সাইকেল

লিখেছেন লিখেছেন আবু আঈশার ব্লগ ১২ জুলাই, ২০১৬, ১২:৪২:৪৩ দুপুর

বছর খানেক আগের পুরানো লেখা:

ছেলেবেলায় প্রথম সাইকেলটা পেয়েছিলাম আমার বড় ভাইয়ের কাছ থেকে। পুরোটাই নীল রঙের আর পিছনে একটা হেলান দেবার মত ব্যবস্থা সহ সিট ছিল তাতে । আমার বড় ভাই তার ক্লাস ফাইভের বার্ষিক পরীক্ষা শেষে উপহার হিসেবে সাইকেলটা পেয়েছিল আমার এক ব্যবসায়ী মামা থেকে। আব্বার অর্থনৈতিক অবস্থা তেমন খুব সুবিধার ছিলনা। খুব কষ্টে বাবা তার সামাজিক মর্যাদাটা "মধ্যবিত্ত" পর্যায়ে ঠেকিয়ে রেখেছিলেন আমার জন্মের সমসাময়িক সময়ে ধার দেনা দিয়ে বানানো একটা নিজের বাড়ি দিয়ে। এই অবস্থায় একটা সাইকেল যেনতেন কথা নয়। সম্ভবত সাইকেলটা যখন প্রথম আমাদের বাসাতে আসে, তখন আমি অল্প বয়সের কারণে ঈর্ষা ব্যাপারটা বুঝে উঠতে পারিনি। তাই কখনো ভাইয়ার সাথে এটা নিয়ে ঝগড়া হয়েছে বলে মনে পরেনা। এখন অবশ্য আমার ৪.৫ আর ২ বছরের আঈশা আর আব্দুল্লাহর মাঝেই যার পর নাই ঈর্ষা; কোনো একটা ব্যাপার নিশ্চয় পরিবর্তন হয়েছে।যাক, এই ব্যাপারে পরে কথা বলব। সাইকেল টা পাবার পর আমি সেটা নিয়ে ততটুকুই খুশি হয়েছিলাম যেমন টা নতুন কিছু পেলে কেউ খুশি হয়। অনেক দিন চালিয়েছিলাম সেটা। আমার যতটুকু মনে পরে, পরে সেটা আমার ছোট খালাত ভাইও চালিয়েছিল। ও কতটুকু খুশি হযেছিল সেটা না জানলেও একটা বিষয় পরিষ্কার। তখন হালের consumerism মধ্যবিত্তের সন্তানের ঘাড়ে এখনকার মত করে চেপে বসেনি। নতুন আর দামী জিনিসের চাহিদা এতটা তীব্র ছিলনা; আর জিনিসপত্র ও বেশ টেকসই ছিল। বছর ঘুরতেই (অথবা কিছু ক্ষেত্রে মাস শেষ হতে না হতেই ) নতুন জিনিস কেনার ইচ্ছা ছেলে বুড়ো সবার মাথায় জেকে বসতনা।

এরপর অনেক দিন চলে গেল। ক্লাস টেনে অথবা কলেজে থাকা কালীন আমার মাথায় আর একবার সাইকেল চালানোর শখ হয়েছিল। কিন্তু আমার মা (রাহিমাহাল্লাহ) কোনো ভাবেই আমাকে অনুমতি দেননি। আমি বড় ভাইয়ার ডাক্তারী পড়তে থাকা বন্ধুদের কাছ থেকে সাইকেল চালানোর অনেক উপকার জেনে এসে বললেও আমার মা এই ব্যাপারে একটা কথাই বলতেন, " তোমার নানা ভাই সাইকেল চালাতেন, তার হার্নিয়া ছিল। তোমার ছোট ফুপা সাইকেল চালান, তার ও একই অবস্থা। অতএব, সাইকেল কোনভাবেই তুমি চালাতে পারবেনা।" আলহামদুলিল্লাহ, আমি অসন্তুষ্ট হলেও কখনো এ নিয়ে মায়ের সাথে চেচামেচি করেছি বলে মনে পরেনা। বারবার কেবল রাজি করানোর চেষ্টা করতাম। পরে একই কথা লান্স আমস্ট্রং এর ব্যাপারে শুনে আমি সত্য মিথ্যা যাচাই না করেই সাইকেল চালানোর চিন্তা মাথা থেকে বাদ দিয়ে দিলাম।

