ইয়াজিদের পক্ষে উকালতি করবার নির্লজ্জ ও সুচতুর প্রয়াস
লিখেছেন লিখেছেন ওবাদা বিন সামেত ০৭ জুন, ২০১৭, ০৭:৪৮:২২ সন্ধ্যা
এজিদপন্থীরা কারবালার ঘটনার প্রকৃত ইতিহাস শেখানোর নামে সুকৌশলে ইয়াজিদের পক্ষে উকালতি করে থাকে। তাদের লেখার সূচনা দেখলে মনে হবে, ইমাম হোসাইনের (রা) প্রতি সহানুভূতি ও সম্মান প্রদর্শন করা এবং তাঁর খুনীদের প্রতি ধিক্কার জানানোই বুঝি তাদের উদ্দেশ্য। কিন্তু ক্রমে লেখার মাঝখানে ও শেষের দিকে তাদের প্রকৃত উদ্দেশ্য ধরা পড়ে। উক্ত ঘটনায় ইয়াজিদকে সম্পূর্ণ নির্দোষ প্রমাণ করা এবং ইমাম হুসাইনের (রা) 'হঠকারিতা'-কে দায়ী করাই তাদের আসল মোটিভ, একথা পরিস্কার হয়ে পড়ে।
"কি ঘটেছিল কারবালায়? কারা হুসাইন (রা) কে হত্যা করেছে?" শীর্ষক একটি লেখাতে এমনই এক সূক্ষ্ম অপপ্রয়াস পরিলক্ষিত হয়েছে। লেখাটির শুরুতে হুসাইনের (রা) প্রতি মায়াকান্না প্রদর্শিত হলেও শেষ পর্যন্ত ইয়াজিদকে নির্দোষ ও হুসাইনকে দোষী প্রমাণের অপচেষ্টাই লেখাটির মূল উপজীব্য বিষয় হয়ে দাঁড়িয়েছে। যা নিম্নে বিশ্লেষণ করা হলো:-
(১)
ইয়াজিদ উবাইদুল্লাহ বিন যিয়াদকে আদেশ দিলেন যে, তিনি যেন কুফা বাসীকে তার বিরুদ্ধে হুসাইনের সাথে যোগ দিয়ে বিদ্রোহ করতে নিষেধ করেন। সে হুসাইনকে হত্যা করার আদেশ দেন নি।যেন উবাইদুল্লাহ বিন যিয়াদ নিছক একজন দূত ছিল, যে শুধু নিষেধ করতে এসেছিল। সামরিক পদাধিকারসম্পন্ন একজন সেনাপতি কিনা শুধু নিষেধ করতে এসেছিল, আর নিষেধাজ্ঞা বাস্তবায়ন করতে গিয়ে যতসব অঘটন ঘটে গেল!
(২)
অতঃপর মুসলিম বিন আকীল চার হাজার সমর্থক নিয়ে অগ্রসর হয়ে দ্বিপ্রহরের সময় উবাইদুল্লাহ বিন জিয়াদের প্রাসাদ ঘেরাও করলেন।তার মানে হুসাইনের পক্ষের লোকই আগে হাঙ্গামাটা শুরু করেছিলেন! হুসাইন (রা) পক্ষই আগে উষ্কানীমূলক আচরণের দ্বারা বাধ্য করেছে ইয়াজিদ পক্ষকে কঠোর হতে।
(৩)
ইবনে উমর হুসাইনকে লক্ষ্য করে বলেন: হুসাইন! আমি তোমাকে একটি হাদীছ শুনাবো। জিবরীল (আঃ) আগমন করে নবী সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লামকে দুনিয়া এবং আখিরাত- এ দুটি থেকে যে কোন একটি গ্রহণ করার স্বাধীনতা দিয়েছিলেন। তিনি দুনিয়া বাদ দিয়ে আখিরাতকে বেছে নিয়েছেন। আর তুমি তাঁর অংশ। আল্লাহর শপথ! তোমাদের কেউ কখনই দুনিয়ার সম্পদ লাভে সক্ষম হবেন না। তোমাদের ভালর জন্যই আল্লাহ তোমাদেরকে দুনিয়ার ভোগ-বিলাস থেকে ফিরিয়ে রেখেছেন। হুসাইন তাঁর প্রস্তাব প্রত্যাখ্যান করলেন এবং যাত্রা বিরতি করতে অস্বীকার করলেন। অতঃপর ইবনে উমর হুসাইনের সাথে আলিঙ্গন করে বিদায় দিলেন এবং ক্রন্দন করলেন।তার মানে ইমাম হুসাইন (রা) দুনিয়ালোভী ছিলেন এবং দুনিয়ার ক্ষমতা ও সম্পদের জন্যই ওখানে গিয়েছিলেন! আমাদের নবীর (সা) শত্রুরাও নবীজীর নামে ঠিক এই ধরনের প্রচারণাই চালিয়ে থাকে। যারা নবীর বন্ধুকে (আবুবকরকে) ক্ষমতালোভী বলে, আর যারা নবীর কলিজার টুকরাকে (হোসাইনকে) ক্ষমতালোভী বলে, তারা মূলত একই মুদ্রার এপিঠ ওপিঠ, যদিও তারা প্রত্যেকেই নিজেদেরকে নবীপ্রেমিক দাবি করে।
(৪)
হুসাইন সেখানে অবতরণ করে আল্লাহর দোহাই দিয়ে এবং ইসলামের কথা স্মরণ করিয়ে দিয়ে তিনটি প্রস্তাবের যে কোন একটি প্রস্তাব মেনে নেওয়ার আহবান জানালেন।এই বর্ণনাটির মধ্যেও একটি সূক্ষ্ম বিকৃতি আরোপ করা হয়েছে। কারণ, আমরা জানি, হুসাইন (রা) ইয়াজিদের দরবারে যেতে চেয়েছিলেন আলোচনার জন্য, বাইয়াত গ্রহণের জন্য নয়। ইমাম হুসাইনকে ছোট ও হেয় করবার কী জঘন্য নির্লজ্জ প্রয়াস!
