কাশ্মীর শুধুই কাশ্মীর না,অনেক কিছু

লিখেছেন লিখেছেন স্বপ্নলোকের সিঁড়ি ২৬ সেপ্টেম্বর, ২০১৬, ০৭:৫০:৪২ সন্ধ্যা

নব্বই দশকের শেষ প্রান্তে বিজেপি সরকারের আমলে সংঘ পরিবারের ২০ হাজার স্কুলে পাঠ্য ভূগোল বইয়ের মানচিত্রে ভারত, পাকিস্তান, বাংলাদেশ, তিব্বত, মিয়ানমার, নেপাল ও ভুটানকে অখণ্ড ভারতের অবিচ্ছেদ্য অংশ হিসাবে দেখানো হয় এবং ভারত মহাসাগরকে হিন্দু মহাসাগর, আরব সাগরকে সিন্ধু সাগর এবং বঙ্গোপসাগরকে গঙ্গা সাগর হিসাবে আখ্যা দেয়া হয়।

শুধু তাই নয়, আফগানিস্তান, লাওস, থাইল্যান্ড ও কম্বোডিয়াকেও অখণ্ড ভারতের অংশ হিসাবে কল্পনা করা হচ্ছে। বিশ্বব্যাপী হিন্দুদের সংগঠিত করে এ লক্ষ্যে পৌঁছার স্বপ্ন লালন করা হচ্ছে। খণ্ড বিখণ্ড ভারতকে ঐক্যবদ্ধ করা হচ্ছে কট্টরপন্থী হিন্দু মহাসভার ঘোষিত নীতি। এ ব্যাপারে অর্পণা পাণ্ডে এক্সপ্লেইনিং পাকিস্তান ফরেন পলিসি শিরোনামে গ্রন্থের ৫৬ নম্বর পৃষ্ঠায় উল্লেখ করেছে, "The Hindu Maha Sabha had declared: India is one and indivisible and there can never be peace unless and until the separated parts are brought back into the Indian Union and made integral parts thereof."

অর্থাৎ হিন্দু মহাসভা ঘোষণা করেছে: ভারত অভিন্ন ও অবিভাজ্য। বিচ্ছিন্ন অংশগুলো যতদিন ভারত ইউনিয়নে ফিরিয়ে এনে সেগুলোকে ভারতের অবিচ্ছেদ্য অংশে পরিণত করা না হবে ততদিন শান্তি আসবে না।



চিত্রঃ অখন্ড ভারত।

ভারতের এ দৃষ্টিভঙ্গী তাদের পূর্বপুরুষদের মনোজগত হতেই মূলত উত্থাপিত। প্রাচীন ভারতীয় রাজ্য উপদেষ্টা চাণক্য তার অর্থশাস্ত্রে অনৈতিকতার বীজ বপন করে গেছেন।যাকে ভারতের ম্যাকিয়াভেলীও বলা হয়ে থাকে।সক্রেটিস নিরক্ষর ছিলেন বলে ধারনা করা হয়।তার শিষ্য প্লেটো গুরুর ধারণাকে রিপাবলিকে তুলে ধরেছেন-সেখানে ন্যায়তত্ব গুরুত্ব পেয়েছে,কিন্তু চাণক্য বা কৌটিল্য এরকম ন্যায় ধারণার বাইরে এসে আগ্রাসি রাজনৈতিক তত্বে বিশ্বাসী ছিলেন।ভারতের পররাষ্ট্রনীতিতে এখনও চাণক্যনীতি এখনও বিরাট স্থান দখল করে আছে গান্ধী ও নেহেরুনীতির পাশাপাশী।



চিত্রঃ চাণক্য।

জন মিয়ারশাইমার রাজনৈতিক বস্তুতন্ত্র তত্ত্বের বিশেষ শাখা আগ্রাসী বস্তুতন্ত্রবাদ বা অফেনসিভ রিয়েলিজ্‌মের একজন গবেষক ও ব্যাখ্যাদানকারী। এই তত্ত্বকে হ্যান্স মর্গানথর ক্লাসিকাল রিয়েলিজ্‌ম থেকে একটু আলাদা করে সংজ্ঞায়িত করা হয়ে থাকে এবং বলা হয় যে আন্তর্জাতিক ক্ষেত্রে উদ্ভূত বিভিন্ন সংঘাতময় পরিস্থিতির জন্য মানব সম্প্রদায়ের স্বাভাবিক আচরণ দায়ী নয় বরং দায়ী হচ্ছে মূলত শক্তিশালী রাষ্ট্রগুলোর নিরাপত্তাজনিত প্রতিযোগীতা। বস্তুতন্ত্রবাদের আরেকটি শাখা ডিফেন্সিভ রিয়েলিজ্‌ম, আন্তর্জাতিক সম্পর্ক বিশেষজ্ঞ কেনেথ ওয়াল্টজ যেটির ব্যাখ্যা দেন, অফেনসিভ রিয়েলিজ্‌ম তা থেকেও কিছুটা ভিন্নতা অবলম্বন করে ব্যাখ্যা দেয় যে কোন রাষ্ট্রই তার বর্তমান শক্তির সম্পর্কে সন্তুষ্ট থাকেনা বরং প্রতিনিয়ত নিরাপত্তা ব্যাবস্থায় নেতৃত্ব অর্জনের জন্য চেষ্টা চালিয়ে যায়।

