হতাশ ইরান
লিখেছেন লিখেছেন মুফতি মুহাম্মাদ শোয়াইব ০৫ মে, ২০১৬, ০৭:৫৯:৩৪ সকাল
আবদুর রহমান আলরাশেদ
আপডেট: ১২:০০:০০ AM, মঙ্গলবার, মে ৩, ২০১৬
ইরানের সর্বোচ্চ নেতা তিক্তভাবে অভিযোগ করেছেন যে, পশ্চিমারা তাদের প্রতিশ্রুতি রক্ষা করেনি এবং তার দেশের ওপর থেকে অর্থনৈতিক নিষেধাজ্ঞা প্রত্যাহার করা হয়নি। যদিও তেহরান তার পরমাণু কর্মসূচি বন্ধ করার ব্যাপারে প্রয়োজনীয় সব অঙ্গীকার রক্ষা করেছে। এ পরিস্থিতি ইরান সরকারের জন্য খুব কঠিন।
ইরানের ভাগ্য খুবই খারাপ। কারণ তেলের দাম এখনও সস্তা এবং পরমাণু চুক্তি স্বাক্ষরের পর ইরানের বর্তমান আর্থিক অবস্থা গেল বছরের এ সময়ের তুলনায় (যখন ইরান প্রাথমিক চুক্তি গ্রহণ করে) অনেক খারাপ। ইরান ভেবেছিল, নিষেধাজ্ঞা তুলে নিলে অর্থনৈতিক সংকট শেষ হবে। চলতি বছরের ১৬ জানুয়ারি থেকে ইরানের ওপর থেকে দীর্ঘদিনের অর্থনৈতিক অবরোধ যখন প্রত্যাহার শুরু হয়, তখন ইরানের পররাষ্ট্রমন্ত্রী মোহাম্মদ জাভেদ জারিফ অবরোধ প্রত্যাহারকে অর্থনীতির জন্য আশীর্বাদ হিসেবে আখ্যায়িত করেছিলেন। অবরোধ প্রত্যাহারকে ইরানের কর্তারা যেমন ইতিবাচক দিক হিসেবে দেখেছিলেন, তেমনি বিশ্ববাণিজ্যের জন্যও এটা খুবই গুরুত্বপূর্ণ বিবেচিত হয়েছিল। ইইউ ও জাতিসংঘ অবরোধ তুলে নিলে অর্থনীতির প্রবৃদ্ধি উন্নয়নে সহায়তা পাবে এবং লোকাল কোম্পানিগুলো তাদের ক্ষতি পোষাতে পারবেÑ এ ধরনের আশা ছিল ইরানের। অবরোধ প্রত্যাহারে ইরান আরও যেসব সুবিধা লাভের আশা করেছিল, সেগুলোর শীর্ষে ছিল ইরানের ব্যাংকিং খাত ও মোটরগাড়ি শিল্প। আজির নিউজের মতে, বাজার বিশেষজ্ঞরা বলেছেন, তেহরানের ওপর অবরোধ প্রত্যাহার হলে সবার আগে সুবিধা পাবে ইরানের ব্যাংকিং খাত ও মোটরগাড়ি শিল্প। ইরানের ব্যাংকগুলো বিশ্বের সঙ্গে আবার সংযুক্ত হতে পারবে। বিশ্বব্যাপী আন্তঃব্যাংকিং অর্থ-যোগাযোগ বৃদ্ধি করতে পারবে। অর্থ আদান-প্রদানে খরচ কমবে অনেকাংশে, যা ইরানের পুঁজিবাজারে অবরোধ প্রত্যাহারে গুরুত্বপূর্ণ প্রভাব ফেলবে। ইরানের ব্যাংক, বিশেষ করে যাদের বৈদেশিক শাখা আছে, তারা সরাসরি সুফল ভোগ করবে। ইরান তাদের ফার্মাসিউটিক্যাল ও মোটরগাড়ির যন্ত্রাংশের কাঁচামাল বিদেশ থেকে কিনে থাকে, যার মূল্য পরিশোধ করতে হয় বিশ্বব্যাপী পরিচালিত ব্যাংকিং সিস্টেমের মাধ্যমে। কিন্তু অবরোধ সেখানেও হানা দেয়। অবরোধের কারণে অর্থ আদান-প্রদানে নতুন সিস্টেম অনেক বেশি খরচের শিকার হতে হয়েছে এ কয়েক বছরে। ফলে ব্যাংক, ফার্মাসিউটিক্যাল ও মোটরগাড়ি শিল্প নজিরবিহীন ক্ষতির সম্মুখীন হয়। লোকসান দিতে হয় বেশ মোটা অঙ্কের ডলারের। বাজার বিশেষজ্ঞ হামিদ মিরমোহিনীর ভাষায়, অবরোধ প্রত্যাহারে পেট্রোকেমিক্যাল ও ফার্মাসিউটিক্যাল সেক্টর খুবই স্বল্পসময়ে বেশ বড় প্রতিক্রিয়া দেখাবে। মুদ্রার প্রবাহ বাড়ায় খুবই কম সময়ে অনেক বেশি আন্তর্জাতিক মুদ্রার আদান-প্রদান করতে পারবে।
