একটি অসমাপ্ত রহস্য
লিখেছেন লিখেছেন আরাফাত আমিন ২৯ মে, ২০১৬, ১২:৪৬:৩৪ দুপুর
কাকির গলা বেয়ে রক্ত গড়িয়ে পড়ছে!
চিৎকার আর ধস্তাধস্তির শব্দ পেয়ে কাকী র ঘরে সবাই ছুটে এলাম।
কাকি দুহাত দিয়ে তার গলা চেপে ধরে আছেন।রক্ত বন্ধ করার চেষ্টা করছেন।তার দুহাত রক্তে লাল হয়ে আছে।আমাদের সবাইকে দেখে কাকা সরে এলেন।তার হাতে রক্তাক্ত ব্লেড।আমি ঘড়িতে সময় দেখলাম।রাত এখন তিনটা।
মাত্র ছয়মাস আগে জসিম কাকার বিয়ে হয় পাশের গ্রামে।কাকী বিএ পাশ।আমাদের গ্রামের প্রাইমারি স্কুলে শিক্ষকতা করেন।কাকা ইন্টার পাশ করতে পারেন নি।ইন্টার পরীক্ষা চলাকালীন সময় নকলের অভিযোগে কিছু ছাত্রকে বহিস্কার করা হয়েছিল।বহিষ্কৃতরা পরীক্ষাকেন্দ্রে আগুন দেয়।সেবার জসিম কাকা উত্তরপত্র বাসায় এনে লিখে জমা দিয়ে এসেছিলেন।পরে সেই পরীক্ষা এবং কেন্দ্র দুটোই বাতিল করে জেলা সদরে নেয়া হয়।
জেলা সদরে নাকি নকল করা যায়না।কাকা আর পরীক্ষা দেন নি।তার বিশ্বাস পরীক্ষা দিলে তিনি পাশ করতে পারবেন না। সেদিন আমি বুঝতে পারি,পাশ করার জন্য নকল আসলে অতিব দরকারি!
আম্মু ঘরে প্রবেশ করে কাকি কে নিয়ে অন্যঘরে চলে গেলেন।রিনি আপু গলায় কেটে যাওয়া অংশটা ভালমত ড্রেসিং করলেন।রিনি আপু আমার জেঠাতো বোন।ক্লাস টেনে পড়েন। উনি ডাক্তার না।স্কুলে স্কাউটিং করেন।ফার্স্টএইড সেখানে ট্রেনিং দেয়া হয়।আমি অনেকবার আপুকে বলেছি আমাকে শেখাতে।আমার স্বপ্ন আমি ডাক্তার হয়ে রিনি আপুর মতই মানুষের সেবা করব।আমি বসে আপুর ড্রেসিং করা দেখছি।
দাদাজানের গলার আওয়াজ পেলাম।আমাদের ঘরের পাশের ঘরটাতে কাকা-কাকী থাকেন।তার পাশের টাতে দাদাজান।দাদাজানের পরের ঘরটায় জেঠা থাকেন।সবগুলো ঘরের সামনে দিয়ে একটা কমন বারান্দা আছে।আমাদের ঘর থেকে দেখতে পাচ্ছি কাকা বারান্দায় চেয়ারে বসে আছেন।তার পেছনে দাদাজান আর আব্বু দাঁড়িয়ে আছেন।দাদাজান একাই বকে যাচ্ছেন।আব্বু দু'একবার দাদাজান কে থামানোর চেষ্টা করলেন।তারপর দাদাজানকে বুঝিয়ে ঘুমাতে পাঠালেন।কাকার হাত থেকে ব্লেড টা সরিয়ে নিয়ে হাত ধুয়ে দিলেন।কাকা এখনো নিচের দিকে তাকিয়ে চুপ করে আছেন।কিছুক্ষন আগের বড় বড় নিশ্বাস এখন কিছুটা ছোট হয়েছে।
কাকি তার কাটা গলা নিয়ে আজ রাত আমাদের ঘরেই থাকলেন।কাকী ঘুমানোর সময় আম্মুকে বললেন গলায় পোচ দেবার আগে কাকার দুই চোখ বাইরে বেরিয়ে এসেছিল।নাক এবং মুখ দিয়ে রক্ত ঝরছিল।ফ্লোরে যে রক্ত আমরা দেখেছি তা কাকীর ছিল না।সবাই ভয়ে ভয়ে ঘুমিয়ে পড়লাম।
সকালে ঘুম থেকে উঠেই দাদাজান চিৎকার শুরু করলেন।জসিম কাকা কে খুজে পাওয়া যাচ্ছে না!
