অন্যভুবনের যাত্রী

লিখেছেন লিখেছেন আরাফাত আমিন ২৮ মে, ২০১৬, ০৪:৪৬:৪৪ বিকাল

.............তুহিন সুইসাইড করেছে!

ওকে নিয়ে সিঁড়ি বেয়ে নামতে অনেক কষ্ট হল।ওর নিথর দেহটা আমাদের কাধে। রাত এখন সাড়ে তিনটা। আমি আর রাতুল ওকে নিয়ে হলের সামনে দাঁড়িয়ে আছি।এত রাতে রিক্সা পাওয়া কঠিন।বাসস্ট্যান্ডের দিকে গেলে পাওয়া যেতে পারে।নয়নকে বললাম তুই বাসস্ট্যান্ডে যা,রিক্সা নিয়ে আয়।তুহিনের শরীর অনেক ঠান্ডা হয়ে আছে।দেহের ওজন টা অনেক বেশি মনে হচ্ছে।নিশ্বাস নিচ্ছে না।মানুষ মরে গেলে শুনেছি ওজন বেড়ে যায়।কিভাবে বাড়ে ইঞ্জিনিয়ারিং এর ছাত্র হিসেবে এটা আমার মাথায় ঢুকে না।মোট ভর তো বাড়েনি,তবে কি অভিকর্ষজ ত্বরণ 'g' এর মান মৃতব্যক্তির ক্ষেত্রে তারতম্য হয়!

আমার হাত-পা এখনো কাপছে।খুব কান্না পাচ্ছিল।

কিছুক্ষন আগেই তুহিন আমাদের সাথে বসে তাস খেলছিল।তাস খেলায় মনোযোগ ছিলনা ওর।বারবার একটা নাম্বারে ফোন দিচ্ছিল আবার কেটে দিচ্ছিল।

হঠাৎ উঠে চলে গেল।

-তোরা খেল,আমি একটু কথা বলে আসছি।

-অই তাড়াতাড়ি আসিস।

প্রতিটা দিন বলি,খেলতে বসলে ফোন অফ করে বসবি।করবে না,খেলার মাঝপথে আমাদের বসিয়ে রেখে চলে যাবে।

আমি,রাতুল,নয়ন আর তুহিন হলের একই রুমে থাকি।জিয়া ভাই পাশ করে এখন একটা ভাল কোম্পানিতে জব করেন।উনি প্রতি বৃহস্পতিবার হলে চলে আসেন আমাদের সাথে আড্ডা দিতে।তুহিনের উঠার আগে উনি এই রুমেই ছিলেন।এতক্ষন ল্যাপটপে মুভি দেখছিলেন।একটু পরপর খুব জোরে হেসে উঠেন।বলিউডি কমেডি মুভি ওনার খুব পছন্দের।

তুহিনের দেরি দেখে জিয়া ভাইকে ডাকলাম।মুভি পজ করে বললেন এখন খেলবেন না।আগে ভাত খাবেন,রাত অনেক হয়েছে।

নয়ন ফিরে আসল।রিক্সা পায়নি,ব্যাটারিচালিত অটো পাওয়া গেল। ঢাকা মেডিকেলের ইমার্জেন্সি ওয়ার্ডে পৌছলাম।ফজরের আযান এখনো হয়নি।ইমার্জেন্সি ওয়ার্ডের বাইরে দাঁড়িয়ে মিরাকলের অপেক্ষা করছি।রাতুল সুইসাইড নোট আর বিষের শিশি নিয়ে দাঁড়িয়ে আছে।সুইসাইড নোট টা আবার পড়লাম-

'আমি চেয়েছি অনিক তোমায় ছেড়ে দিক,তুমি আবার আমার কাছে ফিরে আসবে।তাই আমি অনিক কে তোমার নামে মিথ্যে বলেছি।তোমাদের দুজনের কনফারেন্স কলে আমাকে কেন 'আমার মরা বাপের কসম দিলে?এত বিশ্রী গালিগুলো দিতে কি করে পারলে? তুমি তো জানতে এই মিথ্যে টা তোমাকে ফিরে পেতেই আমি বলেছি।আজ আমি অনিক কে সত্যটা বলে দিয়েছি।তোমার সাথে আমার কোন ফিজিক্যাল রিলেশন হয়নি।আমি আব্বুর কাছে ক্ষমা চাইতে চলেছি।তুমিও আমাকে ক্ষমা করে দিও।'



