জঙ্গি বনাম চরমপন্থী
লিখেছেন লিখেছেন ওবাদা বিন সামেত ২৮ আগস্ট, ২০১৭, ০৬:৫৩:৫৪ সকাল
জঙ্গি শব্দটি অতীতে কোন মন্দ বা নেতিবাচক শব্দ ছিল না। উৎপত্তিগত অর্থে জঙ্গ শব্দের অর্থ যুদ্ধ বা war। আর জঙ্গি অর্থ যোদ্ধা বা warrior। মুসলিম ইতিহাসের কোন কোন গৌরবময় সুলতান নিজের নামের সাথেও 'জঙ্গি' উপাধি ব্যবহার করেছেন। যুদ্ধ জিনিসটা ভালো ও মন্দ দুই রকমই হতে পারে। অন্যায় যুদ্ধ হলো নিরপরাধ মানুষের উপর হানা দেয়া, আর ন্যায় যুদ্ধ হলো মানুষের উপর অত্যাচার বা অন্যায় যুদ্ধকে প্রতিহত করবার জন্য অন্যায়কারী হানাদারদের বিরুদ্ধে পদক্ষেপ গ্রহণ করা। আবার সেই ন্যায় যুদ্ধটাই যখন নিছক নিজের পার্থিব স্বার্থের জন্য না করে আল্লাহর সন্তুষ্টি, দ্বীনের প্রতিষ্ঠা ও মানুষের কল্যাণের জন্য করা হয়, তখন তাকে বলা হয় জিহাদ। অপরদিকে চরমপন্থা হলো কোন ব্যাপারে নিজের লক্ষ্য হাসিলের জন্য নিষ্ঠুর ও অযৌক্তিক পন্থা গ্রহণ করা, ন্যায়-নীতি ও মানবিকতার সীমা অতিক্রম করা। সীমালংঘনকারীদেরকে অপছন্দ করবার কথা আল্লাহ তাআলা কোরআনে বারবারই উল্লেখ করেছেন। চরমপন্থী হলো তারা, যারা কোন আদর্শের প্রতিষ্ঠা বা অন্যায়ের প্রতিশোধ গ্রহণের নামে যুদ্ধ করতে গিয়ে বা যুদ্ধ ছাড়াই নিরপরাধ মানুষের উপর নৃশংসতা চালায়, কিংবা অপরাধীর শাস্তি প্রদানের ক্ষেত্রেও বাড়াবাড়ি করে; যারা শাস্তিযোগ্য নয় তাদেরকে শাস্তি দেয় কিংবা শাস্তিযোগ্য ব্যক্তিদেরকেও প্রাপ্য শাস্তির তুলনায় বহুগুণ বেশি শাস্তি দেয়। আর এই চরমপন্থী কাজ কেউ আল্লাহর সন্তুষ্টি বা মানবকল্যাণের নিয়তে করে থাকলেও সেটাকে জিহাদ বলা যাবে না, বরং ফাসাদ বলেই গণ্য করতে হবে।
এছাড়া যুদ্ধ বা জঙ্গ সংক্রান্ত আরো একটি term রয়েছে, তাহলো 'যুদ্ধবাজ' বা warlord। যুদ্ধবাজ বলতে তাদেরকে বোঝায়, যুদ্ধ করাটাই যাদের নেশা ও পেশা। ক্ষমতার জন্য, আপন গোত্রের জন্য, আদর্শের জন্য, সম্পদের জন্য, খ্যাতির জন্য বা যেকোন উদ্দেশ্যে যুদ্ধ করাটাই যাদের সার্বক্ষণিক কাজ, যুদ্ধ না করে যারা এক মুহুর্ত সুস্থে থাকতে পারে না, তারাই যুদ্ধবাজ। যুদ্ধের কোন বিকল্প অপশন এরা রাখে না, প্রয়োজন হোক বা না হোক যুদ্ধটাই হয়ে থাকে এদের একমাত্র choice। যুদ্ধবাজরা ন্যায় যুদ্ধেও জড়িত হতে পারে, আবার অন্যায় যুদ্ধেও লিপ্ত হয়ে পড়তে পারে। এরা অনেকটা আলাদীনের দৈত্যের মত- কাজ পেলে কাজ করে দেবেন, না পেলে ঘাড় মটকাবে।
