রিক্সা মেকানিক আব্দুল মতিনের সাংবাদিকতা

লিখেছেন লিখেছেন মোঃ নেছার উদ্দিন ১৮ মে, ২০১৬, ১১:৪৯:৫১ রাত

মোহাম্মাদ নেছার উদ্দিন

আব্দুল মতিন একজন সাংবাদিক। দৈনিক বনবাস পত্রিকার উপজেলা প্রতিনিধি পদে সে নিয়োগ পায়। অবশ্যই পত্রিকার উপজেলা প্রতিনিধি হওয়ার জন্যে অনেক কাঠখড় পুড়তে হয়েছে। পত্রিকা অফিসে সিভি পাঠানোর পর কর্মকর্তারা তার শিক্ষাগত যৌগ্যতা নিয়ে কোন প্রশ্ন তুলেনি। যদিও আব্দুল মতিন অষ্টম শ্রেণী পাশ। কিন্তু, তারা বলেছে টাকা দিতে হবে। কেন টাকা দিতে হবে জিজ্ঞেস করলে নয় ছয় বুঝিয়েছে। টাকা যে আসলে কেন দিতে হবে বলেনি শুধু সেটা। এক টাকা বা দুই টাকা নয়। পুরো পাঁচ হাজার টাকা দিতে হবে। এই ব্যাপারে কোন ছাড় নেই। আব্দুল মতিন রিক্সার মেকানিক। এতো টাকা তার কাছে চাট্টিখানি কথা নয়। পাঁচ হাজার টাকা সে কখনো একসাথে দেখেছে কিনা তাও সন্দেহ আছে। কিন্তু, শখের পেশা সাংবাদিকতা যে তাকে করতে হবে। আব্দুল মতিন অষ্টম শ্রেণী পাশ করা ছাত্র হলেও, ছাত্র হিসেবে সে এতো ভালো নয়। তার পাশের ক্ষেত্রে পার্শ্ববর্তী ছাত্রদের অবদান নেহায়েত কম নয়। আব্দুল মতিনের নিজ যোগ্যতা বলতে ভুল বানানে ভরা বাংলা লেখাটুকুই শুধু সে জানে। যাইহোক, শখের পেশা সাংবাদিকতায় যেতে চায় আআব্দুল মতিন। তাই সসে টাকা জোগাড় করতে কাজে লেগে যায়। অক্লান্ত পরিশ্রম করে চলে আব্দুল মতিন। আর আয়কৃত অর্থের ক্ষুদ্র অংশ নিজের জন্য রেখে বাকি টাকা জমা রাখে। এভাবে দিন যায়, দিন আসে, একসময় আব্দুল মতিনের কাঙ্খিত পাঁচ হাজার টাকাও পূর্ণ হয়। তারপর সে আবার দৈনিক বনবাসে কল করে। আর জানায় তার কাছে পাঁচ হাজার টাকা আছে। এখন সে সাংবাদিকতা করতে প্রস্তুত। দৈনিক বনবাসের সম্পাদক অফিসে আসতে বললেন আব্দুল মতিন কে। অবশেষে বনবাস অফিসে আব্দুল মতিন। সম্পাদক সাহেবের হাতে আব্দুল মতিন নিজে পাঁচ হাজার টাকা তুলে দিয়েছেন। সাথে নিজের ৪ কপি পাসপোর্ট সাইজের ছবি, জাতীয় পরিচয়পত্রের ফটোকপি। তার কিছুক্ষণ পরে একজন এসে সম্পাদকের হাতে কিছু দিয়ে যান। সেগুলো আর কিছুই নয়। আব্দুল মতিনের নিয়োগপত্র এবং আইডি কার্ড। সম্পাদক নিজ হাতে নিয়োগপত্র এবং আইডি কার্ড আব্দুল মতিনের হাতে তুলে দেন। এইসময় তাদের ছবিও তুলেন অন্য একজন। এরপর কিভাবে সাংবাদিকতা করতে হবে এই বিষয়ে ধারনা দেন। আর বললেন, কাল আপনার নাম এবং ছবি বনবাস পত্রিকায় ছাপা হবে। আপনি চাইলে ৫০ কপি বনবাস পত্রিকা নিতে