অনেক বেশি ইমোশনাল ছিল তুহিন।সুইসাইড নোট টা পড়লেই তা বুঝা যায়।অনেকবার বুঝিয়েছি ওকে।লিবিয়ায় যুদ্ধ শুরুর পর ওর বাবা সেখানে নিহত হন।আন্টি একা কুমিল্লায় থাকেন।নিজেদের বাড়ি ভাড়ায় সংসার চালান।তুহিনের আর কোন ভাই বোন নেই।বুয়েট কোচিং করার সময় শিলার সাথে ওর পরিচয়।শিলা চান্স পায়নি,এখন একটা বেসরকারি ভার্সিটিতে ইঞ্জিনিয়ারিং পড়ে।

ডাক্তার এসে মিরাকলের স্বপ্ন শেষ জানিয়ে গেলেন।আমি শুধুই কাদছি।রাতুল জোরে চিৎকার দিয়ে মূর্ছা গেল।তুহিন এবং রাতুল কলেজ ফ্রেন্ড ছিল।একসাথে কয়েকটা বছর কাটিয়েছে।নয়ন রাতুলকে ধরে আছে,আমার দিকে তাকিয়ে কাদছে জিয়া ভাই।হাত টা ধুয়ে আসতে পারেন নি।হাতে তরকারির ঝোল শুকিয়ে গেছে।

জিয়া ভাই কিছুক্ষন আগেই খেতে বসেছিলেন।বসেই ডাকাডাকি শুরু করলেন।উনি হলে এলেই বাইরে থেকে খাবার নিয়ে আসেন।এখন আর হলের খাবার পছন্দ না তার।অমৃতে অরুচি ধরেছে।হলের অনেক বড় ভাইদের দেখেছি হল ছাড়ার পর এখানকার খাবার আর খেতে চান না।

খেতে বসে তুহিন কে ডাকলাম।একদম নড়াচড়া নেই।অনেকবার ডাকলাম কোন সায় নেই।গায়ে হাত দিয়ে দেখি শরীর বরফ শীতল হয়ে আছে।বুকে কান রেখে কোন সাড়াশব্দ পাচ্ছিনা।আমার চিৎকারে সবাই তড়িঘড়ি এগিয়ে এল।বালিশ থেকে উঠিয়ে বসানোর চেষ্টা করলাম।কোন রেসপন্স পেলাম না।বালিশের সাথেই একটা কাগজ পেলাম।

কি খেয়েছে খুজে পাচ্ছিলাম না।যাক,বাথরুমে বিষের শিশিটা পাওয়া গেল।কি করা যায়,সবাই তো ফেসে যাব।

একবার ভাবলাম,ওর বাসায় জানাব আন্টি এসে ডিসিশন নিবেন।আবার মনে হল, তখন আন্টি এসে বলবেন-তোমরা হসপিটালে নাওনি কেন?আমার জন্য অপেক্ষা করেই তোমরা আমার ছেলেকে মেরে ফেলেছ!

আমি শিউর হয়ে গেছি ও বেচে নেই।মৃত্যু টের পাওয়া যায়।তার পদশব্দ ক্ষীন কিন্তু অত্যন্ত তীক্ষ্ণ।

তারপরো মেডিকেল মিরাকল বলে কথা থাকে।সাধারণত সুইসাইড কেইসে এধরনের মিরাকল বেশি হয়।

আগে হসপিটাল নিতে হবে।

আবার ভাবছি-সুইসাইড কেইস।হসপিটাল নিলেই পুলিশি ঝামেলা।

-আন্টি কে এখন ফোন দেয়া ঠিক হবেনা।একা মানুষ ঘুমোচ্ছেন।এত রাতে এক মা কে ফোনে জানানোর দায়িত্বটা পুলিশকে দিতে পারলে ভাল হত।এদের কোন ইমোশন থাকে না।লাশবাহি এম্বুলেন্স থেকেও এরা সুবিধা নেয়।আবার টিভি চ্যানেলের কোন নিউজ প্রেজেন্টার হলেও ভালভাবে জানাতে পারবে।ইমোশন লুকানোর ক্ষেত্রে এরা বিশেষ প্রশিক্ষন প্রাপ্ত।

আগে চল হসপিটাল নিয়ে ট্রাই করি।সুইসাইড নোট তো আছেই।আমরা ফাসবোনা।রাতুল সমাধান দিল।

ঢাকা মেডিকেল মসজিদের মাইকে আযান হচ্ছে।ইমার্জেন্সি ওয়ার্ডের বাইরে দাঁড়িয়ে আছি সবাই।কুমিল্লায় আন্টি হয়ত এতক্ষনে ফজরের নামাজ পড়তে উঠেছেন।কি করে এক মাকে তার একমাত্র সন্তান আর নেই এখবর দিব!তিনি কি সহ্য করতে পারবেন?

