স্বাধীনতা ও চাওয়া-পাওয়া
লিখেছেন লিখেছেন স্বপ্নলোকের সিঁড়ি ২০ জুলাই, ২০১৬, ১০:২৪:৫৮ রাত
স্বাধীনতার ৪৪ বছরের এ লগ্নে আজ নির্মোহ পর্যালোচনা দরকার-অর্থবহ স্বাধীনতা আমরা কতটুকু পেয়েছি।কোন সংকীর্ণ মানসিকতা বা দলীয় ভাবাবেগ আশ্রিত না হয়ে সত্যটাই উন্মোচিত হওয়া আবশ্যক জাতির বৃহত্তর স্বার্থে।আমাদের অনেক পরে স্বাধীনতা লাভ করেও আমাদের চেয়ে সকল দিক দিয়ে এগিয়ে আছে এরকম দৃষ্টান্ত আছে অনেক।মালয়েশিয়া বা জেলেপল্লী সিঙাপুর তাদের ভীশনের কারণেই আজ প্রায় উন্নত বিশ্বের কাতারে।
আমাদের সংবিধানের প্রস্তাবনায় বলা হয়েছে-আমাদের রাষ্ট্রের মূল লক্ষ্য হইবে গণতান্ত্রিক পদ্ধতিতে এমন এক শোষণমুক্ত সমাজের প্রতিষ্ঠা যেখানে সকল নাগরিকের জন্য আইনের শাসন,মৌলিক মানবাধিকার এবং রাজনৈতিক,অর্থনৈতিক ও সামাজিক সাম্য,স্বাধীনতা ও সুবিচার নিশ্চিত হইবে।
যার যা প্রাপ্য তাকে তাই দেয়ার নামই হচ্ছে সুবিচার।প্লেটো তার রিপাবলিকে ন্যায় বা সুবিচারের বিস্তর আলোচনা করেছেন।ইতিবাচক অর্থে কথায় ও কাজে সততাই হচ্ছে সুবিচার।পশ্চিমা ধারণায়,সমাজ ও রাস্ট্রের সিদ্ধান্তে সততা,সমঅধিকার ও সবার কল্যাণই সুবিচার।মানবাধিকার,সুষম বন্টনব্যবস্থা ইত্যাদির প্রাতিষ্ঠানিক ও অপ্রাতিষ্ঠানিকরূপও সুবিচারের সাথে জড়িত।এর সাথে রাজনীতি,অর্থনীতিসহ রাষ্ট্রিক সকল দিকও সম্পর্কযুক্ত।
বিচার ব্যবস্থা সুবিচারের একটি বড় অনুষঙ্গ।আমাদের সংবিধানেও এটি নিশ্চিত করার কথা বলা হয়েছে।
পৃথবীর বিভিন্ন মহান বিপ্লবোত্তর সময়ে বা বিপ্লবের মূলমন্ত্রে জনগণের ঐক্যকে গুরুত্বের সাথে বিবেচনা করা হয়েছে।সে ঐক্য ধরে রাখার জন্যও উদ্দ্যোগও ছিল লক্ষ্যণীয়।মেন্ডেলা জাতির ঐক্যের স্বার্থে অনেক বড় বড় ছাড় দিয়েছেন।আমাদের মুক্তিযুদ্ধ পরবর্তী সময়েও জাতীয় ঐক্যের জন্য চেষ্টা করা হয়েছিল।কিন্তু,স্বাধীনতার এতবছর পরেও আমাদের জাতীয় ঐক্য কাঙিত মানে আসতে পারেনি।বিভক্তির বীজ ক্রমশ বিস্তৃত হচ্ছে।যা সামগ্রিক উন্নয়ন কর্মকান্ডের প্রতিবন্ধক।