পারেন। যেগুলি আপনি আপনার শুভাকাঙ্ক্ষীদের কাছে বিলি করতে পারেন। পত্রিকায় ছবি ছাপাবে এই খুশিতে আব্দুল মতিন বললো একশ টা দেন। সম্পাদক বললেন, ১০০ কপি পত্রিকা বাবদ আপনাকে আরো পাচঁশত টাকা দিতে হবে। আব্দুল মতিন সকালে এখানে আসার সময় একজনের কাছ থেকে এক হাজার টাকা অতিরিক্ত এনেছিলো। যেটা এক রিক্সাওয়ালা থেকে ধার নিয়েছিলো। সেখান থেকে পাঁচশত টাকা দিয়ে দিলো। তারপর বিবিধ আলোচনা শেষে আব্দুল মতিন বনবাস অফিস থেকে চলে আসলো। পরেরদিন সকালে ওর বাসায় পত্রিকা চলে আসলো। পত্রিকার প্রথম পাতায় আব্দুল মতিনের ছবি ছাপানো। লেখা আছে "উপজেলা প্রতিনিধি হিসেবে আব্দুল মতিনের নিয়োগ"। আব্দুল মতিন সেই পত্রিকা থেকে কয়েক কপি নিজের জন্যে রেখে বাকিগুলো হকারকে দিয়ে দিলো। আর বললো সব অফিসে তার পত্রিকা বিনামূল্যে বিতরণের জন্য। হকার কিছু বিক্রি করে টাকা নিজের পকেটে পুরেছে। আর কিছু পত্রিকা বিনামূল্যে বিতরণ করেছে। পত্রিকার দুই এক কপি উপজেলার অন্য সাংবাদিকদের হাতেও গেছে। কেউ কেউ বলাবলি করছে, এই লোক কি করে সাংবাদিক হয়। আবার কেউ কেউ এই পথেই সাংবাদিক হয়েছে আগে। তাই তারা চুপ করে আছে। তবে সবাই একসাথে চুপ হয়ে গেলো এই ভেবে যে, মিলেমিশে না থাকলে টিকে থাকা যাবে না। আব্দুল মতিনের বিরোধিতা করলে সে স্রোতের বিপরীতে চলবে। সেটা উপজেলার সাংবাদিকদের জন্যে মোটেও কল্যাণকর নয়। উপজেলার সাংবাদিকরা মিলেমিশে চাঁদাবাজি করে। তাই কারো বিরুদ্ধে কেউ কথা বলে না। এই যে, গতবছর খালবিলের সাংবাদিক রঞ্জিত মল্লিকা নামে এক মেয়েকে ধর্ষণ করেছে। সেই খবর ধামাচাপা পড়েছে সাংবাদিকদের মিলেমিশে থাকার কারনেই তো। আব্দুল মতিনের সাংবাদিকতা জীবনের শুরু হলো। আব্দুল মতিন রাস্তা দিয়ে হেটে যাচ্ছিলো। রাস্তার পাশে দেখলো এক মহিলাকে থাপ্পড় মারলো ইউপি চেয়ারম্যান। যেহেতু আব্দুল মতিন একজন সাংবাদিক। সাথে সাথে থাপ্পড় মারার দৃশ্য ক্যামেরাবন্দি করলো আব্দুল মতিন। এরপর গলায় আইডি কার্ড ঝুলিয়ে সগর্বে ইউপি চেয়ারম্যানের সামনে গেলো আব্দুল মতিন। সম্পাদক বলেছিলো কারো ব্যাপারে রিপোর্ট করতে হলে তার মতামত নিতে হবে। আব্দুল মতিন যেহেতু ইউপি চেয়ারম্যানের ব্যাপারে রিপোর্ট করবে। সেহেতু তার মতামত নেয়া আবশ্যক। চেয়ারম্যান কে জিজ্ঞেস করলো, আপনি ওকে থাপ্পড় মারছেন, আমার কাছে ছবি আছে। আপনি ওরে থাপ্পড় মারলেন কেন? চেয়ারম্যান ঘাবড়ে গেলেন। গলায় ঝুলন্ত আইডি কার্ড দেখে চেয়ারম্যান