একটি অযৌক্তিক অনুযোগ ও তার যৌক্তিক জবাব

লিখেছেন লিখেছেন ওবাদা বিন সামেত ১২ জানুয়ারি, ২০১৭, ০৬:০৫:৩১ সকাল

মানুষ বলে, আমার ছেলের বউ সংসারের কোন কাজই করে না, শুধু নিজের বাচ্চা নিয়েই পড়ে থাকে। আমি মানুষকে বলি, বউকে যদি সুস্থ ও কর্মক্ষম রাখতে, তাহলে বউ তোমার সংসারের কাজ আরো উত্তমরূপে আঞ্জাম দিতে পারত। বউয়ের বাচ্চাটাকে যদি সুস্থ থাকতে দিতে, তাহলে বাচ্চার চিকিৎসা ও পরিচর্যায় ঔষধ-পথ্য তৈরির পিছনে অতিরিক্ত সময় ও এনার্জি ব্যয় করতে হতো না। আর বলাবাহুল্য, সেই বেঁচে যাওয়া সময় ও কর্মশক্তিটা বউ তখন নিজের অসুস্থ ও দুর্বল শিশুকন্যার সেবায় না দিয়ে তোমার সুস্থ-সবল যুবতী কন্যাদের রসনার সেবায় লাগাতে পারত- আদার রস বাটার সময়টাতে সে তখন তোমার মেয়ে ও মেয়ে-জামাইদের জন্য আরো দুটো অতিরিক্ত মুখরোচক খাবার তৈরি করতে পারত। বউয়ের বাপের বাড়ি থেকে আসা দুধের চালান থেকে তোমার যুবতী কন্যা ও যুবক পুত্রের কফি খাওয়া বাবদ নয় ভাগ খরচ করে এক ভাগও যদি বউয়ের শিশুকন্যাটির জন্য রেখে দিতে, বউয়ের বাচ্চার দুধ খাওয়া নিয়ে কটাক্ষ ও কড়াকড়িটা যদি একটু রয়ে সয়ে করতে, বাজার থেকে কেনা দুধগুলো যদি ল্যাক্টোমিটার দিয়ে মেপে মেপে তুলনামূলক খাঁটি দুধটা নিজের মেয়ের হেফাজতে দিয়ে নিম্নমানের দুধটা বউয়ের বাচ্চার জন্য না রাখতে, যদি নিয়মিতভাবে দুধের সরগুলো তুলে তুলে শুধু মেয়ের ঘরের নাতিনকে খাইয়ে ছেলের ঘরের নাতিনের জন্য শুধু পানির অংশটা রেখে না দিতে; তাহলে বাচ্চার হাত-পা টেপার পিছনে যে সময়টা ব্যয় হয়েছে, সেই সময়টাতে তোমার এই বউটা তোমার প্রিয় ছেলেটি ও তোমার আদরের চাকুরীজীবি বউমাটির জন্য আরো দুই পদ অধিক উপাদেয় খাদ্যের যোগান দিতে পারত। বাচ্চা পেটে থাকার দুর্বল ও নাজুক মুহুর্তে তোমার ছেলের বউকে যদি দীর্ঘক্ষণ রান্নাঘরে দাঁড়িয়ে থেকে ঘাম ঝরাতে ও পায়ে পানি নামাতে বাধ্য না করতে, যদি ফিড়ির উপর তরকারি কাটতে বসে পেটের বাচ্চার উপর অযাচিত শারীরিক চাপ প্রয়োগ করতে না দিতে, বাচ্চা ডেলিভারির সময় যদি টাকার হিসাব না করে তুলনামূলক সহজ ও নিরাপদ পন্থা গ্রহণ করতে দিতে, বউয়ের শরীরে যদি চিরস্থায়ী খুঁত সৃষ্টি হতে না দিতে; তাহলে একটা সুস্থ সবল কর্মক্ষম বউ সর্বদা তোমার পাশে পেতে। কিন্তু নিজের কপাল যে তুমি নিজেই পুড়েছ। স্বার্থপর মানুষ যে শেষ পর্যন্ত নিজের স্বার্থটাও রক্ষা করতে পারে না, তারই ইতিহাস সৃষ্টি করেছ তুমি।