হুসাইন বিন আলী (রা এবং রাসূলের দৌহিত্রকে ইয়াজিদের দরবারে যেতে দেয়া হোক। তিনি সেখানে গিয়ে ইয়াজিদের হাতে বয়াত গ্রহণ করবেন। কেননা তিনি জানতেন যে, ইয়াজিদ তাঁকে হত্যা করতে চান না। অথবা তাঁকে মদিনায় ফেরত যেতে দেয়া হোক।
অথবা তাঁকে কোন ইসলামী অঞ্চলের সীমান্তের দিকে চলে যেতে দেয়া হোক। সেখানে তিনি মৃত্যু পর্যন্ত বসবাস করবেন এবং রাজ্যের সীমানা পাহারা দেয়ার কাজে আত্ম নিয়োগ করবেন।
(৫) হুসাইনের (রা) পক্ষে আর কে কে 'নিহত' হয়েছেন, তারও তালিকা দেয়া হয়েছে। লক্ষণীয় যে, বর্ণিত প্রবন্ধকারের মতে তাঁরা শুধুই 'নিহত', শহীদ নন।
(৬) বর্ণিত প্রবন্ধে স্বতন্ত্র একটি অনুচ্ছেদেরই শিরোনাম করা হয়েছে, "হুসাইনের বের হওয়া ন্যায় সংগত ছিল কি?" তার মানে, এরা বোঝাতে চাচ্ছে, ইমাম হুসাইন (রা) অন্যায়ভাবে বের হয়েছিলেন! এদের বক্তব্যের ভাবখানা হলো, বেটা গেছে কেন ওখানে মরতে? না গেলে তো আর কেউ মারতে পারত না!
(৭) পরিশেষে উক্ত প্রবন্ধে তাদের মনের আসল খায়েশ তথা আসল প্রশ্নটি উত্থাপন করা হয়েছে, "হুসাইনের হত্যায় ইয়াজিদ কতটুকু দায়ী?" এ সংক্রান্ত অনুচ্ছেদে হুসাইন পক্ষের বন্দী মহিলাদের প্রতি ইয়াজিদ কেমন সম্মান দেখিয়েছে, তাদেরকে দয়া করে আলাদা কক্ষে বসতে দিয়েছে- পরাজিত পক্ষের প্রতি এজিদের এটুকু অনুগ্রহের কথা বর্ণনা করবার দ্বারা কারবালার হত্যাযজ্ঞে এজিদের জড়িত থাকার বিষয়টিই নাকচ করার প্রয়াস চালানো হয়েছে।
(৮) ইমাম হুসাইনের প্রতি ইরাকবাসী তথা শিয়াদের বিশ্বাসঘাতকতার প্রসঙ্গ এনে এনারা বোঝাতে চাচ্ছেন যে, হুসাইনের হত্যাকারী ইয়াজিদ নয়, বরং ইরাকবাসী তথা শিয়ারাই হুসাইনকে হত্যা করেছে এবং তারপর নিজেরাই চিরদিনের তরে মাতম শুরু করেছে। কিন্তু কথা হলো, মীরজাফরের দায়ী হওয়াটা কি লর্ড ক্লাইভের নির্দোষিতা প্রমাণ করে? বর্ণিত প্রবন্ধে ইমাম হুসাইনের ভাষণের উল্লেখ করে যুক্তি দেখানো হয়েছে, হুসাইন (রা) যেহেতু কেবল তাঁকে আমন্ত্রণ করে আনা ইরাকবাসীর প্রতি ক্ষোভ প্রকাশ করেছেন, এজিদের প্রতি ক্ষোভ প্রকাশ করেননি, অতএব কেবল ইরাকীরাই দায়ী, এজিদ দায়ী নয়। কিন্তু কথা হল, এজিদ তো ছিল প্রকাশ্য শত্রু। তার বিরুদ্ধে ক্ষোভ প্রকাশের প্রয়োজন হবে কেন? অপরদিকে ইরাকবাসীরা ছিল বিশ্বাসঘাতক, তাই তাদের বিরুদ্ধে ক্ষোভ প্রকাশ প্রয়োজন হয়েছে। ইমাম হোসাইনের হত্যায় কুফাবাষীগণ বিশ্বাসঘাতকতা করে এজিদের পক্ষ নিয়েছে, এজিদকে সহায়তা করেছে, একথা সত্য। কিন্তু তার মানে কি এজিদ সম্পূর্ণ নির্দোষ? এজিদের অনুমতি ছাড়া যদি কেউ আইন হাতে তুলে নিয়ে হুসাইন (রা)-কে হত্যা করে থাকে, তাহলে এজিদ কেন তাদের বিরুদ্ধে ব্যবস্থা গ্রহণ করেনি? একটা বিশাল সেনাবাহিনীর দ্বারা ঘেরাও থাকা অবস্থায় অন্য কেউ এসে মেরে দিয়ে গেল! যত্তসব আজগুবি গাঁজাখুরি তত্ত্ব। এদের এই সমস্ত উদ্ভট কাহিনী বিশ্বাস করতে হলে এজিদের মতই মদ্যপ হতে হবে। হোসাইন (রা) হত্যায় এজিদকে নির্দোষ প্রমাণের জন্য ইনিয়ে বিনিয়ে অন্য কাউকে দায়ী করবার প্রবণতা আম্মার (রা) হত্যার দায় প্রসঙ্গে মুয়াবিয়ার চাতুর্যপূর্ণ ব্যাখ্যার কথাই স্মরণ করিয়ে দেয়। উল্লেখ্য, আম্মার (রা) হত্যা প্রসঙ্গে নবী (সা)-এর একটি ভবিষ্যদ্বাণীর কথা স্মরণ করিয়ে দেয়া হলে মুয়াবিয়া বলেছিলেন, "আমরা কি আম্মারকে হত্যা করেছি নাকি? আম্মারকে হত্যা করেছে আলী আর তার সঙ্গীরা। তারাই আম্মারকে আমাদের তীর-বল্লমের সামনে এনে দাঁড় করিয়ে দিয়েছে!"
