কড়া (সত্য ঘটনা অবলম্বনে)
লিখেছেন লিখেছেন সরওয়ার ফারুকী ৩০ জুন, ২০১৬, ১১:১১:৩৪ রাত
কড়া'য় নাড়া আর কর্কশ কণ্ঠের আওয়াজে ঘুম ভেঙ্গে যায় ফয়সল মাহমুদের। গভীর রাতের মশারি ভেদ করে কে আসতে পারে? এমন প্রশ্ন ঘুরপাক খায় মাথারখুলি-তে। সদ্যলাগা কাঁচা ঘুমের আঁচ ভাঙ্গতেই আবারও ঠাশঠাশ শব্দ আর বিশ্রী ঘেউঘেউ! এতো রাত্রে দুটি প্রজাতিই আসতে পারে- একটি ডাকাত অন্যটি প্রহরী। প্রহরীর আওয়াজে থাকে বিনয় ডাকু'র আওয়াজে থাকে অর্ডার। এ স্বর তো অর্ডারের- মানে সোজা; ঘরে আজ ডাকাত পড়েছে! কাঁপাস্বরে ফয়সল প্রশ্ন করে- কে? তীব্র নিনাদে গালি দিয়ে বলে উঠে "পুলিশ, শালারপুত দরজা খুল।" পুলিশেরা একই সাথে দু'টি গোত্রেরই প্রতিনিধিত্ব করে! তারা প্রহরী- কারণ, সমাজকে ডাকাত থেকে নিরাপদ রাখার মহান পেশায় নিয়জিত। একই সাথে তারা ডাকাতও। কারণ সকলেই জানি ।
এবার আর অর্ডার নয়- দরজা ভাঙ্গার তোড়জোড় দেখে ফয়সল নিজেই খুলে দেয় শিটকিনি। হড়হড়ে বাঁধ ভাঙার আওয়াজ করে ঢুকে পড়ে একপাল পুলিশ।
ফয়সল মাহমুদেরা শহরের একটি বাসায় কয়েকজন মিলে মেস করে থাকে । কলেজ পড়ুয়াদের মেসে এমন কিছু থাকে না যে ডাকাত আসবে। মাঝেমধ্যে
ছিচকে চুরেরা টুঁ-মারে। কারো টুথপেস্ট কারো বা শার্ট খুয়া যায়। মাসের প্রথম দিকের চুরেরা অবশ্য কিছুটা লাভবান হয়- হাজার পনেরো'শ কপালে জুটে- এই যা।
ট্রিগারে টিপ রাখা অস্ত্রসজ্জিত বিশাল বাহিনীর ঘেরে বন্দি ফয়সল মাহমুদের ছোট্ট রুম। দেশের পুলিশেরা সেই এনালগ যুগে আর নাই! বুলেটপ্রুফ জ্যাকেট, হ্যামলেটেও নানাবিধ বনজ গাছগাছড়ার ঝাঁঝর, আর অলটাইম তাক করা সঙিন! এমন ভয়ঙ্কর মুহূর্তে রুবটিক ম্যানও ভয় পেয়ে যায়; আর ফয়সল তো এখনো নাবালকের তকমা ছেড়ে সাবালক হতে পারে নি। এখনও বাড়ি গেলে মায়ের পাশে ঘুমায়- আলগ ঘরের বাসিন্দা হয়ে উঠতে পারেনি। ফ্লাডলাইট-সার্চলাইটের আলোয় ছোট্ট মেসের প্রতিটা কক্ষ-ই ইউনিফর্মধারী ডাকু'রা তন্নতন্ন করে। কালিঘাট থেকে কিনা তিনশো টাকার খাটে লোহার পাত দিয়ে জোড়া দেয়া, অল্পবয়সী এক পুলিশ হ্যাচকা টানে সেটা ভেঙ্গে ফেললো।
ইউরেকা ইউরেকা বলে আরেকজন দাঁত কড়কড়ে ডাক দিল, স্যার স্যার! পেয়েছি! এই তো মহানাস্ত্র! এটোমিক বুম, হাইড্রোজেন বুম- সবই বানানো যাবে এই মারাত্মক রকম রড দিয়ে! ইউ.কে-ফেরত নবাগত কয়েকজন পুলিশের নেয়া আছে কুকুরের ট্রেনিং। খুবই ক্ষিপ্র; চোখেরা তীক্ষ্ণ আর আঙারময় । এদের একজন ফয়সল মাহমুদের নতুন কেনা কিছু বই ছিঁড়তে গিয়ে লাফিয়ে ওঠে ! অম্ল-ক্ষারের মাত্রাচিত্র দেখতেই নাঁক ঘষে দেয় বইয়ের পাতায় ! এখানেই হ্যাণ্ডগ্রেনেডের সূত্র- ছবিসহ বাতলিয়ে দেয়া হয়েছে! কুত্তা-ট্রেনিং সূত্রানুসারে এ-ই আবিস্কার করে পুলিশপালেরা। সমস্বরে 'জয় জয়'
আর বিস্ময়কর ট্রেনিং দেয়ার ফজিলত হাতেনাতে পেয়ে আনন্দে বাকবাকুম-বাকবাকুম! পুলিশপালেরা ব্রহ্মাণ্ডে আণ্ডা পাড়ার আনন্দে তাধিন-ধিন নাচে !
