জঙ্গীবাদের পোস্টমর্টাম ও জাসদ প্রসঙ্গ
লিখেছেন লিখেছেন স্বপ্নলোকের সিঁড়ি ১৪ জুন, ২০১৬, ১০:৫৬:১০ রাত
জঙ্গীবাদের ধোঁয়ায় তমসাচ্ছন্ন ৫৬ হাজার বর্গমাইলের প্রতিটা জনপদ(মিডিয়া ও সরকারি ভাষ্যমতে)।প্রতিদিন অহরহ জঙ্গীদের!অহরহ সরঞামসহ আমাদের সামনে হাজির করা হচ্ছে।কর্তাব্যক্তিরা সহাস্যবদনে,গর্বিতস্বরে তাদের কৃতিত্বও জাহির করছেন।
কয়েকজন মাননীয় মন্ত্রি রিতিমতো এ বিষয়ে জিহাদ ঘোষণা করেছেন-অবস্থাদৃশেয়্য মনে হচ্ছে।জলবায়ূ পরিবর্তন সংক্রান্ত অনুষ্ঠানেও এ বিষয়ের অবতারণা হচ্ছে।
Huntington তার "Clash of Civilization" লিখেছিলেন যে প্রেক্ষাপটে বহমান এ সময়ে মনে হচ্ছে সবাই তার চিন্তাকেও ছাড়িয়ে যাচ্ছেন।৯/১১ এর পর বুশ বলেছিলেন"Either you are with us,nor you are a terrorist".সে সময় থেকেই মূলত জঙ্গিবাদের সাথে একটি আদর্শের অনুসারিদের এর সাথে সংমিশ্রিত করার প্রয়াস লক্ষনীয়।
সময় অনেক গড়িয়েছে।নীলনদের,পদ্মা,মেঘনার পানিও অনেক গড়িয়েছে।জঙ্গিবাদেরও আপেক্ষিক বিবর্তন ঘটেছে।
ইসলাম ফোবিয়া থেকেই এর ব্যাপক সংক্রমন ঘটেছে এতে কোন সন্দেহ নেই।জায়নবাদি ইহুদিরা যদি পুঁজিবাদের স্বার্থে,নিজেদের স্বার্থে সন্ত্রাস পরিচালনা করতে পারে-সেটাকে যদি আমি পুঁজিবাদের বাইরে অথবা ভিন্নভাবে চিন্তা করি তাহলে সুবিচার করা হবেনা।ঠিক তেমনি স্বাধিনতাউত্তর বাংলাদেশে সন্ত্রাসের বিস্তারকরা আজ যদি সন্ত্রাসবাদের বিরুদ্ধে কথা বলেন সেটাও হাস্যকর।
চুয়াত্তরের ২৪ নভেম্বর রাতে যাত্রাবাড়িতে গফুর মেম্বারে বাড়িতে তার দুই সহযোগী গোলাম মোর্শেদ ও কাইয়ূমকে নিয়ে বোমা বানানো শুরু করেন।বেশ কয়েকটি বোমা বানানো হয়ে গিয়েছিল।হঠাৎ দূর্ঘটনা ঘটে।একটি বোমা বিস্ফোরিত হয়ে যায়।তারপর আরো কয়েকটি।কাইয়ূম ঘটনাস্থলেই মারা যান।নিখিল আহত হয়।তার শরিরের বেশ কিছু অংশ ঝলসে যায়।নয়ন নিখিলকে নিয়ে প্রথমে পোস্তাগোলা যান।সেখান থেকে একটা এম্বুলেন্স জোগাড় করে নিখিলকে ঢাকা মেডিকেল কলেজ হাসপাতালে নিয়ে আসেন।২৫ তারিখ ঢাকা নগর গণবাহিনীর সদস্য বাদল খাঁন হাসপাতালে নিখিলকে দেখতে যান।নিখিল তাকে সতর্ক করে দিয়ে বলেন"আমার ডায়েরীটা সম্ভবত পুলিশের হাতে পড়েছে।রাতে বাড়িতে থেকোনা।"২৬ নভেম্বর হাসপাতালে নিখিলের মৃতুয়্য হয়।দলের মধেয়্য কেউ কেউ সন্দেহ করেন,নিখিল বেঁচে থাকলে অনেক গোপন তথ্য ফাঁস হয়ে যেতে পারে।তাই তাকে মেরে ফেলা হয়।"