(৯)
হুসাইনের মৃত্যুতে রোদন করা যদি আহলে বাইতের প্রতি তাদের প্রকৃত ভালবাসার প্রমাণ হয়, তাহলে হুসাইনের প্রতি তাদের ভালবাসা সত্য হলে তারা হামজাহ (রা)এর মৃত্যুতে রোদন করে না কেন?এ বিষয়ে আমার বক্তব্য হলো, হামজা (রা)-এর হত্যাকারীরা মুসলিম পরিচয়ে এ কাজ করেনি এবং এ হত্যাকাণ্ডকে জায়েয করা বা হত্যাকারীদের নির্দোষ প্রমাণের কোন অপপ্রয়াস আজ পর্যন্ত পরিলক্ষিত হয়নি। সুতরাং এ বিষয়ে সচেতনতামূলক কর্মসূচী ও বিস্তারিত আলোচনার কেউ প্রয়োজন বোধ করেনি। তবে বিষয়টি মনে করিয়ে দেবার জন্য ধন্যবাদ। এটি মনে করিয়ে দিতে গিয়ে যে উপরের দিকে থুথু নিক্ষেপ করা হলো, তা বোধহয় আপনারা টেরই পেলেন না। কারণ, ইতিহাস সাক্ষী, হামজা (রা)-এর হত্যাকারীরা ছিল হুসাইন (রা)-এর হত্যাকারীদেরই পূর্বপুরুষ। হুসাইনের মস্তক ছিন্নকারী আর হামজার কলিজা ভক্ষণকারীরা ছিল একই পরিবারের সদস্য। আপনাদের পরম পূজনীয় আমীর মুয়াবিয়া ছিলেন কলিজা খাদকেরই সন্তান। আর আপনাদের নয়নমনি ইয়াজিদ ইবনে মুয়াবিয়া ছিল কলিজা খাদকেরই নাতি।
(১০)
এ কথা ঠিক যে, যারা হুসাইন (রাঃ)কে হত্যা করেছে তারা স্বৈরাচারী, জালেম ও পৈশাচিক নরপশুর পশুর চেয়েও অধম ছিল। তাই বলে যুগ যুগ ধরে বিষয়টি নিয়ে বাড়াবাড়ি করা ঠিক নয়।এ কথার উদ্দেশ্য হলো, যুগের ইয়াজিদগণকে যাতে মানুষ চিনতে না পারে। এদের অভিপ্রায় ও বক্তব্যটা হলো, এজিদ একটা অন্যায় কাজ করেছে ব্যাস, কিন্তু ওটা নিয়ে আমাদের এত ঘাটাঘাটি ও নাড়াচাড়ার কী প্রয়োজন! আসল ব্যাপারটা হলো, এই কথাগুলো যেখান থেকে প্রচারিত হচ্ছে, সেখানকার রাজপরিবারের চরিত্র ও লাইফস্টাইল এজিদের থেকে ভিন্ন কিছু নয়, যেটা সারা দুনিয়ার মানুষ জানে। এ কারণেই ইয়াজিদের চরিত্র ও কর্মকাণ্ড নিয়ে নাড়াচাড়া করা হলে এরা জলাতঙ্ক রোগীর ন্যায় দিগবিদিগশূন্য হয়ে পড়ে।
এবার উক্ত প্রবন্ধে উত্থাপিত কয়েকটি প্রশ্নের জবাব প্রদান করছি:-
প্রথম প্রশ্ন: হুসাইনের পিতা এবং ইসলামের চতুর্থ খলীফা আলী বিন আবু তালেব (রা হুসাইনের চেয়ে অধিক উত্তম ছিলেন। তিনি ৪০ হিজরী সালে রমযান মাসের ১৭ তারিখ জুমার দিন ফজরের নামাযের উদ্দেশ্যে বের হওয়ার সময় আব্দুর রাহমান মুলজিম খারেজীর হাতে নির্মমভাবে নিহত হয়েছেন। তারা হুসাইনের মৃত্যু উদযাপনের ন্যায় তাঁর পিতার মৃত্যু উপলক্ষে মাতম করে না কেন?
