বাঙালি ও বাংলা ভাষা
লিখেছেন লিখেছেন আলমগীর ইমন ১৬ ফেব্রুয়ারি, ২০১৭, ০৭:৪৭:২৭ সন্ধ্যা
আমরা বাঙালি। অধিকার আদায়ে কভু পিছু হটি না। পৃথিবী জেনে গিয়েছে- তার বুকে বাঙালি নামে একটি জাতি আছে, পৃথিবীর মানুষ জেনে গিয়েছে বাংলা ভাষাভাষীর ষোল কোটি মানুষ রয়েছে। পৃথিবীর শেষদিন পর্যন্ত ইতিহাসে লিখা থাকবে- বাঙালির ইতিহাস সৃষ্টির স্বীকৃতি স্বরূপ পুরো পৃথিবীবাসী একটি সংখ্যা মুখস্ত রেখেছে- ২১!
১৯৪৮ সালে রেসকোর্স উদ্যানে মোহাম্মদ আলী জিন্নাহ যখন ঘোষণা করলেন, "উর্দু এবং উর্দুই হবে পাকিস্তানের একমাত্র রাষ্ট্রভাষা।" বাংলা ভাষাভাষীর কেউ মানতে পারেন নি তার এই ষোঘণা। তরুণরা ঝাপিয়ে পড়েছিল- "রাষ্ট্রভাষা বাংলা চাই" শ্লোগানে। ১৯৫২ সালের ২১শে ফেব্রুয়ারি ১৪৪ ধারা ভঙ্গ করে সালাম, বরকত, শফিক, জব্বরসহ অনেকে উৎসর্গ করেছেন বুকের তাজা রক্ত! পেলাম- প্রিয় মাতৃভাষা, বাংলা ভাষা।
পৃথিবী নতুন করে জেনেছে- বাঙালিরাই পারেন ভাষার জন্যও প্রাণ দিতে পারেন, যা পৃথিবীর ইতিহাসে বিরল। এরই স্বীকৃতি স্বরূপ ইউনেসকো কর্তৃক ১৯৯৯ সালের ১৭ নভেম্বর ২১শে ফেব্রুয়ারিকে আন্তর্জাতিক মাতৃভাষা দিবস হিসেবে ঘোষণা করলো।
রক্তের বিনিময়ে অর্জিত আমাদের মাতৃভাষা, বাংলা ভাষা, পঞ্চাশটি বর্ণের প্রতিতে রক্ত লেগে আছে এখনো। কিন্তু আজ সেই ভাষা আমাদের কাছেই কতোখানি গুরুত্ব পাচ্ছে ভাবিয়ে তুলেছে নতুন করে।
ক. চাকরিযুদ্ধে প্রায় সর্বত্রই ইংরেজি ভাষায় দক্ষতার প্রমাণ যে হারে নেয়া হয় বাংলা ভাষায় তা নেয়া হয় না। মৌখিক পরীক্ষাগুলো অধিকাংশই হয় ইংরেজিতে এবং সেখানে ইংরেজিতে কথা বলায় পারঙ্গম পরীক্ষার্থীদের প্রাধান্য দেয়া হয়। তারা শুদ্ধ বাংলায় কথা বলতে বা লিখতে পারেন কি না, তা দেখা হয় না।
খ. আমাদের আরেক শ্রেণি ভাষাকে খিচুড়ি বানাতে খুব ভালোবাসি। বাংলার সঙ্গে ইংরেজি শব্দকে ভালোভাবে মিশ্রিত করতে পারলেই যতো তৃপ্তি! অবশ্য এই প্রবণতার পেছনে বিশেষ ভূমিকা রাখে চলছে কিছু এফএম রেডিও।
গ. বাংলাকে বাংলা বর্ণ দিয়েয়ে নয়, ইংরেজি বর্ণ দিয়েই লিখতে ভালোবাসি। ভার্চুয়াল জগতে এর ব্যবহার বিশেষভাবে লক্ষ্যনীয়। অনেক শব্দ তো পড়তেই পারি না!
ঘ. অনেকে বাংলায় লিখলেও যেনো বানান ভুল লিখার প্রতিযোগিতা চলছে! 'অভ্র' থেকে যারা লিখি তাদের অধিকাংশ জন-ই এ প্রতিযোগিতার প্রতিযোগী। অথেচ বাংলা লেখার জন্য বিজয়, ইউনিজয়, প্রভাত, জাতীয়সহ অনেক ফন্ট-ই না রয়েছে। একটি পছন্দ করে নিলেই এই ভুল থেকে মুক্তি পাওয়া যায়। এই ভুল বানান লিখার প্রতিযোগিতায় অনেকে লেখক হওয়ারও স্বপ্ন দেখি! অথেচ আমাদের মানসম্পন্ন লেখা হলেও পাঠকের কাছে, সম্পাদকের কাছে ভুল বানান লেখাটির মান কতোখানি কমিয়ে দেয় তা যেনো ভাবার সময়ই নেই আমাদের!