মিয়ারশাইমার আগ্রাসী বস্তুতন্ত্রবাদ প্রসঙ্গে তার দৃষ্টিভঙ্গিকে দ্যা ট্র্যাজেডি অফ গ্রেট পাওয়ার পলিটিক্স বইয়ে এভাবে তুলে ধরেছেন-

" বর্তমান ও ভবিষ্যতের নিশ্চয়তার জন্য কতটুকু ক্ষমতাবান হওয়া যথেষ্ট এটি নিরূপণ করা যেহেতু সহজ নয়, সেহেতু শক্তিধর রাষ্ট্র বা সুপার পাওয়ারগুলো প্রতিনিয়ত ক্ষমতার বিস্তারের জন্য ও প্রতি ক্ষেত্রে নেতৃত্ব দেয়ার জন্য সদা সচেষ্ট থাকে যেন তারা অন্যান্য প্রতিপক্ষ হতে আগত সম্ভাব্য হুমকির মোকাবেলা করার জন্য সবসময়ে প্রস্তুত থাকতে পারে। যদি কোন রাষ্ট্র এই ধারণা লাভ করে যে তারা ইতোমধ্যেই যথেষ্ট পরিমাণ ক্ষমতার্জন করতে পেরেছে, এর অর্থ হচ্ছে উক্ত রাষ্ট্রটি প্রকৃতপক্ষে ভুল পথে পরিচালিত হচ্ছে এবং তারা ক্ষমতা বৃদ্ধির জন্য তাদের প্রাপ্ত সুযোগ গুলোর সদ্ব্যাবহার করতে ব্যার্থ হবে।"

মিয়ারশাইমারের ব্যাখ্যা অনুযায়ী ক্ষমতার কোন স্ট্যাটাস কো শ্রেণীভুক্ততা নেই কেননা কোন শক্তিধর রাষ্ট্র যদি বাস্তবে তার প্রতিপক্ষের চেয়ে অধিক ক্ষমতা অর্জন করতে সক্ষম হয় তবে রাষ্ট্রটি স্বাভাবিক নিয়মেই অপেক্ষাকৃত দূর্বল প্রতিপক্ষের প্রতি আগ্রাসন প্রদর্শন করবে বা প্রবণতা ব্যাক্ত করবে। এই ব্যাখ্যা দেয়ার মাধ্যমে মিয়ারশাইমার গণতান্ত্রিক শান্তি তত্ত্বের যথার্থতাকেও নাকচ করেছেন। গণতান্ত্রিক শান্তি তত্ত্ব মূলত ব্যাখ্যা করে যে গণতান্ত্রিক রাষ্ট্রগুলো কখনওই বা অধিকাংশ ক্ষেত্রে যুদ্ধে লিপ্ত হয়না বা শান্তিভঙ্গের কারণ সৃষ্টি করেনা; এবং আগ্রাসী বস্ততন্ত্রবাদ এই ব্যাখ্যাকে যৌক্তিক মনে করে না।

ভারতের আগ্রাসীনীতির বহি;প্রকাশ হল-তার সীমান্ত।ভারত-পাক ও ভারত-বাংলাদেশ সীমান্ত বিশ্বের সবচেয়ে ঝুকিপূর্ণ সীমান্ত হিসেবে চিহ্নিত।

ভারত-পাকিস্তান সীমান্ত

এই সীমান্তের ৪০টি ‘স্পর্শকাতর’ অংশে ‘লেজার’-এর বেড়া দেয়া হবে বলে জানিয়েছে ভারত৷ পাকিস্তান থেকে ভারতে অবৈধ প্রবেশ ঠেকাতে এই ব্যবস্থা নেয়া হচ্ছে৷ এর ফলে বেড়ার সংস্পর্শে কিছু আসলে উচ্চস্বরে সাইরেন বেজে উঠবে৷ ২০১১ সালের জুনে ‘ফরেন পলিসি’ ম্যাগাজিনে প্রকাশিত প্রতিবেদন অনুযায়ী, ১৮০০ মাইল দীর্ঘ এই সীমান্তে নিহত হয়েছে এক লক্ষ ১৫ হাজারের বেশি মানুষ।

বাংলাদেশ-ভারত সীমান্ত

আইন ও সালিশ কেন্দ্রের হিসাব অনুযায়ী, ২০১৫ সালে বাংলাদেশ-ভারত সীমান্তে বিএসএফ এর হাতে ৪৬ জন বাংলাদেশি নিহত হয়েছে৷ আহত হয়েছে ৭৩ জন৷ এছাড়া অপহরণ করা হয়েছে ৫৯ জনকে৷ কয়েক সপ্তাহ আগে ভারতের কেন্দ্রীয় স্বরাষ্ট্রমন্ত্রী রাজনাথ সিং অবৈধ অনুপ্রবেশ বন্ধ করতে বাংলাদেশ-ভারত সীমান্ত শিগগিরই বেড়া দেয়ার কাজ শেষ করার পরিকল্পনা নেয়া হয়েছে বলে জানান৷

