"আপনি ভুল করেও এক ডাস্টবিনের ময়লা আরেক ডাস্টবিনে ফেলবেন না"

লিখেছেন লিখেছেন ওবাদা বিন সামেত ০৭ অক্টোবর, ২০১৬, ০৭:৫৬:৫৮ সকাল

ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের কলাভবনের সামনে দিয়ে যারা চলাচল করেছেন, তাদের সকলের চোখেই কমবেশি এই নোটিশটা পড়ে থাকবে। এই সতর্কবাণীটাকে আগে হাস্যকর বলেই মনে হতো। ভাবতাম, কার এমন ঠেকা পড়েছে, খেয়েদেয়ে আর কাজ নেই, এক ডাস্টবিনের ময়লা তুলে আরেক ডাস্টবিনে ফেলতে যাবে! কিন্তু অনেকদিন পর মনে হলো, কথাটা একেবারে ফেলনা নয়। আমার বিবেচনায় এই বাক্যটির মাঝে যে সমস্ত অন্তর্নিহিত তাৎপর্য লুকিয়ে থাকতে পারে, তা হলো:-

(১) একজনের কথা আরেকজনের কাছে লাগাবেন না।

(২) একজনের মাথায় কাঁঠাল ভেঙ্গে আরেকজনকে খাওয়াবেন না।

(৩) একজনের গুণ বা দোষ আরেকজনের উপর চাপাবেন না। অন্যায়কারীর পরিবর্তে অন্যায়ের শিকার ব্যক্তিকে তিরস্কার করবেন না।

(৪) একজনের প্রাপ্য হক বা অধিকার আরেকজনকে দিয়ে দেবেন না কিংবা একজনের দায়িত্ব বা বোঝা আরেকজনের উপর চাপিয়ে দেবার কথা ভাববেন না। একজনের কাজের বিনিময়ও আরেকজনকে দেবেন না।

(৫) এক জায়গায় মারা দিয়ে আরেক জায়গা থেকে ভাড়া তুলতে যাবেন না। এক জায়গায় লোকসান দিয়ে আরেক জায়গা থেকে পুষিয়ে নিতে যাবেন না। এক জায়গাতে নিজের সব বিলিয়ে দেবেন, আরেক জায়গা থেকে যত পারেন যথাসম্ভব হাতিয়ে নেবেন- এমন কাজটি করতে যাবেন না। অর্থাৎ, এক জায়গায় শুধু দিয়েই যাবেন, আরেক জায়গা থেকে শুধু নিতেই থাকবেন- এরকম করা যাবে না। এক পাত্রে দান করে বা এক গাছে পানি দিয়ে আরেক পাত্র থেকে বা আরেক গাছ থেকে ফল লাভের আশা করবেন না।

(৬) এক জায়গা থেকে ঋণ নিয়ে আরেক জায়গার ঋণ শোধ করবেন না।

(৭) একজনের হাতে মার খেয়ে আরেকজনের উপর প্রতিশোধ নেবেন না।

(৮) একেজনের সাফল্যের তথা আরেকজনের কাছে (বিশেষত হিংসুক ও প্রতিদ্বন্দ্বী ব্যক্তির কাছে) পাচার করবেন না।

বর্ণনা:

(২) একজনের শ্রম বা সম্পদ তার স্বত:স্ফূর্ত ও স্বেচ্ছাপ্রণোদিত সম্মতি বা উপযুক্ত বিনিময় ছাড়া অন্য কারো জন্য ভোগ করা বৈধ নয়। আল্লাহ বলেন, "তোমরা পারস্পরিক সম্মতিভিত্তিক ব্যবসায়িক বিনিময় ছাড়া একে অপরের সম্পদ অন্যায়ভাবে ভক্ষণ করো না।" বিশেষ করে অসুস্থ ও স্পর্শকাতর অবস্থায় যে সময় তার কাছ থেকে সার্ভিস গ্রহণ করলে তার (এবং তার সাথে আরো কারো) শারীরিক ক্ষতি হবার জোরালো সম্ভাবনা থাকে, সেই অবস্থায় সম্মতি থাকলেও তার থেকে কোন সেবা গ্রহণ বৈধ নয়। কারণ, অসহায় অবস্থায় মানুষ নিজের সম্পদ ও শ্রম অনিচ্ছা সত্ত্বেও নিরূপায় হয়ে জড়তার কারণে দিয়ে বসতে পারে। যেমন- যুদ্ধ ও দাঙ্গার সময় অনেকে সস্তা দামে জায়গা-জমি ও গরু-বাছুর বিক্রি করে দিয়ে যায়; এক্ষেত্রে বাহ্যত এটা সম্মতিক্রমে লেনদেন হলেও বাস্তবে এটা সম্মতিভিত্তিক লেনদেনের মধ্যে পড়ে না। কারো ফসল নষ্ট হয়ে যাবার উপক্রম হওয়ায় এবং সংরক্ষণ করতে না পারায় পানির দরে বিক্রি করে দিতে বাধ্য হল, এটাও সম্মতিভিত্তিক লেনদেন নয়। আবার খাদ্য গুদামজাত করে কৃত্রিম সংকট সৃষ্টি করে ভোক্তাকে বেশি দামে কিনতে বাধ্য করা হল, এক্ষেত্রে ক্রেতার দেয়া টাকাটা বাহ্যত সম্মতিসূচক হলেও আসলে ঠেকাবশত বলেই গণ্য হবে। এমনকি ঋণ গ্রহণের ক্ষেত্রেও আপনি কেবল তার কাছ থেকেই ঋণ চাইতে পারেন, যে আপনাকে "না" বলতে সক্ষম। আপনার স্ত্রী বা পুত্রবধূ স্বেচ্ছায় সামর্থ্যের মধ্যে নিজের কোনরূপ শারীরিক ক্ষতি না করে আপনাকে যতটুকু দেবে, কেবল ততটুকু ভক্ষণ করাই আপনার জন্য হালাল। এর বাইরে জুলুম বা কষ্ট দিয়ে একটা ভাতের দানাও আপনার জন্য দোযখের জ্বালানি হবে, এক ফোঁটা তরকারির ঝোলও আপনার জাহান্নামের পানীয়ে রূপান্তরিত হবে। আর সেই কষ্ট প্রদান ও ক্ষতি সাধনটা যদি ইচ্ছাকৃত ও পরিকল্পিতভাবে অন্যায় ও অযৌক্তিক প্রতিহিংসাবশত হয়ে থাকে, তাহলে তা নি:সন্দেহে চরম জুলুম ও সীমালংঘনমূলক আচরণ।

