কথা না। সিগ্রেট
জ্বালিয়ে দিয়াশলাইয়ের বাক্স
ফিরিয়ে দিতে দিতে বললাম
-ধন্যবাদ ভাই। রূপাইকে পেলে আপনার কথা বলবো।
পুলিশ ভ্যানটি চলে গেল। আমি আবার হাটা শুরু করলাম।
মিনিট চারেক পর পুলিশ ভ্যানটি ফিরে এলো।
আমি তখনো দাড়িয়ে সিগ্রেট টানছি। নীল
ধুয়া কুন্ডলী পাকিয়ে গিয়ে ল্যম্পপোষ্টের আলোয়
মিশে যাচ্ছে।
গাড়ীটা আবার আমার কাছেই থামলো। প্রথমেই সেই
পুলশি অফিসার সামনের দরোজা খুলে বের হলো।
-আপনি আছেন এখনো? ভালোই হল। আপনার
রূপাইরে পাওয়া গেছে।
ভ্যানের পিছন থেকে দুজন পুলিশ নামলো। একজনের
কোলে একটা বিড়াল। হেডলাইটের আলোয় দেখলাম
বিড়ালটা সাদা তবে রূপাইর ধারে কাছেও যায়না এই
রং। মাথায় ধূসর ছোপও নেই। অফিসার হয়তো এত কিছু
খেয়াল করেনি আমি কি বলেছি।
আমাকে বিড়ালের
দিকে তাকিয়ে থাকতে দেখে পুলিশ
অফিসারটি বিশ্বজয়ী হাসি দিয়ে বললো
-বাড়ীতে নিয়ে খাওয়ান যান।
অভিমানে পালিয়ে এসে ক্ষুধায়
আবর্জনা খাচ্ছে দেখলাম।
আমি কি এখন অফিসারকে বলবো যে‚বিড়ালটা আমার
রূপাই না। রূপাই
আবর্জনা খায়না নাকি বলবো আমি মিথ্যা বলেছি?
বিড়ালটাকে রূপাই বলে এদের
কাছথেকে নিয়ে গেলে আমার রূপাইকে অপমান
করা হবে। হয়তো রূপাইর আত্মা কষ্ট পাবে।
আচ্ছা বিড়ালদেরও কি আত্মা থাকে? থাকতেই প্রাণে।
প্রাণ যেহেতু আছে আত্মা থাকতে সমস্যা কি!
বিষয়: বিবিধ
৯৮১ বার পঠিত, ০ টি মন্তব্য
পাঠকের মন্তব্য:
মন্তব্য করতে লগইন করুন