সদকাতুল ফিতর : পরিমাণ ও কিছু কথা
লিখেছেন লিখেছেন মুফতি মুহাম্মাদ শোয়াইব ০৪ জুলাই, ২০১৬, ০৪:৪৩:২০ রাত
রমজানের একটি গুরুত্বপূর্ণ অনুষজ্ঞ সদকাতুল ফিতর। এটি ঈদুল ফিতরের দিন আদায় করা নিয়ম। রাসুল সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লামের একাধিক সহিহ হাদিসে সদকাতুল ফিতর আদায়ের ব্যাপারে গুরুত্ব আসার কারণে মুসলিম উম্মাহ রাসুলের যুগ থেকে এটি আদায় করে আসছে। সদকাতুল ফিতর মূলত জাকাতেরই একটি প্রকার। আমাদের এ অঞ্চলে সদকাতুল ফিতর ‘ফিতরা’ নামে অধিক পরিচিত। একটি দয়ীফ হাদীসে এই ইবাদতের দুটি হিকমত ও তাৎপর্য বলা হয়েছে। হজরত আব্দুল্লাহ ইবনে আব্বাস রা. থেকে বর্ণিত, তিনি বলেন: ‘সদকাতুল ফিতর হচ্ছে রোজাদারের জন্য পবিত্রতা এবং মিসকিনদের জন্য খাদ্য। আর যে তা ঈদের নামাজ আদায় করার পূর্বে আদায় করে তা কবুল করা হয়। আর যে তা ঈদের নামাজ আদায় করার পর আদায় করে, তা সদকাতুল ফিতর না হয়ে সাধারণ সদকাহ হিসাবে আদায় হয়ে যাবে।’ (সুনানে আবু দাউদ ১/২২৭ ও ইবনে মাজাহ্) অর্থহীন, অশালীন কথা ও কাজে রোজার যে ক্ষতি হয় তা পূরণের জন্য এবং নিঃস্ব লোকের আহার যোগানোর জন্য রাসুলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম সদকাতুল ফিতরকে অপরিহার্য করেছেন। সুতরাং খুশিমনেই সদকাতুল ফিতর আদায় করা উচিত। কেননা তাতে রয়েছে ফকিরদের জন্য দয়া এবং তাদেরকে ঈদের দিনে অন্যের নিকট চাওয়া হতে বিরত রাখা। ঈদের দিনে তারা যেন ধনীদের মত আনন্দ উপভোগ করতে পারে এবং ঈদ যেন সবার জন্য সমান হয় সেটাই সদকাতুল ফিতরের মুখ্য উদ্দেশ্য। আর এর মধ্যে আরও রয়েছে সাম্য ও সহমর্মিতা, সৃষ্টিজীবের জন্য ভালবাসা, ভ্রাতৃত্ব। রাসুলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম যা আমাদের ওপর অপরিহার্য করেছেন তা মানা আমাদের জন্য জরুরি। আর রাসুল সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম যা আমাদের ওপর অপরিহার্য করেছেন তা মানা আমাদের জন্য জরুরি। এ সম্পর্কে আল্লাহ তাআলা বলেছেন:
• ﴿مَّن يُطِعِ ٱلرَّسُولَ فَقَدۡ أَطَاعَ ٱللَّهَۖ وَمَن تَوَلَّىٰ فَمَآ أَرۡسَلۡنَٰكَ عَلَيۡهِمۡ حَفِيظ ا ٨٠﴾ [النساء: ٨٠]
যে রাসূলকে অনুসরণ করল, সে আল্লাহ তাআলাকে অনুসরণ করল। আর যে তা থেকে মুখ ফিরিয়ে নিল, তবে আপনাকে তো আমরা তাদের উপর রক্ষক (প্রহরী) করে প্রেরণ করিনি। (সূরা নিসা, আয়াত ৮০)
আর আল্লাহ বলেন-
• ﴿وَمَن يُشَاقِقِ ٱلرَّسُولَ مِنۢ بَعۡدِ مَا تَبَيَّنَ لَهُ ٱلۡهُدَىٰ وَيَتَّبِعۡ غَيۡرَ سَبِيلِ ٱلۡمُؤۡمِنِينَ نُوَلِّهِۦ مَا تَوَلَّىٰ وَنُصۡلِهِۦ جَهَنَّمَۖ وَسَآءَتۡ مَصِيرًا ١١٥﴾ [النساء: ١١٥]
আর যারা তাদের নিকট হিদায়াত পৌঁছার পরও রাসূলের বিরোধিতা করে এবং মুমিনদের ব্যতীত অন্যদের পথের অনুসরণ করে, তারা যেভাবে ফিরে যায়, আমরাও তাদেরকে সেদিকে ফিরিয়ে রাখব এবং জাহান্নামে দগ্ধ করাব। আর তা কতই না খারাপ প্রত্যাবর্তনস্থল। (সূরা আন নিসা, আয়াত ১১৫)
আর আল্লাহ তাআলা বলেন, যাকাতুল ফিতর
• ﴿وَمَآ ءَاتَىٰكُمُ ٱلرَّسُولُ فَخُذُوهُ وَمَا نَهَىٰكُمۡ عَنۡهُ فَٱنتَهُواْۚ وَٱتَّقُواْ ٱللَّهَۖ إِنَّ ٱللَّهَ شَدِيدُ ٱلۡعِقَابِ ٧﴾ [الحشر: ٧]
তোমাদের রাসূল যা কিছু নিয়ে এসেছেন তা তোমরা গ্রহণ কর এবং যা থেকে বিরত থাকতে বলেছেন তা থেকে বিরত থাক। (সূরা আল হাশর, আয়াত ৭)
সদকায়ে ফিতর কাদের উপর ওয়াজিব?
