সেই মৃত্যু এখনও মনে আছে
লিখেছেন লিখেছেন মুফতি মুহাম্মাদ শোয়াইব ২৪ এপ্রিল, ২০১৬, ১১:৩২:৪৮ রাত
মৃত্যুর নির্ধারিত সময়ে প্রত্যেক প্রাণীকেই মৃত্যুর স্বাদ আস্বাদন করতে হবে। তবে আল্লাহর প্রিয় বান্দা ও বান্দী যারা, আল্লাহর পক্ষ হতে তারা লাভ করেন সুন্দর ও ‘সুস্বাদু’ মৃত্যু। আমার খালাম্মার মৃত্যু ছিলো তেমনি একটি মৃত্যু, যা হতে পারে প্রতিটি মুমিনের আকাঙ্খা! বেশ কিছু দিন তিনি অসুস্থ। আমি মাদরাসায় ছিলাম। দুপুরে জরুরি তলব এল। ছুটে গেলাম। তখন তার শ্বাসকষ্টটা মারাত্মক। শ্বাসকষ্ট কী জিনিস তা জানে শুধু ওই কষ্টের রোগী। আল্লাহ যেন তা কাউকে না দেন।
তিনি হাঁটতে পারছিলেন না, আমার কাঁধে ভর দিয়ে পাঁচতলার সিঁড়ি বেয়ে নামলেন অনেক কষ্টে। খিদমাহ হাসপাতালে নেয়ার পর উদ্বিগ্ন ডাক্তার বললেন, অনেক বিলম্ব হয়ে গেছে। জরুরি পরীক্ষা-নিরীক্ষার পর বললেন, এখনই তাকে অপারেশন করতে হবে।
খালাম্মা শুনলেন, কিন্তু কোনো অস্থিরতা প্রকাশ করলেন না। এটা তার স্বভাবে ছিল না। যে কোনো কষ্ট তিনি বরণ করে নিতেন প্রশান্ত চিত্তে, পূর্ণ আত্মনিবেদনের সঙ্গে। তিনি শুধু বললেন, তোমরা চিন্তা করো না। আল্লাহর যা ইচ্ছা তাই তো হবে! তারপর অজু করে দু’রাকাত নামাজ পড়লেন। বিপদে ও প্রয়োজনে সারা জীবন নামাজই ছিল তার আশ্রয়। আমার কেন জানি মনে হলো, হয়ত এটাই তার শেষ নামাজ! আল্লাহর প্রিয় যারা, মৃত্যুর পূর্বে তাদেরকে আল্লাহ প্রস্তুতি গ্রহণের সুযোগ দেন। তার এত কষ্টের নামাজটি যেন ছিল সেই প্রস্তুতি!
নামাজ শেষ করে তিনি আমাকে অসিয়ত করলেন। এটাই ছিল তার জীবনের শেষ অসিয়ত। আমি মুখের কাছে কান নিলাম, কমযোর আওয়াজে তিনি বললেন, আমার নামাজ ও রোজার কাফফারা দিয়ে দিও। আমার ছেলে-মেয়েদের দ্বীনের বুঝ দিও; তুমিও দ্বীনের ওপর চলার চেষ্টা করো। আমার ভীষণ কান্না পেল। ভিতর থেকে কান্নার ঢেউগুলো চোখের তীরে এসে আছড়ে পড়ল। আগে বুঝিনি আমার শক্ত মনেও এত কান্না আছে! আমার শুকনো চোখেও এত অশ্রু আছে! তিন বছরের ছোট্ট ভাগিনীটি আমার খুব প্রিয়। একপাশে চুপচাপ দাঁড়িয়ে আছে, কাঁদছে। তার চোখেও পানি! জানি না মাসুম চোখের পানিতে ভিজিয়ে আল্লাহর কাছে কী মিনতি নিবেদন করছে!