কিন্তু বর্তমান ঘটনাপ্রবাহ সব আশা নিরাশায় পরিণত করছে। যদিও এমনটি ঘটবে তা তাদের কল্পনার বাইরে। একই সময়ে ইরানের সীমানার বাইরে তার সামরিক সম্পৃক্ততার পরিধি যুদ্ধ তীব্রতা ও তার মিত্রদের অর্থদানের কারণে আগের চেয়ে অনেক গুণ বেড়েছে। যেমন সিরিয়ায় বাশার আল আসাদ, লেবাননে
হিজবুল্লাহ ও ইয়েমেনে হুথিদের ইরান অর্থদান করছে।
ইরান তেল উৎপাদনকারী অন্য দেশগুলোর মতো ক্ষতিগ্রস্ত হয়েছে। ইরান তার প্রধান আয়ের ৬০ শতাংশের বেশি হারিয়েছে, যা তার হিমায়িত মজুদ থেকে প্রাপ্ত অর্থও এ বিশাল ক্ষতিপূরণে সাহায্য করেনি। উল্লেখ্য, অবরোধের কারণে ইরানের অর্থনীতিতে ক্ষতির পরিমাণ হচ্ছে ২০১২ থেকে ২০১৪ সালে জিডিপি কমেছে প্রায় ৩০ শতাংশ। অটোমোটিভ ইন্ডাস্ট্রি কমেছে ৩৮ শতাংশ, তেল রফতানি কমেছে ২০১২-১৩ অর্থবছরে ৬৫ হাজার কোটি ডলার। মুদ্রাস্ফীতি হয় প্রায় ৫৯ শতাংশ। হিমায়িত মজুদ সংকট হয় ৮০ হাজার কোটি ডলার।
ঠিক তেমনিভাবে অস্ত্র ও বেসামরিক বিমান কেনার জন্য এবং অবকাঠামোগত প্রকল্প বাস্তবায়ন করার জন্য বিভিন্ন ব্যবসা প্রতিষ্ঠান, বিভিন্ন দেশের সরকার এবং বিশ্বব্যাপী কোম্পানির সঙ্গে তেহরান যেসব চুক্তি স্বাক্ষর করেছে, সেসবের জন্য কোনো তহবিল তাদের হাতে নেই। এর মানে হলো এই যে, তেহরান যখন নির্ধারিত সময়ে এ বিপুল পরিমাণ অর্থ প্রদান করতে ব্যর্থ হবে, তখন সে অধিক মূল্যে ব্যাংক সুদ ও জরিমানা আদায় করতে বাধ্য হবে।
ইরান সরকার পারমাণবিক সমঝোতা চুক্তি স্বাক্ষর করে সুখী হতে পারেনি। একটিই কারণ ইরানের সর্বোচ্চ নেতার তিক্ততা এবং পশ্চিমাদের প্রতি তার রাগ-অনুরাগ প্রকাশের। তিনি নিজেও প্রতারিত হয়ে থাকতে পারেন, যখন তার দল পশ্চিমাদের সঙ্গে শান্তিচুক্তিতে তাকে উৎসাহী করে তোলে এবং তাকে বিশ্বাস করায় যে, পরমাণু চুক্তি দেশের আর্থিক সমস্যার সমাধান করবে। যাহোক, তিনি এখন উপলব্ধি করছেন যে, রাষ্ট্রীয় আয় ভীতিকরভাবে কমে গেছে। তাই ইরানের বর্তমান অবস্থা তার প্রতিদ্বন্দ্বী প্রতিবেশী দেশগুলোর সঙ্গে কোনোভাবে মেলে না। যেমন তার প্রতিদ্বন্দ্বী প্রতিবেশী উপসাগরীয় তেল উৎপাদনকারী দেশগুলো ব্যাপক মজুদ এবং তহবিল ঘাটতি পূরণ করার মতো ক্ষমতাসম্পন্ন অর্থের মালিক। অক্ষম হয়ে গেলে অর্থায়ন করতে সক্ষম। এছাড়াও বিশ্বের ব্যাংকগুলো প্রয়োজন হলে তাদের ঋণ দিতে প্রস্তুত। অথচ ইরান এর কোনোটারই মালিক নয়। এ কারণে তেহরান সরকার উপলব্ধি করতে পেরেছে যে, ওয়াশিংটনের সঙ্গে সমঝোতার চুক্তিতে তাদের কোনো