অনন্ত নক্ষত্র যাত্রা
লিখেছেন লিখেছেন আরাফাত আমিন ১৭ মে, ২০১৬, ১২:২৫:০১ দুপুর
১৪ এপ্রিল ২০১২ সকাল ১০টা।
আব্বুকে আমি সাধারণত কল দেই না।তিনি মিসকল দিলে কলব্যাক করেন।আমারো পয়সা বাচে!অনেকদিন পরপর কথা হয়।মেসে সামনাসামনি আমাদের কথা শুনে বন্ধুরা আড়ালে ডেকে নিয়ে জিজ্ঞেস করে,'উনি কে?' যখন আমি বলি আমার আব্বু ওরা আকাশ থেকে পড়ে।কি বলিস একবারো মনে হয়নি-বাপ বেটা কথা বলছিলি!
এটা দূরত্বের কারণে।আব্বু দু দফায় প্রায় ১৪ বছর প্রবাসে ছিলেন।শেষবার যখন ফিরে আসেন তখন আমি নাইনে পড়ি।আব্বুকে ছাড়াই আমি তখন পৃথিবীতে অনেকটা পথ চলে এসেছি।দূরত্বটা এভাবেই সৃষ্টি হল।অজানা অচেনা একজনকে আব্বু বলতে হত বলেই বলতাম।অনেক সময় সামনে গিয়ে দাঁড়িয়ে কথা বলতেই সংকোচ হত।বেশিরভাগ সময়ই আম্মুর মাধ্যমে সবকিছু চাইতাম।কোন কিছু পছন্দ না হলে আব্বুর কাছে না গিয়ে আম্মুর সাথে শুরু করতাম প্যানপ্যানানি। আব্বুকে খুব ভয় পেতাম।তাই আম্মুই ছিল সব চাওয়া মিটানোর ভরসা।আম্মুর কাছে শুনেছিলাম-ছোটবেলায় আমি আব্বুর কোলে গিয়ে কাদছিলাম।আব্বু এমন ধমক আমাকে দিয়েছিল কান্নাতো থেমেছিলই,আব্বুকেও গোসল করতে হয়েছিল!
কল কেটে দিয়ে কলব্যাক করলেন।সকল বাবাই এই কাজটি করেন।প্রায় ৫ মিনিটের মত কথা বললাম।ভার্সিটি থেকে ইন্টার্নি ঠিক করতে বলেছে।কোথায় করব কিছুই বুঝতেছিনা।আব্বু বলল,আমি আজকে নারায়ণগঞ্জ যাচ্ছিনা,কালকে যাব।যেয়েই তোমার ইন্টার্নির ব্যাপারে পারভেজের(আমার আংকেল) সাথে কথা বলব।কথা প্রসংগে জানালেন মোনার বাড়িতে আসার কথা ছিল,কিন্তু আসেনাই।বলে দিয়েছে ওর জন্য ইলিশ মাছ এনে ফ্রিজে রাখতে। পরে এসে পহেলা বৈশাখের পান্তাইলিশ খাবে!তাই মেয়ের আবদার রাখতে ইলিশ মাছ কিনেছেন।আরো জানালেন ছোটজনের এস,এস সির রেজাল্টের অপেক্ষা করছেন।ভালো করলে কলেজে ভর্তি করাবেন আর না হলে পলিটেকনিকে দিয়ে দিবেন।আমাকে বললেন তুমি একটু খোজ নিও কোনটা ভাল হয়।
ফোন রেখে ভাবছিলাম।ইদানিং আব্বু যেকোন বিষয়েই সিদ্ধান্ত নিতে আমাকে আগে জানায়।মতামত চায়।কিছুদিন আগে ছোটবোনের ভার্সিটি এডমিশন নিয়ে সিদ্ধান্ত নিতে আমার উপর সব ছেড়ে দিলেন।আমি বড় ছেলে, হয়তো এজন্যই।মনে পড়ল ফতুল্লায় বাড়ি করতে চাচ্ছেন। কিভাবে করলে ভাল হয় এই সিদ্ধান্ত চাচ্ছেন।একবার ছোটবোনের জন্য একটা ভাল বিয়ের প্রস্তাবের কথা বললেন।আমি বললাম এখন না,আরো পড়াব।রাজি হয়ে গেলেন,বিয়ে বাদ।ভার্সিটি দেখ,কোন সাব্জেক্টে ভাল হবে।
কিছুদিন ধরে আব্বুর এই পরিবর্তন লক্ষ্য করছি।