যাহোক, জঙ্গিবাদের উপরে বর্ণিত সংজ্ঞা মোতাবেক জঙ্গি মানেই খারাপ একথা একবাক্যে বলা যায় না; বরং জঙ্গি ভালো ও মন্দ দুই রকমই হতে পারে। জঙ্গি মানে যুদ্ধরত পক্ষ। আভিধানিক অর্থে বিচার করলে যেকোন রাষ্ট্রীয় সেনাবাহিনী কিংবা রাষ্ট্র বহির্ভূত গেরিলা বা অস্ত্রধারী বাহিনী সকলকেই জঙ্গি বলা যায়। শুধু 'জঙ্গি' শব্দের দ্বারা কাউকে খারাপ বলা যায় না, তা সে কোন দেশের সরকারী বাহিনী হোক বা বিদ্রোহী বাহিনী হোক। বরং জঙ্গি হলো একটি নিরপেক্ষ শব্দ। কোন জঙ্গি (কোন দেশের সরকারী সৈন্য বা বেসরকারী যোদ্ধা) যখন জঙ্গ (যুদ্ধ) করতে গিয়ে ন্যায়নীতি ও মানবিকতার পরিপন্থী কাজে লিপ্ত হয়, মানবাধিকার লংঘন ও বাড়াবাড়ি করে, তখন তাকে বলা হয় চরমপন্থী বা সীমালংঘনকারী। অতএব, জঙ্গি ভালো ও মন্দ দুই রকমই থাকে, তবে চরমপন্থী মাত্রই মন্দ হয়ে থাকে। তাই কোন ব্যক্তি বা দল ও গোষ্ঠীকে সম্পূর্ণ মন্দ অর্থে বোঝাতে চাইলে তাকে জঙ্গি না বলে চরমপন্থী নামে অভিহিত করাই যুক্তিযুক্ত। অথচ মজার ব্যাপার হলো, বর্তমানে যারা কমুনিজমের নামে কিংবা অন্য কোন ধর্ম বা আদর্শের নামে নিষ্ঠুরতা ও অমানবিক কর্মকাণ্ডে লিপ্ত হয়, তাদেরকে চরমপন্থী বলা হয়। কিন্তু যারা ইসলামের নামে বর্বরতা ও নারকীয় কর্মকাণ্ডে লিপ্ত হয়, তাদেরকে বলা হয় জঙ্গি। তার মানে কমুনিজম কিংবা অন্য কোন ধর্ম বা মতাদর্শের নামে অস্ত্র ধারণ, সশস্ত্র দল বা বাহিনী গঠন, সশস্ত্র তৎপরতা পরিচালনা ও যুদ্ধ-বিগ্রহে লিপ্ত হওয়াটা দোষের কিছু নয়- শুধু তাদের মধ্যকার কিছু বাড়াবাড়ি ও অপকর্ম নিন্দনীয়। চরমপন্থী হবার criteria নির্দিষ্ট ও সীমিত হওয়ায় কিছু চিহ্নিত গোষ্ঠীর কর্মের দায় বহনের আশংকা থেকে পৃথিবীর তাবত কমুনিষ্টগণ বেঁচে যায় এবং অস্ত্রসজ্জিত হওয়া, রণপ্রস্তুতি গ্রহণ ও প্রয়োজনে (বা অপ্রয়োজনে) যুদ্ধে প্রবৃত্ত হওয়াটাও কমুনিষ্ট ও অন্যান্য মতাদর্শপন্থীদের জন্য জায়েয থেকে যায়। এজন্য বাংলাদেশের অজপাড়াগায়ের সর্বহারা বা বিপ্লবী কমুনিষ্টগণের কৃতকর্মের জন্য কেউ আফগানিস্তানে আগ্রাসনকারী রুশ বাহিনী, কম্বোডিয়ার গেরিলা গোষ্ঠী খেমাররুজ বা আরাকানে সামরিক অভিযানের নামে গণহত্যা পরিচালনাকারী বর্মী সামরিক জান্তাকে মন্দ বলতে পারবে না। এমনকি খোদ ঐ আন্ডারগ্রাউন্ড