ফায়দা হয়নি। এ চুক্তি তাকে কোনো সম্পদ, প্রভাব-প্রতিপত্তি বা আধিপত্য দান করেনি। একই সঙ্গে তাকে অবশ্যই এ উপলব্ধি করতে হবে যে, এটা তার সামরিক বাহিনী ও বিপ্লবী গার্ড বাহিনীর শক্তিও বৃদ্ধি করেনি। বরং ইরানের বর্তমান অবস্থা হলো, সে এখন রুটি-চাল বাজেটের ঘাটতি পূরণ করতেও পারবে না এবং তার নাগরিকদের অপরিহার্য চাহিদা পূরণ করতেও সক্ষম হবে না।
ইরান এখন সর্বত্র এবং সব ক্ষেত্রে তার শর্তারোপ করতে চায়। মূল্যে অংশগ্রহণ ছাড়াই বিশ্বব্যাপী তেলের দাম বাড়াতে চায়। যেমনটা সে দোহায় সাম্প্রতিক ওপেক সম্মেলনে করেছিল। যেখানে উৎপাদনে তার ভাগ হ্রাস করতে অস্বীকার করে এবং অন্যান্য ওপেকভুক্ত দেশগুলোকে অনুরোধ করে উৎপাদনে তাদের হার হ্রাস করতে। যাতে তেলের দাম বৃদ্ধি পায়। উপসাগরীয় দেশগুলোকেও সে এ অনুরোধ করে।
সম্ভবত ইরানের হতাশা বৃদ্ধির আরও কারণ হলো, ইরানের সর্বোচ্চ নেতা, রাষ্ট্রপতি এবং রাষ্ট্র স্তম্ভের বাকি সদস্যরা এ বছরের শুরুতে ইরানের জনগণকে প্রতিজ্ঞা করেছিলেন যে, সেখানে দ্রুত সুন্দর উন্নতি হবে। তারা তাদের বোঝাতে চেয়েছিলেন, যদিও তারা ২০ বছর ধরে আন্তর্জাতিক নিষেধাজ্ঞার সহ্য করতে বাধ্য হয়েছেন, অবশেষে তারা যুদ্ধে জয়ী হয়েছেন। যদিও তারা পারমাণবিক বোমা তৈরির প্রতিশ্রুতি পূরণ করতে পারেননি। যাহোক, ইরানিরা বর্তমানে বুঝতে পেরেছে, তাদের সঙ্গে কৃত এ অঙ্গীকার ও প্রতিশ্রুতি সত্য নয় এবং তারা যে ২০ বছর আন্তর্জাতিক নিষেধাজ্ঞা সহ্য করেছে তার পরিণতিতে পেয়েছে আগের চেয়ে বেশি দরিদ্রতা।
পরমাণু চুক্তির সাফল্য লাভে ব্যর্থতার পর, নীতিনির্ধারক ও তেহরানের নীতি-নির্বাহকারীদের কাছে আরও স্পষ্ট হয়ে উঠেছে যে, পশ্চিমাদের সঙ্গে সমঝোতা চুক্তি ইরানের কাঠামোগত সংকট সমাধানে সফল হবে না এবং শাসকদের জরুরি চাহিদা পূরণ করতে পারবে না।
তেহরান-শাসনের যুক্তি ও বিজ্ঞান এখন দাবি করে, তেহরান সংকট সমাধানে প্রতিবেশী রাষ্ট্রগুলোর তার দিকে হাত বাড়ানো ছাড়া বিকল্প কোনো রাস্তা নেই। এখন ইরানিদের স্থিতিশীলতা ও সমৃদ্ধিকরণ অর্জন করতে হবে। তবে ইরান ও উত্তর কোরিয়ার মতো শাসকদের জন্য এ যুক্তি বোঝা কঠিন। এ যুক্তি প্রত্যাখ্যান অব্যাহত রাখলে তেহরানের সংকট আরও বৃদ্ধি পাবে। কী হাস্যকার, ইরান প্রসারিত হতে চায়, কর্তৃত্ব করতে চায়। অথচ সে তার নিজের লোকদের খাওয়ানোর খাদ্যসামগ্রীর মালিকও নয়।
আল আরাবিয়া নেট অবলম্বনে
মুহাম্মাদ শোয়াইব
http://www.alokitobangladesh.com/todays/details/179002/2016/05/03
http://www.alokitobangladesh.com/epaper/pages/index/page:10
বিষয়: বিবিধ
১১৬৯ বার পঠিত, ৩ টি মন্তব্য
পাঠকের মন্তব্য:
মন্তব্য করতে লগইন করুন