প্রত্যেক সামর্থ্যবান মুসলিম ব্যক্তির ওপর ফেতরা আদায় করা ওয়াজিব। ‘সামর্থ্যবান’ শব্দের ব্যাখ্যা হলো, প্রয়োজনের চেয়ে অতিরিক্ত সম্পদের মালিক হওয়া। অনেকের মনে প্রশ্ন আসবে, অতিরিক্ত বলতে কতটুকু? সোজা উত্তর হচ্ছে যাকাতের নেসাব পরিমাণ সম্পদের (৫২.৫ ভরি রূপা অথবা ৭.৫ ভরি সোনা অথবা সমমূল্যের সম্পদ) মালিক হওয়া।
সুতরাং বলা যায়, যেসব নারী-পুরুষ ঈদুল ফিতরের চাঁদ উঠার পর থেকে সেদিনের সূর্য অস্ত যাওয়া পযর্ন্ত সময়ে একদিনের আবশ্যকীয় প্রয়োজনীয় সামগ্রী ব্যতিত সারে বায়ান্ন তোলা রুপা বা তার সমমূল্যের মালিক হয় তাদের উপর সদকায়ে ফিতর আদায় করা ওয়াজিব।
• في تنوير البصائر ( على كل ) حر ( مسلم ) ولو صغيرا مجنونا حتى لو لم يخرجها وليهما وجب الأداء بعد البلوغ (ذي نصاب فاضل عن حاجته الأصلية) كدينه وحوائج عياله (الدر الختار- كتاب الزكاة باب صدقة الفطر-2/99)
• وفى الأشباه والنظائر-وجبت بقدرة ممكنة فلو افتقر بعد يوم العيد لم تسقط-(الأشباه والنظائر-2/225 الفن الثانى)
আমরা জানি, কোন ব্যক্তির যদি উপরোক্ত সম্পত্তি সঞ্চিত থাকা অবস্থায় এক বৎসর অতিক্রান্ত হয় তবে তার উপর যাকাত ফরজ হয়। তবে ফেতরা দাতার ক্ষেত্রে ব্যতিক্রম নিয়ম হলো, যাকাতের ন্যায় নিসাব পরিমাণ সম্পদের এক বৎসর অতিক্রান্ত হওয়া জরুরী নয়। কেউ যদি ঈদের আগের দিনও এই পরিমাণ সম্পদের মালিক হয়ে যায়, তাকেও ফেতরা আদায় করতে হবে। সামর্থ্যবান না হলে অর্থাৎ উপরোল্লিখিত নিসাব পরিমান সম্পদ ককারো ননা থাকলে তার উপর সদকাতুল ফিতর ওয়াজীব হবে না। সহীহ বুখারী শরীফে এসেছে, রাসূল সা. বলেছেন,
ﺧﻴﺮ ﺍﻟﺼﺪﻗﺔ ﻣﺎ ﻛﺎﻥ ﻋﻦ ﻇﻬﺮ ﻏﻨﻲ
"সর্বোত্তম সদকা সেটাই, যেটা সামর্থ্যবান কেউ আদায় করে।"
অথচ আমাদের সমাজে এমন কথা প্রচলিত আছে যে, যদি কেউ সামান্য অর্থের মালিক হয় তবে তাকেও ফেতরা আদায় করতে হবে। আরেকটি ধারণা প্রচলিত আছে যে, কারো ঘরে যদি ঈদের দিনের খাবার থাকে, সেও ফেতরা দিতে হবে! এগুলি সম্পূর্ণ ভূল ধারণা। আল্লাহর রাসুল মুহাম্মাদ সা. কারো উপর জোর করে এমন কোন কাজ চাপিয়ে দেননি, যে কাজের সাধ্য বা সামর্থ্য তার নেই! তাই বলে আমি নিরুৎসাহিত করছি না। আপনি সাদক্বা দিন। নিকটস্থ পরিবারে বা অসচ্ছল আত্মীয়দের খয়রাত করুন। ঈদের কাপড় কিনে দিন। ঈদ উপলক্ষ্যে অন্যান্য সামগ্রী কিনে দিন। কিন্তু আপনার মনে এটা পরিস্কার হওয়া আবশ্যক যে, আপনার উপর ফেতরা বা সদক্বাতুল ফেতর ওয়াজিব কি না।
সদকায়ে ফিতর কতটুকু আদায় করা ওয়াজিব?
রাসুলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লামের হাদিসে সদকাতুল ফিতর আদায়ের বিশেষ পদ্ধতি নির্ধারণ করে দেয়া হয়েছে। দুটি মাপকাঠি দ্বারা আদায় করতে হবে। তা হচ্ছে, ১. نصف صاع (নিসফে সা’) আধা সা’ গম বা যব বা তার সমমূল্য। ২. صاع (‘সা’) এক সা’ খেজুর, কিসমিস, পনির ও যব বা তার সমমূল্য। যব, খেজুর, পনির ও কিসমিস দ্বারা আদায় করলে এক ‘সা’ এবং গম দ্বারা আদায় করলে ‘নিসফে সা’ প্রযোজ্য হবে। এ প্রসঙ্গে হাদিসে বর্ণিত হয়েছে,
• كنا نخرج زكاة الفطر صاعًا من طعام أو صاعا من شعير أو صاعا من تمر أو صاعا من أقط أو صاعا من زبيب وذلك من صاع النبي صلى الله عليه وسلم.
1. হজরত আবু সাঈদ খুদরী রা. বলেন, ‘আমরা সদকা ফিতর আদায় করতাম এক ‘সা’ খাদ্য দ্বারা অথবা এক ‘সা’ যব অথবা এক ‘সা’ খেজুর, কিংবা এক ‘সা’ পনির বা এক ‘সা’ কিসমিস দ্বারা। আর এক ‘সা’-এর ওজন ছিল নবী করীম রাসুলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লামের ‘সা’ অনুযায়ী।’ (মুয়াত্তা মালেক পৃ ১২৪, আল ইসতিযকার, হাদীস ৫৮৯, ৯/৩৪৮) তবে সাহাবায়ে কেরাম সাধারণত খেজুর দ্বারাই সদকাতুল ফিতর আদায় করতেন। হজরত আব্দুল্লাহ ইবনে উমর রা. সারা জীবন খেজুর দ্বারাই সদকা ফিতর আদায় করেছেন। তিনি একবার মাত্র যব দ্বারা আদায় করেছেন। (আলইসতিযকার, হাদীস নং ৫৯০,৯/৩৫৪) এ প্রসঙ্গে ইবনে উমর রা. এর ভাষ্য হলো,
إن أصحابي سلكوا طريقا وأنا أحب أن أسلكه
‘সাহাবিগণ যে পথে চলেছেন আমিও সে পথেই চলতে আগ্রহী।’ ইবনে কুদামা রহ. স্বীয় কিতাবে আবু মিজলাযের বর্ণনা উল্লেখ করে বলেন, ‘এ বর্ণনা দ্বারা বুঝা যায় যে, সাহাবায়ে কেরাম অধিকাংশই যেহেতু খেজুর দ্বারা ফিতরা আদায় করতেন তাই ইবনে উমর রা.ও খেজুর দ্বারা ফিতরা আদায় করতেন।’
২. হযরত আবদুল্লাহ ইবনে আববাস রা. থেকে বর্ণিত, তিনি রমযানের শেষ দিকে বসরার মিম্বারের উপর খুতবা দানকালে বলেছেন,
فرض رسول الله صلى الله عليه وسلم هذه الصدقة صاعا من تمر أو شعير، أو نصف صاع من قمح على كل حر أو مملوك، ذكر أو أنثى، صغير أو كبير.
রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম সদকাতুল ফিতর অপরিহার্য করেছেন এক সা খেজুর বা যব কিংবা আধা সা গম; গোলাম-স্বাধীন, নারী-পুরুষ ও ছোট-বড় প্রত্যেকের উপর। (সুনানে আবু দাউদ ১/২২৯। প্রখ্যাত হাদীস বিশারদ আল্লামা ইবনে আবদুল হাদী আল হাম্বলী রাহ. বলেন, হাদীসটির সকল রাবী প্রসিদ্ধ ও নির্ভরযোগ্য। আল্লামা যাহাবী রাহ. বলেছেন, হাদীসটির সনদ শক্তিশালী।)
আধা সা দ্বারা সদকাতুল ফিতর আদায় করা যাবে কিনা বিষয়টি নিয়ে ওলামায়ে কেরামের মহলে বেশ বিতর্ক রয়েছে। একদল ওলামায়ে কেরাম আধা সা দ্বারা সদকাতুল ফিতর আদায় করা যাবে না বলে মত পেশ করেছেন। কিন্তু আমাদের নিকটে আধা সা দ্বারা সদকাতুল ফিতর আদায় করলেও আদায় হয়ে যাবে। এবং এ সম্পর্কীয় হাদিসগুলো সহিহ। এখানে কয়েকটি হাদিস উল্লেখ করা হলো।
# হজরত আবদুল্লাহ ইবনে আমর ইবনুল আস রা. থেকে বর্ণিত,
• أن النبي صلى الله عليه وسلم بعث مناديا ينادي في فجاج مكة : ألا إن صدقة الفطر واجب على كل مسلم، ذكر أو أنثى، حر أو عبد، صغير أو كبير، مدان من قمح، أو صاع مما سواه من الطعام.
রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম একজন ঘোষক প্রেরণ করলেন সে যেন মক্কার পথে পথে এ ঘোষণা করে যে-জেনে রেখো! প্রত্যেক মুসলিম নর-নারী, গোলাম-স্বাধীন, ছোট-বড় প্রত্যেকের উপর সদকায়ে ফিতর অপরিহার্য। দুই মুদ (আধা সা) গম কিংবা এক সা অন্য খাদ্যবস্ত্ত।(জামে তিরমিযী ১/৮৫)। ইমাম তিরমিযী রাহ. বলেন, হাদীসটি হাসান।
# হজরত আসমা বিনতে আবু বকর রা. বলেন,
• كنا نؤدي زكاة الفطر على عهد رسول الله صلى الله عليه وسلم مدين من قمح، بالمد الذي تقتاتون به.
যে মুদ (পাত্র) দ্বারা তোমরা খাদ্যবস্ত্ত গ্রহণ করে থাক এমন দুই মুদ (আধা সা) গম আমরা রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম-এর যমানায় সদকাতুল ফিতর আদায় করতাম।(মুসনাদে আহমদ ৬/৩৪৬। শায়খ শুআইব আরনাউত বলেন, হাদীসটি সহীহ এবং এ সনদটি হাসান। শায়খ নাসীরুদ্দীন আলবানী রাহ. বলেছেন, এই হাদীসের সনদ বুখারী ও মুসলিমের শর্তে উত্তীর্ণ, সহীহ।)
ইমাম তহাবী রাহ. এ হাদীসটি বর্ণনা করার পর বলেন-
فهذه أسماء تخبر أنهم كانوا يؤدون في عهد النبي صلى الله عليه وسلم زكاة الفطر مدين من قمح، ومحال أن يكونوا يفعلون هذا إلا بأمر رسول الله صلى الله عليه وسلم، لأن هذا لا يؤخذ حينئذٍ إلا من جهة توقيفه إياهم على ما يجب عليهم من ذلك.
# হজরত আসমা রা. জানিয়েছেন যে, নবী-যুগে সাহাবায়ে কেরাম সদকাতুল ফিতর দিতেন আধা সা গম। এ তো সম্পূর্ণ অসম্ভব যে, রাসূলুললাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম-এর নির্দেশ ছাড়া তাঁরা এই কাজ করতেন। কারণ দ্বীনের বিষয়ে তাঁদের কর্তব্য কী তা জানার একমাত্র সূত্র রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম-এর শিক্ষা ও নির্দেশনা।
#হজরত সাঈদ ইবনুল মুসাইয়্যিব রাহ. বলেন,
• فرض رسول الله صلى الله عليه وسلم زكاة الفطر مدين من حنطة.
রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম সদকাতুল ফিতর নির্ধারণ করেছেন দুই মুদ (আধা সা) গম।(মারাসীলে আবু দাউদ পৃ. ১৬। আল্লামা ইবনে আবদুল হাদী আলহাম্বলী রাহ. বলেন, এ হাদীসের সনদ দিবালোকের ন্যায় স্পষ্ট, সহীহ। তবে তা মুরসাল। আর সাঈদ ইবনুল মুসাইয়্যিব রাহ.-এর মুরসাল রেওয়ায়েতও দলিলযোগ্য হয়।)
#হজরত আবদুল্লাহ ইবনে ছালাবা রা. বলেন, রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম ঈদুল ফিতরের একদিন বা দুদিন আগে সাহাবীদের উদ্দেশ্যে খুতবা দিয়েছেন।
• أدوا صاعا من بر أو قمح بين اثنين، أو صاعا من تمر، أو صاعا من شعير على كل أحد صغير أو كبير.