বুঝলেন এই লোক সাংবাদিক। মানসম্মানের ব্যাপার চেয়ারম্যানের। এই ছবি পত্রিকায় ছাপা হলে পদও যাবে, মানসম্মানও যাবে। তার চেয়ে ভালো ম্যানেজ করা। আব্দুল মতিনকে ঢেকে আলাদা নিলো চেয়ারম্যান। জানতে চাইলেন কত হলে দফারফা করবে। রিক্সা মেকানিক আব্দুল মতিন কথার সারমর্ম বুঝলেন না। চেয়ারম্যান বুঝিয়ে বললেন। আরো জানালেন, তার বিরুদ্ধে রিপোর্ট না করলে মাসে মাসে একটা নির্ধারিত অংক তার নামে চলে যাবে। তাছাড়া এই মূহুর্তে তাকে বিশ হাজার টাকা দেয়া হবে। তবে শর্ত একটা তার বিরুদ্ধে রিপোর্ট করা যাবে না। এই ছবি ডিলিট করে দিতে হবে। আব্দুল মতিন খুশিতে রাজি হয়ে গেলো। এরপর আব্দুল মতিন থানায় গেলো। পুলিশের অপরাধ নিয়ে কথা বলল, মাসোয়ারা পেয়ে পুলিশের গুনগান গাইতে লাগলো। সখ্যতা গড়ে উঠলো পুলিশ, ডাক্তার, জনপ্রতিনিধি, চোর, ডাকাত, ট্রাফিক পুলিশ, সরকারি কর্মকর্তা সবার সাথে। কোন ঘটনা ঘটলে আব্দুল মতিন সেখানে হাজির। কেউ একজন এসে আব্দুল মতিনের সাথে হাত মেলায়, আব্দুল মতিন হাত পকেটে নেয়। তারপর ঘটনাস্থল ত্যাগ করে। তার পত্রিকা বনবাসে নিয়মিত অত্র উপজেলার মানববন্ধন, সভা, সমাবেশ, মিছিল এবং এলাকার উন্নয়ন নিয়ে রিপোর্ট হয়। বানানে যথেষ্ট ভুল থাকলেও কখনো কখনো সেই বানান ঠিক করে দেয়া হয়। কখনো আবার ঠিক করা হয় না। আব্দুল মতিন মোটরসাইকেল কিনে। লুঙ্গী-গেঞ্জি-স্যান্ডেল তো সেই কবে ছেড়ে দিয়েছে। এখন নিয়মিত ইন করে প্যান্ট শার্ট পড়ে। পায়ে সু জোড়া সব সময় আছে। আব্দুল মতিন এখন অনেক উন্নত। এবার তার পদোন্নতি দরকার। দশ হাজার টাকা ব্যায় করে সে দৈনিক বনবাসের জেলা প্রতিনিধি পদে নিয়োগ পায় সে। তার আয় আরো বাড়ে। সে শহরে জমি কিনে বাড়ি করে। একসময় সে নিজে একটা পত্রিকা চালানোর সিদ্ধান্ত নেয়। অনেক টাকা পয়সা খরচ করে সে দৈনিক বনজঙ্গল নামক একটা পত্রিকার প্রকাশনা শুরু করে। সে দৈনিক বনজঙ্গল পত্রিকার সম্পাদক এবং প্রকাশক। এইভাবে আব্দুল মতিন সফলতার শীর্ষে উঠতে থাকেন। কিন্তু, তার এই সফলতার মধ্যে সততার কোন চিহ্নও ছিলো না। যে সততা তার রিক্সা মেকানিকের জীবনে ছিলো।

বিষয়: সাহিত্য

৮৮৮ বার পঠিত, ১ টি মন্তব্য


 

পাঠকের মন্তব্য:

369539
১৯ মে ২০১৬ রাত ০২:৪১
শেখের পোলা লিখেছেন : সততা বড়ই সেকেলে জিনিষ,রং ডিজিটাল যুগে টাকা অনেক নতুন আইটেম। তাই মানুষ সে দিকেই মনযোগ দিয়েছে।

মন্তব্য করতে লগইন করুন




Upload Image

Upload File