উত্তর: হযরত আলী (রা) শহীদ হয়েছিলেন একটি বিদ্রোহী গ্রুপের দ্বারা প্রেরিত আততায়ীদের হাতে। অপরদিকে হুসাইন (রা) শহীদ হয়েছেন ক্ষমতাসীন শাসকদের হাতে। সন্ত্রাসী কর্তৃক হত্যাকাণ্ডের চেয়ে রাষ্ট্রীয় মদদে হত্যাকাণ্ড অবশ্যই বেশি গুরুতর। তদুপরি আলী (রা)-এর হত্যাকারীদের সরাসরি সমর্থক বা অনুসারী এখন নেই। কিন্তু হুসাইন (রা)-এর হত্যাকারীদের সমর্থক ও বেনিফিশিয়ারীগণ আজও বহাল তবিয়তে আছেন, এই যে ধরুন আপনারাই। এ কারণেই এ বিষয়টা নিয়ে আলোচনা ও প্রতিবাদ করার প্রয়োজন বেশি হচ্ছে। এর দ্বারা হুসাইন (রা)-কে মর্যাদার দিক থেকে আলী (রা)-এর উপরে স্থান দেওয়া বুঝায় না। এছাড়া নৃশংসতার দিক থেকেও কারবালার ঘটনাটি অন্যান্য পূর্বাপর অন্যান্য হত্যাকাণ্ডের চাইতে অধিক মর্মান্তিক, যেহেতু শিশুপুত্রসহ ইমাম হোসাইন (রা)-কে সপরিবারে নিষ্ঠুর পন্থায় হত্যা করা হয়েছিল এবং হত্যাকাণ্ডের পরেও ইমামের পবিত্র লাশের সাথে ঔদ্ধত্যপূর্ণ আচরণ ও বেয়াদবি করা হয়েছিল।
দ্বিতীয় প্রশ্ন: আহলে সুন্নত ওয়াল জামআতের আকীদাহ অনুযায়ী উসমান বিন আফ্ফান ছিলেন আলী ও হুসাইন (রাএর চেয়ে অধিক উত্তম। তিনি ৩৬ হিজরী সালে যুল হজ্জ মাসের আইয়ামে তাশরীকে স্বীয় বাস ভবনে অবরুদ্ধ অবস্থায় মাজলুম ভাবে নিহত হন। ন্যায় পরায়ণ এই খলীফাকে পশুর ন্যায় জবাই করা হয়েছে। তারা তাঁর হত্যা দিবসকে কেন্দ্র করে অনুষ্ঠান করে না কেন?
উত্তর: দ্বিতীয় প্রশ্নের জবাবও প্রথম প্রশ্নের জবাবেরই অনুরূপ হবে। যেহেতু উসমান হত্যাকারীদের প্রত্যক্ষ সমর্থক কেউ নেই, যেমনটি রয়েছে হুসাইন হত্যাকারীদের ক্ষেত্রে, তাই এ নিয়ে খুব বেশি প্রতিবাদ না করলেও চলে। অবশ্য একথা ঠিক যে, সাবায়ী সম্প্রদায়কে উসমান হত্যাকারীদের মানসপুত্র হিসেবে গণ্য করা যায়।
তৃতীয় প্রশ্ন: এমনভাবে খলীফাতুল মুসলিমীন উমর ইবনুল খাত্তাব (রা উসমান এবং আলী (রা থেকেও উত্তম ছিলেন। তিনি ফজরের নামাযে দাঁড়িয়ে কুরআন তেলাওয়াত করছিলেন এবং মুসলমানদেরকে নিয়ে জামআতের ইমামতি করছিলেন। এমন অবস্থায় আবু লুলু নামক একজন অগ্নি পূজক তাঁকে দুই দিকে ধারালো একটি ছুরি দিয়ে আঘাত করে। সাথে সাথে তিনি ধরাশায়ী হয়ে যান এবং শহীদ হন। লোকেরা সেই দিনে মাতম করে না কেন?
উত্তর: এ প্রশ্নের জবাবও প্রথম প্রশ্নের জবাবের অনুরূপ হবে।
চতুর্থ প্রশ্ন: ইসলামের প্রথম খলীফা এবং রাসূলের বিপদের দিনের সাথী আবু বকরের মৃত্যু কি মুসলিমদের জন্য বেদনাদায়ক নয়? তিনি কি রাসূলের পরে এই উম্মতের সর্বশ্রেষ্ঠ ব্যক্তি ছিলেন না? তার মৃত্যু দিবসে তারা তাজিয়া করে না কেন?
উত্তর: এটা হাস্যকর প্রশ্ন। কারণ, স্বাভাবিক মৃত্যুর ক্ষেত্রে যেহেতু হত্যাকারী নেই, সেহেতু কারো বিরুদ্ধে বিক্ষোভ প্রকাশের প্রয়োজন হয় না।
পঞ্চম প্রশ্ন: সর্বোপরি নবী মুহাম্মাদুর রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম দুনিয়া ও আখেরাতে সমস্ত বনী আদমের সরদার। আল্লাহ্ তায়ালা তাঁকে অন্যান্য নবীদের ন্যায় স্বীয় সান্নিধ্যে উঠিয়ে নিয়েছেন। সাহাবীদের জন্য রাসূল সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লামের মৃত্যুর চেয়ে অধিক বড় আর কোন মুসীবত ছিল না। তিনি ছিলেন তাদের কাছে স্বীয় জীবন, সম্পদ ও পরিবার-পরিজনের চেয়েও অধিক প্রিয়। তারপরও তাদের কেউ রাসূলের মৃত্যুতে মাতম করেন নি। হুসাইনের প্রেমে মাতালগণকে রাসূলের মৃত্যু দিবসকে উৎসব ও শোক প্রকাশের দিন হিসেবে নির্ধারণ করতে দেখা যায় না কেন?