রাতুল কে বললাম আন্টিকে ফোন কর।বল তুহিন অসুস্থ, হসপিটালে চলে আসতে।এর বেশিকিছু ফোনে বলার দরকার নেই।কিছুদিন আগেই মাত্র আংকেল মারা গেছেন,উনি এমনিতেই প্রেসারের রোগী।হয়ত সন্তান হারানোর শোক সহ্য করতে পারবেন না।

না থাক,মায়ের সাথে মিথ্যে বলতে নেই।তুই সত্যি কথাই বল।

-আসসালামু আলাইকুম আন্টি।আমি তুহিনের ফ্রেন্ড রাতুল বলছি।তুহিন আর নেই আন্টি,বলেই হাউমাউ করে কান্না শুরু করল।

আমি ওর হাত থেকে ফোন নিয়ে আন্টিকে স্বান্তনা দিয়ে বললাম,'আপনারা তাড়াতাড়ি ঢাকা মেডিকেলে চলে আসেন।' এইটুকু বলে লাইন কেটে দিলাম।

কথা বাড়ান যাবে না।ফোনের মাধ্যমে ইমোশন ট্রান্সফার হতে দেয়া যাবেনা।মাকে স্বান্তনা দেয় এমন সাধ্য কার আছে!

এখন বাদ থাকল শিলা।ওকে ফোনে জানিয়ে দেয়া দরকার।বেচারি না জানি কত বড় চিৎকার দেয়!সব মৃত্যুই কষ্টের,সুখের মৃত্যু তো কিছু নেই।

তুহিনের নাম্বার দিয়ে ফোন দিলে রিসিভের সম্ভাবনা ক্ষীন।আমার ফোন থেকেই কল দিলাম। ঘুম জড়ানো কন্ঠে ফোন ধরল।

-শিলা বলছ?

-হুম,কে আপনি?

-আমি তুহিনের ফ্রেন্ড রাসেল বলছি।তুহিন একটু আগে সুইসাইড করেছে।আমরা এখন ডিএমসিতে আছি।ও সুইসাইড নোটে তোমার কাছে ক্ষমা চেয়েছে।

কল কেটে যাবার শব্দ পেলাম।মনে হয় বিশ্বাস করেনি।আবার কল দেয়া যেতে পারে।এবার কল দিতেই ভেসে এল-

'the number you have dialed cannot be reach'

যাক বেচারা মনে হয় কষ্ট পেয়েছে খুব! নাকি খুশি হয়েছে বুঝতে পারলাম না।এটা বুঝা উচিত ছিল।খুশি হবারই তো কথা! প্রায় দুই বছর প্রেম করেছে।এই দুই বছরে তুহিন শুধু কয়েকবার ওর হাত ধরতে পেরেছিল!কয়েকবার লেকের পাড়,আর কয়েকটা রেস্টুরেন্টে বসেছিল!

এর মধ্যে ফোনে প্রতিনিয়ত ওয়েটিং পাওয়া যেত আর সুন্দর সুন্দর এক্সকিউজ দিত।

বাদ সাধল মোবাইল ফোন কোম্পানির কল ডিটেইলস!

চেক করার পর তুহিন কে আর স্বাভাবিক দেখিনি।সব সময় চুপচাপ আর খুব টেনশন করত।

এফ,এন এফ লিস্ট এবং কল রেকর্ড নিয়ে শিলার উত্তর জানতে চেয়েছিল।শিলা একতরফা ব্রেক আপ চাপিয়ে দেয়।আরো জানায় সে গত দু'বছর ধরে অন্য আরেকটা সম্পর্ক চালিয়ে গেছে।

তারপর প্রতিদিন ওদের কথা হত।সম্পর্ক জোড়া লাগানোর কথা!

