হঠাৎ আলোর ঝলকানি লেগে ঝলমল করে চিত্ত

লিখেছেন লিখেছেন সরওয়ার ফারুকী ৩০ জুন, ২০১৬, ০৭:৪৩:৩০ সকাল

মাধ্যমিকের আঙিনায় ছুটোছুটি করার বয়স থেকেই 'মাসিক মদিনা'-র সাথে পরিচয়। অবশ্য পড়ে নয়, দেখে। প্রবাস ফেরত বাবা'র অবসরের সাথী 'মাসিক মদিনা' । একসময় নিজেও পড়তে শিখলাম, জানতে পারলাম । ততক্ষণে মুখস্থ হয়ে গেছে দুটো নাম : 'মাসিক মদিনা' আর 'মুহিউদ্দীন খান', প্রাণের আকাশে গেঁথে যাওয়া আরেকটি শিরোনাম 'প্রশ্নোত্তর পর্ব'। এভাবেই কৈশোরে পাঠ্যবইয়ের পাশাপাশি আমার চিন্তাজগতের চরম নিয়ন্ত্রণ মাসিক মদিনার হাতে। স্কুলপড়ুয়া আমার গায়ে ওঠে পাঞ্জাবি-পাজামা-টুপি, অভ্যাসে ভর করে আলেম-উলামার আদত- এ আমার জীবনের পুঁজি, এ-ই আমার আখেরি উত্তরণের একমাত্র পাথেয়; এ আমার একীন। আনাস ইবনু মালিক থেকে বর্ণিত,

সাহাবী জিজ্ঞাসা করলেনঃ ইয়া রাসূলুল্লাহ ! কিয়ামত কখন ?

রাসুল (সঃ) বললেনঃ তুমি তার জন্যে কি সঞ্চয় করেছ?

আমি খুব বেশী সালাত, সওম অথবা সাদাকা আদায় করতে পারিনি। কিন্তু আমি আল্লাহ আর আল্লাহর রাসুলকে খুব ভালবাসি।

রাসুলুল্লাহ (সঃ) উত্তর দিলেন : যাকে ভালবাসো, তুমি তো তারই সঙ্গী হবে।

এ ভালবাসা এক মহা পুঁজি, এ ভালবাসা সঙ্কট উত্তরণে শক্তসোপান ।

গত শতাব্দীতে দু'জন মনিষী বাঙালি মুসলিম সমাজে অসম্ভব জনপ্রিয়তা অর্জন করেছেন । সম্ভবত এমন কোনো বাঙালি মুসলিম কর্ণ নেই যা একজনের আওয়াজ শুনেনি, এবং এমন কোনো বাঙালি মুসলিম পরিবার নেই যেখানে অপরজনের কলম প্রবেশ করেনি। একজনের আওয়াজ এবং অপরজনের কলমকে আল্লাহ এমনভাবে কবুল করেছেন যা ভৌগলিক সীমারেখা ছিড়ে ফেলেছে। আল্লাহ তাদের সকল কাজের সর্বোত্তম বিনিময় দিন।

২০০৮ সালে যখন মদিনা ভবনে এ মহীরুহের মুখোমুখি হই, তখন আমার হাতে "মরমি কবি ইবরাহিম তশ্না ও অগ্নিকুণ্ড গানের সংকলন" গ্রন্থের খসড়া পাণ্ডুলিপি। 'আছছালামুয়ালাইকুম' বলে হুজুরের মুখোমুখি হতেই, ইঙ্গিতে আমায় বসতে বললেন । দশ/বারো মিনিট পর হাতের কাগজ টেবিলে রেখে প্রশ্নাত্মক চোখে তাকালেন। সংগৃহীত পাণ্ডুলিপির লক্ষ্য-উদ্দেশ্য পেশ করলাম। আমার বক্তব্যে ছিল ইবরাহীম তশনার জীবন-কর্মের ব্যাপকতা বুঝানো এবং তাঁর মরমী-কবিতার উচ্চাঙ্গতা প্রমাণ করা ! তারপর দরখাস্ত পেশ করলাম, "হুজুর, কষ্ট করে সংক্ষেপে হলেও একটা অভিমত দিতেন তাহলে আমরা........।"

'দেখি' বলে টাইপিং পাণ্ডুলিপি হাতে নিয়ে খানিকক্ষণ চোখ বুলিয়ে মুচকি হেসে বললেনঃ আমি তো অসুস্থ মানুষ, তাছাড়া হাতে সময়ও নেই। আমি দুই বার ইবরাহীম তশনা (র.)-র মাজার জিয়ারত করেছি।

বাড়ি সংলগ্ন মাজার না?