উত্তর: আমাদের নবী করীম (সা) সমগ্র মানব ও মাখলুকাতের মধ্যে শ্রেষ্ঠ এবং তাঁর ইন্তেকাল আমাদের জন্য সর্বাধিক শোকের কারণ, একথা অনস্বীকার্য। তবে নবীজী জীবনে বিভিন্ন সময় শত্রুর দ্বারা মারাত্মকভাবে আহত ও বিপদগ্রস্ত হলেও তাঁর মৃত্যুটা স্বাভাবিকভাবে হয়েছিল বলেই ধরে নেয়া হয়, যদিও খায়বরের ইহুদী মহিলার দ্বারা প্রয়োগকৃত বিষক্রিয়ার প্রভাব নবীর শাহাদাতের পিছনে ক্রিয়াশীল ছিল বলে একটি ধারণা রয়েছে। কিন্তু যাই হোক, আমাদের নবীর শত্রু বা হত্যাকারী কেউ মুসলিম পরিচয়ে মুসলিম জাতিকে ধোঁকা দানের মতন অবস্থায় নেই, যেরূপ অবস্থানে আছে নবীর নাতির হত্যাকারীদের অনুসারী ও অনুগামীরা। নবীর উম্মত তাঁর শত্রু বা হত্যাকারী বা মৃত্যুকামীদের ভক্ত ও অনুগামী হয়ে পড়বে- এরূপ কোন প্রকাশ্য আশংকা না থাকায় নবীজীর (সা) ওফাত নিয়ে অতটা আনুষ্ঠানিক শোক পালন না করলেও চলে। কিন্তু নবীর নাতির হত্যাকারীদের উত্তরসূরীরা নবীর উম্মত সেজে নবীর উম্মতদেরকে বিভ্রান্ত করবার ও নবীর উম্মতদের উপর প্রভাব বিস্তারের চেষ্টায় মেতে আছে বলেই তাদের অপপ্রয়াসকে প্রতিহত করবার জন্য এই হত্যাকাণ্ডের বিষয়টি নিয়ে সচেতনতামূলক কর্মসূচী গ্রহণের প্রয়োজন হয়।
ষষ্ঠ প্রশ্ন: সর্বশেষ প্রশ্ন হচ্ছে হুসাইনের চেয়ে বহুগুণ বেশী শ্রেষ্ঠ ব্যক্তিদের মৃত্যু দিবসকে বাদ দিয়ে ইমাম হুসাইনের মৃত্যুকে বেছে নিয়ে এত বাড়াবাড়ি শুরু করা হল কেন?
উত্তর: হুসাইনের চেয়ে বহুগুণ শ্রেষ্ঠ ব্যক্তিগণের মধ্যে কেউ স্বাভাবিক মৃত্যুবরণ করেছেন, আর কেউ শহীদ হলেও তাদের হত্যাকারী বা হত্যাকারীদের অনুসারীরা এখন সক্রিয় অবস্থায় নেই, যেরূপ দাপটের সাথে আছেন হুসাইনের (রা) হত্যাকারী ইয়াজিদের প্রেতাত্মারা- মানে আপনারা। তাই আপনাদের মত দুর্বৃত্তদের মুখোশ উন্মোচন এবং আপনাদের অনিষ্ট থেকে ইসলাম ও মুসলমানদের সতর্ক রাখার প্রয়োজনেই ইমাম হুসাইনের শাহাদাতের ঘটনা নিয়ে আলোচনা করবার দরকার হয়। এজন্যই হুসাইন হত্যার প্রসঙ্গ আসলেই আপনাদের আঁতে ঘা লাগে। অবশ্য তাই বলে মাতম ও রক্তপাতের অনুষ্ঠানকে আমরা সমর্থন করছি না।
প্রসঙ্গক্রমে ইয়াজিদের দাদা আবু সুফিয়ানের একটি উক্তি উল্লেখ করছি, যে উহুদের যুদ্ধের পরে মুসলমানদের উদ্দেশ্য করে বলেছিল, "(আমার) সৈন্যরা (তোমাদের) নিহতদের নাক-কান কেটে নিচ্ছে। আমি অবশ্য নির্দেশ দেইনি, তবে এর জন্য আমার দু:খবোধও হয়নি।" কারবালার ঘটনায় ইয়াজিদের ভূমিকাও অনেকটা ঐরকমই।
এজিদ এদের কাছে এতই প্রিয় যে, এজিদকে সম্মানিত করবার জন্য হোসাইন (রা)-কে অপমানিত করে হলেও তা করা চাই। অথচ যারা প্রকৃত মুমিন, যারা রসূল (সা)-কে ভালোবাসে, যাদের ভালোবাসা ও শত্রুতা কেবল আল্লাহ ও তাঁর রাসূলের জন্য হয়ে থাকে, তাদের পক্ষে নবীর প্রিয়জনের (হুসাইনের) প্রতি কুধারণা করবার চাইতে নবীর দুশমনের (আবু সুফিয়ানের) প্রিয়জনকে (ইয়াজিদকে) মন্দ ভাবা অনেক সহজ।
আরেকটা কথা, ইমাম হাসান (রা) ও মুয়াবিয়ার মধ্যকার চুক্তির বিষয়টি এই মতলববাজরা হয় এড়িয়ে যায়, অথবা উল্লেখ করলেও চুক্তি ভঙ্গের পক্ষে যৌক্তিক কারণ ও বাস্তব প্রয়োজনের বিষয় নিয়ে প্যাঁচাল পাড়তে শুরু করে। এ সম্পর্কে আমাদের বক্তব্য হলো, যদি অনিবার্য কারণ ও জরুরতবশত চুক্তির ব্যতিক্রম করতেও হয়, তাহলে তা যাদের সাথে চুক্তি করা হয়েছে তাদের সাথে আলোচনা ও সমঝোতা সাপেক্ষেই করা উচিত, তাই নয় কি? ধর্মের বা জাতির কল্যাণের দোহাই দিয়ে মিথ্যা, শঠতা, প্রতারণা ও বিশ্বাসঘাতকতাকে জায়েয করবার প্রবণতা অনেক অনাচারের রাস্তাই খুলে দেয়, যার প্রমাণ আজকের রাজনীতি।
খলিফা ইয়াজিদ, ইমাম হোসাইন (রাঃ) ও কারবালা নিয়ে রচিত মিথ্যা ইতিহাস থেকে নিজের ঈমানকে হেফাযত করুন (দ্বিতীয় পর্ব) শীর্ষক একটি লেখাতে বলা হয়েছে, "খলিফা হবার পর ইয়াজিদ কতৃক যদি কোন অন্যায় হয়ে ও থাকে সেটার জন্য মোয়াবিয়া (রাঃ) কখনো দায়ী হবেন না।" মুয়াবিয়া দায়ী হবেন কিনা, সে বিষয়ে আমার কোন মন্তব্য নেই। কিন্তু ইয়াজিদের দ্বারা 'যদি কোন অন্যায় হয়েও থাকে' এ কথাটি সত্যকে পাশ কাটানোর অপপ্রয়াস। আর কী পরিমাণ অন্যায় হলে অন্যায় হয়েছে বলে গণ্য করতে হবে? কোন্ অন্যায়টা ইয়াজিদ বাকি রেখেছে, বলুন? কারবালার হত্যাযজ্ঞ, মদীনার গণহত্যা, কাবা শরীফে অগ্নিসংযোগ এগুলো কি আদৌ কোন অন্যায়ের মধ্যেই পড়ে না? এগুলো বেশ ভালো কাজ, এই তো? আর যদি এগুলো মন্দ কাজ হয়েও থাকে, তাহলে সোনার ছেলে এজিদ এগুলো করেনি, তার নাম ভাঙ্গিয়ে এগুলো সব শিয়ারা করেছে, তাই না?