সকালের আলো ফুটেছে।এর মধ্যে কয়েকবার তুহিনের আত্নীয়স্বজনদের ফোনের কৌতুহল মিটাতে হল।নিজেকে হঠাৎ কাস্টমার কেয়ার এক্সিকিউটিভ মনে হচ্ছিল।সবাই ফোন করছে,আমি সালাম দিয়ে জবাব দিয়েই যাচ্ছি।এরমধ্যে একজন ধমক দিয়ে ফোনের ওপাশ থেকে বলল,'এই ছেলে তুমি কাদছো না কেন?'

বুঝলাম,মস্তবড় ভুল হয়ে গেছে। কান্না শুনানো উচিত ছিল।হয়তো ইমোশনের ঘাটতি ছিল।সেটা তুহিনের নানার দৃষ্টি এরোয়নি।পরের বার যেই ফোন দেয়,খবরের সাথে ফুপিয়ে কান্নার অভিনয় ফ্রি।

বুয়েটের স্যার রা,হলের সবাই,সহপাঠী,বন্ধুবান্ধব অনেকেই ভিড় করলেন মেডিকেলে।সবার মন খুব খারাপ।খুব ভাল আর নিরীহ ছেলে ছিল।সবসময় চুপচাপ থাকতে পছন্দ করত।সবার মনেই দু:খ।কেউই এই অস্বাভাবিক মৃত্যু মেনে নিতে পারছেনা।

ওর মামারা এসে গেছেন এরমধ্যে।মা চলে আসলেন কিছুক্ষন পরেই। অনবরত কেদেই যাচ্ছেন তিনি।কখনো সন্তানের লাশ ধরে আবার কখনো সহপাঠী, আত্নীয়দের বুক চাপড়ে আর্তনাদ করেই চলেছেন।আমরা এর মধ্যে একটু শক্ত ছিলাম,কিন্তু ওনার কান্না আমাদের বারবার গাল ভেজাচ্ছিল।

লাশ নিয়ে ছুটছি কুমিল্লার উদ্দেশ্যে।সকাল থেকেই প্রকৃতি মুখ ভার করে আছে।কাচপুর ব্রিজের উপর জ্যামে স্থবির লাশবাহি এম্বুলেন্স। আকাশ ভেংগে অঝোর ধারায় কাদছে প্রকৃতি।তুহিন বৃষ্টি খুব পছন্দ করত।সেদিন ব্যালকনিতে বসে মুষলধারে বৃষ্টি দেখছিল।আমাকে ডেকে বলল,জানিস বৃষ্টিরদিনে কি করতে মন চায়?

'ইস,এই বৃষ্টির দিনে

রিক্সায় হুড তুলে শিলাকে নিয়ে শহীদমিনার এরিয়াটা ঘুরতে পারতাম।'

শিলার কথা আবার মনেপড়ল।ফোনটা এখনো বন্ধ। গত কয়েকঘন্টায় কিছুক্ষন পরপর কল দিচ্ছিলাম।একবারের জন্য নাম্বারটা খুলেনি।

আন্টির কান্না কিছুটা কমেছে।মামার কাছে জানতে পারলাম-একমাত্র সন্তানের প্রতি মমতা কমে যাবে তাই তার বোন দ্বিতীয় কোন সন্তান নেয়নি।

জ্যাম ঠেলে গাড়ি চলতে শুরু করেছে।

আন্টি এখন আর কাদছে না।

নিজের মাথাটা তুহিনের বুকের উপর রেখেছেন।

চোখের পানিতে তুহিনের বুকটা ভিছে যাচ্ছে।

একহাতে ছেলের সুইসাইড নোট।অন্যহাত তুহিনের মাথার চুলে বিলি কেটে দিচ্ছেন।

আমার ফোন টা হাতেই রেখেছি। একটু পরপর ফোনের দিকে তাকাচ্ছি।

মৃত মানুষদের জন্য আমরা অপেক্ষা করি না।আমাদের সমস্ত অপেক্ষা জীবিতদের জন্য।অন্য ভুবনের দিকে যাত্রার আগে আগে সবাই প্রিয়জনদের দেখতে চায়।যে মানুষ মারা গেছে তার উপর কোন রাগ কোন ঘেন্না থাকা উচিত নয়।

বাইরে বৃষ্টি বেড়ে চলেছে।



বিষয়: বিবিধ

১১৫০ বার পঠিত, ০ টি মন্তব্য


 

পাঠকের মন্তব্য:

মন্তব্য করতে লগইন করুন




Upload Image

Upload File