এরপর আবার অনেক দিন গেল। আমার মা (রাহিমাহাল্লাহ) মারা গেছেন অনেক দিন হলো। আল্লাহ সত্যিই মানুষ কে এক দারুন নেয়ামত দিয়েছেন তার কষ্টের কথা ভুলে যাওয়ার ক্ষমতা দিয়ে! আমার মত মা নেওটা ছেলে এখন বাচ্চা-কাচ্চা, বউ নিয়ে এমন ভাবে সংসার করছি যেন এটাই খুব স্বাভাবিক। স্বাভাবিক তো বটেই। তবে খুব সুখের সময় (অথবা অন্য যে কোনো সময়) তার কথা মনে পড়লে তাকদীর কে মেনে নিয়ে আল্লাহ এর কাছে তার জন্য দোআ করার চেষ্টা করি। যাই হোক, সাইকেল ফিরে এসেছে। বেশ দারুন ভাবে ফিরে এসেছে। এবার বাধা এলো বাবা আর আঈশার মার কাছ থেকে। এইবার আর হার্নিয়া বিষয় নয়, সড়ক দুর্ঘটনা হলো নিষেধের কারণ। যাই হোক মার সাথে না চেচালেও বৌএর সাথে অধিকার বলে বেশ এক চোট চেচামেচি করেছি। কোনো ভাবেই মাথা থেকে সাইকেল বের হয়না। এ এক মহা সমস্যা। বুঝতে হবে, সেই ছোট বেলার আমি আর নেই। এখন আমিও consumerism গিলে ফেলেছি (smartphone কিনতে ৪০-৫০ হাজার টাকা খরচ না করলেও অফিস থেকে দেয়া ভাতা ব্যবহার করে ২০-৩০ হাজার টাকা খরচ করছি নিয়মিত। ইদানিং chinese ব্র্যান্ড এর ফোনে আসাতে সে খরচ একটু সহনীয় পর্যায়ে এসেছে। কিন্তু তাও বৈধ কিনা আল্লাহ ভালো জানেন )। নিজের নফসের সাথে যুদ্ধ করতে লাগলাম। এই সময় আমার ভায়রা একটা সাইকেল (৫-৬ হাজার টাকায়) কিনেই ফেলল আমাকে সাথে নিয়ে; আমি তাতেই কিছুদিনের জন্য ঠান্ডা হলাম। ভাবলাম, দেখি তার কয়দিন আগ্রহ থাকে? এটা দেখে নিজের ব্যাপারে একটা ধারণা পাওয়া যাবে। ওই সাইকেলটা কিছুদিন চালানোর পর সেই গ্যারাজেই পরে থাকলো।