বড় হয়েছি,পড়াশুনা শেষ, জবে ঢুকব নিজেকে তখন বেকার ই ভাবি।এই সময় আমাকে শুধু আব্বুই গুরুত্ব দিচ্ছেন।হয়ত ভাবছেন সন্তান বড় হয়েছে,সিদ্ধান্তগুলো ওরাই নিক।এ সময়টাতে নিজেকে আব্বুর খুব কাছাকাছি মনে হত।আগের সেই দূরত্ব টা মনে হচ্ছিল এখন আর নেই।সত্যিকার সন্তান হয়ে উঠছি।এখন আব্বুকে অনেক মিস করি।
মনে পরল সিটি কলেজে ইন্টারে ১ম সেমিস্টারে কেমেষ্ট্রিতে ফেল করেছিলাম।ওয়ালিউল হক স্যার তখন হেড অফ কেমেষ্ট্রি,আব্বুকে আসতে বললেন।
আমাকে দাড় করিয়ে রেখে আব্বুকে অনেক বকাঝকা করলেন।আব্বু যাওয়ার সময় মুখটা খুব কাল করে কেঁদে ফেলেন এরকম অবস্থা।আমাকে হাতে ধরে বল্লেন-সব ই তো শুনলা,এখন তোমার ইচ্ছা কি করবা,মন চাইলে পড়িও।
সেদিন খুব খারাপ লেগেছিল।সেদিনই প্রথম বুঝতে পারি আব্বুকে কতটা ভালবাসি।বাসায় এসে আমি স্যারের কথা গুলো মনে করে কেদেছিলাম।
১৫ এপ্রিল ২০১২,সকাল ১১টা।
আবার কথা হল।
আমি তো এখনো রওনা হইনি।
বিকালে যাব।
কেন? আপনি না সব কাজ সকাল সকাল করেন?
তোমার আম্মুর জন্য অপেক্ষা করছি। স্কুল থেকে আসুক।তারপর বিকালে রওনা দিব।
আচ্ছা ঠিক আছে।
সন্ধ্যা সাড়ে ৭টা,১৫ এপ্রিল ২০১২
বিকেল থেকে আকাশের মুখ ভার।একটু পরপর দমকা বাতাস।কালবৈশাখী শুরুর আগের অবস্থা।একটু বেরিয়ে ছিলাম ফ্লেক্সিলোডের জন্য।ধুলিবালি মাখা হয়ে রুমে ঢুকলাম।তখনই ফোন বেজে উঠল।অপরিচিত নাম্বার।রিসিভ করতেই ওপাশ থেকে কাকীর চিৎকার শুনতে পেলাম,'বাবু তুমি কই,ভাইয়ে এক্সিডেন্ট করছে,এই নাম্বার টাতে ফোন দাও।' ফোন নাম্বার নিয়ে ফোন দিলাম।ওপাশ থেকে শুধু এইটুকুই জানাল,আপনার কি হয়? বললাম আমার বাবা।বলল, 'মাথায় খুব আঘাত পাইছে,রক্ত বন্ধ হচ্ছেনা,আমরা নারায়ণগঞ্জ মেডিকেল থেকে ঢাকা মেডিকেল এ নিয়া আসতেছি,আপনি ঢাকা মেডিকেল চলে যান,খুব সিরিয়াস কন্ডিশন।'এইটুক বলেই ফোন রেখে দিল।চিৎকার করে বের হয়ে গেলাম।
প্রচন্ড ঝড় বৃষ্টি উপেক্ষা করে ঢাকা মেডিকেল পৌছলাম।আব্বু শুয়ে আছে।নিঃশ্বাস নিচ্ছে।বুক উঠানামা করছে,কিন্তু চোখ দুটো ক্রমশ বন্ধ হয়ে যাচ্ছে।খুলতেই পারছেনা।দুই কান বেয়ে রক্ত নেমে মাথার নিচ টা ভিজে গেছে।সিটিস্ক্যান করানোর পর তারা জানালো সিচুয়েশন খুবই ক্রিটিকাল,আইসিও তে নিতে হবে।অনেক দৌড়ানোর পর আইসিও ব্যবস্থা করতে পারলাম না।আমার চার রুমমেট রক্ত,আইসিইউ আর ডাক্তারের জন্য ছুটছে।
এক ফাকে মাকে ফোন দিয়ে সান্ত্বনা দিলাম।
মা কেদোনা,নামাজ পড়ে দোয়া কর।
আব্বুর কিচ্ছু হবেনা।
এই যে আব্বু আমার সামনে নিঃস্বাস নিচ্ছে মা।
না মা,কথা বলে নি।
আমি কয়েকবার ডাকছিলাম,আব্বু মনে হয় শুনতে পায় নি,কোন সাড়াও দেয় নি।
ওপাশ থেকে আম্মুর কান্নাকাটি শুনতে পেলাম।
আড়াই ঘন্টা ডিএমসি তে কাটানোর পর আইসিইউ ম্যানেজ করতে পারলাম না।এম্বুলেন্সে করে আব্বুকে নিয়ে ছুটলাম পপুলারে।রাত সাড়ে দশটায় আইসিও তে নেয়া হল।
