আধুনিক উৎপাদন ব্যবস্থা ও ইন্ডাস্ট্রিয়াল ইঞ্জিনিয়ারিং
লিখেছেন লিখেছেন আরাফাত আমিন ২৪ মে, ২০১৬, ০২:২৩:০৩ দুপুর
গত কয়েক দশকে পোশাকশিল্পের ক্রমবিকাশে পিছিয়ে নেই আমাদের দেশীয় প্রতিষ্টানগুলো। প্রতিদন্দ্বীতামূলক বিশ্ববাজারে আজ অবস্থান করে নিতে আমাদের প্রতিষ্টানগুলো ঝুকছে আধুনিক প্রযুক্তিসংশ্লিষ্ট উৎপাদন ব্যবস্থার দিকে। সেই সুবাদে নব্বইর দশকের গোড়ার দিকে এদেশে বিজ্ঞান
ভিত্তিক উৎপাদন ব্যবস্থার যে যাত্রা শুরু হয় তা আজ প্রায় দুই যুগ পার করে শক্ত অবস্থান করে নিয়েছে।
বর্তমানে আমাদের পোশাকশিল্প এমন এক ক্রান্তিকাল অতিক্রম করছে যখন প্রতিষ্ঠানগুলোর উপর আছে স্বল্পতম সময়ে শিপমেন্টের চাপ,আছে দক্ষ শ্রমিকের অভাব,আছে সম্পদের অপর্যাপ্ততা তদুপরি অপর্যাপ্ত
সম্পদের স্বেচ্ছাচারী অপচয়মূলক ব্যবহার। আর সেই সাথে যুক্ত হয়েছে ম্যানেজমেন্টের প্রাচীন ধ্যান-ধারণা,যেখানে দিন শেষে ইফিসিয়েন্সি মুখ্য নয়-গুরুত্ব পায় বেশি প্রোডাকশন। আর তাতে করে অহেতুক প্রেসার বাড়ছে শ্রমিক-কর্মচারী সবার উপর।
ইন্ডাস্ট্রিয়াল ইঞ্জিনিয়ারিং বা আ,ই এই প্রেসার কমানোর উপায় নিয়ে এসেছে।আমাদের আগে কাজ করতে হবে শ্রমিকের দক্ষতা নিয়ে। আমরা যদি শ্রমিকের দক্ষতা বৃদ্ধি করতে পারি তবেই উৎপাদন বৃদ্ধি পাবে ।
লক্ষ্য করুন, একটি কারখানার পাশাপাশি দুটি লাইনে একই স্টাইল চলছে-
লাইন-১, শ্রমিক -৫০ জন,১০ ঘণ্টায়- ৫০০ পিস।
লাইন-২,শ্রমিক -৬০ জন,১০ ঘণ্টায়- ৫৪০ পিস।
আপনার কাছে যদি প্রশ্ন করা হয় কোন লাইন টি ভাল? আপনি বলবেন ২ নাম্বার এর কথা। একটু লক্ষ্য করুন যেখানে ১ জন শ্রমিক ৯ পিস করে করছে আপনি তাকে ভাল বলছেন অথচ লাইন ১ এ ১ জন শ্রমিক ১০ পিস করে করছে একই স্টাইল। এই যে আপনার এই ধারণা,একে পরিবর্তন করে সঠিক উৎপাদন সিস্টেম বের করা এবং তা থেকে সম্পদের সর্বত্তম ব্যবহার নিশ্চিত করে সর্বোচ্চ উৎপাদন করাই হচ্ছে ইন্ডাস্ট্রিয়াল ইঞ্জিনিয়ারিং বা আই,ইই।