তুমি মানুষের কাছে বলে বেড়াও, আমার ছেলের বউ আমার ঘর-সংসার ফেলে যখন তখন বাপের যায়, এত বেশি বাপের বাড়ি বেড়ানোটা কোনমতেই গ্রহণযোগ্য নয়। আমি বলি, এই ছেলের বউটিকে দিয়ে তোমার বাকি ৩ ছেলেমেয়ে ও বউ-জামাইদের জন্য তাদের পছন্দ ও ফরমায়েশ মোতাবেক (২ x ৩)= ৬ পদ করে রান্না করানোর পাশাপাশি ৭ম পদটি যদি বউকে নিজের রুচি ও প্রয়োজন মত রান্না করে খাওয়ার স্বাধীনতা দিতে, বউয়ের বাপের বাড়ি থেকে আসা খাবারগুলোর ৫%ও যদি ছেলের বউ ও তার বাচ্চাকে খেতে দিতে, তাহলে বউকে বছরে ৭ দিন বাপের বাড়ি কাটাতে হতো না। ফলে তুমি তোমার প্রিয় সন্তানাদিকে নিয়ে বছরে ৩৬৫ দিনই ৬/৭ পদ করে ফরমায়েশি মুখরোচক খাবার বউকে দিয়ে করিয়ে খেতে পারতে; তোমাদের দৈনিক বনভোজন ও রসনাবিলাসটা (৩৬৫ - ৭)= ৩৫৮ দিনে সীমাবদ্ধ রাখতে হতো না। বছরের সাত সাতটা দিন অতি কষ্টে মাত্র তিন পদ তরকারি দিয়ে গরীবী খানা খেয়ে জিহবা ও পেট মহাশয়কে কষ্ট দিতে হতো না। সর্বোপরি যে বাচ্চার দাদাবাড়িতে বাচ্চার দুধ খাওয়া নিয়ে খোঁটা শুনতে হয়, সে বাচ্চার নানাবাড়ি যাওয়া নিয়ে আপত্তি জানানোর অধিকার কারো নেই। ইসলামের বিধান হলো, একটা বিড়ালকেও আটকে রাখার অধিকার তোমার নেই। একটা বিড়ালকে বেঁধে রাখতে হলেও পারতপক্ষে এতটুকু নিশ্চিত করতে হবে যে, মুক্ত অবস্থায় বিড়ালটি যে মানের ও পরিমাণের খাবার সংগ্রহ করে খেতে পারত, কমপক্ষে সেই সমমানের ও সমপরিমাণের খাবার তাকে provide করতে হবে।

তোমার অভিযোগ, তোমার অপ্রিয় ছেলে ও ছেলের বউটি শুধু নিজেদের বাচ্চাকেই খাওয়ায়, কোলে নেয়, গোসল করায়; তোমার মেয়েদের বাচ্চাগুলোর প্রতি অনুরূপ যত্ন করে না। কিন্তু আগেই বলেছি, তুমি যদি বউটাকে সুস্থ থাকতে দিতে, তাহলে নিজের বাচ্চার পাশাপাশি তোমাদের আরো পাঁচটা বাচ্চাকেও লালন-পালন করতে পারত। কিন্তু বউকে তো নিজের বাচ্চা কোলে নেবারই সময় বা সুযোগ দাওনি, নিজের বাচ্চা কোলে নেবার শক্তি-সামর্থ্যটুকুও অবশিষ্ট রাখতে দাওনি। নিজের বাচ্চার একান্ত জরুরী কাজগুলো যেগুলো না করলেই নয়, সেগুলো তো শত অসুবিধার মধ্যেও মানুষ করতে বাধ্য। এখন কেউ সেগুলো কোনমতে চালিয়ে নিতে পারলেই যে তার কাছ থেকে অন্যদেরটাও আশা করতে হবে এবং তা প্রোভাইড করতে না পারার জন্য তার প্রতি অনুযোগ প্রকাশ করতে হবে, এর কোন মানে নেই।