(৩) এক ধরনের মানুষ আছে, যেকোন কাজের বেলায় (বিশেষ করে যে কাজ ভাল ও প্রশংসনীয় হিসেবে বিবেচিত হবে) অন্য কেউ করলেও (বা অন্যকে দিয়ে করানো হলেও বা কাজের কষ্টটা নিজে ভোগ করার পরিবর্তে অন্যকে ভোগ করিয়ে থাকলেও) তার কৃতিত্বটা নিজে নিয়ে নেয় অথবা নিজের প্রিয় ব্যক্তিদের কাউকে দিয়ে দেয়। আর যেকোন অকাজের বেলায় (বিশেষ করে যে কাজ মন্দ ও নিন্দনীয় হিসেবে বিবেচিত হবে কিংবা যেকোন অলসতা, আরাম ও সুখ ভোগের কাজ) তা নিজে করলেও বা নিজের প্রিয় ব্যক্তিদের মধ্য থেকে কেউ করে থাকলেও তার দায়টা নিজের অপ্রিয় (বা অপেক্ষাকৃত কম প্রিয়) কারো উপর চাপিয়ে দেয়।

আমি একটা জিনিস বুঝি না, মানুষ এসব আচরণ কেন করে? এসব কাজ করে কী লাভ! নিজেরই পেটের ছেলেমেয়েদের মধ্যে কাউকে ঋণ করে হলেও ঘি খাওয়াতে হবে, আর কাউকে বাচ্চা-কাচ্চাসহ শুকিয়ে মারতে হবে; একজনকে লেবুর মত নিংড়ে বাদবাকিদের মোটাতাজা করতে হবে- এমন অদ্ভুত প্রবণতা ও সংকল্পের হেতুটা কি? একজনকে (প্রাপ্তবয়স্ক বুঝমান মহিলা হওয়া সত্ত্বেও) ফরমায়েশ মত খাবার প্রদানে সর্বদা বাধ্য থাকিবেন, প্রতিটি রান্না তার পছন্দ ও অর্ডার মতো হবে; আরেকজনকে (অবুঝ শিশু হওয়া সত্ত্বেও) "রিজিক আসে আল্লাহর তরফ থেকে, খাবার যখন যা পাওয়া যায় তখন তাতেই সন্তুষ্ট থাকতে হয়" বলে নসীহত করবেন- এমন মুনাফেকিটা কি না করলেই নয়? সূরা কাসাসের প্রথম আয়াতে বর্ণিত ফেরাউন কর্তৃক দেশবাসীকে বিভিন্ন দলে বিভক্ত করে রেখে তার মধ্যে একটি অংশকে দুর্বল করে রাখার মত নিজের ছেলেমেয়েদের মাঝেও এরূপ অসম বৈষম্যমূলক আচরণ কেন করছেন? এতে আপনার নিজের কী উপকার হচ্ছে, আর আপনার সন্তানদেরই বা কী কল্যাণ হচ্ছে! নাহয় বুঝলাম যে, একজনের তুলনায় আরেকজনের প্রতি আপনার ভালবাসা বেশি থাকতেই পারে। তাই মন চাইতে পারে তুলনামূলকভাবে নিজের প্রিয় ও পছন্দেরগুলোকে আদর-আস্তিক ও খাতির-যত্ন একটু বেশিই উপহার দিতে। কিন্তু এতে কি সত্যিকার আদর করা হলো? উদর পূর্তি করে রসনা তৃপ্ত করে খাওয়াতে পারাটাই কি আদর? আপনি যাকে ভালবাসবেন, তার দুনিয়া ও আখেরাতের সার্বিক কল্যাণই তো চাওয়ার কথা।

বিষয়: বিবিধ

১০৪৩ বার পঠিত, ০ টি মন্তব্য


 

পাঠকের মন্তব্য:

মন্তব্য করতে লগইন করুন




Upload Image

Upload File