জি, হুজুর।

আরো বললেন: ইবরাহীম তশনা (রঃ)-কে আমি জানি। বিশ/পঁচিশ বছর পূর্বে আমি বাংলা একাডেমী বরাবর দু'বার লিখিত আবেদন করেছি, আল্লামা ইবরাহীম আলী তশনার সংগ্রামী জীবন ও তার মরমী গান আছে, এগুলো উদ্ধার করার জন্য, ইসলামিক ফাউণ্ডেশনেও লিখিত দিয়েছি, কিন্তু কে শুনে কার কথা।

আচ্ছা, তুমি যদি কাজটা সম্পন্ন করো তাহলে আমি 'মদিনা পাবলিকেশন্স' থেকে ছাপবো এবং তুমাকে রয়েলিটি দিবো !-আর উনার নাম ইবরাহীম আলী তশনা 'ইবরাহীম তশনা' নয়! এমন খুঁটিনাটি পর্যন্ত জানা আর বিস্ময়কর মন্তব্যে আমি সম্বিৎহারা!

ইবরাহীম তশনার ব্যাপারে তাঁর অবাক-করা উৎসাহ আমাকেও যেনো ছাড়িয়ে যায় । তাঁর উৎসাহের আরো প্রমাণ পাই ২০০৮/৯ সালে জকিগঞ্জ তাফসীর মাহফিলের বয়ানে, যেখানে তিনি বয়ানের শুরুতেই ক্ষোভ প্রকাশ করেন আমাদের সাহিত্য ও জাতীয় পাঠ্যসূচীতে ইবরাহীম তশনার অনুপস্থিতির জন্যে ।

এখানে বলে রাখা ভাল, স্বাধীনতা সংগ্রামী, সমাজ সংস্কারক ও মরমি কবি ইবরাহীম আলী তশনার জীবন-কর্ম ও তাঁর সঙ্গীত নিয়ে একটি সংকলন সম্পাদনার ইচ্ছা থেকেই আমার এ উদ্যোগ। আমার নিয়ত ছিল, যদি কোনদিন টাকাপয়সা হয় তবে বইটি প্রকাশ করবো, কারণ ২৬০০/= টাকা বেতনের চাকুরী দিয়ে বই প্রকাশের খোয়াবও দেখা যায় না। কিন্তু, এ মনীষার কর্ম ও রচনাবলীর অনুপস্থিতি আমার হৃদয়কে প্রচণ্ড ব্যথাতুর করে রেখেছিল। এজন্য দূরকালব্যাপী একটি লক্ষ্য নির্ধারণ করে রেখেছিলাম! স্বপ্ন ছিলো এমন; আগামী দশ বছর যদি একটু একটু করে টাকা জমিয়ে রাখি, তাহলে হয়তো বইটি প্রকাশ করতে পারবো, আর যদি আমার হায়াতে সম্ভব না-ও হয় তাহলে অন্তত প্রকাশযোগ্য একটি পাণ্ডুলিপি তৈরি করে রাখি, ভবিষ্যতের কেউ একজন হয়তো প্রকাশ করবে, জাতী জানবে এ মনীষার জীবন-কর্ম । প্রকাশযোগ্য প্রস্তুতি নিয়ে রাখলে তাদের আর কষ্ট করতে হবে না। এমন একটি স্বপ্ন থেকেই হুজুরের অভিমত আদায় করতে আমার ঢাকা গমন।

প্রায় দু'মাস পর বাংলাবাজার মদিনা ভবনে যখন তাঁর হাতে প্রস্তুতকৃত পাণ্ডুলিপি তুলে দেই তখন একুশে বইমেলা আগত, ২০/২৫ দিন বাকী। পাশের রুমে কর্মরত একজনের নাম বলে উনার কাছে পাণ্ডুলিপি দিয়ে আসতে বললেন। উনি আমাকে কিছু প্রক্রিয়ার কথা জানালেন: প্রুফ দেখতে কতদিন, প্রেসে কতদিন, তারপর বাঁধাইসহ নানাবিধ সময়সাপেক্ষ প্রক্রিয়া সমূহের কথা।

ঠিক আছে, আমি তো এতসব জানি না। যেভাবে নিয়ম আছে তা তো আর ভাঙা যাবে না, যেখানে প্রক্রিয়াপদ্ধতি নিঃসন্দেহে যৌক্তিক- এমন বলে হুজুরের রুমে এলাম । মনে কিছুটা শঙ্কাও দানা বাঁধলো !

উনি কি বললেন? আমাকে হুজুরের প্রশ্ন।

তিনি বলেছেন দেখবেন, বড় বই তো প্রুফ দেখায় সময় লাগতে পারে।

কি! আমি কি না-দেখে দিয়েছি! বলেই হুজুর ক্ষেপে গেলেন। অফিসের একজনকে দিয়ে পাণ্ডুলিপি ফেরত আনালেন। আমিও ভড়কে গেলাম!