মুক্তিযুদ্ধ ও ইসলামকে অত্যন্ত সুকৌশলে দাঁড় করানো হয়েছে পরস্পর বিরোধীরূপে।"মুক্তিযুদ্ধের পরবর্তীকালে ইসলাম এলার্জী শিক্ষিত সমাজের মধ্যে একটা মানসিক ব্যাধির ন্যায় বিরাজ করছে।ইসলামের কথা শুনামাত্রই তারা বিরক্তি ও ঘৃণাভরে কতকটা তোতাপাখির মতই কতপয় শব্দ উচ্চারণ করে বসে-যেমন,প্রতিক্রিয়াশীল,সাম্প্রদায়িক।বিনা জ্ঞানে কোন কিছু সম্পর্কে মন্তব্য করা যে প্রতিক্রিয়াশীলতার লক্ষণ সে সত্যটাই তারা বেমালুম ভূলে যায়।কোন দর্শনকে প্রত্যাখ্যান করতে হলেও যে সেই দর্শন সম্পর্কে সম্যক জ্ঞান থাকা আবশ্যক সে কথা স্মরণ করিয়ে দেবার কোন প্রয়োজন আছে বলে মনে করিনা(অরক্ষিত স্বাধীনতাই পরাধীনতা-মেজর জলিল-পৃষ্ঠা--৭৪).।
ইসলামকে নাটক সিনেমার মাধ্যমে মুক্তিযুদ্ধের বিরোধী শক্তি হিসেবে প্রাতিষ্ঠার প্রয়াস ইদানিংকালে মাত্রাতিরিক্তভাবে বেড়ে গেছে।স্বাধীনতা বিরোধী মানেই দাড়ি টুপিওয়ালা কোন ব্যক্তির প্রতিচ্ছবি।৯০ ভাগ মুসলমানের দেশে এর প্রতিক্রিয়া যে কি হতে পারে তা নিয়ে সকলের ভাবা দরকার।এক্ষেত্রে সাম্রাজ্যবাদী,আধিপত্যবাদী শক্তির হাত যে আছে তা সুস্পষ্ট।সরকারসহ সকলকে এই জাতিবিনাসী প্রকল্প হতে জাতিকে উদ্ধার করার জন্য এগিয়ে আসা উচিত।অসংখ্য মায়ের জায়নামাজ ভিজিয়ে দেয়া কান্না,আল্লাহর কাছে জালিমের বিরূদ্ধে ফরিয়াদ কি মুক্তিযুদ্ধের চেতনার বিরুধী।শামসুর রহমানের মতো সেক্যুলার কিছিমের কবি এই সত্যকে অস্বীকার করতে পারেননি।তিনি বলেছিলেন,স্বাধীনতা তুমি,পিতার কোমল জায়নামাজের উদার জমিন।
অর্থবহ স্বাধীনতার জন্য প্রয়োজন ব্যাপক জনসচেতনতা।জাতীয় ক্রান্তিকালে ইস্পাতকঠিন ঐক্য।আমরা আজো এটি নিশ্চিত করতে পারিনি।স্বাধীনতার চেতনা যে বিভক্তির নয়,ঐক্যের সে বিষয়টি সর্বমহলে ছড়িয়ে দেয়া প্রয়োজন।
রাষ্ট্রের শক্তিসামর্থ্য বিশাল।রাষ্ট্র তার সকল অঙগকে গড়ার কাজে নিয়োজিত করলেই সে দেশ ও জাতির কল্যাণ হয়।আর একে নিয়ন্ত্রণে রাখতে না পারলে সীমাহীন ভোগান্তির শিকার হতে হয়।দেশ আজ এক ভয়ঙ্কর চোর ডাকাতদের হাতে জিম্মি।সকল স্তরেই সীমাহীন দূর্নীতি।পাহাড়সম দূর্নীতির,আকন্ঠ মজ্জাগত স্বভাবের কারণেই স্বাধীনতার অর্থবহতা নষ্ট হচ্ছে প্রতিনিয়তই।করাপশন ইন্ডেকক্সে আমাদের এ অবস্থান বরাবরই উর্ধমুখী।