তুমি মনে কর, বউয়ের দায়িত্ব হলো নিজের কোলের বাচ্চাকে ফেলে রেখে দিন-রাত শুধু তোমার সংসারের (মানে তোমার মেয়েদের) সেবায় আত্মনিয়োগ করা। অবশ্য তোমার এ আকাঙ্ক্ষাটিও পূরণযোগ্য ছিল। বউ তোমার মেয়েদের সেবার্থে রান্নাঘরে অবস্থানকালে তুমি যদি বউয়ের বাচ্চাটাকে নিরাপত্তা দিতে পারতে, বাচ্চার মায়ের অনুপস্থিতিতে বাচ্চাটাকে তোমার দজ্জাল কন্যাগুলোর হাতে অরক্ষিত অবস্থায় ফেলে না রাখতে, তোমার গুণধর কোয়ান্টাম মাস্টার্স প্রো-অ্যাকটিভ মেয়েরা যদি ভাতিজীকে একা পেলে সুযোগ পেলে যখন তখন ধাক্কা না মারতো, বাচ্চার মা নিজের অনুপস্থিতিতে বাচ্চাকে তোমার জিম্মায় রাখার পরও তুমি যদি তোমার রাজকীয় কন্যার গোবেচারা দাসীকে বউয়ের বাচ্চার কাছে রেখে নিজে তোমার মেয়ের বাচ্চাদের কাছে চলে না যেতে, তোমার পুত্রবধূর বাচ্চাকে সঙ্গদানের অপরাধে আল্লাহর অপর কোন অসহায় নিষ্পাপ বান্দা যদি তোমার কন্যার প্ররোচনায় তোমার জামাই বাবার লাথি খেয়ে আর্তচিৎকার করে আল্লাহর আরশ কাঁপিয়ে না তুলত, তাহলে তোমার এই ছেলের বউটা বাচ্চার নিরাপত্তার ব্যাপারে নিশ্চিন্ত হয়ে ২৪ ঘন্টা সময়ই নির্দ্বিধায় তোমার সংসারের সেবায় দিয়ে দিতে পারতো।

তুমি সর্বদা বলে থাক, বউ কোন কাজই করে না, শুধু নিজের বাচ্চাই পালে। আচ্ছা, বলতো দেখি, বউয়ের ক্ষেত্রে নিজের (মাসুম) বাচ্চা পালন করাটা যদি কাজের মধ্যে না পড়ে, তাহলে তোমার ক্ষেত্রে নিজের (ধামড়া-ধামড়ি) বাচ্চা

কী আশ্চর্য! তুমি একদিকে বলে বেড়াও, বউ কোন কাজ করে না, শুধু খায় আর ঘুমায়। অপরদিকে অভিযোগ কর, বউ শুধু বাপের বাড়ি গিয়ে পড়ে থাকে। এখন কথা হলো, যে কোন কাজই করে না, সে বেড়াতে গেলে সমস্যা হবে কেন? অকম্মা মানুষ ঘরে না থাকলে তো আরো সুবিধা হবার কথা, কাজ না করা বউ দু'দিনের জন্য বাপের বাড়ি থাকলে তো আপনাদের আরো খুশি হবার কথা যে, যাক বাঁচা গেল, দু'দিনের ভাত বাঁচল। অকর্মণ্যতার অভিযোগ আর বেড়ানোর অভিযোগ এই দুটো দাবি কি পরস্পরবিরোধী ও সাংঘর্ষিক নয়? কৈ, আপনার মেয়েদের শ্বশুরকূল থেকে তো তাদের বেড়ানো নিয়ে কোন অভিযোগ আসে না। আপনার মেয়েরা বছরভর আপনার কোলের মধ্যে পড়ে থাকলেও তাদের শাশুড়ী-ননদদের তরফ থেকে তো কোন অনুযোগ করা হয় না। কারণ, আপনার মেয়েদের কাছ থেকে কোন সার্ভিস লাভের আশাই তারা করে না। তারা কোনদিন শাশুড়ী বা ননদকে এক বেলা ডিম পোছ করেও খাওয়ায়নি। বছরে এক-আধদিনের জন্য শাশুড়ীর মুখদর্শন করলেও ওখানে তারা মেহমান হিসেবেই যায়, মেহমান হিসেবেই থেকে বেড়িয়ে আসে।