সে খুতবায় তিনি বলেছেন, তোমরা প্রতি দু’জনের পক্ষ থেকে এক সা গম অথবা ছোট-বড় প্রত্যেকের মাথাপিছু এক সা খেজুর বা এক সা যব প্রদান করো। (মুসান্নাফ আবদুর রাযযাক ৩/৩১৮। আল্লামা যাইলাঈ রাহ. বলেন, এই হাদীসটির সদন সহীহ ও শক্তিশালী।)
# ইমাম ইবনে শিহাব যুহরী রাহ. বলেন, তিনি সাঈদ ইবনুল মুসাইয়্যিব, আবু সালামা ইবনে আবদুর রহমান ও উবাইদুল্লাহ ইবনে আবদুল্লাহ ইবনে উতবাহ রা. প্রমুখকে বলতে শুনেছেন,
• أمر رسول الله صلى الله عليه وسلم بزكاة الفطر بصاع من تمر، أو بمدين من حنطة.
রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম সদকাতুল ফিতর আদায়ের আদেশ করেছেন এক সা খেজুর বা দুই মুদ (আধা সা) গম। (শরহু মাআনিল আছার ১/৩৫০। আল্লামা আইনী রাহ. বলেন, হাদীসটি সহীহ। নুখাবুল আফকার ৫/২২৫)
# হজরত সাঈদ ইবনুল মুসাইয়্যিব, উবাইদুল্লাহ ইবনে আবদুল্লাহ ইবনে উতবাহ, কাসেম ও সালেম রাহ. বলেছেন,
• أمر رسول الله صلى الله عليه وسلم في صدقة الفطر بصاع من شعير أو مدين من قمح.
রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম আদেশ করেছেন সদকাতুল ফিতরে এক সা যব বা দুই মুদ (আধা সা) গম আদায় করার। (শরহু মাআনিল আছার ১/৩৫০। আল্লামা আইনী রাহ. বলেন, হাদীসটি সহীহ। শায়খ শুআইব আরনাউত বলেন, এটি সহীহ ও মুরসাল)
আধুনিক হিসাবে সা ও নিসফে সা
১ সা = ২৮০.৫০ তোলা
১ তোলা = ১১.৬৬ গ্রাম (প্রায়)
অতএব
১ সা = ৩২৭০.৬০ গ্রাম (প্রায়)
অর্থাৎ ৩ কেজি ২৭০ গ্রামের কিছু বেশি।
এবং আধা সা = ১৬৩৫.৩১৫ গ্রাম বা ১.৬৩৫৩১৫ কেজি (প্রায়)
অর্থাৎ ১ কেজি ৬৩৫ গ্রামের কিছু বেশি।
[সূত্র : আওযানে শরইয়্যাহ, মুফতী মুহাম্মাদ শফী রাহ. পৃ. ১৮; মেট্রিক/আন্তর্জাতিক পদ্ধতি সংক্ষিপ্ত বিবরণ (জনসাধারণের জন্য) ১৯৮২; বাংলাদেশ স্ট্যান্ডার্স ইনস্টিটিউশন পৃ. ৩]
মোটকথা, হাদিসে মোট পাঁচ ধরনের খাদ্যদ্রব্যের কথা বলা হয়েছে এবং দুটি পরিমাপের কথাও বলা হয়েছে। তার মাঝে গম দিয়ে আদায় করলে আধা সা অর্থাৎ ১ কেজি ৬৩৫ গ্রামের কিছু বেশি, আর খেজুর, পনির, কিসমিস ও যবের দ্বারা আদায় করলে এক সা অর্থাৎ ৩ কেজি ২৭০ গ্রামের কিছু বেশি দিতে হবে। এই দুই ধরনের খাদ্যদ্রব্য বা তার বাজারমূল্য যে কোনোভাবেই হোক তা আদায় হয়ে যাবে। তবে একটি বিষয় মনে রাখা দরকার যে, মোট যে কয়টি খাদ্যদ্রব্যের কথা হাদিস শরিফে বর্ণিত হয়েছে তার যে কোনো একটি দ্বারা আদায় হলেও সবচেয়ে কমদামের বস্তুটিকে মাফকাঠি না বানিয়ে বরং সামর্থ্য অনুযায়ী বেশিমূল্যের খাদ্যবস্তুকে মাপকাঠি নির্ধারণ করে সদকাতুল ফিতর আদায় করা উচিত। আর যেহেতু সহিহ হাদিসে গমকেও একটি মাপকাঠি সাব্যস্ত করা হয়েছে এবং এর পরিমাণ নির্ধারণ করা হয়েছে ‘আধা সা’ তাই আধা সা গম বা তার মূল্য আদায় করলে নিঃসন্দেহে সদকাতুল ফিতর আদায় হয়ে যাবে। বর্তমান বাজার দর হিসাবে যেহেতু গমের দামই সবচেয়ে কম, তাই ইসলামিক ফাউন্ডেশনের পক্ষ থেকে প্রতি বছর আধা সা গমকে মাপকাঠি ধরে ফিতরার সর্বনিম্ন পরিমাণ ঘোষণা করা হয়। টাকার অংকটি নির্ধারিত হয় আধা সা গমের ওই সময়ের বাজারদর হিসাবে। আর ফাউন্ডেশন কর্তৃক ঘোষিত পরিমাণটি ফিতরার সর্বনিম্ন পরিমাণ। যার সামর্থ্য আছে, তিনি এক সা পরিমাণের খাদ্যবস্তুগুলোর কোনো একটিকে মানদন্ড ধরেও ফিতরা আদায় করতে পারেন এবং এটিই তার জন্য উত্তম। কারণ তাতে গরিবদের উপকার হয়। সদকাতুল ফিতর মূলত গরিবদের উপকারের জন্যই নির্ধারিত।
