একদিন আমাদের আকাশ ছিল, আমাদের জমিন ছিল!
লিখেছেন লিখেছেন সরওয়ার ফারুকী ০১ জুলাই, ২০১৬, ১১:৩৮:০৪ রাত
১।
আমি নৈরাশ্যবাদী নই, বাস্তববাদী। নৈরাশ্য আসে শয়তানের পক্ষ থেকে, আর আশা আসে রহমানের পক্ষ থেকে; আমি রহমানের পক্ষেই- নিরপেক্ষ নই। কিন্তু বিশ্বাস করি: এ বিশ্বজগত নিয়মের অধীন, এ বিশাল জগৎসংসার আল্লাহ একটি নিয়মের মধ্যেই পরিচালনা করছেন। দিনরাতের আগমন-নির্গমনে রয়েছে সুনির্দিষ্ট শৃঙ্খল; জগতের তাবৎ আল্লাহপ্রেমীরা চাইলেও এ নিয়মের ব্যত্যয় হবে না দানা পরিমাণ।
মাখলুকের উপরেও রয়েছে তাঁর নির্ধারিত নিয়মাবলী। সততার জন্যে পুরস্কার- মিথ্যার জন্যে তিরস্কার, সুস্থ দেহ আনে বল, অসুস্থতা নিঃসন্দেহে নির্বল! কার্যকারণ ব্যতিরেকে এ ধরার কোন স্থানেই খরা নামে না- মানুষ হাহাকারে মরে না। ‘তোমাদের উপর যে বিপদ আসে তা তোমাদেরই হাতের কামাই- সূরা শুআরা। ‘মানুষের কৃতকর্মের জন্যে জলে-স্থলে বিপর্যয় ছড়িয়ে পড়ে, ফলে কোনো কোনো কর্মের জন্যে তাদেরকে শাস্তি আস্বাদন করানো হয়, যেন তারা সৎ পথে ফিরে আসে’ (সূরা রুম : ৪১)। 'ছোট-বড় যত দুর্ভোগ বা হয়রানি বান্দার ওপর আপতিত হয় সবই তার কর্মদোষে। আর অধিকাংশই আল্লাহ ক্ষমা করে দেন’- বুখারি।
‘আপনার যে কল্যাণ হয়, তা হয় আল্লাহর পক্ষ থেকে, আর আপনার যে অকল্যাণ হয়, সেটা হয় আপনার নিজের কারণে। হে রাসূল, আমি আপনাকে মানুষের জন্য পয়গামের বাহক হিসেবে পাঠিয়েছি। আর আল্লাহ তায়ালাই এর সাক্ষী হিসেবে যথেষ্ট।’ সূরা আন নিসা : ৭৯।
আয়াত সমূহ কার্যকারণের পক্ষে সুস্পষ্ট দলিল। এটা বৈজ্ঞানিকও। কেউই আশা করে না ধুতরাগাছে আঙুর ফলবে, আর কেউই বিশ্বাস করে না যে, পরিশ্রমের কোন পরিণামফল নেই!
২।
ঘুমের রাজত্বে আমাদের বাসঃ
চল্লিশ বছর ঘুমের রাজত্বে ছিল আমাদের বাস। এ চার দশকে পৃথিবী আপন কক্ষে পাড়ি দিয়েছে কয়েক কোটি সৌর-কি.লো। এ দীর্ঘ পথের নানা বাঁকে নানান পরিবর্তনের সাথে আমাদের ছিল না কোনই পরিচয়। মানুষ আকাশ থেকে মহাকাশে ছুটোছুটি করেছে, ঘরবাড়ি তৈরি করতে চাঁদেরে ভাগাভাগি করেছে, দূরত্বের দেয়াল ভাঙতে মানুষ হাতে হাতে বাকযন্ত্র পৌঁছে দিয়েছে। আমরা তখন- 'ঘুমের ঘোরেতে কেটেছে ফজর তখনো জাগি নি যখন জোহর/হেলায় হেলায় কেটেছে আসর মাগরিবের ঐ শুনি আজান অবস্থা!