আমাদের স্বাধীনতা ও স্বার্বভৌমত্ব আজ অনেকাংশে প্রশ্নের উর্ধে নয়।মিয়ানমারের মতো প্রতিবেশী রাষ্ট্রের হাতে আমাদের সীমান্তরক্ষী বাহিনী বিজিবি মার খাচ্ছে।এমনকি বিজিবি নায়েককে ধরে নিয়ে যাওয়ার ঘটনাও ঘটেছে।
সীমান্ত হত্যার কোন সুষ্ঠু কোন সুরাহা আমরা করতে পারিনি।বিএসএফের হাতে প্রতিদিনই নিরীহ বাংলাদেশীরা প্রাণ দিচ্ছে।ফেলানীরা প্রতিনিয়তই প্রতিনিধিত্ব করছে সীমান্ত হত্যাকান্ডের।ভারতের সীমান্তজুড়ে মাদকের কারখানা আর মাদকপাচার এক সময় আমাদের জাতিসত্বাকে নষ্ট করে দিতে পারে।ইয়াবা আগ্রাসন তার একটা উদাহরণমাত্র।
পার্বত্য চট্রগ্রাম স্বাধীন বাংলাদেশের ভূরাজনৈতিক ও অর্থনৈতিক দিক দিয়ে সম্ভাবনাময় এক জনপদ।সেই ব্রিটিশ শাসনামল হতে এই জনপদের দিকে ছিল সাম্রাজ্যবাদীদের লোলুপদৃষ্টি।১৮৬০ সালে চট্রগ্রাম হতে পৃথক করে পার্বত্য চট্রগ্রাম জেলা করা হয়।১৯৯৭ সালের ২ ডিসেম্বর ১৫ পৃষ্ঠার পার্বত্য শান্তিচুক্তি করা হয়।এতে ১২ টি উপজাতিকে বাদ দেয়া হয়।ভৌগলিক দিক দিয়ে ভারতের কাছে পার্বত্য জেলাগুলো অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ।নাফ নদীর তীর পর্যন্ত ভারতের আধিপত্য বিস্তার আর সাতবোন রাজ্যকে নিয়ন্ত্রণে রাখতে কৌশলগত দিক দিয়ে এ অঞ্চল ভারতের দরকার।ভারত-পাকিস্তান সীমান্ত নির্ধারণের সময় ভারত রেডক্লিফের কাছে সে দাবি করেছিল।কিন্ত ভৌগলিক বাস্তবতায় ভারতের সে দাবি মানা হয়নি।এরপরেও ভারত এখানে তার প্রভাব ধরে রাখতে অনুগত শ্রেণীর সৃষ্টি করে।শান্তিবাহিনীর মাধ্যমে পাহাড়ে অশান্তি জিইয়ে রাখা হয়েছে।গত ৩৫ বছরে শান্তিবাহিনীর হাতে ৮৫ হাজার সৈন্য,বিদ্রোহী ও বেসামরিক লোক নিহত হয়েছে।বাঘাইছড়ি,কাউখালী,পানছড়ি হত্যাকান্ড শান্তিবাহিনীর বর্বরতার প্রমাণ।ভারতের দি টেলিগ্রাফ পত্রিকায় নভেম্বর ১৯৯৬ সালে শান্তিবাহিনীর সাথে ভারতীয় সং্যোগের চিত্র প্রকাশিত হয়।কলকাতার আলোকপাত পত্রিকায় ১৯৯৬ সালে উত্তম উপাধ্যায় নামে এক রিপোর্টার খুবই পরিষ্কারভাবে জানিয়েছেন,এখন ১০ হাজার চাকমার মিলিশিয়া বাহিনী যে ভারতীয় সামর্থ্যপুষ্ট এটা ত্রিপুরার ছোট ছোট বাচ্ছারাও বুঝে।RAW's Role in Furthering Indias Foreign Policy বইতে অশোক রায়না বলেন,"RAW is now involved in training rebles of chakma tribes & shantibahini who carryout subversibe activities in Bangladesh.(মোহাম্মদ নূরুল ইসলাম-পার্বত্য চট্রগ্রাম:সমস্যা ও স্বরূপ প্রবন্ধ)