যেহেতু যব, খেজুর, পনির ও কিসমিস দ্বারা আদায় করলে এক ‘সা’ (১ সা = ৩২৭০.৬০ গ্রাম (প্রায়) অর্থাৎ ৩ কেজি ২৭০ গ্রামের কিছু বেশি) আদায় করতে হয়। আর সবচেয়ে উন্নতমানের আজওয়া খেজুরের মূল্য প্রতি কেজি ১০০০/- টাকা হলে একজনের সদকায়ে ফিতর দাঁড়ায় ৩২৫৬/- তিন হাজার দুই শত ছাপ্পান্ন টাকা। মধ্যম ধরনের খেজুর যার মূল্য প্রতি কেজি ৩০০/- টাকা হলে একজনের সদকায়ে ফিতর দাঁড়ায় ৯৭৭/- নয়শত সাতাত্তর টাকা। কেউ যদি কিসমিস দ্বারা আদায় করে তাহলে কিসমিস প্রতি কেজি ২৩০/- টাকা করে হলে একজনের সদকায়ে ফিতর দাঁড়ায় ৭৪৮/- (সাত শত আটচল্লিশ) টাকা। কেউ যদি পনির দ্বারা আদায় করে তাহলে পনির প্রতি কেজি ৫০০/- টাকা করে ধরা হলে একজনের সদকায়ে ফিতর দাঁড়ায় ১৬২৮/- (এক হাজার ছয় শত আটাশ) টাকা। আর যদি কেউ গম দ্বারা আদায় করে তাহলে তাকে প্রধান করতে হবে ‘নিসফে সা’ বা আধা সা (আধা সা = ১৬৩৫.৩১৫ গ্রাম বা ১.৬৩৫৩১৫ কেজি (প্রায়) অর্থাৎ ১ কেজি ৬৩৫ গ্রামের কিছু বেশি)। গম প্রতি কেজি ৩৫/- টাকা হিসাবে ধরা হলে একজনের সদকায়ে ফিতর দাঁড়ায় ৫৭ টাকা।
এখানে একটি কথা মনে রাখা জরুরি যে, সাহাবা, তাবেয়ি ও তাবেয়িনের কোনো যুগে সবাই মিলে আধা সা গম দ্বারাই সদকাতুল ফিতর আদায় করেছেন বলে কোনো দুর্বল প্রমাণও পাওয়া যায়। আমাদের দেশে সবাই হাদিসে বর্ণিত সব দ্রব্যের সবচেয় নিম্মমূল্যের গম দ্বারা আদায় করে থাকে। বাকিগুলো দিয়ে কেউ আদায় করে না। অথচ নিময় তো ছিল প্রত্যেকে যার যার সামর্থ্য অনুযায়ী বেশিমূল্যমানের দ্রব্য দ্বারা সদকাতুল ফিতর আদায় করবে। নবী করীম সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লামকে সর্বোত্তম দান সম্পর্কে জিজ্ঞাসা করা হলে তিনি ইরশাদ করেন, ‘দাতার নিকট যা সর্বোৎকৃষ্ট এবং যার মূল্যমান সবচেয়ে বেশি’। (সহীহ বুখারী, কিতাবুল ইতক ৩/১৮৮; সহীহ মুসলিম, কিতাবুল ঈমান, বাব- আফযালুল আমল ১/৬৯) সাহাবায়ে কেরাম সর্বোচ্চমূল্যের জিনিস দ্বারাই দান সদকা করতেন। এমনকি চার মাজহাবের সবাই উত্তম সদকা বলতে সর্বোচ্চমূল্যেরটাকে গ্রহণ করেছেন। ইমাম শাফেয়ি রহ. এর মতে উত্তম হলো হাদীসে বর্ণিত বস্তুর মধ্যে সর্বোৎকৃষ্ট ও সর্বোচ্চ মূল্যের দ্রব্য দ্বারা সদকা দেয়া। অন্য সকল ইমামের মতও এমনই। ইমাম মালিক রহ. এর নিকট খেজুরের মধ্যে সবচেয়ে উন্নত খেজুর ‘আজওয়া’ খেজুর দেয়া উত্তম। ইমাম আহমদ রহ. এর নিকট সাহাবায়ে কেরামের অনুসরণে খেজুর দ্বারা ফিতরা আদায় করা ভালো। (আলমুগনী ৪/২১৯; আওজাযুল মাসালিক ৬/১২৮) ইমাম আবু হানীফা রহ. এর নিকটেও অধিক মূল্যের দ্রব্যের দ্বারা ফিতরা আদায় করা ভালো। অর্থাৎ যা দ্বারা আদায় করলে গরিবের বেশি উপকার হয় সেটাই উত্তম ফিতরা।
সদকাতুল ফিতর কখন ওয়াজিব হয়?