আমাদের জয়েন্ট ফ্যামিলি।দাদাজানের নিজের তৈরি করা এই বাড়িটিতে রিনি আপু ছাড়াও তার ছোটবোন মিলি,জেঠা-জেঠি,কাকা-কাকি,আব্বু -আম্মু আর আমি থাকি।দাদিকে আমি দেখিনি।আর এক ফুপি আছেন,তিনি শ্বশুরবাড়িতে থাকেন।এখানে খুব কম আসেন।দাদাজানে কাঠের ব্যবসা।এই এলাকার সবচেয়ে বড় স'মিল টা আমাদের।দাদাজান এখন অবশ্য ব্যবসা থেকে রিটায়ার্ড করেছেন।বর্তমানে তার তিনসন্তান ব্যবসা দেখাশুনা করেন।
গতকিছুদিন ধরে জসিম কাকা কে নিয়ে সবাই খুব টেনশনে আছে।আজকের ঘটনার পর টেনশন আরো বেড়ে গেল।দুদিন আগেও একবার সমস্যা হয়েছিল।
সেদিন রাত আড়াইটার দিকে কাকির চিৎকারে সবাই ছুটে আসি।ঘরের দরজা ভিতর থেকে আটকানো ছিল।কাকি দরজা খুলে আম্মুকে জড়িয়ে ধরে কাদছেন।কাকা ঘরে নেই!
কাকির পাশেই শুয়েছিলেন,ঘুম ভেংগে দেখেন পাশে কেউ নেই!
সকাল বেলা কাকাকে তার ঘরেই পাওয়া গিয়েছিল।কিন্তু পরিবর্তিত অবস্থায়।সবার দিকে তাকিয়ে থাকেন।কিছু বলেন না।নাস্তা করেন না,কিছু জিজ্ঞেস করলেও চুপ করে থাকেন।যেন আমাদের কাউকে তিনি এর আগে কখনো দেখেন নি!
দুদিন পর কাকা ফিরে এলেন।একেবারে বিধ্বস্ত চেহারায়।সারাদিন চুপচাপ,কোথায় ছিলেন কিছু বলেন না।কারো সাথে কোন কথা নেই।
কাকীর মুখ থেকে জানতে পারলাম তাদের মধ্যে দাম্পত্য কোন কলহ নেই।কোন কিছু নিয়েই তাদের মধ্যে কোন সমস্যা নেই। হঠাৎকরে কাকার এই বদলে যাওয়া নিয়ে তাদের মধ্যে কোন কথা হয়না।কাকা ব্যবসায় কোন সময় দেন না।সারাদিন বাসায় থাকেন।
কিছুদিন পরের ঘটনা।কাকার অসুস্থতার খবর শুনে আত্নীয়স্বজন অনেকেই দেখতে এসেছেন।কাকা বিছানায় শুয়ে আছেন।জেঠা আর ফুফা বিচানায় কাকাকে পিছন ফিরে বসে আছেন।সবাই তাকে পিছন ফিরে কথা বলছিল।আনুমানিক সন্ধ্যে ৭টা তখন।আম্মু আর কাকি ঘরের দিকে মুখ ফিরে বারান্দায় দাঁড়িয়ে কথা বলছেন।
হঠাৎ আম্মু চিৎকার করে উঠলেন,'ওরে ধর,ওরে ধর সবাই'।
পিছন ফিরে দেখি কাকা বিছানা থেকে প্রায় কয়েক হাত উপরে উঠে শুন্যে ভাসছেন!
ফুফা,আব্বু,দাদাজান এবং আমি, আমরা সবাই কাকাকে শক্ত করে ধরলাম।প্রচন্ড শক্তি প্রয়োগ করে ছুটে যেতে চাচ্ছেন।দড়ি দিয়ে খাটের সাথে বেধে ফেলা হল।পরে শিকলের ব্যবস্থা করা হল।
আমাদের ধর্মপরায়ণ মধ্যবিত্ত পরিবার।আজকের ঘটনায় সবাই খুব ভয় পেয়ে গেলাম।দাদাজান কাকার ব্যাপারে প্রথমেই কথা বললেন বড় মসজিদের হুজুরের সাথে।হুজুর সবশুনে জিনের আছর থাকতে পারে বলে মত দিলেন।উপায় হিসেবে সেই জিনকে হাজির করার কথা বললেন।
এই জিন-ভুত নিয়ে আমার খুব আগ্রহ।জিন দেখার মজা নিতে যাচ্ছি।বন্ধুমহলে আমার অবস্থান অনেক উপরে উঠে যাবে,কারন আমি জিন দেখেছি।সবাই আগ্রহভরে জিনের কাহিনী শুনতে আসবে।আমি তাদের জিনের গল্প বলব।তারা কি খায়,কি পড়ে,ঘুমায় কিনা,পড়াশুনা করে কিনা এই সব গল্প!