আরো আশ্চর্যের বিষয় হলো, তোমরা দাবি কর, বউকে দাসী-বান্দী হিসেবে ব্যবহার করবার ইচ্ছা ও মানসিকতা নাকি তোমাদের নেই, এমনকি বউয়ের কাজ খাওয়ার প্রয়োজনই তোমাদের নেই, ৫/৬ টা দাস-দাসী রাখার সামর্থ্য নাকি তোমাদের আছে। কিন্তু কথা হলো, তাই যদি হবে, তাহলে বউ দু'-তিন দিনের জন্য বাপের বাড়ি গেলে সমস্যা হয় কেন? বউয়ের বাপের বাড়ি যাওয়া নিয়ে তোমরা অমন নেকড়ে বাঘের মত ক্ষিপ্ত হয়ে ওঠ কেন? কেনই বা তোমরা ছেলে বিয়ে করিয়ে বউ আনার সাথে সাথে বউকে চিরকাল চিড়িয়াখানার পশুর মত খাঁচায় আটকে রাখার এবং জীবনে কোনদিন বাপ-মায়ের বাড়িতে যেতে না দেবার সিদ্ধান্ত প্রকাশ করেছিলে?

তোমার বহুল প্রচারিত আরেকটা অভিযোগ হলো, আমার ছেলের বউ আমার মেয়েদেরকে দেখতে পারে না, সহ্য করতে পারে না। আমার মেয়েরা মাঝেমধ্যে এক-আধটু বেড়াতে আসে; ওরা (মেয়েরা) যখন আসে, তখনই সে (বউ) বিরক্তি বোধ করে। ---- ন্যায়বিচারের দাবি তো ছিল কিসাস (অর্থাৎ, ইচ্ছাকৃতভাবে সাধন করা শারীরিক ক্ষতির বদলে সমপরিমাণ শারীরিক শাস্তি), নিদেনপক্ষে দিয়াত (অর্থাৎ, অর্থের দ্বারা ক্ষতিপূরণ)। অথচ ভিকটিমদের তরফ থেকে কোন কিসাসের দাবি নয়, দিয়াতের দাবি নয়, এমনকি কোন মামলা বা অভিযোগও নয়, কোন প্রকাশ্য প্রতিবাদও নয়, শুধু মনে মনে কষ্ট অনুভব করাটাকেও তোমরা tolerate করতে পার না?

হে মানুষ! শুধু মানুষের কাছে কি পেলাম কি না পেলাম, তা নিয়ে দরবারে দরবারে অনুযোগ করে বেড়াও? অথচ মানুষ তোমার দ্বারা কতটুকু উপকৃত হলো, আর কতটুকু ক্ষতিগ্রস্থ হলো- সেই হিসাবটা দেখ না? আর মানুষেরই বা আক্কেল কী? শুধু বউয়ের সহযোগিতার অভাবে শাশুড়ী অসুস্থ হলো কিনা, তা নিয়ে বিলাপ করে বেড়ায়। তাদেরকে জিজ্ঞেস করি, শাশুড়ীর অসুস্থতা কি বউয়ের কারণে হয়েছে? এই বউ কি তাকে অসুস্থ বানিয়েছে? অথচ বউয়ের অসুস্থতার জন্য উক্ত শাশুড়ী ষোলআনাই দায়ী, জ্বলজ্যান্ত একটা সুস্থ মানুষকে ইচ্ছাকৃতভাবে ঠাণ্ডা মাথায় পঙ্গু বানিয়েছে নিজের মেয়েদের আদর-যত্ন ও মনরক্ষা করতে গিয়ে। কোথায় বউয়ের অভিভাবকরা ছেলেপক্ষের অভিভাবকদেরকে তলব করবে ও কৈফিয়ত চাইবে; উল্টো আরো ক্রিমিনালরাই ভিকটিমের অভিভাবকদের তলব করে। এরা মাইরাও জেতে, কাইন্দাও যেতে। এ ধরনের নীচু মনমানসিকতার রক্তপিপাসু মহিলাদের হিংসা ও কুটিলতার শিকার হওয়া থেকে আল্লাহতাআলা আমাদেরকে হেফাজত করুন।