সদকাতুল ফিতর বা ফেতরা ঈদুল ফিতরের ভোর হওয়ার সঙ্গে সঙ্গে ওয়াজীব হয়। কাজেই সেদিন ভোরের আগে যে জন্ম নিয়েছে, সে যদি নিসাব পরিমান সম্পদের মালিক হয়, তাকেও এই সদকাতুল ফিতর আদায় করতে হবে। কেউ যদি সেদিন ভোরের আগে মারা যায়, তার ওপর সদকাতুল ফিতর আদায় করা ওয়াজিব নয়। আবার ভোর হবার পর কেউ জন্ম নিলে তার পক্ষ থেকেও আদায় করা ওয়াজিব নয়।
এক ব্যাক্তির ফিতরা একজন মিসকিনকে দেওয়াই উত্তম। তবে একাধিক মিসকিনকে দেওয়া জায়েজ আছে। একজন লোকের উপর যে ফিতরা ওয়াজিব তা একজন মিসকিনকে দেওয়াও জায়েজ আছে।
আমরা অনেকেই ফিতরা দেই। তবে যদি একটু চিন্তা করে দেই, তাহলে তা অনেক সুন্দরভাবে সম্পন্ন করা যাবে। যেমন আমরা যদি যৌথ ৫/৭ জন লোকের পরিবারের ফিতরা একটা পরিবার কে দিয়ে দেই, তাহলে হয়ত তার ঈদের বাজার হয়ে যাবে। এতে পরিবারটির ছেলেমেয়ের পোষাক হয়ে যাবে। আনন্দের সঙ্গে ঈদ কাটাবে। তাই যেন আমরা ঈদের আগে এটি দেওয়ার চেষ্টা করি। আমরা শুধু আটার দামে ফিতরা দেই, কিন্ত খেজুর বা কিছমিছ এর দামে দেইনা কেন? কারণ এগুলোর দাম বেশি। উচিত হচ্ছে সাধ্য মত দেওয়া। নিম্নবিত্তরা আটার দামে দিবে আর বিত্তশালীরা খেজুর বা কিছমিছ এর দামে দিবে।সবাই যদি সস্তা খোঁজেন, তাহলে গরিব ধনীর পার্থক্য থাকেনা। অনেকেই ঈদের দিন ফিতরার হিসাব না করে দশ বিশ টাকা করে অনেককে দেন, কিন্তু তাতে করে আপনার ফিতরা আদায় হবেনা।
সদকাতুল ফিতর আদায়ের সঠিক সময়ঃ
ঈদুল ফিতরের দিন সকালে ঈদের নামাজ পড়তে যাওয়ার আগে সদকাতুল ফিতর বা ফেতরা আদায় করা উত্তম। তবে সেই সময়ের আগেও অর্থাৎ রমজানেও আদায় করা যেতে পারে। কেউ ফেতরা আদায় না করে মৃত্যুবরণ করলে তার পক্ষ থেকে তার উত্তরাধিকারী ফেতরা দিলেও আদায় হয়ে যাবে।
ঈদুল ফিতরের দিন ঈদগাহের উদ্দেশ্যে বের হওয়ার আগে ফিতরা আদায় করা মুস্তাহাব। তবে পরে আদায় করলেও তা আদায় হবে।
فى الدر المختار مع الرد المحتار-( بطلوع فجر الفطر ) متعلق بيجب ( فمن مات قبله ) أي الفجر ( أو ولد بعده أو أسلم لا تجب عليه .ويستحب إخراجها قبل الخروج إلى المصلى بعد طلوع فجر الفطر ) عملا بأمره وفعله عليه الصلاة والسلام .(كتاب الزكاة، باب صدقة الفطر-2/106)
وفى صحيح البخارى-عن ابن عمر رضي الله عنهما قال : فرض رسول الله صلى الله عليه و سلم زكاة الفطر صاعا من تمر أو صاعا من شعير على العبد والحر والذكر والأنثى والصغير والكبير من المسلمين وأمر بها أن تؤدى قبل خروج الناس إلى الصلاة (صحيح البخارى-كتاب الزكاة ، باب فرض صدقة الفطر-رقم المحديث-1432، 1433 ، 1436 ، 1438 ، 1440 ،1441)
সদকাতুল ফিতর প্রদানের স্থান :
সদকাতুল ফিতর প্রদানের সময় যে এলাকায় সে অবস্থান করছে ঐ এলাকার গরীবরাই বেশী হকদার। উক্ত এলাকায় সে স্থায়ী হোক বা অস্থায়ী। কিন্তু যদি তার বসতি এলাকায় কোন হকদার না থাকে বা হকদার চেনা অসম্ভব হয়, তাহলে তার পক্ষে উকিল নিযুক্ত করবে। সে উপযুক্ত ব্যক্তি খুঁজে তার সদকাতুল ফিতর আদায় করে দিবে ।
সাদকাতুল ফিতর কাদের পক্ষ থেকে দেয়া যাবে?
যার ওপর ওয়াজিব হবে তার নিজের পক্ষ থেকে এবং নিজের অধীনস্থ অর্থাৎ অপ্রাপ্ত বয়স্ক সন্তান বা অবিবাহিত মেয়ের পক্ষ থেকে ফেতরা আদায় করা ওয়াজীব। সন্তানের নামে সম্পদ থাকলে সেখান থেকে আদায় করা যাবে। প্রাপ্ত বয়স্ক সন্তানের পক্ষ থেকে আদায় করা ওয়াজীব নয়। কোনো এতিম শিশুর ভরণপোষণের দায়িত্ব নিয়ে থাকলে তার পক্ষ থেকেও আদায় করতে হবে। স্ত্রী এবং বালেগ সন্তানগণ তারা তাদের ফিতরা নিজেরাই আদায় করবে। স্বামী এবং পিতার উপর তাদের ফিতরা আদায় করা ওয়াজিব নয়, অবশ্য দিয়ে দিলে আদায় হয়ে যাবে। নিজ পরিবারভুক্ত নয় এমন লোকের পক্ষ থেকে তার অনুমতি ছাড়া ফিতরা দিলে আদায় হবে না। কোনো ব্যাক্তির উপর তার পিতা-মাতা এবং ছোট ভাই বোন ও নিকট আত্মীয়র পক্ষ হতে ফিতরা আদায় করা ওয়াজিব নয়।
সদকাতুল ফিতর কাদেরকে প্রদান করা যাবে?