আই,ই একটি মর্ডান কনসেপ্ট যা দেশের বর্তমান তৈরি পোশাকশিল্প খাতে নিয়ে এসেছে বৈপ্লবিক পরিবর্তন।বর্তমানে দেশের প্রথম সারির প্রায় সব তৈরি পোশাককোম্পানি এ ধারনা গ্রহন করেছে।তাই এ খাত টেক্সটাইল এবং আইপি ইঞ্জিনিয়ারদের বিপুল সম্ভাবনার এক দুয়ার খুলে দিয়েছে।তবে পর্যান্ত জানাশোনার অভাবে অনেকেই পিছিয়ে পড়ছে।অনেকেই এসে আবার ট্র্যাক পরিবর্তন করে ফেলছে।আর দেশীয় কোম্পানিগুলো এ শুন্যতা পূরন করছে শ্রীলংকা এবং ভারত থেকে মানবসম্পদ নিয়ে।
আমাদের তরুনদের যারা সদ্য পাশ করে জবের জন্য প্রস্তুতি নিচ্ছে তাদের কে আই,ই সম্পর্কে সাধারন ধারনা দেয়া এবং আগ্রহী করে তোলাই আজকের লেখার উদ্দেশ্য।
আই,ই বলতে সাধারন কথায় বললে আমরা এটুকুই বলতে পারি 'একটা প্রতিষ্ঠানের সম্পদের সর্বোত্তম ব্যবহার নিশ্চিতের মাধ্যমের অপচয় কমিয়ে আনা এবং লাভের পরিমান বৃদ্ধি করাই আই,ই।
আই,ই সাধারণত একটা প্রতিষ্ঠানের নিম্নোক্ত বিষয়গুলো নিয়ে সরাসরি কাজ করে-
১.দক্ষ জনশক্তি নিয়োগ
২.কাজের স্ট্যান্ডার্ড প্রসিডিউর(SOP)ঠিক করা।
৩.বর্তমানে কিভাবে কাজ হচ্ছে তা তুলে আনা।
৪.কোথায় কোথায় অপচয় হচ্ছে তা চিহ্নিত করা।
৫.অপচয় এরিয়াগুলো চিহ্নিত করার পর তা দূরীকরণে ব্যবস্থা নেয়া।
৬.এবং প্রতিটি ক্ষেত্রে উন্নতির ধারা অব্যাহত রাখা।
আই,ই একটি সায়েন্স যার অন্যতম পার্ট হচ্ছে ওয়ার্কস্টাডি।
কি করতে হবে (work measurement) এবং কিভাবে করতে হবে (method study) এই নিয়ে ওয়ার্ক স্টাডি।
আরেকটি ব্যাপার এর সাথে জড়িত,’সম্পদের সর্বত্তম ব্যবহার’ যাকে বলা যায় ওয়ার্ক স্টাডির মূল উদ্দেশ্য এবং ওয়ার্ক স্টাডির সফলতা এর উপর অনেক খানি নির্ভরশীল।
এখন আমাদের জানতে হবে একটা কারখানার জন্য কি কি বিষয় তার সম্পদ
বলে বিবেচিত হবে।একে আমরা বলি 5M
১.জনশক্তি (MANPOWER)
২.মেশিন (MACHINE)
৩.দ্রব্যাদি (MATERIALS)
৪. সময় (MINUTES)
৫.অর্থ (MONEY)
এই 5m কে লক্ষ্য মেনে প্রতিনিয়ত কাজ করে চলেছে ওয়ার্ক স্টাডি ডিপার্টমেন্ট।