আমাকে বললেন "তুমি এক কাজ করো, আমাদের এখানে তো প্রচণ্ড ব্যস্ততা, বইমেলার কাজ চলছে, তুমি ট্রেসিং বের করে নিয়ে আসো, আমি তোমার খরচা দেবো, তাহলে বইমেলায় বের করা সম্ভব।" সপ্তাহান্তে ট্রেসিং আউট করে হুজুরের হাতে তুলে দিলাম এবং তাঁর চোখেমুখে আনন্দের ঝিলিক দেখলাম। সেদিনই হুজুরের ছেলে মোর্তাজা বশিরুদ্দীন খানের হাতে ট্রেসিং দিয়ে বললেন, 'আমি উনাকে দিয়ে খুব উৎসাহ নিয়ে কাজটা করিয়েছি, এ কাজটা আমার দীর্ঘদিনের স্বপ্ন ছিল, কেউ করেনি। বইমেলায় বের করতে যা যা করা দরকার করো। এভাবেই একটি শুকনো বীজকে আল্লাহ প্রস্ফুটিত করলেন '১৫ফেব্রুয়ারি, একুশে বইমেলা ২০০৯'-এ।

অতঃপর অনেক কথা দু'য়ে। জৈন্তা অঞ্চলের হারিয়ে যাওয়া আলেমদের ওপর একটি সংকলন তৈরি করতে তাগাদা দিলেন। দুঃখপ্রকাশ করলেন অনেককেই দায়িত্ব দিয়েছিলেন যদিও, কিন্তু কাজের কাজ কিছুই হয় না, খালি রাহমতুল্লাহি আলাইহি লিখে- বলে হাসলেন ! প্রতিলাইনে দু/তিনবার রাহমাতুল্লাহি আলাইহি, সার নাই কিছুই। মুসলিম বাংলার সামাজিক-ইতিহাস সংকলিত নেই বলে তাঁর প্রাণে প্রচণ্ড ব্যথা । এ শূন্যতা আমাকেও ব্যথাতুর করলো।

তারপর সিলেটে প্রকাশনা অনুষ্ঠান হলো, তিনি এলেন, অনেক অজানা কথা বললেন। কেন্দ্রীয় মুসলিম সাহিত্য সংসদের প্রতিষ্ঠাতা মৌলভী নুরুল হকের অপ্রকাশিত রচনাবলি 'মদিনা পাবলিকেশন্স' থেকে প্রকাশের ঘোষণা দিলেন (এর অগ্রগতি স্পম্পর্কে আমার জানা নেই, প্রবাস থেকে সব খবর জানাও যায় না।)

সেই থেকে তাঁর স্নেহাশিস অবিরত বর্ষেছে এ নগন্যের ওপর। সামনে যেমন চিনতেন, ফোনেও তেমনি। সিলেটের নামজাদা প্রবীণ এক লেখক স্বরচিত একটি বইয়ের ব্যাপারে হুজুরের সাথে আলাপ করলেন এবং মদিনা পাবলিকেশন্স থেকে তার একটি বই প্রকাশ হোক এমন স্বপ্নের কথা জানালেন। জবাবে 'সরওয়ার ফারুকী-র সাথে যোগাযোগ করবেন' (!) এমন জওয়াব শুনলে আমার দেহ প্রচণ্ড ঝাঁকুনি খায় । আমি দায়িত্বে অবহেলার অপরাধে অপরাধী হই ।

এমন ব্যক্তিত্বের ঋণ একটি জাতী-ই শোধতে পারে না, আমি কেমনে শোধি ! দোয়া দোয়া দোয়া ছাড়া আমার/আমাদের হাতে আর কিছু নাই ।

যে জাতি 'আসমাউর রিজাল' শাস্ত্রের জনক, সে জাতীর হাতের কলম আজ নিখোঁজ ! বাংলাভাষায় যে মুজাহিদ এ কলম ফিরিয়ে আনার লড়াই শুরু করেন তিনি মাওলানা মোহাম্মাদ আকরম খাঁ। এবং এ কাজকে যিনি দক্ষতার হাতে বাংলার ঘরে ঘরে পৌঁছে দেন, ঘুমন্ত জাতীকে আবার জাগিয়ে তুলতে নকীবের ভূমিকা পালন করেন, তিনি মাওলানা মুহিউদ্দিন খান (র.)। আমরা সাক্ষ্য দিচ্ছি তিনি হক, আমরা দোয়া করছি 'আল্লাহ তাঁর সকল খেদমত কবুল করুন', আমরা শপথ করছি "তাঁর অপূর্ণ কাজের পূর্ণতা দান করবই"- আল্লাহ আমাদের তৌফিক দিন ।

বিষয়: বিবিধ

১১৭৬ বার পঠিত, ০ টি মন্তব্য


 

পাঠকের মন্তব্য:

মন্তব্য করতে লগইন করুন




Upload Image

Upload File