রিবান নাসিআহ ও সুদি ব্যাংক
লিখেছেন লিখেছেন মুফতি মুহাম্মাদ শোয়াইব ১৭ এপ্রিল, ২০১৬, ১০:০৫:০২ সকাল
‘রিবা’ পরিভাষাটি আরবি শব্দমূল ‘রাবউন’ থেকে উদ্ভূত। যার বাংলা অর্থ হচ্ছে, বেশি হওয়া, বৃদ্ধি পাওয়া, অতিরিক্ত হওয়া, সম্প্রসারিত হওয়া, মূল থেকে বেড়ে যাওয়া ইত্যাদি। কিন্তু আরবির রিবাকে উর্দু ভাষার ‘সুদ’ শব্দ দিয়ে অনুবাদ করলেও এর পূর্ণ অর্থ প্রকাশ পায় না। বরং উর্দু ‘সুদ’ আরবি ‘রিবা’র ব্যাপক অর্থের একটি অংশমাত্র। ইসলামী শরিয়তের দৃষ্টিতে নির্দিষ্ট সময়ের মধ্যে পরিশোধের শর্তে কোনো নির্দিষ্ট পরিমাণ পণ্য বা অর্থের বিপরীতে পূর্বনির্ধারিত হারে যে অধিক পরিমাণ পণ্য বা অর্থ আদায় করা হয়, তাই ‘রিবা’ বা সুদ।
রিবা প্রধানত দুই ধরনের ১. রিবা নাসিআহ; একে রিবাল করজ ও রিবাল কোরআনও বলা হয় ২. রিবাল ফদল; একে রিবাল বাই ও রিবাল হাদিসও বলা হয়।
রিবান নাসিআহ : আরবি ‘নাসিআহ’ শব্দের অর্থ হচ্ছে মেয়াদ, সময় নেয়া, বিলম্ব বা প্রতীক্ষা করা। ইমাম আবু বকর আল জাস্সাস তার বিখ্যাত তাফসির ‘আহকামুল কোরআনে’ রিবার সংজ্ঞা দিয়েছেন এভাবে, ‘রিবান নাসিআহ হচ্ছে ঋণের ওপর সময়ের অনুপাতে ধার্যকৃত অতিরিক্ত অংশ।’ জাহিলিয়াতের সময় সুদ ছিল, ‘কোনো নির্ধারিত সময়ের জন্য প্রদত্ত ঋণের আসলের ওপর ঋণগ্রহীতা কর্তৃক দেয় নির্ধারিত অতিরিক্ত।’ অর্থাৎ অতিরিক্ত প্রদানের শর্তে কাউকে মেয়াদি ঋণ দেয়া। যেমন কেউ যদি কাউকে ১০০ টাকা ঋণ দেয় এ শর্তে যে, তাকে মেয়াদান্তে ১১০ টাকা দিতে হবে। এখানে অতিরিক্ত ১০ টাকাকে রিবান নাসিআহ বলা হবে। (আহকামুল কোরআন ১/৫৫৭)। প্রখ্যাত মুফাসসির জারির ইবনে আত-তাবারি মুজাহিদের সূত্রে জাহেলি যুগে প্রচলিত রিবা সম্পর্কে নিম্নে বর্ণিত হাদিসে উল্লেখ করেছেন যে, ‘জাহিলি যুগে কোনো ব্যক্তি ঋণদাতার কাছ থেকে ঋণ গ্রহণ করত। অতঃপর সে ঋণদাতাকে বলত, আমি এত এত পরিমাণ বেশি দেব, আমাকে সময় বাড়িয়ে দাও।’ ইমাম ফখরউদ্দিন আর রাজি জাহিলি যুগের রিবা সম্পর্কে বলেছেন, ‘জাহিলিয়াতের যুগে রিবান নাসিআহ ছিল সুপরিচিত ও স্বীকৃত। সে সময় তারা অর্থঋণ দিত এবং মাসিক ভিত্তিতে একটা অতিরিক্ত পরিমাণ আদায় করত, কিন্তু মূলধন ঠিক থাকত। অতঃপর মেয়াদ শেষে ঋণদাতা ঋণগ্রহীতার কাছে আসল অঙ্ক ফেরত চাইত। ঋণগ্রহীতা আসল অঙ্ক ফেরত দিতে না পারলে ঋণদাতা আসলের পরিমাণ বৃদ্ধি করে দিত এবং মেয়াদ বাড়িয়ে দিত।’ এছাড়া হাদিসে রিবা বা সুদের সংজ্ঞায় আরও বলা হয়েছে, ‘যে ঋণ মুনাফা টেনে আনে তা-ই রিবা বা সুদ।’