এই জগৎ সংসারে এমন আহাম্মক কাকে পাবেন, যে নিজে না খেয়ে বা উচ্ছিষ্ট ও ঝড়তা-পড়তা খেয়ে অন্যের জন্য উত্তম খাবারের যোগান চিরদিন দিয়েই যাবে! একজন নিজের দুধের বাচ্চাকে ফেলে রেখে, নিজের মাথার ঘাম পায়ে ফেলে, নিজেকে ও নিজের বাচ্চাকে অসুস্থ বানিয়ে রকমারি সুস্বাদু সব খাবার তৈরি করবে; আর আরেকজন সেই খাবার থেকে উত্তম ও সার অংশটি [ভাতের বেলায় উপরের অংশ (নিজের মেয়ে ও মেয়ে-জামাইদের জন্য) নিয়ে তলার অংশ (বউ ও তার বাচ্চার জন্য) রেখে যাওয়া, মুরগীর বেলায় স্যুপটি (নিজের মেয়ের জন্য) নিয়ে সাবাটি (অর্থাৎ নীরস মাংসপিণ্ডটি) আর সবাইকে দেয়া, দুধের বেলায় সর তুলে নিয়ে (নিজের মেয়ে ও মেয়ের বাচ্চার জন্য) পানির অংশ (বউয়ের বাচ্চার জন্য) রেখে দেয়া, (বউয়ের বাপের বাড়ি থেকে কষ্ট করে বয়ে আনা) আখের মধ্যে গোড়াটা নিজেরা তুলে নিয়ে আগাটা (বউয়ের বাচ্চার হাতে) ধরিয়ে দেয়া] নিয়মিত তুলে নিয়ে যাবে- এই রেওয়াজকে চিরস্থায়ী বন্দোবস্ত হিসেবে মেনে নেবে এমন কোন নারী কোথাও নেই। আর মেনে নিলেই বা সেটা কি কোন যৌক্তিক উদারতা ও মহত্ত্বের পর্যায়ে পড়ে? আদব-কায়দার অর্থ কি এই যে, যতসব মগের মুল্লুক মার্কা কাণ্ডকারখানা অম্লান বদনে মেনে নেয়া? অন্যায়কে প্রশ্রয় দেয়া- সে তো আরেক অন্যায়। অন্যায়কারী ও জালেমকে সহযোগিতা করাও তো একপ্রকার জুলুম। অবিচারকে সহ্য করাও তো আরেকটা অবিচার।

শুধু বউ বেড়াতে গেলেই যে সমস্যা হয় তাই নয়, কোন কাজে তুমি কিছুদিনের জন্য বাইরে গেলেও তো ফেরার সাথে সাথে তোমার মেয়েদের খাবারের কষ্টের অনুযোগ শুনতে পাও। উল্লেখ্য, সেই কষ্টটা হলো ৬ পদের বদলে ৩ পদ করে খাওয়ার কষ্ট। [আর সেই বাকি ৩ পদও যে তুমি উপস্থিত থাকলে তুমি করে খাওয়াতে তা নয় বরং তুমি মেয়েদের পক্ষ থেকে হুকুম জারি করে বউকে দিয়েই করাতে।] তোমার আদরের দুলালী ননীর পুতুলেরা (যদিও তাদের মনটা ননীর পুতুল নয়, পিতলের মূর্তি) যদি শৌখিন কষ্টও সহ্য করতে না পারে, তাহলে পরের মেয়ে কিভাবে তোমার ও তোমার মেয়েদের আরোপিত বাস্তব কষ্ট ও দুর্ভোগ সহ্য করে?