আজ- ক্রসফায়ারের আওয়াজ, ট্রিগারের শব্দ, ভিনদেশী সিলেবাসের কর্কশ ফুঁৎকারে যখন আমাদের ঘুমঘোর ছুটোছুটি করছে, ততক্ষণে নিচের চাদর, উপরের কাঁথা কিছুই আর নিজহাতে নেই! এ দীর্ঘ সময়ে ওরা এসেছে, জাল পেতেছে, প্রতিটি বালিশের নিচে পুঁতেছে কামরূপ কামাইক্কার অসুরীয় বাণ। রাষ্ট্রের রন্দ্রে রন্দ্রে পেড়েছে অগুনতি ডিম; একেকটি ডিম থেকে পয়দিছে অগুনতি গুণধর পোনা! ওদের আনাগোনায় আজ রাতের নিস্তব্ধতা ভেঙে খানখান, নিরস্ত্র যুবকের আখেরি আর্তনাদ, অসহায় মায়ের 'ও বাছাধন' আহাজারি, অস্ফুট ধ্বনিতে হারিয়ে যাওয়া প্রেয়সীর প্রলাপ!
স্বাধীনতা রক্ষার আর কোনই সম্ভাবনা নেই-
"কোন সম্প্রদায় সম্পর্কে আল্লাহ যদি অশুভ কিছু ইচ্ছা করেন তবে তা রদ করার কেউ নেই। এবং তিনি ব্যতীত তাদের কোন অভিভাবক নেই।" (১৩:১১) আল্লাহর নির্ধারিত আজাব কোন অসাবধানী পথে আসে না, সবদিক গোছগাছ করেই আসে; যেন পালিয়ে যাওয়ার পথ না থাকে! আর কোন জাতীর জন্য গজবের সিদ্ধান্ত নিশ্চিত হলে তা ফেরানোর কোন পথ খোলা থাকে না।
মিরমদন, মোহনলালের খুনে যেদিন পলাশীরবন রঙিন হয়েছিল, সেদিন ভোরে পলাশীর খেতে অগুনতি বাঙালী কৃষক হাল চষেছিল- ধান, ভুট্টা, গমের আশায়! ইংরেজ ঐতিহাসিক তারই সরলোক্তি করেছেন কেতাবের পাতায় 'যদি ঐ কৃষকপাল পাথর আর লাঙলের ফলা নিয়ে সিরাজের পক্ষে দাঁড়িয়ে যেতো, তাহলে সেদিন একটা ইংরেজ সৈনিকও জীবন্ত ফিরে আসতো না- খেতের জমিনেই তাদের সলিলসমাধি হয়ে যেতো!' কিন্তু, আল্লাহর আজাব যাদের জন্য নির্ধারিত, তাদের কী আর রক্ষা করা যায়? মীরজাফর, রায়দুর্লভেরা গাধার মতো দাঁড়িয়ে থাকলো, খেতের জমিনে 'তুরররররর থিথিথি তাতাতাতাতা' করলো কৃষক পাল! সন্ধ্যায় গরু-ছাগলের সাথে কৃষকপাল যখন ঘরে ফিরলো, তার আগেই স্বাধীন-বাংলার লাল সূর্যটা অস্তমিত হয়ে গেছে দু'শো বছরের জন্যে।
এটাই আল্লাহর নির্ধারিত কৌশল; যখন যে যার উপযোগী হয় তখন তা নেমে আসে আজাব অথবা রহমতের ব্যানারে।
৩।
সভ্যতা বিনির্মাণের প্রাক্কালে এ জাতী বিশ্বাসঘাতকতা করেছে আপন সত্ত্বার সাথে। জাতীয় চেতনা, বোধ, বিশ্বাসের বিপরীতে জবরদস্তিমূলক উন্মাদনাকেই প্রেরণার উৎস বলে ঘোষণা করেছে। পূর্বে কেউ বলে নি, কেউ শুনে নি- এমন চারটি বিষবৃক্ষ রোপণের মধ্য দিয়ে লক্ষলক্ষ জীবনের সাথে প্রতারণার চরম প্রদর্শনী করেছেন পিতা আর চৌত্রিশ পিতর। লক্ষণসেন যে বিশ্বাস নিয়ে এ মাটি ছেড়ে পালিয়েছে, বিপরীতে বখতিয়ারি বিশ্বাস ধারণ করে যে জমিন আটশো বছর ধরে বিশ্বাসের, সাম্যের, ঐক্যের, দয়া-প্রেম-ভালবাসার প্রসাধ নির্মাণ করেছে; চারটি বিষফোঁড়া ক্রমাগত খাবলিছে তারই গতর।
পাথর-রড-সিমেন্টে বাঁধানো বেদিমূলে অর্ঘ্য নিবেদন, জবানের অধীকার আদায়ে শহীদদের স্মরণে জুতোহীন মৌনচলন- এসবের কিছুই চিনতো না এ জাতীর হাজার বছরের পূর্বপুরুষেরা। কোথা থেকে আসা কিছু বিকৃতমগজ-নিঃসৃত বিনোদনই আজ জাতীর ঈমান, জাতীর আকীদা!