রিবাল ফদল : আরবি ‘ফদল’ শব্দের অর্থ হচ্ছে অতিরিক্ত। একই জাতীয় জিনিস লেনদেনে কমবেশি করে আদায় করার নাম রিবাল ফদল। অর্থাৎ একই জাতীয় দ্রব্য বা মুদ্রার লেনদেনকালে এক পক্ষ আরেক পক্ষের কাছ থেকে চুক্তি মোতাবেক শরিয়াসম্মত বিনিময় ব্যতীত যে অতিরিক্ত মাল গ্রহণ করে তাকে রিবাল ফদল বলে। যেমন এক কেজি উন্নতমানের খেজুরের সঙ্গে দেড় কেজি নিম্নমানের খেজুর বিনিময় করা। রিবাল ফদলকে মালের সুদও বলা হয়। হাদিস শরিফে বলা হয়েছে, ‘সোনার বিনিময়ে সোনা, রুপার বিনিময়ে রুপা, গমের বিনিময়ে গম, যবের বিনিময়ে যব, খেজুরের বিনিময়ে খেজুর এবং লবণের বিনিময়ে লবণ আদান-প্রদান করলে তা সমান সমান ও হাতে হাতে হতে হবে। অর্থাৎ নগদ হতে হবে। কমবেশি করলে বা বাকিতে করলে তা সুদি কারবার বলে গণ্য হবে। এতে দাতা-গ্রহীতা সমান অপরাধী বিবেচিত হবে।’ (বোখারি, মুসলিম)।
রিবান নাসিআহর প্রচলিত কয়েকটি রূপ
১. সুদি ব্যাংক : বাংলাদেশের সুদি ব্যাংকগুলোর অন্যতম প্রধান কার্যক্রম সাধারণত স্বল্প সুদে ঋণ নেয়া ও বেশি সুদে ঋণ দেয়া। সুদি ব্যাংকগুলো সুদের কার্যক্রমে তাদের কার্যক্রম সীমাবদ্ধ রাখে না। আরও নানা কার্যক্রম করে থাকে। তাই ওলামায়ে কেরামের সিদ্ধান্ত হলো, সুদি ব্যাংকের কারেন্ট অ্যাকাউন্ট ছাড়া বাকি সব অ্যাকাউন্ট সুদি অ্যাকাউন্ট। চাই তা DPS হোক বা FDR হোক অথবা সাধারণ ফিক্সড ডিপোজিট হোক; সবই SND অ্যাকাউন্ট। তবে ইদানীং ঝঘউ কারেন্ট অ্যাকাউন্ট নামে এক ধরনের অ্যাকাউন্ট বের হয়েছে। তাতে সুদের মিশ্রণ দেয়া হয়। এ ধরনের সুদি অ্যাকাউন্ট খোলাই গোনাহ। কারণ সুদের চুক্তিতে আবদ্ধ হওয়া গোনাহ। আর সুদ গ্রহণ করলে তো সুদ খাওয়ার গোনাহ হয়ই। তাছাড়া সুদি ব্যাংকগুলো বিভিন্ন নামে লোন দিয়ে থাকে। যেমন কার লোন, হোম লোন, হাউস লোন, ইনভেস্টমেন্ট লোন, সিসি লোন, কৃষি লোন, স্টুডেন্ট লোন ইত্যাদি। এগুলো সবই রিবান নাসিআহ। কারণ, এ ধরনের লোনে ঋণ দিয়ে সুদ গ্রহণ করা হয়।
২. প্রচলিত প্রাইজবন্ড : বর্তমান প্রচলিত প্রাইজবন্ডে রিবান নাসিআহ রয়েছে। কারণ যে টাকা দিয়ে প্রাইজবন্ড কেনা হচ্ছে শরিয়তের দৃষ্টিতে তা সংশ্লিষ্ট কর্তৃপক্ষের কাছে ঋণ হিসেবে আছে। সুতরাং প্রাইজবন্ড ছাড়ার পর একটি নির্ধারিত সময় পার হওয়ার পর ড্র করার মাধ্যমে বিজয়ীদের যে পুরস্কার দেয়া হয় তা ঋণের বিনিময়ে দেয়া হচ্ছে বিধায় তা রিবান নাসিআহ বা সুদ। (ফাতওয়ায়ে উসমানী-৩/১৭৩-১৭৬)।