তাছাড়া আমেরিকার বিভিন্ন থিংকট্যাংকের গবেষণায় দেখা গেছে -বিশ্বের ক্রমবর্ধমান অর্থনীতি পশ্চিম হতে পূর্বে অর্থাৎ এশিয়ায় সম্প্রসারিত হবে।এক্ষেত্রে চীনই হবে এর নিয়ন্তা।BRICS গঠনের সিদ্ধান্ত আমেরিকার উদ্বেগ আরো বাড়িয়ে দিয়েছে। চীনের এ বর্ধিষ্ণু অর্থনীতিকে টেক্কা দিতে বিকল্প ভারসাম্যের জন্য ভারতকে দরকার আমেরিকার।Blue Water Economy নিয়ন্ত্রণেও ভারতকে দরকার।কাশ্মীরের কিছু অংশ ও অরুণাচল প্রদেশ চীনের সাথে লাগোয়া হবার দরুণ ব্যাপারটি আরো জটিল রূপ ধারণ করেছে।সেভেন সিস্টারের ভৌগলিক রাজনীতি ও অর্থনীতি ভারতের জন্য আরেক মাথাব্যাথা।

এমতাবস্থায় কাশ্মীরের চলমান স্বাধীনতাকামী আন্দোলন নিয়ে পাক-ভারত উত্তেজনা শেষ পর্যন্ত ৩য় বিশ্বযুদ্ধে রূপ নিতে পারে বলে বিশেষজ্ঞরা মত প্রকাশ করেছেন।উরির সেনা হত্যাকান্ড নিয়ে পরাশক্তিগুলোর সামরিক মহড়া বিশেষকরে ভারতের অনুরোধ উপেক্ষা করে পাক-রাশিয়া সেনা মহড়া ও চীনের পাকিস্থানের প্রতি একনিষ্ঠ সমর্থন বৈশ্বিক রাজনীতিতে এক নতুন আবহ তৈরি করেছে।কাশ্মীরের রয়েছে ভূরাজনৈতিক ও অর্থনৈতিক ক্ষেত্র।যার কারণে ভারত বিভিক্তির পরেই স্বাধীন রাজ্য কাশ্মীর নিয়ে ভয়াবহ যুদ্ধ হয়।সংখ্যাগরিষ্ঠ মুসলিম জনগণ ও অমুসলিম রাজা হরিসিং দ্বন্দে কাশ্মীরের দুই-তৃতিয়াংশ ভারত ও এক -তৃতিয়াংশ পাকিস্তান অধিকৃত হয়।মুসলিম সংখ্যাগরিষ্ঠ জনগণের উপর অব্যাহত জুলুম নির্যাতনের প্রেক্ষিতে গড়ে উঠা আন্দোলনে বিষয়টি জাতিসংঘেও উত্থাপিত হয়।

আসলে ইতিহাস সবসময় বিজয়ীদের পক্ষে থাকে।আঞ্চলিক রাজনীতির যাতাকলে পড়ে কাশ্মীর স্বাধীন হতে পারেনি সত্য কিন্তু তারা মজলুম।বাংলাদেশের অন্যতম মূলনীতি হল জোটনিরপেক্ষ ও মজলুমদের পাশে থকা।সংবিধানের ২য় ভাগের ২৫ অনুচ্ছেদ "Promotion of intrenational peace,security & solidarity...C-তে বলা হয়েছে-.Support oppressed peoples throughout the world waging a just struggle against imperialism, colonialism or racialism. কিন্তু কাশ্মীরের ক্ষেত্রে এর ব্যতিক্রম হয়েছে।কিন্তু বাংলাদেশের জনগণ বা রাষ্ট্র মজলুম কাশ্মীরের পাশে আছে যদিও সরকার নেই।ব্রিটিশ ভারতে ১৭৯৮ সালে লর্ড ওয়েসলি "Policy of subsidiary allince" বা অধীনতামূলক মিত্রতা নীতি চালু করেন যার মূল কথা হল-কোন রাজ্য চাইলে স্বাধীন থাকতে পারবে কিন্তু ব্রিটিশ সরকারকে কর দিতে হবে,স্বাধীন পররাষ্ট্রনীতি প্রণয়ন করতে পারবে না এমনকি ব্রিটিশ সৈন্যদের ব্যয়ভার বহন করতে হবে।তাহলে কি আমরা আধুনিক আধীনতামূলক মিত্রতা নীতির আওতায় আছি?

বিষয়: বিবিধ

১৪১৮ বার পঠিত, ০ টি মন্তব্য


 

পাঠকের মন্তব্য:

মন্তব্য করতে লগইন করুন




Upload Image

Upload File