কালো আর ধলো বাহিরে কেবল:রক্তদান দিবস
লিখেছেন লিখেছেন স্বপ্নলোকের সিঁড়ি ১৪ জুন, ২০১৬, ০৫:২১:৪৬ বিকাল
যে বুকে আগলে রেখেছিলো, যার বুকের দুধ আমার রক্ত হয়েছে, যার ঋণ আমি শোধ করতে পারি না। শুধু যদি দুধের কথাই ধরি, যা কিনা তার রক্তকণা উজাড় করে আমার রক্ত গড়েছে, এর প্রতিদান কী হতে পারে ! রক্ত ছাড়া!বাবার রক্ত ঘাম হয়ে ঝরেছে আমাকে মানুষ করতে। আমার শিক্ষক থেকে শুরু করে দারোয়ান, গৃহকর্মী, রিকশাওয়ালা- সবার শ্রম, ঘাম, রক্ত, আমাকে এত দূর এনেছে। কতটুকু রক্ত আমার আছে তাদেরকে দেবার ? একটি শিশু। সজল দিঘির চোখ, মায়াবি সরল চাহনি,আধো আধো বোল, তার কোমল স্পর্শ- কত সুন্দর, কত পবিত্র সে! কাছে যখন সে ছুটে আসে,আদর করে গলা জড়িয়ে ধরে, চুমো খায়- স্বর্গসাধ মিটে যায়। এই থ্যালাসিমিক দেবশিশু মিনতি করে, তার রক্তস্রোত যেটা আমি আটকে রেখেছি, সেটা ছেড়ে দেবার জন্যে। তার মিনতি স্বর ক্ষীণ থেকে ক্ষীণতর হয়ে আসে। তার সব পবিত্রতা নিয়ে সে আবার স্বর্গে ফিরে যায়। শুধু আমার স্বার্থপরতার জন্যে। পারি কিভাবে এভাবে বেহেশতের ফুল মেরে ফেলতে?কি জবাব দেবো স্রষ্টার কাছে? বিবেকের কাছে? স্বর্গের হাওয়া কি আমার সইবে ? আমার যে ভাইদের রক্ত রাঙানো একুশে ফেব্রুয়ারি আর স্বাধীনতার রক্ত ঝরানো দিনগুলি- তারা কি একজনের পর একজন, বার বার, এতবার, কানে কানে বলে যায় নি, শিখে নাও, তোমারও সময় আসবে রক্ত দেবার? যে শপথ ছিলো ভাইয়ের কাছে, সেটা যে কত বড় ঋণ, শোধ না করা পর্যন্ত শান্তি পাই কোথায় ?
"এ বয়স জানে রক্তদানের পুণ্য
বাষ্পের বেগে স্টিমারের মতো চলে,
প্রাণ দেওয়া-নেওয়া ঝুলিটা থাকেনা শূণ্য
সঁপে আত্বাকে শপথের কোলাহলে।"
কবি সুকান্তের এ আকুতি যেন মানবতারই অনুরণন।
পবিত্র কোরআনের ঘোষণা-"একজন মানুষের জীবন বাঁচানো সমগ্র মানবজাতির জীবন বাঁচানোর মতো মহান কাজ (সূরা মায়েদা-৩২)।"
মানুষ মানুষের জন্য,জীবন জীবনের জন্য কিংবা কালো আর ধলো বাহিরে কেবল ভিতরে সবারই সমান রাঙ্গা-কথাগুলো যেন আজকের দিনের সাথে অনেকটাই বেশি সাযুজ্যপূর্ণ।