কারবালার মর্মান্তিক ঘটনা নিয়ে একটি মহল রাজনৈতিক উদ্দেশ্য হাসিল করতে চায় একথা সত্য। তারা যে এ ঘটনায় শুধু এজিদ ও মুয়াবিয়াকে দায়ী করেই ক্ষান্ত হয় না, বরং অপ্রাসঙ্গিকভাবে পূর্ববর্তী খোলাফায়ে রাশেদীনকেও আকারে-ইঙ্গিতে পরোক্ষভাবে এ ঘটনার সাথে জড়াতে চায়, তাও সত্য। কিন্তু কারবালা নিয়ে একটি মহলের উদ্দেশ্যমূলক রাজনৈতিক প্রচারণার দোহাই দিয়ে কারবালার হত্যাযজ্ঞকে সমর্থন করা বা হালকা করে দেখা এবং ইমাম হুসাইনের হত্যাকারী জঘন্য স্বৈরশাসক নরঘাতক ইয়াজিদ বিন মুয়াবিয়ার পক্ষে নির্লজ্জ সাফাই গাওয়ার প্রয়াসকে মেনে নেওয়া যায় না।
এজিদপন্থীদের বক্তব্যের মধ্যে সবচেয়ে উল্লেখযোগ্য লক্ষণীয় দিকটি হলো পরস্পরবিরোধিতা। এরা একদিকে বলে থাকে, "কাজটা এজিদ করেনি, অন্য কেউ করে বেচারার উপর দোষ চাপিয়ে দিয়েছে।" অপরদিকে বলে থাকে, "কাজটা অবশ্যই অন্যায় হয়েছে, কিন্তু তাই বলে এটা নিয়ে এত মাতামাতি করার কী আছে! যার আমল নিয়ে সে চলে গেছে, খামাখা মৃত ব্যক্তিকে নিয়ে ঘাটাঘাটি করে কী লাভ!" এ অনেকটা বাংলাদেশের রাজনীতিবিদদের মত, যারা কোন দুষ্কর্ম বা অপ্রীতিকর ঘটনার ক্ষেত্রে একদিকে বলে, কাজটি আমরা করিনি, বরং আমাদের উপর দোষ চাপানোর উদ্দেশ্যে আমাদের প্রতিপক্ষই এ কাজ করেছে; অপরদিকে কাজটির পক্ষে যৌক্তিকতা অন্বেষণ ও রুটকজ প্রদর্শন করে, অর্থাৎ আমাদের প্রতিপক্ষের আচরণই আমাদেরকে এ কাজ করতে বাধ্য করেছে- এমন একটা ভাব প্রদর্শন করে।
এরা কেন যে এজিদের কলংক যেচে নিজেদের কাঁধে নিতে চায়, কোন্ দু:খে যে এজিদের হাতের রক্তের দাগ নিজেদের হাতেও মাখতে চায়, এটা আমার বোধগম্য নয়। এজিদের উপর ঝাড়া দিলে কেন যে এদের গায়ে পিছা পড়ে, তাও বুঝি না।
মজার ব্যাপার হলো, যারা কারবালার ঘটনার জন্য ইয়াজিদকে দায়ী না করে ইনিয়ে বিনিয়ে ইমাম হুসাইনের অপরিণামদর্শিতাকেই দায়ী বলে প্রমাণ করতে চাচ্ছে, তারা কিন্তু বর্তমান ফিলিস্তিনের ব্যাপারেও ইসরাইলকে দায়ী না করে হামাসকে দায়ী করে থাকে, মিশরের ঘটনাবলীর জন্যও সিসিকে দায়ী না করে ব্রাদারহুডকে দায়ী করে থাকে এই বলে যে, ওরা কেন আমাদের কথা শুনল না, ওরা কেন বেশি চালাকি করতে গেল ইত্যাদি। এই চক্রটি মুসলমানদের ধিক্কার ও অভিশাপ থেকে শুধু এজিদকে নয়, ইসরাইলকেও রক্ষার নানারকম বাহানা তালাশ করে থাকে। এরা এই মর্মে এক উদ্ভট ফতোয়া দিয়েছে, "ইসরাইল যেহেতু একজন নবীর (ইয়াকূব আ) নাম ছিল, সেহেতু ইসরাইলকে অভিশাপ দেয়া বৈধ নয়।" ধর্মকে ঢাল হিসেবে ব্যবহার করে ধর্মের শত্রুদেরকে সুরক্ষা দান করা এবং নিজেদের নাপাক অভিলাষ চরিতার্থ করার কাজে এরা যে কতটা এক্সপার্ট ও ধুরন্ধর, তা এ থেকেই বোঝা যায়। এ চক্রটি অতীতে পলাশীর যুদ্ধেও খিজির (আ)-কে টেনে এনেছিল এবং লর্ড ক্লাইভের অনুকূলে খিজির (আ)-এর আশীর্বাদ আদায় করে ছেড়েছিল।