তবে?
না।
এ বিপর্যয় রোধ হবে না, এ থেকে নিস্তারের কোনো পথ অবশিষ্ট নেই আর। বিরানভূমিতে উট-পানি হারানো দুর্ভাগার ধুঁকে ধুঁকে মৃত্যুই তার নিশ্চিত ভবিষ্যৎ। আগামী কয়েক বছর ইয়াজুজি জিব চেটে নিবে উদীয়মান তরুণ, কিনে নিবে সুশীল মগজ। রাতের অন্ধকারে শোনা যাবে আরো গোঙানি, আরো কাতর আওয়াজ, আরো আরো প্রিয়হারা প্রেয়সীর আর্তনাদ। বাইরের বাঘ-সিংহ-গণ্ডারের হামলা থেকে মানুষ নিজেকে, সমাজকে বাঁচিয়ে রাখতে পারে, কিন্তু দেহাভ্যন্তরে এককোষী ভাইরাস, কোষঘাতী কোষের হামলা থেকে বেরিয়ে অমরত্ব লাভ করতে পারে না। আমাদের ছাকরাতুল মউতের আখেরি আওয়াজ ভেসে আসছে- ঘোষণাই কেবল বাকী!
তবুও-
জাতী পরাধীন হয়, অনেকেই পরাধীন হয় না। দু'শো বছরের পরাধীন যুগে অধীনতা মেনে নেয়নি মজনু শাহ, তিতুমীর, দুদু শাহ, শরীয়ত উল্লাহ-রা। একটি মরা জাতীর মধ্যে থেকেও তরতাজা তারা, আকাশসম উচ্চতা ধারণ করে ঘুরেছে বনে-জঙ্গলে। লাঠিসোঁটা নিয়ে দাঁড়িয়েছে, আকস্মিক আক্রমণ করেছে, মেরেছে-মরেছে। আবারো তাঁদের দেখা মিলবে! আবারো জঙ্গী খুরের ঢেউ আসবে ঢাকা, চট্টগ্রাম, সিলেট, রাজশাহী, খুলনা, বরিশালের বন-জঙ্গল থেকে। কিন্তু তাদের আত্মাহুতি নিজেদের ঔজ্জ্বল্য ব্যতিরেক অন্য কিছুই হবে না। একটি নির্দিষ্ট সময়কালব্যাপী চলে শাস্তিদান কর্মসূচী। 'আল্লাহ কোন জাতীর অবস্থা পরিবর্তন করেন না, যতক্ষণ না তারা নিজেরাই নিজেদের পরিবর্তন না করে'- আল-কোরআন।
৪।
আশার উপর নৈরাশ্যের বিজয়দর্শী আমরা এক দুর্ভাগা প্রজন্ম। আমাদের সময়েই আমরা সাক্ষাৎ করছি পূর্বসূরিদের পরিণামদর্শন। 'ঘুম পাড়ানো মাসীপিসী' গানের বোল শুনে ঘুমিয়ে পড়া আমাদের প্রজন্মেই আমরা হয়ে গেছি অন্যের 'মালে গনিমত'!
নিজেকে রক্ষার, নিজেকে বাঁচিয়ে রাখার, নিজেকে নিয়ে ব্যস্ত থাকার নির্লজ্জ প্রচেষ্টা ব্যতীত এ প্রজন্মের হাতে আর কোন দান নেই; যদিও মাঝেমাঝে শুনি, "আমি আল্লাহ ব্যতীত আর কারো কাছে ক্ষমা চাইবো না", "নবুওতের দরজা বন্ধ হলেও শাহাদাতের দরজা এখনো খোলা", "আমাকে শেষ পর্যন্ত দৃঢ় দেখতে পাবে", অথবা "ফাঁসির মঞ্চে আমি কি পোষাকে যাবো প্রিয়তম" ধ্বনিরাগসমূহ ! আমার বুকে ওঠে এক অজানা ঢেউ, রূহে জাগে এক তর্জমাহীন শিহরণ!
বিষয়: বিবিধ
৯৩৯ বার পঠিত, ১ টি মন্তব্য
পাঠকের মন্তব্য:
মন্তব্য করতে লগইন করুন