রাত নয়টায় খালাম্মাকে অপারেশন থিয়েটারে নেয়া হলো; আমাদের যেতে দেয়া হলো না। কবরে এভাবেই একা যেতে হয় আমাদের! কেউ সঙ্গে যায় না, যায় শুধু আমল। উৎকন্ঠা ও অস্থিরতার মাঝে ওটির বাইরে আমরা অপেক্ষা করছি, আর সাধ্যমতো আল্লাহকে ডাকছি। প্রতিটি মুহূর্ত যেন ছিল একটি যুগ। অপারেশন শেষ হল। খালাম্মাকে কেবিনে আনা হলো। তার হুঁশ ফিরে এল; কিন্তু অবস্থার উন্নতি হলো না। তিনি এখন কথাও বলতে পারেন না। ডাক্তার বললেন, দ্রুত ঢাকা মেডিকেলে নেয়া দরকার। কিন্তু খালাম্মা বিছানার চাদরে লিখে বললেন, ‘সময় হয়ে গেছে, আর কোথাও নেয়ার প্রয়োজন নেই।’
শেষরাতে খালাম্মা গোসল করতে চাইলেন। আমরা বুঝতে পারিনি, এটা ছিল তার জীবনের শেষ ইচ্ছা। ডাক্তারের নিষেধাজ্ঞা থাকায় আমরা শুধু কাপড় বদলে দিলাম।
খালাম্মা আমার কাঁধে মাথা রেখে বসা ছিলেন। তখন তার ভীষণ কষ্ট। হঠাৎ লক্ষ্য করলাম, তার সব কষ্ট যেন দূর হয়ে গেল। তিনি সোজা হয়ে বসলেন, দেয়ালের দিকে তাকিয়ে মুচকি হাসলেন। তারপর ডান হাত গালের নিচে দিয়ে সুন্নত তরীকায় শুয়ে পড়লেন এবং একটু পরে খুব শান্তভাবে চিরাবদায় গ্রহণ করলেন, আমরা কেউ কিছু বুঝতে পারিনি। (ইন্না লিল্লাহ ওয়া ইন্না ইলাইহি রাজিউন) জীবিত অবস্থায় তার মুখমন্ডল যেমন আলোকশুভ্র ও নুরানিয়াতপূর্ণ ছিল, মৃত্যুর পর তা যেন আরো বৃদ্ধি পেল। যে দেখল সেই আনন্দিত হলো এবং ‘নেকফাল’ গ্রহণ করল। এমনকি হাসপাতালের ‘সিস্টার’রাও শোক প্রকাশ করে বলেছেন, এমন সবর ও ধৈর্য আমরা খুব কমই দেখেছি।
কে তখন কাকে সান্ত¦না দেবে? আমারও তো প্রয়োজন ছিল একটু ¯িœগ্ধ কোমল সান্ত¦নার! যে কোনো শোকার্ত হৃদয় সান্ত¦না ও সহানুভূতির জন্য কাতর হয়, আর আমার জন্য তো তিনি ছিলেন মায়েরই মতো! ওই কঠিন মুহূর্তে আমি অবশ্য সান্ত¦না পেয়েছি, তবে কোনো মানুষের কাছ থেকে নয়, আল্লাহর কাছ থেকে, কুরআনের আয়াতের মাধ্যমে, ‘আর খোশখবর দাও সবরকারীদের যারা মুসিবতগ্রস্ত অবস্থায় বলে, ইন্না লিল্লাহি ওয়া ইন্না ইলাইহি রজিউন।’
হে আল্লাহ! তুমি আমার খালাম্মাকে বেলা হিসাব জান্নাত নছীব করো এবং যারা তার মাগফিরাতের জন্য দোয়া করবে তাদের উত্তম বিনিময় দান করো। আমীন।
বিষয়: বিবিধ
১০৯৪ বার পঠিত, ৩ টি মন্তব্য
পাঠকের মন্তব্য:
মন্তব্য করতে লগইন করুন