নব্য এজিদদের বর্তমান ভূমিকাই দেখুন না। একদিকে এরা সমগ্র মুসলিম বিশ্বে ধর্মের নামে সন্ত্রাসী কর্মকাণ্ড ও চরমপন্থী তৎপরতায় ইন্ধন যোগাচ্ছে, অপরদিকে যারা মজলুম ফিলিস্তিনী মুসলমানদেরকে ইহুদীবাদী জালেমদের কবল থেকে মুক্ত করবার জন্য সংগ্রামে রত আছে তাদেরকে ও তাদের সহযোগীদেরকে সন্ত্রাসী আখ্যা দিয়ে অবরোধ আরোপ করছে। এদের এজিদপ্রেমের আসল হাকীকত এখানেই নিহিত। এজিদ এদের কাছে কেন এত প্রিয়, কেনই বা এজিদের সম্মান এদের কাছে অনাপোষযোগ্য, সেই রহস্যও এর মধ্যেই লুকিয়ে আছে। অবস্থাদৃষ্টে মনে হচ্ছে, কথিত সালাফীবাদ আসলে সৌদী রাজতন্ত্রের পক্ষে বিশ্ব মুসলিম জনগণের সমর্থন আদায়ের লক্ষ্যে প্রণীত একটি মতবাদ মাত্র। আলী (রা)-এর সাথে যুদ্ধরত মুয়াবিয়া বাহিনী যেভাবে কোরআনের পাতাকে ঢাল হিসেবে ব্যবহার করে ফায়দা হাসিল করেছিল, আলী (রা)-এর বিরুদ্ধে বিদ্রোহকারী খারিজীরা যেভাবে ধর্মের নামে বিশৃঙ্খলা সৃষ্টি করেছিল, ঠিক একইভাবে বর্তমান এজিদপন্থী চক্রটি ধর্মের অপব্যাখ্যার দ্বারা তরুণ সমাজকে বিভ্রান্ত করে মুসলিম দেশগুলোতে বিশৃঙ্খলা সৃষ্টির মাধ্যমে মুসলিম বিশ্বের উপর নিজেদের রাজপরিবারের কর্তৃত্ব প্রতিষ্ঠার পথ সুগম করতে চাচ্ছে, ঠিক যেভাবে এজিদ নিজেকে মুসলিম বিশ্বের খলীফারূপে প্রতিষ্ঠা করবার জন্য কারবালা ও মদীনায় হত্যাযজ্ঞ চালিয়েছিল। এদের সাহাবীপ্রেমও আবার এতটাই অদ্ভূত (Peculiar) যে, নবী কর্তৃক বেহেশতের যুবকদের নেতা হিসেবে ঘোষিত নবীর প্রিয়তম সাহাবী কলিজার টুকরা দৌহিত্রকে হত্যা করলেও এবং সেই হত্যাকাণ্ডের পক্ষে নির্লজ্জভাবে সাফাই গাইলেও সাহাবীর অসম্মান হয় না, আর সাহাবীদের মধ্যে থার্ড ক্লাস এক ব্যক্তির দুই আনা দামের লম্পট ও নিষ্ঠুর অসাহাবী পুত্রকে মন্দ বললে তাতে সাহাবীর সম্মান ক্ষুণ্ন হয়, যেহেতু এর দ্বারা প্রকারান্তরে একজন সাহাবীর সিদ্ধান্তকে (অর্থাৎ, মুয়াবিয়া কর্তৃক ইয়াজিদকে উত্তরাধিকারী নির্বাচনের সিদ্ধান্তকে) ভুল বলা হয়।
যারা বলেন, খলীফার বিরুদ্ধে বিদ্রোহ করে ইমাম হোসাইন (রা) অন্যায় করেছেন, তাদেরকে বলি, তাহলে আপনারা কেন মুসলিম দেশগুলোতে রাষ্ট্রবিরোধী সন্ত্রাসী কর্মকাণ্ড পরিচালনা করছেন? ইয়াজিদের বেলায় এবং ইয়াজিদের বর্তমান উত্তরসূরী অত্যাচারী রাজা-বাদশাদের বেলায় আমীরের আনুগত্য বা শাসকের আনুগত্যের ফযীলত বয়ান করা, খলীফার অবাধ্যতার অপকারিতা তুলে ধরা; কিন্তু আর সব মুসলিম রাষ্ট্রের বেলায় আল্লাহর আইন ও তাওহীদ প্রতিষ্ঠার গুরুত্ব বয়ান করা, রাষ্ট্র ও বিচার ব্যবস্থার বিরুদ্ধে বিদ্রোহকে জরুরী সাব্যস্ত করা— এসব ডবল স্টান্ডার্ড পলিসির মানে টা কী? এক জায়গায় কোরআনের রেফারেন্স দিয়ে বলবেন, আল্লাহর আইন দিয়ে বিচার না করলে কাফের হবে; আরেক জায়গায় আল্লাহর আইনের খণ্ডিত ও অপপ্রয়োগ হলেও তাদের প্রতি আনুগত্য প্রদর্শনকে জরুরী বলবেন- এমন ভণ্ডামি গ্রহণযোগ্য নয়।
বাংলাদেশে চরমপন্থী সন্ত্রাসী কার্যক্রমের স্থপতি ব্যক্তি কোন্ ইউনিভার্সিটি থেকে দীক্ষা নিয়ে এসেছিলেন, তা সবাই জানে। মুসলিম বিশ্বে খেলাফত প্রতিষ্ঠার নাম দিয়ে কেউ কোন একটা বিশেষ রাজবংশের রাজতন্ত্র প্রতিষ্ঠার ধান্ধায় লিপ্ত আছে কিনা, সে ব্যাপারে মুসলিম যুবকদের সচেতন থাকতে হবে এবং ওরকম কোন চক্রের খপ্পরে পড়া থেকে সাবধান থাকতে হবে। মুসলিম বিশ্বের নারীদেরকে কোন রাজপ্রাসাদের হেরেমের খাদেমা (বাঁদী) বানাতে দেয়া হবে না। যারা ইহুদী রাষ্ট্র ইসরাইলকে লালন করছে, যারা নবীর দৌহিত্রকে সপরিবারে হত্যাকারী শাসককে গুরু মানে, তাদের দ্বারা আর যাই হোক ইসলামের কল্যাণ হতে পারে না।