হে মানুষ! স্মরণ করে দেখ, তুমি যখন পুত্রবধূ ছিলে, তখন তোমার শ্বাশুড়ী-ননদরা তো তোমাকে একতরফাভাবে শুধু দাসী-বান্দীরূপে ব্যবহার করেনি। তুমি নিজেই না নিজ শ্বাশুড়ীর নামেই অনুযোগ করতে গিয়ে বলেছ, শ্বাশুড়ি যখন এদিক ওদিক বেড়াতে যেত, তখন তুমি কাজের চাপে অসুবিধায় পড়ে যেতে। একথার দ্বারা তো প্রকারান্তরে এই তথ্যটাই প্রকাশ পায় যে, তোমার শ্বাশুড়ীর উপস্থিতিতে তোমার উপর কোন কাজের চাপ পড়ত না। অপরদিকে তুমি যখন অনুপস্থিত থাক, তখন তোমার বউ একটু নি:শ্বাস নেবার সুযোগ পায়, তোমার মারফত আগত তোমার মেয়েদের ফরমায়েশী অর্ডারগুলো ফলো করতে গিয়ে বাড়তি নাভিশ্বাস ওঠার কর্মগুলো থেকে অব্যাহতি পায় এবং রান্না-খাওয়ার কর্মটি তুলনামূলক সংক্ষেপে ও আয়েশে সম্পন্ন করতে পারে। তোমার শাশুড়ী অনুপস্থিত থাকলে বউয়ের কষ্ট হতো, অপরদিকে তুমি অনুপস্থিত থাকলে বউয়ের সুবিধা হয় আর মেয়েদের কষ্ট হয়- এ থেকেই তো প্রমাণিত হয় যে, শ্বাশুড়ী হিসেবে তোমার শাশুড়ী ও তোমার মধ্যে কে উত্তম। তদুপরি তোমার শাশুড়ী-ননদেরা তোমার বাচ্চাদেরকেও কোলে-পিঠে করে মানুষ করেছে, তোমার ছেলে-মেয়েদের দিকে কখনো হিংসা ও বিদ্বেষের দৃষ্টিতে তাকায়নি, তোমার ছেলে-মেয়েদের খাবারের উপর কুনজর দেয়নি। কিন্তু তা সত্ত্বেও তো তুমি শাশুড়ী-ননদকে জব্দ করবার জন্য, তোমার উপর কথিত অন্যায়-অবিচারের প্রতিশোধ নেবার জন্য ধর্মদ্রোহী ভ্রষ্টাচারী মহিলার সাথে হাত মিলিয়েছ, তোমার শ্বশুরকূলের এক নিষ্পাপ অবোধ শিশুকে বলির পাঠা বানিয়েছ। তোমার এক সহযোদ্ধার বিদ্রোহের আগুনে ইন্ধন যোগাতে গিয়ে সেই আগুনে নিষ্পাপ শিশুকে দগ্ধ করিয়েছ। তোমার কল্পিত দু:খ-কষ্টের জ‍ন্যই যদি তুমি এতখানি প্রতিহিংসাপরায়ণ হয়ে থাকতে পার; তাহলে তোমার ঘরের যে পুত্রবধূকে তুমি ইচ্ছাকৃত ও পরিকল্পিতভাবে বাস্তবেই ক্ষতির শিকার করেছ, বাচ্চাসহ অসুস্থ বানিয়েছ, তার কাছে তুমি কিরূপে নম্রতা ও আনুগত্য আশা কর? কিভাবে শর্তহীন নিরবচ্ছিন্ন অব্যাহত সেবা কামনা কর? এমনকি কোন পাল্টা প্রতিবাদ না হতেই এবং সেবা ও সহযোগিতায় কোনরূপ কমতি ঘটার পূর্বেই আগ বাড়িয়ে বদনাম করে বেড়াতে শুরু কর?

মানুষ গরুর দুধ খাবে, এটাই স্বাভাবিক। কিন্তু এক্ষেত্রে দুটি শর্ত অবশ্যপালনীয়। শর্ত দুটি হচ্ছে- গরুকে ঘাস খেতে দিতে হবে এবং গরুর বাছুরকেও এক ঢোক দুধ খাবার সুযোগ দিতে হবে।