বাংলা পৃথিবীর সমৃদ্ধ ভাষাগুলোর অন্যতম। এই ভাষার জন্য আমরা বিশ্বের দরবারে আলাদাভাবে পরিচয় দিতে পরি, এই ভাষাকে জাতিসংঘের দাপ্তরিক ভাষা হিসেবে প্রতিষ্ঠিত করার দাবি তুলি, অথচ সেই বাংলা ভাষা, আমাদের মাতৃভাষা আজ আমাদের কাছে থেকে যথাযোগ্য সম্মান থেকে বঞ্চিত, বিকৃতিরও শিকার! নিম্ন ও উচ্চ আদালতে রায় লেখা হয় ইংরেজিতে। উচ্চ আদালতে সব কার্যক্রম ইংরেজিতে হয়। প্রশাসনের সর্বস্তরে বাংলার ব্যবহারের আইন থাকলেও মানা হয় না। যেনো সর্বত্রই অবহেলিত!
বাংলাদেশের সংবিধানে শিক্ষা কার্যক্রমের সর্বস্তরে বাংলা ভাষার শিক্ষা ও চর্চার ওপর গুরুত্ব আরোপ করা হয়েছে। জাতীয় শিক্ষাক্রম ও পাঠ্যপুস্তক বোর্ড (এনসিটিবি) শিক্ষার প্রাথমিক স্তরে বাংলা ভাষায় শুদ্ধ উচ্চারণকে অন্যতম গুরুত্বপূর্ণ যোগ্যতা হিসেবে চিহ্নিত করেছে। কিন্তু বিশ্ববিদ্যালয়ের সর্বোচ্চ ডিগ্রি অর্জনের পরও আমরা কজনই-বা শুদ্ধ বাংলায় শুদ্ধ উচ্চারণে কথা বলার বা লেখার যোগ্যতা অর্জন করি। ভাষায় আঞ্চলিকতার প্রভাব থাকা খুবই স্বাভাবিক। তবে শুদ্ধ বাংলার ব্যবহার ও চর্চা সম্পর্কে সচেতনতা খুব জরুরি।
আমার এই বক্তব্যে এটা বোঝাতে চাইনি যে সব ভাষা বাদ দিয়ে সর্বত্র কেবল বাংলা প্রয়োগই নিশ্চিত হোক। আমরা এশিয়ার দেশগুলোর মধ্যে জাপান ও চীনের দিকে তাকালে দেখতে পাই- তারা জ্ঞান-বিজ্ঞানের চর্চা করে মাতৃভাষায়, বিদ্যাশিক্ষা করে মাতৃভাষায়। অফিস-আদালতের কাজকর্ম, ব্যবসা-বাণিজ্য, পারস্পরিক যোগাযোগের সমস্ত ক্ষেত্রে তারা মাতৃভাষাই ব্যবহার করে। আবার তারা একাধিক বিদেশি ভাষাও শেখে। এভাবেই তারা অর্থনৈতিক, সামাজিক, রাজনৈতিক সকল ক্ষেত্রে অগ্রগতি সাধন করেছে। তাহলে আমরা কোন অংশে কম?
একুশের মাসে তথা ভাষার মাসে আমাদের শপথ হোক- আমরা শুদ্ধ বাংলা জানবো, শুদ্ধ বাংলার চর্চা করবো, শুদ্ধ বাংলায়, শুদ্ধ উচ্চারণে পরিষ্কারভাবে কথা বলবো। সব কাজে বাংলা ভাষা ব্যবহার করি। সর্বস্তরে বাংলা চালু করার যে কথা বলা হয়, তা শুধু কথার কথা হিসেবেই না রেখে শহীদের রক্তের বিনিময়ে পাওয়া রাষ্ট্রভাষা বাংলার প্রকৃত মর্যাদা নিশ্চিত করি। উচ্চ শিক্ষার পাঠ্যপুস্তক বাংলায় লেখা হোক। এ ভাষার মর্যাদা তখনই পূর্ণাঙ্গ প্রতিষ্ঠা পাবে, যখন সমাজ ও রাষ্ট্রের সর্বস্তরে এই ভাষা ব্যবহার নিশ্চিত করা হবে।
লেখক: নির্বাহী সম্পাদক, ইদানীং।
বিষয়: সাহিত্য
১১১৫ বার পঠিত, ২ টি মন্তব্য
পাঠকের মন্তব্য:
আজ আমাদের ঘরে ঘরে উর্দূ ভাষার মাসতুতো ভাই হিন্দী ব্যাপক আধিপত্য বিস্তার করে বসেছে ।পাকিস্তানীরা জোর করে উর্দূকে আমাদের উপর চাপিয়ে দিতে চেয়েছিল । হিন্দী ভাষার দেশ ভারতীয়রা এতটা বোকা নয় । ওরা এমনভাবে হিন্দী ভাষা আমাদের কাছে পেশ করছে যে আমরা সেটাতে এডিক্ট হয়ে গেছি। ফলে এটা ছাড়া আমরা চলতেই পারি না।
মন্তব্য করতে লগইন করুন