"সত্য গল্পের চেয়েও রোমাঞ্চকর" মার্ক টোয়েনের এ উক্তি বাংলাদেশেরর ক্ষেত্রে বড়ই যথোপযোগী মনে হচ্ছে।সম্ভবত বাংলাদেশের উদ্ভব ও ক্রমবিকাশের ইতিহাস পৃথিবীতে সবচাইতে ত্রুটিপূর্ণ। স্বাধীনতার ইতিহাস বর্ণনায় দলান্ধতায় রিতিমতো প্রতিযোগিতা চলছে।যার কারণে নতুন প্রজন্ম আজো ঘোষক আর ঘোষণার দূর্বৃত্তায়নের গোলকে বন্দী।
স্বাধীনতাউত্তর সময়ে যে জাসদ ছিল আ'লীগের জাতশত্রু,সে জাসদ আজ রাজনীতির সমীকরণজনিত কারণে আ'লীগের বন্ধু।সে সময়ে লাল বিপ্লবীদের প্রতিহত করতেই রক্ষীবাহিনীর জন্ম।চীনাপন্থী পূর্ব পাকিস্তান কমিউনিস্ট পার্টি ও সর্বহারা পার্টিসহ উগ্র বামেরা থানা লুট,পুলিশের উপর হামলা,ডাকাতিসহ ভয়ানকর্মে জড়িয়ে পড়ে।নকশাল স্টাইলে "যার দুই বিঘা জমি আছে,তার সম্পদ কেড়ে নাও"নীতির আলোকে সমাজতন্ত্র বাস্তবায়নের স্বপ্নে তারা বিভোর ছিল। তাদের আদর্শ ছিল-চে গুয়েভারা,সি ডিমন। চে'র বলিভিয়ার ডায়েরি পড়লে পাঠকমাত্রই তাকে ডাকাত বলতে বাধ্য হবেন। ঠিক তার আদর্শ অনুযায়ী ৭২'র ৩১ অক্টোবর জাসদ গঠিত হয়।জাসদের মধ্যে পর্যায়ক্রমে বিপ্লবী সর্বহারা পার্টির প্রয়োজন অনুভূত হয়।৭৪ সালে জাসদের একটি প্রচারপত্রে উল্লেখ করা হয়-"সময়ের দাবি হলো শ্রমিক,কৃষক ও তরুণদের মধ্য থেকে উঠে আসা পেশাদার বিপ্লবীদের নিয়ে এলাকাভিত্তিক গেরিলা ইউনিট গঠন করা।রাষ্ট্রক্ষমতা দখলের প্রধান রণকৌশল হবে-শহরাঞ্চলে উপর্যুপরি গণ আন্দোলন এবং গ্রামাঞ্চল থেকে অভিযানের মাধ্যমে একটি বিপ্লবী অভূত্থান সংঘটিত করা।গণ আন্দোলনের ছত্রছায়ায় নানা কর্মকান্ডে অংশ নিয়ে অভিজ্ঞতা ও দক্ষতা অর্জন করতে হবে।এভাবেই গেরিলা ইউনিটগুলো গড়ে উঠবে।গেরিলা ইউনিটগুলোর কর্তব্য হলো প্রয়োজনীয় অস্ত্র সংগ্রহ করে শ্রেণীশত্রুদের বিরুদ্ধে পরিকল্পিত কার্যক্রম গ্রহণ করা।
তাছাড়া জাসদের সাম্যবাদ নামক গোপন সাময়িকীতে বিপ্লবী গণবাহিনীর যৌক্তিকতার পক্ষে বলা হয় "অনেক অনুন্নত ও পশ্চাৎপদ পুজিবাদী ও আধা পুজিবাদী দেশে শোষিত জনগণের রাজনীতির সংগ্রাম শুরু থেকেই সশস্ত্র হতে বাধ্য।"মাও সে তুংকে উল্লেখ করে বলা হয় "যুদ্ধ হচ্ছে বিরোধ মীমাংসার জন্য সংগ্রামের সর্বোচ্চরূপ।"
জাসদ গঠনের পর থেকে আ'লীগের বাঁকা চাহনি শুরু হয়।জাসদ বনাম আ'লীগ সংঘর্ষ চলতে থাকে।৭৩ সালে রক্ষীবাহিনীর হাতে ২৩ জন মারা যায় বলে জাসদ দাবি করে থাকে।তাছাড়া গুম ও লাশ বিক্ৃতির অভিযোগ উঠে।বিপরীতে জাসদ সন্ত্রাসবিরোধী স্কোয়াড গঠন করে-যার ডেপুটি কমান্ডার ছিলেন হাসানুল হক ইনু।