যাদেরকে জাকাত প্রদান করা যাবে তাদেরকে সদকাতুল ফিতরও প্রদান করা যাবে। কোরআনে বর্ণিত আটটি খাতে জাকাত প্রদান করা যায়।
আল্লাহ তায়ালা পবিত্র কোরআনে বলেছেন, “জাকাত হলো কেবল নিঃস্ব, অভাবগ্রস্ত, এ সংশ্লিষ্ট কর্মচারী ও যাদের চিত্ত আকর্ষণ করা প্রয়োজন তাদের হক এবং তা দাস মুক্তির জন্যে, ঋণগ্রস্তদের জন্যে, আল্লাহর পথে জিহাদকারীদের জন্য এবং মুসাফিরদের জন্যে। এই হলো আল্লাহর নির্ধারিত বিধান। আল্লাহ সর্বজ্ঞ, প্রজ্ঞাময়।” (সুরা তাওবা, আয়াত ৬০)
কোরআনে কারিমে বর্ণিত জাকাতের হকদার বা মাসরাফ হলো আটটি:
১. ফকীর: যার পরিবারের ভরণ-পোষণ ও অন্যান্য প্রয়োজন মিটানোর জন্য অতি সামান্য মাল আছে যা যা তার সংসার চালানোর জন্য যথেষ্ট নয়; বরং অন্যের সাহায্য-সহায়তার প্রয়োজন হয় ইসলামি শরিয়তের দৃষ্টিতে এদেরকে ‘ফকির’ বলা হয়। এ ধরনের লোককে জাকাত দেয়া যাবে।
২. মিসকিন: যার কাছে জাকাতযোগ্য সম্পদ নিসাব পরিমাণ নেই এবং প্রয়োজনের অতিরিক্ত অন্য ধরনের মাল সামান্য ও নিসাব পরিমাণ নেই তাকে শরিয়তের পরিভাষায় ‘মিসকিন’ বলা হয়। তাকেও জাকাত প্রদান করা যাবে।
৩. জাকাতের জন্য নিয়োজিত কর্মচারী: যারা ইসলামী হুকুমতের পক্ষ থেকে জাকাত উসুল এবং তা বন্টন করার জন্য নিয়োগপ্রাপ্ত তাদেরকে জাকাত প্রদান করা যাবে। তাদের আপন পদমর্যাদা অনুপাতে জাকাতের অর্থ প্রদান করা জায়েজ, যদিও তারা ধনী হয়। তবে ব্যক্তিগতভাবে যদি কেউ কোন লোককে জাকাত সংক্রান্ত কাজে নিয়োগ করে, তাকে জাকাতের কোন অংশ দেয়া যাবে না। নিয়োগকারী নিজের পক্ষ থেকেই তাকে বেতন দিবে। এখানে একটি প্রশ্ন আসে যে, বর্তমানে আমাদের সমাজে জাকাত উসুলকারীকে জাকাত থেকে কমিশনের ভিত্তিতে টাকা দেয়া জায়েজ কিনা? আর জাকাত উসুলকারীর যাতায়াত খরচ জাকাত থেকে গ্রহণ করা বৈধ কিনা? এর জবাব হলো, যেহেতু বর্তমানে জাকাত উসুলকারীরা শরয়তসম্মত আমেল নয় (কারণ শরয়তসম্মত আমেল হবার জন্য ইসলামী রাষ্ট্র কর্তৃক নিযুক্ত আমেল হওয়া জরুরি) তাই তাকে জাকাত থেকে পারিশ্রমিক দিলে জাকাত আদায় হবে না। তবে সে যদি গরিব হয় আর তাকে জেনারেল ফান্ড থেকে দেয়া বেতন ছাড়া জাকাতের মাল থেকেও কিছু প্রদান করা হয় তবে তা জায়েজ। জাকাতের টাকা নির্ধারিত হকদারের কাছে পৌঁছানোর পূর্বে তা থেকে খরচ করা বৈধ নয়। যেহেতু জাকাত আদায় হবার জন্য ‘তামলিক’ তথা গরীবকে মালিক বানিয়ে দেয়া শর্ত, আর রাস্তার খরচ জাকাতের সম্পদ থেকে গ্রহণ করা হলে খরচকৃত সম্পদে নির্ধারিত হকদারকে মালিক বানানো হয় না, তাই জাকাতের যেই অংশ রাস্তার খরচ বাবত কাটা হবে তাতে জাকাত আদায় হবেনা। তবে জেনারেল ফান্ড থেকে কালেকশনকারীর খরচ বহন করা জায়েজ আছে। (ইযাহুন নাওয়াদির-২/২২৯-২৩২, ফাতওয়ায়ে শামী-৩/২৯১,২৮৬, হেদায়া-৩/২৭৭, ইযাহুন নাওয়াদির-২/২২৯-২৩২, ফাতওয়ায়ে রহিমীয়া-৭/১৭২,১৮২, ফাতওয়ায়ে আজিজীয়া-৩৬৩, জাওয়াহিরুল ফিক্বহ, আপকি মাসায়িল আওর উনকা হল-৩/৩১৫, আহসানুল ফাতওয়া-৪/২৮৪,২৫২, ফাতওয়ায়ে মাহমুদিয়া-১৪/২৬৬, ইমদাদুল ফাতওয়া-২/৫৬,১৬, তাফসীরে মারেফুল কুরআন-সুরা তাওবা-৭)
৪. মন জয় করার উদ্দেশ্যে: সদ্য মুসলমান হওয়া ব্যক্তির সমস্যা দূরকরণে এবং ইসলামের ওপর অবিচল রাখার উদ্দেশ্যে তাদের জাকাত দেয়া যাবে।
* অমুসলিমদেরকে ইসলামের প্রতি আকৃষ্ট করার জন্য জাকাতের সম্পদ দেয়া জায়েজ নয়। তবে তাদেরকে নফল দান-খয়রাত করা যাবে। (মুসন্নাফে আবদুর রাযযাক, হাদিস নং ৭১৬৬, ৭১৬৭, ৭১৭০, মুসান্নাফে ইবনে আবী শায়বা ৬/৫১৬, ৫১৭)
৫. মুক্তিকামী দাস: যে দাস তার মনিবের সাথে নির্দিষ্ট পরিমান অর্থ পরিশোধ সাপেক্ষে মুক্তি পাওয়ার চুক্তি করেছে এমন দাসকে মুক্তির মূল্য পরিশোধের জন্য জাকাত প্রদান করা যেতে পারে।
* বর্তমানে ইসলামে ক্রীতদাস প্রথা চালু নেই বিধায় এ কাতে জাকাতের অর্থ বণ্টন করা হয় না।
৬. ঋণগ্রস্ত ব্যক্তি: যে ব্যক্তি এমন ঋণগ্রস্ত যে, ঋণ পরিশোধ করার পর তার কাছে নিসাব পরিমাণ সম্পদ থাকে না তাকে জাকাত দিয়ে সাহায্য করা যাবে।
৭. আল্লাহর পথে: এটির অন্য অর্থ জিহাদ। কুফরি ব্যবস্থা দূর করে ইসলামিক ব্যবস্থা প্রতিষ্ঠার লক্ষ্যে যারা জিহাদে লিপ্ত আছেন তাদেরকেও জাকাতের সম্পদ দেয়া যাবে।