বাহিরে দাঁড়িয়ে তখন কাদছি আমি।আমার মামাত বোন,ভাই যারাই ঢাকায় ছিল স্বান্তনা দিচ্ছে আমাকে।
দাঁড়িয়ে আম্মুর কথা,আর ছোট ভাই-বোন দুটোর কথা ভাবছি।আর শুধুই কান্না পাচ্ছে।সময় যেন থমকে আছে,সামনে যাচ্ছেই না।
সোয়া এগারটায় আমার মামাত বোন (ও পপুলারে জব করে) কে ডক্টর রা ভিতরে ডেকে পাঠালেন।তার কয়েক মূহুর্ত্ব পরেই আমার পৃথিবীটা কেমন যেন হয়ে গেল।ভিতর থেকে আমার মামাত বোনের 'ফুফা' বলে এমন চিৎকার বাইরে থাকা আমাকে আর শক্ত থাকতে দিল না।আমার বুঝতে আর বাকি রইল না,আমার বাবা চলে গেছেন।আমার চিৎকারে পপুলারের বাতাস তখন ভারি হয়ে উঠছে।
বাইরে তখন ঝড় টা থেমে গেছে।পপুলারের অপজিটে সিটি কলেজের গেইটে দাঁড়িয়ে আমাকে সান্ত্বনা দিচ্ছে সবাই।কিসের সান্ত্বনা? আমার চিৎকার, বুকফাটা আর্তনাদ থামানোই যাচ্চেনা।আমি পারিনি।
আমি কি করে বলবো আমার মাকে,ছোট ভাই বোন দুটোকে?
আমি কাকে আব্বু ডাকবো?
সেই সিটি কলেজের গেট।যেখানে আমাকে ভর্তি করাতে এসে আব্বু কাউন্টারে টাকা জমা দিচ্ছিলেন।তার চোখে সেদিন পানি দেখেছিলাম।আমার হাত ধরে বলেছিলেন,'ছোট দুইজনের কথা আমি ভাবি না,তোমাকে নিয়েই আমার সব স্বপ্ন।রক্ত বিক্রি করে হলেও তোমাকে পড়াব।তুমি এইসব চিন্তা করবা না,তুমি শুধু পড়বা।আর ভাল রেজাল্ট করবা।’
আর সেই গেইটে আজ আব্বুর লাশ নিয়ে দাঁড়িয়ে আছি,ছোটবোনের আসার অপেক্ষায়।তাকে জানান হয়েছে আব্বু এক্সিডেন্ট করেছে।ও এসে যখন দেখবে আব্বু আর নেই তখন কি করব -ভাবছি আর চিৎকার করে কাদছি।
আম্মুকে বাসায় মামারা জানিয়েছে।মাথায় পানি দিচ্ছে,প্রেসার খুব বেড়ে গেছে।
আব্বুর লাশ নিয়ে ফজরের পর বাড়িতে পৌছলাম।পথে আসতে ছোট বোনটা কয়েকবার মূর্ছা গেল।বাড়িতে আসতেই যাকে সবচেয়ে বেশি শাসন করেছে আব্বু সেই ছোট ভাই টা আব্বুর লাশ ধরে চিৎকার করে কাদছে।
আজ চার বছর হতে চলল বাবা নেই।তার মৃত্যুর জন্য দায়ী ড্রাইভার কে এসে ছাড়িয়ে নিয়ে গেছে স্কয়ার কোম্পানির লোকজন।আমাদের ক্ষতিপূরণ দেয়ার প্রতিশ্রুতি দিলেও স্কয়ার ফার্মা কিছুই করেনি।যা করার তা তাদের ঔষধবাহী সেই গাড়িই করে দিয়ে গেছে।
আরেকটা পহেলা বৈশাখ চলে আসছে।আমার বোন আব্বুকে ফোন করে বলতে পারেনা,তার জন্য ফ্রিজে ইলিশ মাছ রেখে দিতে।
আমাদের বৈশাখ আসে তাই বাবার শূন্যতা নিয়ে।পিতা হারানোর শোক আজ বয়ে চলি।
তুমি পাড়ি দিয়েছ চিরসাশ্বত পথে।এক অনন্তপানে অসীম সেই যাত্রা।সংগীবিহিন সহায় সাথী বিহীন এই নক্ষত্রযাত্রায় জিয়ারতের দু'আ নিয়ে চল অবিরত।
বিষয়: Contest_priyo
১৩৩৭ বার পঠিত, ০ টি মন্তব্য
পাঠকের মন্তব্য:
মন্তব্য করতে লগইন করুন