আমার খুব ইচ্ছে আমি জিনের সাথে কথা বলবো।জিনকে জিজ্ঞেস করব তারা বিজ্ঞান বিশ্বাস করে কিনা?তাদের মধ্যে কেউ বিজ্ঞানি আছে কিনা!জিন হাজির করা নিয়ে আমি খুব উত্তেজিত!
বাড়িতে অনেক মানুষ এসেছে।বাইরে মানুষের ভিড়।ঘরের ভিতর শুধু আমাদের পরিবারের লোকজন।
হুজুর বড় গামলায় পানি আর একটা কাল শিশি নিয়ে সামনে রাখলেন।কাকাকে সাদাকাপড়ে ঢেকে দিলেন।অনেকক্ষন দোয়া পড়লেন।যথাসময়ে জিন হাজির!
হুজুর প্রথমেই জানতে চাইলেন-কোথা থেকে কেন সে এসেছে?
সাদাকাপড়ের ভিতর থেকে অনেক জোরালো কন্ঠে কথা বলছে জিন সাহেব।
উনি জানালেন-সুন্দরবনে যে গাছে তাদের আশ্রয় ছিল তা কেটে ফেলেছে কাঠুরেরা।সেই তিন কাঠুরে কে সে মেরে ফেলেছে!
জসিম কাকার সাথে তার কিসের শত্রুতা জানতে চাইলেন হুজুর।
-সেই গাছগুলো স'মিলে আসার পর জসিম তাতে নাম্বারিং করেছে,জানাল জিন সাহেব।
হুজুর এবার জিজ্ঞেস করলেন আপনাদের কারো কিছু জানার আছে?
দাদাজান রিনি আপুর বিয়ে কেমন ছেলের সাথে হবে জানতে চাইলেন!
জিনসাহেব সবাইকে হতাশ করলেন।
বললেন-রিনি একটা খারাপ ছেলের সাথে প্রেম করে।সে নাকি অই ছেলের সাথে পালিয়ে যাবে!
রিনি আপু এ কথা শুনেই দৌড়।
হুজুর খুক খুক কাশি দিলেন।এই কাশি পরিস্থিতি স্বাভাবিক করার জন্য।আর কারো কিছু জানার আছে?
আমি রিস্ক নিলাম না!
হুজুর এবার কালো শিশিতে গামলা থেকে কিছুটা পানি নিলেন।তারপর আবার দোয়া পড়লেন।এবার লক্ষ্য করলাম ওনার হাতের শিশিটা কাঁপছে।
উনি টুকরো কাপড় দিয়ে শিশির মুখটা বেধে নিলেন।
শিশিটা কোমরে গুজে যাওয়ার সময় বলে গেলেন কাকাকে বিশ্রামে রাখতে।
তিন চার দিন অতিবাহিত হল।কাকার শরীর খুব দুর্বল।ঠিকমত হাটতে পারেন না।কাউকে চিনতে পারছেন না।আমার মনে হল কোন উন্নতি হয়নি।
এবার দাদাজান কে বলে রাজি করান হল-ঢাকায় নিয়ে উন্নত চিকিৎসা করানো হবে।
ঢাকায় এসে মনোরোগ বিশেষজ্ঞ দেখানো হল।পরীক্ষা নিরীক্ষার পর ১৫দিনের ঔষধ দিলেন।আর বিশ্রামে থাকতে বললেন।
১৫ দিন পর আবার সেই ডাক্তারের কাছে।এবার তিনি সুসংবাদ দিলেন।পুরোপুরি সুস্থ হতে আরেকটু সময় লাগবে।এখন বাড়ি নিয়ে যেতে পারেন।
কাকা এখন আগের কিছুই মনে করতে পারেন না।তবে সবার সাথে কথা বলছেন।সবাইকে চিনতে পারছেন।
কাকাকে বাড়ি নিয়ে যাচ্ছি।
ফেরিতে মাওয়া পার হচ্ছি।মাইক্রো থেকে সবাই নেমে হাটাহাটি করছি।রিনি আপু আর কাকি ফেরিতে দাঁড়িয়ে জেলেদের মাছ ধরা দেখছে।
আব্বু,জেঠা আর দাদাজান যোহর নামাজ পড়ে আসলেন।
আমি আর আম্মু হালকা খাবার খেলাম।
ইতোমধ্যে ফেরি ঘাটে ভিড়েছে।
আর কাকা?কাকা কোথায়?
এদিক সেদিক তন্নতন্ন করে খুঁজা হল।
আমার মনে পড়ল।দাদাজানের সাথেই তো নামাজে দাড়িয়েছিল!
বিষয়: বিবিধ
২৬৬৪ বার পঠিত, ০ টি মন্তব্য
পাঠকের মন্তব্য:
মন্তব্য করতে লগইন করুন