জনশক্তি
দক্ষ জনশক্তি একটি কারখানার প্রধান সম্পদ বলে বিবেচিত। ওয়ার্ক স্টাডি দক্ষ জনশক্তি নিয়োগের সেই কাজটি করে থাকে অত্যন্ত সর্তকতার সাথে। ‘স্কিল ইনভেন্টরি’ সেরকম একটি কাজ যাতে কারখানার সকল শ্রমিকের দক্ষতার রেকর্ড থাকে। যার মাধ্যমে আমরা প্রতিটি লাইনের জনশক্তির কোটা নির্ধারণ,দক্ষতা এবং দুর্বল দিক জানা, শ্রমিকের দক্ষতার মূল্যায়ন এবং সে অনুযায়ী বেতন-ভাতা নির্ধারন,পদোন্নতি,বদলি এই সকল কাজ করে থাকে।
মেশিন
মেশিনের সর্বোত্তম ব্যবহার নিশ্চিত করা যায় দক্ষ এবং সুনিপুন পরিকল্পনার মাধ্যমে। প্রতিটি পৃথক স্টাইলের জন্য লে-আউট তৈরির মাধ্যমে সেই কাজটি করে থাকে। কারখানার সকল মেশিনের জন্য মেশিন ইনভেন্টরি তৈরি করা, যাতে সকল মেশিনের বর্তমান অবস্থা এবং অবস্থান তালিকাবদ্ধ থাকে।যার সাহায্যে প্রতিটি মেশিনের সর্বোত্তম ব্যবহার নিশ্চিত করা হয়।একটি প্রতিষ্ঠানের সকল মেশিনের একচ্ছত্র মালিক আই ই।
দ্রব্যাদি
একটি পোশাকশিল্প কারখানার প্রাণ হচ্ছে সুইং সেকশন।এর কাজগুলো কে সহজ, গতিশীল ও ইফিসিয়েন্ট করার পূর্বশর্ত হচ্ছে এর সাথে জড়িত সকল দ্রব্যের (যেমন-ফেব্রিক কাটপেনেল, সুতা,নিডেল,মার্কিং চক,সকল প্রকার এক্সোসরিজ ইত্যাদি) নিরবিচ্ছিন্ন সরবরাহ নিশ্চিত করা। WIP রিপোর্ট,স্টোর ইনহাউজ,কাটিং এবং ফিনিশিং ইফিসিয়েন্সি রিপোর্টের মাধ্যমে এই নিরবিচ্ছিন্ন সরবরাহ ব্যবস্থাকে ওয়ার্ক স্টাডি ডিপার্টমেন্ট বা আই,ই বিভাগ নিয়ন্ত্রন করে থাকে।
সময়
বর্তমান সময়ে প্রতিটি প্রতিষ্ঠান আই,ই প্রতি আগ্রহী হবার অন্যতম প্রধান কারন 'সময় এর সর্বোত্তম ব্যবহার'।
‘নির্দিষ্ট সময়ের মধ্যে শিপমেন্ট’ এই কথা থেকেই আসলে বুঝা যায় সময়ের গুরুত্ব এখানে কতটুকু। সময় নিয়ে ওয়ার্ক স্টাডি ডিপার্টমেন্টের বা আই,ই র কাজের ক্ষেত্র সুবিশাল,তার কিছু নমুনা দিচ্ছি-
১.প্রতিটি স্টাইলকে ক্ষুদ্র প্রসেসে ভাগ করে,প্রতিটি প্রসেসের জন্য স্ট্যান্ডার্ড সময় নির্ধারণ করা,যাকে বলা হয় SMV.