৩. জমি বন্ধক : বাংলাদেশের প্রায় সব এলাকায়ই জমি বন্ধকের নিয়মটি চালু আছে। জমির মালিক জমি প্রার্থীর কাছ থেকে মোটা অঙ্কের টাকা ঋণ হিসেবে গ্রহণ করে। বিনিময়ে টাকার মালিক বন্ধক জমিটি ভোগ করে এবং মেয়াদান্তে পুরো টাকা ফেরত পায় এবং জমির মালিক তার জমি হস্তগত করে নেয়। এখানে জমির মালিক জমি বুঝে পায় আর টাকার মালিক টাকা বুঝে পায়, কিন্তু মাঝখানে টাকার মালিক ঋণ দেয়ার কারণে যে জমিটি ভোগ করল সেটি নিঃসন্দেহে রিবান নাসিআহ’র অন্তর্ভুক্ত, যা হারাম। এ ধরনের বন্ধক বিভিন্ন এলাকায় বিভিন্ন নামে প্রচলিত থাকলেও সবগুলোর হুকুম একই। ঋণদাতার জন্য বন্ধকি জমি ভোগ করা সম্পূর্ণ নাজায়েজ।
প্রকাশ থাকে যে, ওই কারবার বৈধভাবে করতে চাইলে শুরু থেকেই বন্ধকি চুক্তি না করে ভাড়া বা লিজ চুক্তি করবে। যার বিবরণ হলো, জমির মালিক জমি ভাড়া দেবে। তার যত টাকা প্রয়োজন সে জন্য যত বছর ভাড়া দিতে হয় একত্রে তত বছরের জন্য ভাড়া দেবে এবং অগ্রিম টাকা নিয়ে নেবে। যেমন এক বিঘা জমির বার্ষিক ভাড়া ৫ হাজার টাকা। মালিকের ২০ হাজার টাকা প্রয়োজন। তাহলে সে ৪ বছরের জন্য জমি ভাড়া দেবে। এক্ষেত্রে অগ্রিম ২০ হাজার টাকা নিয়ে নেবে। এক্ষেত্রে জমির ভাড়া স্থানীয় ভাড়া থেকে সামান্য কমবেশিও হতে পারে। এরপর ভাড়ার মেয়াদ শেষ হলে অর্থদাতা জমি ফেরত দেবে, কিন্তু প্রদেয় টাকা ফেরত পাবে না। (মুসান্নাফ আবদুর রাযযাক ৮/২৪৪-২৪৫, শরহু মুখতাসারিত তহাবী ৩/১৪৯, রদ্দুল মুহতার ৬/৪৮২, বাদায়েউস সানায়ে ৫/২১২, শরহুল মাজাল্লা, খালেদ আতাসী ৩/১৯৬-১৯৭, ইলাউস সুনান ১৮/৬৪, মুসান্নাফে ইবনে আবী শাইবা, হাদিস : ২১০৭৮ ১৩/৬৪৮, আন্নুতাফ ফিল ফাতাওয়া ২৯৬, বাদায়েউস সানায়ে ৬/৫১৮)।
সম্পাদক, মাসিক আরবি ম্যাগাজিন ‘আলহেরা’
http://www.alokitobangladesh.com/todays/details/177361/2016/04/1
http://www.alokitobangladesh.com/epaper/pages/index/page:10
বিষয়: বিবিধ
১০২০ বার পঠিত, ৩ টি মন্তব্য
পাঠকের মন্তব্য:
সুদের ব্যখ্যাগুলি ভালো হয়েছে।
মহান আল্লাহ আমাদর সবাইকে হেদায়েত দিয়ে দুনিয়া ও আখেরাতে নেক কামিয়াবী দান করুন, আমীন।
মন্তব্য করতে লগইন করুন