ইতিমধ্যে বিডি সাইক্লিস্ট গ্রুপ গঠিত হয়ে ফেসবুক আর গ্রামীনফোনের পাবলিসিটি তে তা এক বিরাট লাইফ স্টাইল এ পরিনত হয়েছে। চারিদিকে সবাই সাইকেল কিনছে, বিভিন্ন সরঞ্জাম কিনছে, সাইকেল নিয়ে দূরপাল্লা ভ্রমনে যাচ্ছে, সে এক এলাহী কান্ড। কোনো এক কারণে আমি তখনও এর পিছনে ব্যয়কৃত অর্থের সম্পর্কে ধারণা পাইনি। কিন্তু এই ব্যাপারে আমার মনে প্রথম খারাপ ধারণা এলো ছেলে-মেয়ে একদল হয়ে সাইকেল নিয়ে ঘুরে বেড়ানো দেখে । বলাই বাহুল্য, এই concept ইসলামে নারীর পর্দার বিধানের বিরুদ্ধে একটা বিশাল দ্রোহ। খুব কষ্ট পেলাম। ভাবলাম, এখনো আমি সাইকেল চালালে কি লোকেরা আমাকে এদের একজনই ভাববেনা? সাথে পুরাতন এয়ারপোর্ট রোডে পিচ্চি থেকে শুরু করে যুবক ছেলেদের সাইকেল নিয়ে স্টান্টবাজি আমার মনে আরো খারাপ ধারণা তৈরী করলো। এর মধ্যে আমাদের নিজেদের (দ্বীনি ভাইদের )মধ্যেও সাইকেল নিয়ে হই হুল্লোর শুরু হয়ে গিয়েছে। কি কারণে ব্র্যান্ড এর সাইকেল কিনতে হবে তার পক্ষে আমরা বিভিন্ন যুক্তি খাড়া করছি। এই সময় আমার টনক নড়ল। দেখলাম, এই সাইকেলের দাম ১৫থেকে শুরু করে ৩০-৩৫ হাজার এমন কি এর অনেক উপরেও আছে। আমি ঠিক এদ্দুর দাম নিজ কানে শুনেছি বলে বললাম। এর চেয়েও বেশি; এমন কি লাখ টাকা দামী সাইকেলও আছে শুনেছি। আমাদের উত্তরা কেন্দ্রীয় জামে মসজিদ (যেটাতে কামালুদ্দিন জাফরী সাহেব খুতবা দেন) এর মুয়াজ্জিন আব্দুল লতিফ ভাই দিনের দিনের পর দিন সেই পুরনো দিনের ফিনিক্স ব্রান্ডের সাইকেল চালিয়ে বাসা থেকে মসজিদ আসা যাওয়া করছেন কোনো ঝামেলা বাদেই; উনার কোনো সাইকেল accessories এর প্রয়োজন হয়না অন্যদের মত; যেগুলোর দাম হয়ত সব মিলিয়ে তার সাইকেলটার চেয়েও দামী।। এই সাইকেল গুলো বংশাল গেলে বেশ অল্পতে হাজার ৭ এক টাকার মধ্যে পাওয়ার কথা। কিন্তু আমরা কোথায় চলেছি? কেবল বেশি টাকা দিয়ে কেনার ব্যাপারটা বাদ দিলেও এই উম্মাদনায় কি আমরা বিনা ভাবনায় যোগ দিতে পারি? যে আন্দোলনের সামনের দিকের লোকেরা ফোটোগ্রাফি আর ছেলেমেয়ে দল বেধে ঘোরাঘুরিকে শখ আর আনন্দ হিসাবে নিয়েছে, তাদের তকমাটা গায়ে লাগানোর আগে আমাদের বেশ কবার ভাবা উচিত। আমার একজন প্রিয় বন্ধু এবং দ্বীনি ভাই এমন একটা আড্ডাতে গিয়ে পরেছিল (আগে জানলে সেই হয়ত যেতনা)। সেখানকার বিডি সাইক্লিস্ট গ্রুপের সদস্যরা পুরো দাওয়াতের সময়টাই সাইকেল নিয়ে কথা বলল? অবশ্য এটা কতটুকু গুরুতর সেটা অন্তরকে জিকরুল্লাহ থেকে অন্য কিছুর দিকে ধাবিত করার ভয়াবহতা সম্পর্কে যারা জানেন, তারা বলতে পারবেন। একবার ভাবুন- আমরাই কি অর্থের অভাবে বাংলাদেশের অজপাড়াগায়ের মুসলিমদের ধর্মত্যাগের গল্প শুনে হতাশ হয়ে জিজ্ঞেস করিনা- কি করা উচিত? পৃথিবীর অন্যত্র মুসলিমদের কান্না আর অভাব দেখে আমাদের চোখে পানি আসে; কিন্তু আমরা বোধ হয় এই ব্যাপারে facebook , youtube এ শেয়ার করাটাকেই আমাদের ভার্চুয়াল করণীয় নির্ধারণ করেছি। আমাদের শখ বা বৈধ বিনোদন থাকা চলবেনা তা নয়; কিন্তু তা কি কখনো consumerism এর দোষে দুষ্ট হওয়া উচিত? পৃথিবীর সম্পদ আর প্রাচুর্যে আমরা মুসলিমরা হয়ে যাব সমুদ্রের নগণ্য ফেনার মত এমন ভয়ই কি রাসুল (সাHappy পাননি তার উম্মাহ কে নিয়ে? কিন্তু যেকোনো বৈধ জিনিস কেই বাড়াবাড়ি রকম ভোগ করে আমরা হারামের সীমানাতে ঘুরাঘুরি করি; এটা আমাদের বেশ পছন্দের। মুসলিমদের obesity এরকম একটা উদাহরণ। আল্লাহ আমাদের রক্ষা করুন।