সকলের মনে রাখা উচিত, ঘরের বউ (বা যেকোন সার্ভিস প্রদানকারী ব্যক্তি) হচ্ছে সোনার ডিম পাড়া হাঁসটির মত। আর বউয়ের হাতের মুখরোচক রান্না হচ্ছে সেই সোনার ডিমগুলোর মত। একবারে সব খেতে চাইলে চিরদিনের তরে হারাতে হয়। (হয় মরে যাবে, নাহয় অকেজো হয়ে যাবে, নয়তো বিগড়ে যাবে।) বউয়ের দুর্বল মুহুর্তের (স্বামীর বেকারত্ব এবং নিজের গর্ভাবস্থা ও বাচ্চা ছোট থাকা) সুযোগ নিয়ে হাউমাউ করে লাকলুকিয়ে চেটেপুটে একবারে যত পারি খেয়ে নেবার প্রবণতা তোমাকে চিরকালের জন্য বউয়ের আন্তরিক সেবা থেকে বঞ্চিত হবার উপযোগী করেছে। বউকে শারীরিকভাবে অসুস্থ ও অক্ষম এবং মানসিকভাবে হতাশ ও বিরক্ত বানিয়ে তুমি নিজেরই ক্ষতি করেছ। কথায় বলে, "অতি চালাকের গলায় দড়ি।" তুমি চালাকি, চাপপ্রয়োগ ও ব্লাকমেইলের দ্বারা অতিরিক্ত কাজ আদায় করতে গিয়ে যে পরিমাণ সার্ভিস তোমার তকদিরে ছিল তাও খুইয়ে বসেছ। তুমি মূলত: লাভবান হতে পারনি, জিততে পারনি। পরকে ঠকাতে গিয়ে নিজেও ঠকে গেছ। কিন্তু যদি মনে করে থাক, আমার জেতার দরকার নেই, লাভের প্রয়োজন নেই, বউটাকে তো শায়েস্তা করতে পেরেছি; ছেলেটাকে ও ছেলের বাচ্চাটাকে যথাক্রমে পঙ্গু বউ ও পঙ্গু মা নিয়ে সারাজীবন কাটানোর বন্দোবস্ত করে দিতে পেরেছি- এতেই আমার কলিজা ঠাণ্ডা, এতেই আমার অন্তরের জ্বালা নিবারণ; তাহলে বলতে চাই, এই বউ তোমার কী এমন ক্ষতি করেছিল, যার জন্য তাকে জব্দ করাটাকেই তোমার জীবনের লক্ষ্য বানাতে হবে? সে কি তোমার বাড়া ভাতে ছাই দিয়েছিল, পাকা ধানে মই দিয়েছিল? সে কি নিজে যেচে তোমার ঘরের অন্ন ধ্বংস করতে এসেছে, নাকি তুমিই আগ বাড়িয়ে তাকে তোমার পুত্রবধূরূপে নির্বাচিত করেছ? তোমার মেয়েদের জোরালো বিরোধিতার মুখেও এবং বিয়ের পাত্রীর সাথে তোমার মেয়েদের নাকগলানো জেরা ও অশালীন আচরণের পরও তুমিই নাকে খত দিয়ে অনুনয়-বিনয় ও কান্নাকাটি করে বউপক্ষকে আশ্বস্ত করেছ। তুমি কি মনে কর, তাকে তোমার ঘরে ঠাঁই দিয়ে ধন্য করেছ, করুণা করেছ? তার বাপের ঘরে কি ভাতের অভাব ছিল? তার বিয়ের জন্য কি পাত্রের অভাব ছিল? তোমার ঘরে যেটুকু নগদ থাকা-খাওয়া দিয়েছ, তার চাইতে বহুত উত্তম অবস্থায় সে তার পিতৃগৃহেই সসম্মানে স্বাচ্ছন্দ্যে কাটাতে পারত। অতএব, এমনটি ভাবার কোন কারণ নেই যে, একটা অভুক্ত আশ্রয়হীন নারীকে তুমি আশ্রয় দিয়ে করুণা করেছ, তার বিনিময়ে তাকে সামান্য দু'মুঠো ভাত খেয়ে বা না খেয়ে তোমার ও তোমার মেয়েদের সেবায় তার নিজের জীবন উৎসর্গ করতে হবে। তুমি কি বউয়ের বাচ্চাকে দিনে এক ঢোক করে দুধ খেতে দিয়ে কৃতার্থ করেছ? নাকি বউ ও তার বাচ্চাকেই তোমাদের সেবায় পড়ে থাকতে গিয়ে বাচ্চার নানাবাড়ির ঘরের গাইয়ের খাঁটি দুধ বিনা হিসাবে খাওয়া থেকে বঞ্চিত থাকতে হয়েছে?

সর্বোপরি নিজের মেয়েদেরকে চিরদিন বাপের বাড়িতে রেখে তাদেরই সেবার্থে আরেকজনের মেয়েকে সারাজীবনের জন্য বাপের বাড়িতে যেতে না দেবার আবদার জগতের কোন আইনেই ধোপে টিকবে না। কোন বিবেকবান সুবিবেচকের কাছে এ সমস্ত একতরফা স্বেচ্ছাচারী অনুযোগ পাত্তা পাবে না। কেবল বিবেকহীন পক্ষপাতদুষ্ট ব্যক্তিই এসব অনুযোগে সায় দিতে ও এর সাথে তাল মিলাতে পারে।

বিষয়: বিবিধ

১৭৪৫ বার পঠিত, ০ টি মন্তব্য


 

পাঠকের মন্তব্য:

মন্তব্য করতে লগইন করুন




Upload Image

Upload File