ভেবে দেখুন, যারা জেনেশুনে ঠাণ্ডা মাথায় ইতিহাস বিকৃত করতে পারে, ইতিহাসের এক প্রতিষ্ঠিত খলনায়ককে নায়ক বানাতে পারে ও নায়ককেই অবজ্ঞা করতে পারে, তারা কিভাবে সহীহ হাদীসের একমাত্র পুরোহিত বিবেচিত হতে পারে, তা আমার বোধগম্য নয়। হাদীস সংকলনের ক্ষেত্রে তো যারা ভুলক্রমে জীবনে দু'একটা মিথ্যা বলেছে তাদেরকেও গ্রহণযোগ্যতার তালিকা থেকে বাদ দেয়া হয়েছে। আর আজ চরম মিথ্যাবাদী আফফাক ও কাযযাবদের কাছ থেকে আমাদেরকে হাদীসের তালিম নিতে হবে কেন? খুঁটিনাটি মাসলা-মাসায়েলের বিষয় ও এবাদতের পদ্ধতি নিয়ে সমাজে হাঙ্গামা সৃষ্টি করে এরা কাদের এজেন্ডা বাস্তবায়ন করতে চায়? যারা ধর্মের নাম দিয়ে রাজসেবায় লিপ্ত, বিশেষ পরিবারের ক্ষমতা ও ভোগ-বিলাসকে নিশ্চিত করবার জন্য যারা ধর্মকে ব্যবহার করছে; ধর্মীয়, রাজনৈতিক বা ঐতিহাসিক যেকোন ব্যাপারে তাদের দেয়া সবককে গিললে আমাদেরকে আবার ইসলামপূর্ব জাহেলী যুগে ফিরে যেতে হবে।
উমাইয়া শাসক (মুয়াবিয়া ও এজিদ) আর খারিজী উভয়ে ছিল নবী (সা) পরিবারের (আলী ও হুসাইনের) অভিন্ন প্রতিপক্ষ। [অবশ্য উক্ত দুটি দল নিজেরাও একে অপরের প্রতিপক্ষ ছিল।] আর বর্তমানে অতীতের এ দুটি গোষ্ঠীকেই (অর্থাৎ তাদের মানসপুত্র ও উত্তরসূরীদের) এক বিন্দুতে মিলিত হতে দেখা যাচ্ছে। নব্য খারিজীরা একদিকে ইয়াজিদের প্রতি মহব্বত ও আনুগত্য প্রকাশ করত: ইমাম হুসাইনের সমালোচনায় মেতে উঠেছে, অপরদিকে খারিজীদের আদলে আল্লাহর আইন কায়েমের ধুয়া তুলে সন্ত্রাসী কর্মকাণ্ডে ইন্ধন যোগাচ্ছে। আলী (রা) ও হুসাইন (রা)-এর শত্রু দুটি পক্ষ এই ১৪০০ বছর পরে এসে কিভাবে যে একটি পক্ষে রূপান্তরিত হয়ে গেল, তা আশ্চর্যের বিষয়।
দুনিয়ার সকল মুসলিম এমনকি সকল ধর্মাবলম্বী সাধারণ মানুষের কাছে যেখানে 'কুফা' শব্দটি অশুভ বা অপয়া অর্থে এবং 'কারবালা' শব্দটি গণহত্যা, বীভৎসতা ও মানবিক বিপর্যয় অর্থে ব্যবহৃত হয়ে আসছে; যেখানে প্রখ্যাত ওলী শাহ নেয়ামতউল্লাহ এক ভবিষ্যদ্বাণীতে বলেছেন, "প্রত্যেক ঘরে ঘরে কারবালা সংঘটিত হবে।", সেখানে
বক্র চিন্তার কিছু মানুষ সব যুগে সব স্থানেই থাকে। সত্যকে মিথ্যা আর মিথ্যাকে সত্য বানাতে না পারলে এদের পেটের ভাত হজম হয় না। এসব মানুষকে কোনদিন ভালো মানুষের পক্ষে উকালতি করতে বা ভালো কাজের পক্ষে যুক্তি পেশ করতে দেখবেন না। কেবল মন্দ লোকদের মন্দ কাজকে আড়াল করা বা জাস্টিফাই করা এবং যেকোন মন্দ কাজের পক্ষে যৌক্তিকতা অন্বেষণ করার পিছনেই এরা সর্বদা লেগে থাকে। একটা মন্দ কাজ কতটা জরুরী বা অপরিহার্য ছিল, তা প্রমাণে উঠেপড়ে লাগে। আসলে আল্লাহর রহমত ছাড়া বিকৃতি ও গোমরাহি থেকে বেঁচে থাকা মানুষের পক্ষে সম্ভব হয় না। হে আল্লাহ! যাবতীয় বিকৃত চিন্তার ভাইরাস থেকে আমাদের সকলের মন, চিন্তা, কথা ও কর্মকে তুমি মুক্ত রেখো।
বিষয়: বিবিধ
২৪২২ বার পঠিত, ০ টি মন্তব্য
পাঠকের মন্তব্য:
মন্তব্য করতে লগইন করুন