সাংস্কৃতিক আগ্রাসন আমাদের স্বাধীনতা ও স্বার্বভৌমত্বের জন্য একটি বড় চ্যালেঞ্জ।আমাদের নিজস্ব সংস্কৃতির বিকাশ সাধন আমরা করতে পারছিনা।বরং বিজাতীয় সংস্কৃতির কাছে আমরা সততই পরাজিত হচ্ছি।ব্যক্তিক সচেতনতা ও রাষ্ট্রিক পৃষ্ঠপোষকতা ছাড়া এটি আমরা ধরে রাখতে পারবনা।সংস্কৃতির বিনিময়ের নামে বিভিন্ন রাষ্ট্রীয় উৎসবে আমাদের নিজস্ব সংস্কৃতি পরাজিত হচ্ছে।এর ফলে জাতীয় জীবনে এক ভয়াবহ অবক্ষয় নেমে এসেছে।আকাশ সংস্কৃতির এ যুগে আমাদের মৌলিক স্বাতন্ত্রবোধ রক্ষার্থে এগিয়ে আসা উচিত।
আমাদের গার্মেন্টস সেক্টর প্রতিনিয়ত আক্রান্ত হচ্ছে।অথচ এটি আমাদের জাতীয় আয়ের একটি গুরুত্বপূর্ণ মাধ্যম।ঘন ঘন শ্রমিক বিদ্রোহ আর অসন্তোষের নামে এই সেক্টরে একরকম নৈরাজ্য চলছে।এজন্য সরকারকে উপযুক্ত ব্যবস্থা নিতে হবে।শ্রমিক বিদ্রোহের আড়ালে ভিনদেশী কোন ষড়যন্ত্র থাকলে তা শক্তহাতে প্রতিরোধ করা দরকার আমাদের সমৃদ্ধির স্বার্থে।
আমাদের রাজনৈতিক সংস্কৃতির আমূল পরিবর্তন নিয়ে আসা জরুরী।রাজনৈতিক ঐক্যহীনতা আমাদেরকে গ্রাসের কারণে জাতীয় জীবনে এর প্রভাব ক্রিয়াশীল।সংকীর্ণ রাজনৈতিক দলাদলির পরিবর্তে জাতীয় উন্নতিই হওয়া দরকার রাজনীতির লক্ষ্য।জাতীয় দূর্যোগমূহূর্তে রাজনৈতিক ঐক্যই হতে পারে আমাদের রক্ষাকবচ।উন্নত দেশগুলোতে এটাই দেখা যায়।
সংবিধান বর্ণিত সকল নাগরিক ও মৌলিক অধিকার,মতপ্রাকাশের স্বাধীনতা,সভা সমাবেশের স্বাধীনতা নিশ্চিতকল্পে উন্নত গণতন্ত্রের দিকে যাত্রাই হোক ৪৪ তম বিজয় দিবসের প্রত্যয়।আর যেন কেউ মেজর জলিলের মত আক্ষেপ করে বলতে না পারে-"আমার সাধের স্বাধীন বাংলায় আমিই হলাম প্রথম রাজবন্দী।৩১ ডিসেম্বর ১০টা ১০.৩০টায় আক্রমণকারী বাহিনীর হাতে বন্দী হয়ে বাংলাদেশের স্বাধীনতার আসল রূপের প্রথম দৃশ্য দেখলাম আমি।ভারতীয় বাহিনীর মদদে বাংলাদেশ স্বাধীন করার অর্থ ও তাৎপর্য বুঝে উঠতে তখনও আর এক মিনিটও বিলম্ব হয়নি।"
বিষয়: রাজনীতি
১৫১২ বার পঠিত, ১ টি মন্তব্য
পাঠকের মন্তব্য:
কথাটা যদি সবাই বুঝতো তবে দৃশ্যপট বদলে যেত।
মন্তব্য করতে লগইন করুন