আজ ১৪ মে, বিশ্ব রক্তদাতা দিবস।সারা বিশ্বে ১৯৯৫ সাল হতে দিনটি পালিত হয়ে আসছে।স্বেচ্ছায় রক্তদাতাদের স্মরণ,স্বেচ্ছা রক্তদানে উদ্ধুদ্ধকরণ ও প্রচার প্রচারণায় এ দিনটি পালন করা হয়।মূলত,রক্তের গ্রুপ আবিষ্কারক ল্যান্ড স্টেইনারের জন্মদিনকে স্মরণ করতে এ দিনটি পালন করা হয়।
সংক্ষিপ্ত ইতিহাস:
রক্ত চলাচল সম্বন্ধে তৎকালীন প্রচলিত গ্যালেনের মতবাদকে ভুল প্রমাণিত করে চিকিৎসাবিজ্ঞানে ১৩০০ শতাব্দীতে বিপ্লবের সূচনা করেছিলেন কে? এসব জিজ্ঞাসার জবাবে যে মুসলিম মনীষীর নাম উচ্চারিত হবে তিনি হচ্ছেন ইবনুন নাফিস।
তিনি পরিষ্কারভাবে বলেছেন যে-
''শিরার রক্ত এর দৃশ্য বা অদৃশ্য ছিদ্র দিয়ে ডান দিক থেকে বাম দিকের হৃৎকোষ্টে চলাচল করে না বরং শিরার রক্ত সব সময়ই ধমনী শিরার ভেতর দিয়ে ফুসফুসে গিয়ে পৌঁছায়। সেখানে বাতাসের সঙ্গে মিশ্রিত হয়ে শিরার ধমনীর মধ্য দিয়ে বাম দিকের হৃৎকোষ্টে যায় এবং সেখানে এ জীবন তেজ গঠন করে।''
তিনি প্রমাণ করেন যে হৃৎপিন্ডে মাত্র দুটি প্রকোষ্ট রয়েছে।
'আল-শামিল ফি আল-তিব্ব' নামের ৩০০ খণ্ডের এক বিশাল বই লিখেছিলেন তিনি। এই বইয়ের পাণ্ডুলিপি বর্তমানে দামেস্কে সংরক্ষিত আছে। তার অন্যান্য বিখ্যাত বইগুলো হল- মুয়াজ আক-কানুন, আল-মুখতার ফি আল-আঘধিয়া।
পরবর্তিতে ১৬১৬ সালে ডা.উইলিয়াম হার্ভে রক্ত পরিসঞ্চালন তত্ব প্রদান করেন।যদিও তাকে রক্ত পরিসঞ্চালন তত্বের জনক বলা হয়ে থাকে।
১৬৫৭ সালে স্যার ক্রিস্টোফার বেন হার্ভে আবিষ্কৃত যন্ত্র দিয়ে জন্তুর দেহে ইনজেকশনের মাধ্যমে তরল পদার্থ প্রবেশ করান।
১৬৬৬ সালে ডা. রিচার্ড লোয়ার কুকুরের দেহ থেকে আরেকটি কুকুরের দেহে রক্ত সঞ্চালন পরীক্ষা চালান।
১৬৬৭ সালে ভেড়ার দেহ হতে মানুষের দেহে রক্ত সঞ্চালনে চিকিৎসকদের হাতে প্রাণ হারান অনেক মানুষ।এর ফলে রক্ত সঞ্চালনে পোপের নিষেধাজ্ঞা আরোপিত হয় ১৬৭৮ সালে।
১৮১৮ সালে ডা.জেমস ব্লান্ডেল রক্ত পরিসঞ্চালনকারী যন্ত্র আবিষ্কার করেন যার ফলে মানুষের দেহ হতে মানুষের দেহে রক্ত স্থানান্তর সম্ভব হয়।
১৯০১ সালে ল্যান্ড স্টেইনারের রক্তের গ্রুপ আবিষ্কারের ফলে মানুষের মধ্যে এ সম্পর্কিত ভূল ধারণার অপনোদন হয়।
১৯১৬ সালে প্রথমবারের মতো সফলভাবে সংরক্ষিত রক্তকে আরেকজনের দেহে প্রবেশ করানো হয়।এ ধারণা থেকে ফ্রান্সে প্রথম ব্লাড ব্যাংকের সূচনা করেন অসওয়াল্ড হোপ রবার্টসন।