জাসদের কিছু জঙ্গী কর্মকান্ডের কিছু নমুনা:
-"সারেন্ডার করবেন, না আমরা থানা দখল করব?উত্তরে ভারপ্রাপ্ত কর্মকর্তা বললেন, আমাদের জানে মারবেন না।কুমারখালি থানার ওসি এভাবে ২২ জন পুলিশ সদস্যসহ আত্বসমর্পন করেন।
-কুমারখালি থানার সামনেই ঈদগাহ।থানার নিয়ন্ত্রণ নেয়া হয় রাত ১১ টায়।২৫ ডিসেম্বর '৭৪ সকালেই ঈদ।লোকে লোকারণ্য, হাজার হাজার মানুষ। জামাত শুরু হবে।সবাই দাঁড়িয়ে গেছেন।সবার সামনে দিয়ে কয়েকজন হেঁটে গেলেন। তাদের পরণে শার্ট,গায়ে চাদর।সামনের কাতারে দাঁড়ানো গোলাম কিবরিয়ার বুকে অস্ত্র ঠেকিয়ে একজন গুলি করে।ঘটনাস্থলেই তিনি মারা যান।
-অধ্যাপক আনোয়ার হোসেন ছিলেন সর্বহারা পার্টির বিস্ফোরক বিশেষজ্ঞ।
-সর্বহারা পার্টির নজরদারিতে অন্যান্য রাজনৈতিক দলের অনেক নেতা ছিলেন।জাসদের অনেক কর্মকান্ডের খবর তারা পেতেন।একবার তারা জানতে পারলেন,সচিবালয়ের সামনে আব্দুল গণি রোডে বোমা রেখে দেয়ার পরিকল্পনা করা হয়েছে।মুজিব ঐ পথে যাওয়ার সময় বোমার বিস্ফোরণ ঘটানো হবে।এটা ১৯৭৪ সালের সমসাময়িক ঘটনা।১৯৭৭ সালে ঢাকা কারাগারে সর্বহারা পার্টির কেন্দ্রীয় কমিটির সদস্য আকা ফজলুল হক,ঢাকা নগর বাহিনীর কমান্ডার আনোয়ার হোসেনের সাথে কিছুদিন একসাথে ছিলেন।আকা ফজলুল হক ঐ ঘটনা জানতে চাইলে আনোয়ার তা স্বীকার করে নেন।
রক্ষীবাহিনীর সন্ত্রাসী কর্মকান্ড:
১৯৭২ সালের ৮ মার্চ "দি রক্ষীবাহিনী অর্ডার ১৯৭২" গেজেটের মাধ্যমে গঠিত রক্ষীবাহিনীর কর্মকান্ড শুরুতেই মানুষের মনে ভীতির সঞ্চার করে।এন্থনী মাস্কারেনহাস তার "The Legacy of Blood" বইয়ে রক্ষীবাহিনী ও মুজিবের আত্বীয়-স্বজনের মাত্রাধিক বাড়াবাড়িকে মুজিব হত্যার প্রেক্ষাপট হিসেবে উল্লেখ করেছেন।
তদানিন্তন প্রশাসনের সবচেয়ে নির্মম নিষ্ঠুরতার শিকার সিরাজ শিকদার।৭৫ সালের ১ জানুয়ারি তাকে গ্রেফতার করা হয় চট্রগ্রামে।২ জানুয়ারি তাকে হত্যা করা হয় পুলিশি রিমান্ড দিয়ে।পরবর্তিতে যা ক্রসফায়ারের নাট্যরূপ পায় সরকারি প্রেসনোটে।
-জাসদ দাবি করে থাকে তাদের ৪০ হাজার কর্মি রক্ষীবাহিনীর হাতে নিহত হয়।
সংসদে দাঁড়িয়ে "কোথায় আজ সিরাজ শিকদার" বলাটা ছিল বিচার বর্হিভূত হত্যাকান্ডের স্বপক্ষে নিরব সমর্থন।
-স্বাধীনতাউত্তর সময়ে প্রকাশেয়্য ব্যাংক ডাকাতি ইতিহাস থেকে মুছা যাবে কি?