পার্টিগুলোর পৃষ্ঠপোষক ও বেনিফিসিয়ারী কমুনিষ্ট রাজনীতিবিদগণকেও তাদের সশস্ত্র কমরেডগণের কৃতকর্মের জন্য মানুষের সামনে লজ্জায় মাথা হেঁট করবার প্রয়োজন পড়বে না। সামরিক শাখার ক্যাডারগণকে চরমপন্থী আখ্যা দিয়ে নিজেদেরকে মধ্যপন্থী বলে অনায়াসেই আলাদা করে নিতে পারবেন। অপরদিকে ইসলামের নামে মুসলিম নামধারী চরমপন্থী গোষ্ঠীগুলোকে 'চরমপন্থী' নামের পরিবর্তে 'জঙ্গি' নামকরণের কারণে মুসলমানদের জন্যই হয়েছে ফাঁপড়। মুসলিম পরিচয়ধারী সীমালংঘনকারী গোষ্ঠীগুলোকে জঙ্গি আখ্যায়িতকরণের দ্বারা জঙ্গ তথা যুদ্ধ জিনিসটাই কার্যত একতরফাভাবে কেবল মুসলমানদের জন্যই হারাম হয়ে গেছে। ফলে পৃথিবীর কোথাও মুসলমানরা যদি বাড়াবাড়ি ও সীমালংঘন না করে নিয়মনীতি ও মানবিকতা বজায় রেখেও সামরিক সরঞ্জাম ও সামরিক প্রশিক্ষণ গ্রহণপূর্বক আত্মরক্ষায় সক্ষম সশস্ত্র শক্তি হিসেবে গড়ে উঠতে চায়, অত্যাচারী ও আগ্রাসী হানাদারদের কবল থেকে স্বজাতিকে রক্ষা করতে চায়, তারাও সেই জঙ্গি নামটাই প্রাপ্ত হবে, যে নামটা ইতোমধ্যে বরাদ্দ হয়ে আছে মুসলিম নামধারী সীমালংঘনকারী চরমপন্থী গোষ্ঠীগুলোর জন্য। দেখা যাবে, জেএমবি বা আইএস মার্কা অপরাধী গোষ্ঠীগুলোর কৃতকর্মের দোহাই দিয়ে ফিলিস্তিনী ও আরাকানী মুসলমানদের ইসরাইলী ও বর্মী জালেমদের জুলুম হতে আত্মরক্ষার প্রয়াসকেও জঙ্গিবাদের লেবেল দিয়ে দাবিয়ে দেয়া হবে। যেহেতু অমুসলিম জঙ্গিদের কুখ্যাত গ্রুপগুলোকে 'চরমপন্থী' আখ্যাদানের দ্বারা মূলধারার জঙ্গিদের মধ্যপন্থী হিসেবে পরিচিত হবার সুযোগ প্রদান করা হয়েছে, যার বিপরীতে মুসলিম জঙ্গিদেরকে চরমপন্থী ও মধ্যপন্থী এই দুই ভাগে ভাগ করার scope বা option রাখা হয়নি। একজন ধর্মবিরোধী বা বিধর্মী ব্যক্তির পক্ষে চরমপন্থী সাব্যস্ত হবার জন্য তার বাড়াবাড়িমূলক কর্মকাণ্ড প্রকাশ হওয়াটা জরুরী, কিন্তু একজন মুসলিমের বেলায় জঙ্গি অভিহিত হবার জন্য তার অস্ত্রধারণ করাটাই যথেষ্ট- অস্ত্রকে বৈধ না অবৈধ কোন্ কাজে ব্যবহার করল সেটা আর দেখার বিষয় হবে না।
আমি ভাবি, যে মতবাদ আপনাতেই ভ্রান্ত ও ধ্বংসাত্মক মতবাদ, যে মতবাদ জগতে কোনকালে মানুষের অমঙ্গল বৈ মঙ্গল করেনি, যে মতবাদ ধ্বংস ও মৃত্যু এবং ইহলৌকিক ও পারলৌকিক সর্বনাশ ছাড়া মানুষকে আর কিছু দেয়নি, সেই মতবাদের মূলধারা ও মধ্যপন্থাই বা কী, আর চরমপন্থাই বা কী!