১৯২১ সালে লন্ডনের কিংস কলেজ হাসপাতালে বৃটিশ রেডক্রসের সদস্যরা একযোগে রক্ত দেন এবং এটিই প্রথম স্বেচ্ছারক্তদানের আনুষ্ঠানিক উদ্দ্যোগ।
আমেরিকার শিকাগোর কুক কাউন্টি হলে বিশ্বের প্রথম আধুনিক ব্লাড ব্যাংকের সূচনা হয়।১৯৫০ সালের দিকে কাঁচের পাত্রের বদলে প্লাস্টিকের ব্যাগে রক্ত সংগ্রহ শুরু হয়।
বাংলাদেশে ১৯৭২ সালে জাতীয় অধ্যাপক ডা. নূরুল ইসলাম নিজ রক্তদানের মাধ্যমে শুরু করেন স্বেচ্ছারক্তদানের ইতিহাস।
ঢাকা মেডিকেলে সন্ধানী কাজ শুরু করে ১৯৭৮ সালে।এটিই দেশের প্রথম স্বেচ্ছারক্তদাতাদের সংগঠন।
রেডক্রিসেন্ট কাজ শুরু করে ১৯৮১ সালে।ঢাবি ছাত্রদের সংগঠন বাঁধন ১৯৯৭ সাল হতে কাজ শুরু করে।
নোবেলজয়ী মাদার তেরেসা বলেছিলেন-"এক ব্যাগ রক্ত শুধু এক ব্যাগ রক্ত নয়,একটি জীবন।" স্বাস্থ্য মন্ত্রণালয় পরিচালিত নিরাপদ রক্ত পরিসঞ্চালন কেন্দ্রের তথ্যমতে, দেশে বছরে প্রায় ৬ লাখ ব্যাগ রক্ত দরকার।যেখানে চাহিদার চেয়ে ঘাটতি রয়েছে ১ লাখ ব্যাগের।
WHO এর মতে,প্রতি বছর ৯২ মিলিয়ন মানুষ রক্তদান করে।৬২ টি শতভাগ প্রয়োজনীয় রক্ত সংগ্রহ ও বিনামূল্যে বিতরণ করা হয়।
বিশ্বের এক শতাংশ মানুষ রক্তদান করলে রক্তের চাহিদা মেটানো সম্ভব।২০২০ সালের মধ্যে WHO বিশ্বের প্রতিটি অঞ্চলে রক্ত সরবরাহের উদ্দ্যোগ নিয়েছে।
রক্ত পরিসঞ্চালন কেন্দ্রের তথ্যমতে,স্বেচ্ছায় রক্তদাতাদের মধ্যে ৭০ ভাগ আত্বীয়-স্বজন আর ৩০ ভাগ অনাত্বীয়।
তাই,আসুন রক্তের প্রবাহে গড়ি আত্বার বন্ধন।আমাদের শরীরে ১০-১২পাউন্ড রক্ত থাকে আর দিতে হয় ১ পাউন্ডের চেয়ে কম।আমার বা আপনার ক্ষুদ্র প্রচেষ্টা হতে পারে অনেকের জন্য মহামূল্যবান।
শেষ করব সাক্ষাতকার দিয়ে,
রক্ত দিয়ে মানুষের জীবন বাঁচানো এক মহান ব্যক্তি অস্ট্রেলিয়ার টেলিভিশানে এক সাক্ষৎকারে বলেন-
“I am not a hero or anything like that – it would just be so good if more people gave blood, because supplies are always low and blood is so badly needed.”
আসুন.......মানবতার সেবায় নিজেকে উৎসর্গ করি।
বিষয়: বিবিধ
১২৩২ বার পঠিত, ০ টি মন্তব্য
পাঠকের মন্তব্য:
মন্তব্য করতে লগইন করুন