2. স্ট্যান্ডার্ড সময় কে ভিত্তি ধরে প্রতিটি প্রসেসের টার্গেট দেয়া। সেই সাথে উপস্থিত জনশক্তি এবং কাঙ্খিত ইফিসিয়েন্সির তথ্য ব্যবহার করে লাইনের প্রতিঘণ্টার টার্গেট দেয়া।
৩.নির্ধারিত সময়ের মধ্যে টার্গেট পূর্ণ করে ওভারটাইম কমিয়ে আনার জন্য প্রয়োজনীয় ব্যবস্থা গ্রহন যেমন-লাইনের ক্যাপাসিটি নির্ণয়, তুলনামুলক লো ক্যাপাসিটি প্রসেসে ক্যাপাসিটি বাড়ানোর মাধ্যমে লাইনে প্রোডাকশান ব্যালান্স করা।
৪.দ্রুততম সময়ের মধ্যে লে-আউট শেষ করার জন্য লাইন ফিডিং রির্পোটের মাধ্যমে লে-আউট মনিটরিং করা।
৫.সর্বপরি সকল ক্ষেত্রে সময়ের অপচয় কমিয়ে আনার লক্ষ্যে নিরলস কাজ করে ইন্ডাস্ট্রিয়াল ইঞ্জিনিয়ার রা।
লেখার শুরুতে বলেছিলাম দক্ষ জনশক্তির কথা।দক্ষতা এমনিতেই তৈরি হয়না, দক্ষতা আসে কঠোর অনুশীলন,নিয়মানুবর্তিতা এবং বাস্তবপ্রয়োগের মাধ্যমে।আর এ ক্ষেত্রে দক্ষ জনশক্তি তৈরিতে গুরুত্বপূর্ণ অবদান রাখছে ইন্ডাস্ট্রিয়াল ইঞ্জিনিয়ারিং পরিচালিত ট্রেনিং সেন্টার,দক্ষ জনশক্তি তৈরি করাই যার মুল উদ্দেশ্য।
আধুনিক উৎপাদন ব্যবস্থায় ইন্ডাস্ট্রিয়াল ইঞ্জিনিয়ারিং সীমিত সম্পদের সুষ্ঠ ব্যবহার করে সর্বোচ্চ আঊটপুট দেয়ার লক্ষ্যে কাজ করে। ইনসেন্টিভ স্কিম চালুর মাধ্যমে শ্রমিকের মধ্যে কাজের প্রতি স্পৃহা জাগ্রত করা এর আরেকটি সাফল্য। ওয়ার্ক স্টাডি শ্রমিকের ভিতর লুকায়িত দক্ষতার উম্মেষ ঘটায়। জনশক্তি কে তার কাজের ক্যাপাসিটি সম্পর্কে এই বিশ্বাস দেয় যে,তারা তখন ভাবতে শেখে নতুন করে,এবং মনে করে তার দ্বারা এই কাজ করা সম্ভব।
লেখার পরিশেষে টমাস আলভা এডিসনের একটি কথা মনে পড়ল,’যেকোন সাফল্যের পেছনে ৯৯ ভাগ থাকে পরিশ্রম,বাকি ১ ভাগ প্রতিভা’।আমাদের সেই ১ ভাগ প্রতিভাবান জনশক্তি রয়েছে,এখন সময় যথাযথ ট্রেনিং এর মাধ্যমে আমাদের সেই প্রতিভাগুলোকে পরিশ্রমী,কর্মঠ এবং সাফল্যউম্মুখ করা,তবেই আসবে চুড়ান্ত সাফল্য।
‘ইন্ডাস্ট্রিয়াল ইঞ্জিনিয়ারিং' হচ্ছে সেই বিজ্ঞান যা আপনাকে দিবে বিশ্বাস এবং আস্থা,।নিশ্চিত করবে সুন্দর কর্মমুখর শ্রম পরিবেশ।এরা আপনাকে শুধু স্বপ্নই দেখাবেনা না,আপনার সেই স্বপ্নকে বাস্তবে রুপ দিয়ে একটি সুন্দর ও বিজ্ঞানভিত্তিক উৎপাদনমুখি কর্মপরিবেশ সৃষ্টি করবে। আর সেজন্য আপনাকে শুধু একটা কাজ-ই করতে হবে,তা হল সঠিক ‘ইন্ডাস্ট্রিয়াল ইঞ্জিনিয়ারিং’ চর্চা।সঠিক ‘আই,ই’ চর্চার মাধ্যমে আমাদের সফলতা আসুক।
#dontcopy #stopplagiarism #clickshare
বিষয়: বিবিধ
১৮৫১ বার পঠিত, ০ টি মন্তব্য
পাঠকের মন্তব্য:
মন্তব্য করতে লগইন করুন