ঘটনাপ্রবাহে দেখা যাচ্ছে -স্বাধিনতাউত্তর সময়ে কারা সন্ত্রাসী বা জঙ্গীবাদের সাথে সম্পৃক্ত ছিলেন।তবুও বলতেই হবে ইসলাম্পন্থীরাই জঙ্গী।মূলত ইহুদিবাদের মস্তিষ্কজাত সন্তান বিশ্বমিডিয়ার অনবরত প্রচারণার ফলেই এহেন অবস্থা।
আজকের স্বাধীন বাংলাদেশে গণতন্ত্র আর মানবতা যেভাবে ভূলুণ্ঠিত হচ্ছে তা নিয়ে সচেতন নাগরিকরা উদ্ধিঘ্ন।প্রতিদিন যে হারে ধর্ষণ আর মূল্যবোধের অবক্ষয় আমার দেখতে পাচ্ছি তা নিয়ে সমাজচিন্তকরা হতাশ।সমাজবিজ্ঞানের মতে,চরাঞ্চলে অপরাধকর্ম বেশি হয়ে থাকে।বর্তমানে সমগ্র বঙ্গদেশ অপরাধের চারণভূমি হয়ে উঠেছে বলে বিলক্ষণ দেখা যাচ্ছে।জাসদের সেই জঙ্গীবাদী রূপ আর রক্ষীবাহিনীর অশরীরী আত্বা আজ সারাদেশব্যপী বিরাজমান। পত্রিকারান্তরে প্রকাশ, অস্ত্রসহ ছাত্রলীগ ধরা পড়ছে,ধর্ষক ছাত্রলীগ নেতা বা আ'লীগ নেতা জনতার গণধোলাইয়ের শিকার,জাসদের ডাকাতি-আ'লীগ নেতার বাড়ি লুট ইত্যাদি সংবাদ।কোথাও আধিপত্য বা ভাগ-বাটোয়ারা নিয়ে রক্তক্ষয়ী সংঘর্ষ,ফলাফল এতজন খুন।ইসলাম্পন্থীদের এসব অন্যায়ের সাথে সম্পৃক্ততা দেখাতে না পেরে গ্রেফতারের পর বোমা নাটক।জিহাদী বইয়ের চালান উদ্ধার নাটক মঞ্চায়িত হওয়া এখন স্বাভাবিক ব্যাপার।গোয়েবলসীয় কায়দায় বিশ্বাস করানোর কোন চেষ্টার কমতি নেই।অনেকটা জায়নবাদি স্টাইলে পরিকল্পিতভাবে সাংস্কৃতিক আগ্রাসন আর ভূয়া দেশপ্রেমের এক জটিল আবহ তৈরি করে -সচেতন সমাজকে প্রতিবাদ হতে দূরে রাখতেই এ অপপ্রয়াস।
সহায়ক গ্রন্থ:
১.জাসদের উত্থান-পতন:অস্থির সময়ের রাজনীতি।
২.রক্ষীবাহিনীর সত্য-মিথ্যা।
৩.Legacy of Blood.
৪.কালো পঁচিশের আগে পরে।
বিষয়: রাজনীতি
১৬৮০ বার পঠিত, ০ টি মন্তব্য
পাঠকের মন্তব্য:
মন্তব্য করতে লগইন করুন