জঙ্গিবাদ নিয়ে খবর পরিবেশন করতে গিয়ে আরো একটি মতলবি টার্মের জন্ম দেয়া হয়েছে- 'জিহাদী বই'। জঙ্গি আস্তানা হতে উদ্ধারকৃত সকল বইপত্রকেই জিহাদী বই বলে আখ্যায়িত করা হচ্ছে। অথচ মুসলিম নামধারী চরমপন্থী গ্রুপগুলো জিহাদের নামে সন্ত্রাসী কর্মকাণ্ডে ছেলেপেলেকে প্ররোচিত করবার জন্য যে সমস্ত বইপত্র ও সাহিত্য ব্যবহার করে, তা আদতে জিহাদী বই নয়, বরং জিহাদের নামে প্রচারিত ভ্রান্ত ও বিকৃত ব্যাখ্যা সংবলিত মনগড়া বই। বইগুলোর নাম দেয়া যেতে পারত 'বিভ্রান্তিকর বই' বা 'বিভ্রান্তিমূলক বই' বা 'ভ্রান্ত বই' বা 'মগজধোলাই পুস্তক'। অথবা কোন নাম বা টাইটেল না দিয়েও শুধু কিছু বইপুস্তক উদ্ধার করা হয়েছে- এভাবেও খবর প্রচার করা যেত। এখানে চরমপন্থীদের ব্যবহৃত ও পঠিত বইপত্রকে 'জিহাদী বই' আখ্যাদানের উদ্দেশ্যই হলো প্রথমত জিহাদ জিনিসটাকেই মুসলিম জাতির জন্য চিরতরে নিষিদ্ধ ও ঘৃণিত করে তোলা, আর দ্বিতীয়ত যেকোন ইসলামী বইকেই জিহাদী বই আখ্যাদানের মাধ্যমে এক পর্যায়ে ইসলাম ধর্মকেই খাটো ও হেয় করে তোলা।
আরো একটি লক্ষণীয় বিষয় হলো, মুসলমানদের মধ্যকার বিপথগামী সীমালংঘনকারী গ্রুপগুলোকে বোঝাতে চরমপন্থী শব্দের পরিবর্তে জঙ্গি শব্দ ব্যবহার করা হলেও বিভিন্ন মুসলিম জনপদে ন্যায়সঙ্গতভাবে স্বাধীনতা যুদ্ধ পরিচালনাকারী প্রতিরোধ যোদ্ধাদেরকে ঠিকই চরমপন্থী ও উগ্রবাদী নামে অভিহিত করা হয়। কী আশ্চর্য! মুসলিম নামধারী সত্যিকার চরমপন্থী দলগুলো চরমপন্থী খেতাব পেল না, শুধু জঙ্গি বলে প্রচারিত হলো; আর মুসলিমদের যেই সংগ্রামী বাহিনীগুলো কোনরূপ চরমপন্থা ও বাড়াবাড়ি এবং পাগলামি ও মাতলামির ধার ধারল না, বরং শুধু আগ্রাসী গণহত্যাকারী সৈন্যবাহিনীর বিরুদ্ধে নিজেদের লড়াইকে সীমিত রাখল; তারাই চরমপন্থী হিসেবে প্রচারিত হলো।
জঙ্গিবাদের দোহাই দিয়ে কার্যত এ জামানার মুসলমানদের জন্য জিহাদকেই হারাম করে দেয়া হয়েছে এবং নির্যাতিত মুসলিম অধ্যুষিত জনপদসমূহের মানুষগুলোর উপর বসে বসে মুখ বুজে গণহত্যা ও নির্যাতন সয়ে যাবার বাধ্যবাধকতা আরোপ করা হয়েছে। "জঙ্গিবাদ ইসলামে আছে কি নেই"- এ প্রশ্নটাই একটা অপ্রাসঙ্গিক ও মতলবি প্রশ্ন। প্রশ্নটা যদি এভাবে করা হতো যে, চরমপন্থা ও বাড়াবাড়ি ইসলামে আছে কিনা, তাহলে বরং সেটা আলোচনার যোগ্য একটি valid question হতো।
বিষয়: আন্তর্জাতিক
৯২৮ বার পঠিত, ০ টি মন্তব্য
পাঠকের মন্তব্য:
মন্তব্য করতে লগইন করুন