৮. অসহায় প্রবাস পথিক: কোনো ব্যক্তি যদি সফরে গিয়ে আর্থিক সমস্যায় পরেন, অথচ নিজ বাড়িতে লোকটি নিসাব পরিমাণ মালের অধিকারী, তবে তাকে সাময়িকভাবে জাকাত দেয়া যাবে। তবে এই ব্যক্তির জন্য শুধু প্রয়োজন পরিমাণ গ্রহণ করাই জায়েজ; এর বেশি নয়।
* জাকাতের টাকা দ্বীনদার পরহেজগার ব্যক্তিকে দেয়া উচিত। দ্বীনদার নয় এমন ব্যক্তি যদি জাকাত গ্রহণের উপযুক্ত হয় তাহলে তাকেও দেয়া যাবে। তবে যদি প্রবল ধারণা হয় যে, জাকাতের টাকা দেয়া হলে লোকটি গুনাহের কাজে ব্যয় করবে তাহলে তাকে জাকাত দেয়া জায়েজ নয়।
* জাকাতের টাকা জাকাতের হকদারদের কাছে পৌছে দিতে হবে। নির্ধারিত খাতে ব্যয় না করে অন্য কোনো জনকল্যাণমূলক খাতে ব্যয় করা হলেও জাকাত আদায় হবে না।
* ঘরের কাজের লোকদেরকে তাদের নির্ধারিত পারিশ্রমিক ছাড়া জাকাতের সম্পদ দেয়া যাবে যদি তারা উপযুক্ত হন।
* আত্মীয়-স্বজন যদি জাকাত গ্রহণের উপযুক্ত হয় তাহলে অন্যদের তুলনায় তাদেরকে আগে দিতে হবে।
আত্মীয়দের মধ্যে যাদেরকে দেয়া যাবে:
ভাই, বোন, ভাতিজা, ভাগনে, চাচা, মামা, ফুফু, খালা প্রমূখ। (মুসান্নাফে আবদুর রাযযাক, হাদিস নং ৭১৬০, ৭১৬১, ৭১৬৪, ৭১৭১, মুসান্নাফে ইবনে আবী শায়বা ৬/৫৪২,৫৪৬)
আত্মীয়দের মধ্যে যাদেরকে দেয়া না:
নিজ পিতা, মাতা, দাদা, দাদী, নানা, নানী, পরদাদা প্রমূখ ব্যক্তিবর্গ যারা তার জন্মের উৎস। অনুরূপ নিজের ছেলে, মেয়ে, নাতী, নাতনী ও তাদের অধস্তনকে জাকাত দেয়া যাবে না। স্বামী স্ত্রী একে অপরকে জাকাত দিতে পারবে না। (রদ্দুল মুহতার ২/২৫৮)
জাকাত-সদকা যেহেতু নিকত্মীয়দের দেয়া বেশি উত্তম। তাই যার উপর সদকা বা যাকাত ওয়াজিব সে যে এলাকায় বসবাস করে তার নিকত্মীয় বা বেশি দরিদ্র ব্যক্তি যদি অন্যত্র বসবাস করে তাহলে তার কাছে তা পাঠানো জায়েজ।
فى الدر المجتار-( و ) كره ( نقلها إلا إلى قرابة )……( أو أحوج ) أو أصلح أو أورع أو أنفع للمسلمين ( أو من دار الحرب إلى دار الإسلام أو إلى طالب علم ) (الدر المختار-كتاب الزكاة،باب المصرف أي مصرف الزكاة والعشر-2/353)
সদকায়ে ফিতর আদায় করার ক্ষেত্রে কোন এলাকার মূল্য ধর্তব্য?
সদকাতুল ফিতর যিনি আদায় করবেন তিনি যে এলাকায় বসবাস করেন সে এলাকার যে দিন আদায় করবেন সেদিনের মূল্য হিসাব করে আদায় করতে হবে।
وتعتبر القيمة يوم الوجوب الخ ويقوم في البلد الذي المال فيه (الدر المختار مع رد المحتار-كتاب الزكاة، باب زكاة الغنم-2/29)
ওয়াজিবকৃত বস্তু দেয়া উত্তম নাকি তার মূল্য দেয়া উত্তম?
ওয়াজিব হওয়া বস্তু দিবে না মূল্য দিবে- বিষয়টি নিয়েও মতানৈক্য পরিলক্ষ্যিত হয়। তবে ফকিহগণ মূল্য দিতে পারবে বলে মত পেশ করেছেন।
فى الدر المختار- أى الدراهم أفضل من دفع العين على المذهب المفتى به…….وهذا فى السعة أما فى الشدة فدفع العين أفضل كما لا يخفى (الدر المختار مع رد المحتار-كتاب الزكاة، باب صدقة الفطر-2/106)
সম্পাদক, মাসিক আরবি ম্যাগাজিন ‘আলহেরা’
http://www.madarisweb.com/majallah/alhira
বিষয়: বিবিধ
১৩৫৩ বার পঠিত, ২ টি মন্তব্য
পাঠকের মন্তব্য:
আপনি একটা আয়াত পেশ করেছেন এ মর্মে বোঝানোর জন্যে.. "সর্বোত্তম সদকা সেটাই, যেটা সামর্থ্যবান কেউ আদায় করে।"
.....এখানে বোঝা যাচ্ছে যারা সামর্থবান তারাই আদায় করবে। তবে সেটি যাকাতের নিসাব পরিমান সম্পদের মালিক হলে করতে হবে কিনা বিষয়টি সুস্পষ্ট নয়। তাই অনেকে বলেছেন স্বচ্ছল ব্যক্তি এটি আদায় করবে যার অন্যকে দিয়ে নিজেরও ভালোভাবে চলার বা ঈদ করার অবস্থা রয়েছে।
এ মর্মে একটি আয়াত রয়েছে যে....তারা স্বচ্ছল ও অস্বচ্ছল অবস্থায় দান করে......উক্ত আয়াত থেকে এটাও বোঝা যায় যে, অস্বচ্ছল অবস্থায় দান করাটাও আল্লাহর আদেশ।....যাইহোক আপনি অনেক রেফারেন্সসহ সুন্দর পোস্ট করেছেন।
========
শা এর হিসাবের কিছু তারতম্য রয়েছে। মদীনার শা এবং ইরাকী শা এক নয়। আবার কেউ বলেছেন এক শা= আড়াই কেজী,কেউ গবেষনা করে এটা ২ কেজীএবং ৩ কেজীও বলেছেন। আমার মতে বেশী পরিমানটা দেওয়াই ভালো। আল্লাহই উত্তম জানেন
মন্তব্য করতে লগইন করুন