ফয়সল মাহমুদেরা যে ক'জন একসাথে মেস করে দিনগুজরান করছে, তাদের সবাই গ্রাম থেকে আসা। গ্রামের কাঁদামাটির মতো সহজসরল তাদের চিন্তা-চেতনা। নানানরকম আজগুবি শব্দ দিয়ে মোড়ানো নয় তাদের মুখর। স্কুলবেলায় তাদের গ্রামে কখনো পুলিশ দেখেনি। শুধুমাত্র নির্বাচনের সময় কেন্দ্র পাহারাদার হিসেবে গুটিকয় পুলিশ আসে গ্রামের স্কুলে- এর বাইরে পুলিশের সাথে তাদের আর কোন মোলাকাত নেই। সেই অবুঝের সামনে আজ সশস্ত্র লহর-বহরের উন্মাদ ভুমিকম্প দেখে পাথর হয়ে গেছে তার চোখ; তার উপর জীবনে প্রথমবারের মতো শুনা হ-য-ব-র-ল জাতীয় নানার প্রশ্নবাণ!
এই শালা তোর মোবাইল দেয়! এক পুলিশ রেড-চোখে জিজ্ঞাসে। মোবাইল কোথায় রেখেছে মগজ থেকে ডিলেট হয়ে গেছে ইতোমধ্যে এখানে খুঁজে, ওখানে হাত দেয়। প্যান্ট ভেবে লুঙ্গিতে হাত ঢুকাতে চায়! দেখে পকেট নাই! অভ্যাস মোতাবিক শার্টের পকেটে হাত দেয় ফের; আরে, এ তো গেঞ্জি! পকেট কোথায়! অভিনয় করো? বুঝি! আমরা সবই বুঝি! বোকা ভেবেছো আমাদের ? ঠকাতে চাও শালা- বলে ক্ষেপে যায় কুত্তাট্রেনিংধারী একজন। আরেকজন নিজেই খুঁজা শুরু করে! রশিতে ঝুলানো প্যান্টের পকেটে পাওয়া যায় দুলাভাইয়ের দেয়া নতুন স্যামসাং মোবাইল।
নিশ্চিত বিদেশি কানেকশন! নইলে ছাত্রাবস্থায় বিদেশি মোবাইল আসে কিভাবে? এমন প্রশ্ন অফিসার গোছের মোছওয়ালার! বাকরুদ্ধ ফয়সল মাহমুদ কিছুরই উত্তর দিতে পারে না।
মোবাইলের সাথে মোড়ানো একটি সাদা কাগজের উপর পাঁচসাতজন হ্যালমেটি হুমড়ে পড়ে। 'ঘোষণা' শিরোনামে সরওয়ার ফারুকীর লিখা একটি ছোট্ট কবিতা এতে লিখা ।
ঘোষণা
একটি বারের জন্যে যদি দাঁড়াতে পারতাম
বিশ্বমঞ্চে আমি!
আর জমাবেশ হতো মানুষসহ পৃথিবীর
তাবৎ প্রাণিকুল।
না!
আমি দীর্ঘ কোনো ভাষণের করি নি প্রতিজ্ঞা
ক্ষণিকের জন্যে আমি একটি ঝিলিক শুধু
একটি শব্দের প্রত্যয়ে গড়া জিন্দেগীর যত
সমস্ত সঞ্চিত জোয়ানির জোরে করে ফুঁৎকার,
একটি উচ্চারণের জন্যে ব্যাকুল-
কেঁদে কেঁদে আমি সহস্র বর্ষ,
সহস্র সহস্র মাস!
যদি একটি মুহূর্তের জন্যে তামাম সৃষ্টিকুল
জমা হতো কোনো ময়দানে-
আর আমি- একটি ঝিলিকের জন্যেও,
শুধু একটি আওয়াজের পেতাম সুযোগ
আমি ভীষণ নিনাদে ভয়ঙ্কর আওয়াজে
ইসরাফিলী সুরে বক্ষ দিতাম খুলে!
একটি উচ্চারণের জন্যে ব্যাকুল আমি পিঞ্জর ছিঁড়ে
আখেরি আর্তনাদে বলে দিতাম-
“হে বিশ্বকুল জেনে রাখ,
আমি এক মৌলবাদী মুসলিম।”
কবিতাটি গতকাল বিকেলে ফেইসবুক থেকে নোট করে রেখেছিল ফয়সল। কেন জানি কবিতাটির মধ্যে স্পষ্ট উচ্চারণ এবং এক বিপ্লবী গন্ধ পেয়েছিল সে । তাই পড়ার ফাঁকে অনেকটা খেয়ালের বসে ছোট্ট এই কাগজে নোট করে পকেটে রেখে দেয়।
এতক্ষণে পুরা পুলিশপাল আগুন হয়ে যায়! কোন কথা নেই- শুধু ফুঁসে ওঠা ঘ্যাগরানো গলার আওয়াজ।
ফয়সল মাহমুদের চুলে ধরে টান দেয় এক পুলিশ। হাতে লোহার চুড়ি পরায়! সদ্য ডিঙিয়ে এসেছে এস.এস.সি-র দেয়াল এমন কয়টি কচিমুখসহ সকলেরে ধরে নিয়ে যায় ক'প্লাটুন সশস্ত্র পুলিশপাল। শেষ রাত্রির পাশে পেঁচার স্বর, কুকুরের ঘেউঘেউ আর গাড়ি'র হর্ণ একাকার হয়ে যায়। কোনটি কার আওয়াজ পাঠ করা যায় না।
পরদিন পত্রিকার পাতায় হেডিং হয়- "শহরের ছাত্রাবাস থেকে দুর্ধর্ষ সাত জঙ্গি গ্রেফতার।"
বিষয়: বিবিধ
১৪৯৫ বার পঠিত, ১ টি মন্তব্য
পাঠকের মন্তব্য:
মন্তব্য করতে লগইন করুন