আমার সাইকেল চালানোর ইচ্ছা পরিপূর্ণ কবরস্ত হওয়ার কথা দিয়ে শেষ করব। আমার কর্মস্থলের কাছের এক আবাসিক এলাকাতে একদিন বাড়ি ফেরার পথে দেখলম একজন বাহ্যত মুসলিমা সাইকেল চালিয়ে যাচ্ছেন। আমি এই বিষয়ে বর্ণনা দিতে চাই না; কিন্তু তার হিজাব ওই অবস্থায় তার জন্য যথেষ্ট হচ্ছিলনা। আমি চারপাশে তাকিয়ে দেখি সকলেই এই বোনের সাইকেল চালানো বেশ উপভোগ করছে; সাথে তার সৌন্দর্য। আশ্চর্য! আমরা কি এখনো পর্দার ফিকহ ই বুঝতে পারলামনা? অথচ কোর্সের পর কোর্সের সার্টিফিকেট জমে যাচ্ছে আর আমাদের দ্বীনের জ্ঞান পাহাড়সম হয়ে যাচ্ছে। সমস্যাটা বোধ হয় আসলে অন্য জায়গাতে। আল্লাহ আমাদের কে সকল বিষয়ে রাসুল (সা Happy কে আদর্শ হিসাবে নিতে বলেছেন; কিন্তু আমরা এই কথাটি আধুনিক যুগের প্রেক্ষাপটে বুঝে উঠতে পারিনি। আমাদের ভালো মন্দ, সাফল্য ব্যর্থতার সংজ্ঞা কখনই কাফিরদের সাথে মিলবেনা, কিন্তু আমাদের সকল চেষ্টা তাদের কাছে একটু প্রশংসিত হওয়াকে ঘিরে । এই বিষয়ে অতি পরিচিত দায়ী ইলাল্লাহ আব্দুর রহীম গ্রীন তার “ কোকাকোলা মুসলিম” নামের দারসে বলেছিলেন, “ওদের মত আমাদের সব কিছু চাই। সামনে আমরা বলব: ওদের ডেমোক্রেসি আছে, তাতে কি? আমাদের শুরাহ আছে; এটাও এক রকম ডেমোক্রেসি । ওদের পতিতাবৃত্তি আছে; তাতে কি; আমাদের বিয়েটাও প্রায় একরকম; আমরা তো মোহর দেই।” এছাড়াও আমাদের নারীরা যে দায়িত্ব পালন করে আল্লাহের কাছে মর্যাদায় আরো উচুতে উঠেন তা হলো মা, মেয়ে, স্ত্রী এসব। আর এসব দায়িত্ব পালন হলো কাফিরের চোখে মেয়েদের বন্দী দশা।কি করে আমাদের এই দুই পৃথিবী (মুসলিম আর কাফির)এক হতে পারে; আর খাদিজা (রাHappy, ফাতিমা (রাHappy, মারিয়াম(আHappy, আসিয়া (আHappy কে ছেড়ে নোবেল বিজয়ী রাজপথে রাজনীতি করে বেড়ানো তাওয়াক্কুল কারমানকে কি করে আমরা আমাদের মেয়েদের জীবনাদর্শ বানাই? যাই হোক, বেশ উল্লেখযোগ্য সংখ্যক মুসলিমাহ বোন নাকি ঢাকা শহরে প্রকাস্য দিবালোকে সাইকেল চালাচ্ছেন পরিপূর্ণ পর্দার সাথে (আমার স্ত্রী থেকে জানা)!!! সে কেমন পর্দা ঠিক বুঝে উঠতে পারলামনা! যে পর্দা পরপুরুষকে তার শরীরের অবয়ব বুঝার সুযোগ করে দিবে,তা সে যতই পুরু হোকনা কেন, তা যে পর্দা নয় তা বুঝতে কি আমাদের নতুন করে কোর্স করতে হবে? অবশ্য ওমর (রাHappy কে নিয়ে নির্মিত সিরিয়াল দেখার ফতোয়া দেয়ার যদি আলেম থাকে, তাহলে এই বিষয়ে ফতোয়া দেয়ার আলেম ও পাওয়া যাবে। আর আমাদের কাছে কোনো আলেমের গ্রহণযোগ্যতা এখন আর তার কোরান সুন্নাহ ভিত্তিক জ্ঞানের গভীরতা নয়; বরঞ্চ তিনি কত টুকু চেঞ্জ accomodate করেন সেটার উপর নির্ভরশীল। এসব দেখে শুনে আমার কাছে এখন সাইকেল চালানোটা একটা cult মনে হচ্ছে। এটা কিছুতেই মানতে পারছিনা। তাই আর বোধ হয় সাইকেল চালাবনা। আমার ভায়রার গ্যারেজে পরে থাকা সাইকেলটা আমাকে এক সময় দিয়েছিল।সাইকেলটা একটা দ্বীনি সংস্থার কাজে লাগিয়ে দিয়েছি অনেক আগে।

আমার এই লিখা কিছুতেই সাইকেলের ব্যাপারে হালাল হারাম ফতোয়া দেয়ার উদ্দেশ্যে নয়; আমি সেই যোগ্যতা রাখিও না। কিন্তু আমাদের trendy হওয়ার প্রবণতা আর হালের সব কিছুতেই গা ভাসিয়ে দেবার জোয়ার (যাতে আমি নিজেও দুষ্ট) আমাকে কষ্ট দেয় । মনে হয় আকীদাহ ঠিক করার পর ইবাদত গুলো খুব ভালো ভাবে পালন করলেও রাসুল সা : এর সাদামাটা জীবন আমাদের কাছে মোটেও আদর্শ নয়। তাই দিনের পর দিন আমাদের সাথে আমাদের গরিব মুসলিম ভাইদের পার্থক্য বাড়ে। নামাজে পায়ে পা লাগালেও আমাদের মধ্যে ঠিকই শয়তান বিভেদ তৈরী করে যায়। আল্লাহ আমাদের অর্থ সঠিক ভাবে এবং হালাল পন্থায় খরচের বুঝ দান করুন যাতে এই উম্মাহ তার কঠিন সময় পার করতে পারে।

আবু আঈশা

বিষয়: বিবিধ

১০১৫ বার পঠিত, ০ টি মন্তব্য


 

পাঠকের মন্তব্য:

মন্তব্য করতে লগইন করুন




Upload Image

Upload File