বাইয়ে ঈনা ও প্রচলিত সমিতি
লিখেছেন লিখেছেন মুফতি মুহাম্মাদ শোয়াইব ১৩ এপ্রিল, ২০১৬, ০৭:৫০:২০ সন্ধ্যা
'বাইয়ে ঈনা' শব্দটির অর্থ হলো বাকি। বাইয়ে ঈনা মূলত দুই দফা বেচাকেনার সমষ্টির নাম। যার একটি হয় বাকিতে, অপরটি হয় নগদে। তাই এই বেচাকেনাকে বাইয়ে ঈনা বলা হয়। অথবা 'ঈনা' শব্দটির অর্থ হলো কোনো বস্তু। যেহেতু এ পদ্ধতিতে একটি বস্তুকে মাধ্যম বানিয়ে বেচাকেনা করা হয়, তাই এই বেচাকেনাকে বাইয়ে ঈনা বলা হয়। উল্লেখ্য, এই বেচাকেনায় পণ্য হস্তগত করা উদ্দেশ্য থাকে না; বরং বিক্রেতা তৎক্ষণাৎ বস্তুটি ক্রেতার কাছ থেকে কিনে নেয় বা ক্রেতা বিক্রেতার কাছে বিক্রি করে দেয়।
বিশিষ্ট হাদিস ব্যাখ্যাকার আল্লামা খলীল আহমাদ সাহারানপুরী (রহ.) বাইয়ে ঈনার সংজ্ঞা উল্লেখ করেছেন এভাবে_
'বাইয়ে ঈনা বলা হয় নির্দিষ্ট মূল্যে কোনো নির্ধারিত সময় পর্যন্ত বাকিতে একটি বস্তু বিক্রি করে পুনরায় বিক্রেতা প্রথম মূল্যের চেয়ে কম মূল্যে বস্তুটি ক্রেতার কাছ থেকে নগদে ক্রয় করে নেয়া।' (বাজলুল মাজহুদ ৪/২৭৬)।
'আল মাউসুআতুল ফিকহিয়্যাহ আল কুয়িতিয়্যাহ' ৯/৯৬-এ বাইয়ে ঈনা সম্পর্কে বলা হয়েছে_
'বাইয়ে ঈনার অনেক পদ্ধতি রয়েছে। তার মাঝে প্রসিদ্ধ পদ্ধতি হলো, কোনো বস্তু নির্দিষ্ট মূল্যে কোনো নির্ধারিত সময় পর্যন্ত বাকিতে বিক্রি করে পুনরায় বিক্রেতা সেই বস্তুটিই প্রথম মূল্যের চেয়ে কমমূল্যে ক্রেতার কাছ থেকে নগদে ক্রয় করে নেয়া। মেয়াদ শেষে ক্রেতা প্রথম মূল্যেই পরিশোধ করবে। আর উভয় বেচাকেনার আড়ালে অর্জিত হবে সুদ, যা প্রথম বিক্রেতা গ্রহণ করবে। বিষয়টি দাঁড়াবে এরকম_ ১০ দেরহাম ঋণ দেয়া পণের দেরহাম অর্জন করার জন্য। আর বেচাকেনা হলো একটি বাহ্যিক অসিলা মাত্র।'
আল্লামা মোল্লা আলী কারী (রহ.) বলেন_
'বাইয়ে ঈনা হলো কোনো বস্তু বাকিতে বিক্রি করার পর (পুনরায় ক্রেতার কাছ থেকে) নগদে কমমূল্যে ক্রয় করা।' (শরহে নেকায়া ২/৩৭)।
প্রসিদ্ধ অভিধান মু'জামু লুগাতিল ফুকাহা গ্রন্থে বাইয়ে ঈনার সংজ্ঞা দেয়া হয়েছে এভাবে_
'বাইয়ে ঈনা হলো কোনো বস্তু নির্দিষ্ট সময়ের জন্য বিক্রি করার পর ক্রেতার কাছ থেকে সে জিনিসটিই পুনরায় বিক্রীত মূল্যের চেয়ে কমমূল্যে নগদে ক্রয় করা।'
উল্লেখ্য যে, বেচাকেনার এই পদ্ধতিকে অনেক ফিকহে হানাফির কিতাবে বাইয়ে ঈনা নামে নামকরণ করা হয়নি। বরং এটিকে 'শিরাউ মা বাআ বি আকালি্লম মিম্মা বাআ' অর্থাৎ অধিক মূল্যে বিক্রীত পণ্য কমমূল্যে খরিদকরণ নামে অভিহিত করা হয়েছে। কিন্তু এই দুইটি একই বেচাকেনার ভিন্ন নাম মাত্র। তাই নাজায়েজ হওয়ার ব্যাপারে কোনো সন্দেহ নেই। (তাবয়িনুল হাকায়েক ৪/১৬৩, আদ্দুররুল মুখতার ৭/৬১৩, ফাতহুল কাদির ৭/২১১)।
বাইয়ে ঈনার পদ্ধতি
বাইয়ে ঈনার অনেক পদ্ধতি রয়েছে। তার একটি প্রসিদ্ধ ও ব্যাপক প্রচলিত পদ্ধতি হচ্ছে, প্রথমে কোনো বস্তু ঋণপ্রার্থীর কাছে বাকিতে বিক্রি করে পুনরায় সে বস্তুটি ক্রেতার কাছ থেকে কমমূল্যে নগদে ক্রয় করে নেয়া। উদাহরণস্বরূপ মনে করুন, রাশেদের কিছু টাকার প্রয়োজন হলে সে তার বন্ধু নাবিলের কাছে ঋণ চাইল। নাবিল তাকে ঋণ না দিয়ে (কারণ ঋণ দিয়ে অতিরিক্ত গ্রহণ করলে সুদ হয়ে যাবে) তার দোকানের একটি মোবাইল ২ হাজার ৫০০ টাকায় এক বছরের মেয়াদে বাকিতে বিক্রি করল। অতঃপর নাবিল সে মোবাইলটি রাশেদের কাছ থেকে ২ হাজার টাকার বিনিময়ে ক্রয় করে নিল। এই পদ্ধতি অবলম্বনে নাবিলের মোবাইল নাবিলের কাছেই ফিরে এলো। কিন্তু রাশেদকে যে ২ হাজার টাকা দিল তার বিনিময়ে সে এক বছরের মাথায় গ্রহণ করবে ২ হাজার ৫০০ টাকায়। তার মানে সে ২ হাজার টাকা দিয়ে লাভ করবে ৫০০ টাকা। এটিই সুদ।
আমাদের সমাজের আর্থসামাজিক উন্নয়নের নামে বিভিন্ন সংস্থা, সংগঠন ও সমিতি রয়েছে। যারা তাদের লেনদেনকে সুদমুক্ত রাখতে চায় বা নিজেদের লেনদেনকে সুদমুক্ত মনে করে। যেমন একটি সমিতির কর্মপদ্ধতি হলো নিম্নরূপ :
সমিতির কাছে কেউ ঋণ চাইলে সমিতি তাকে নগদ অর্থ না দিয়ে তার কাছে কোনো জিনিস বাকিতে অধিক মূল্যে বিক্রি করে। অতঃপর ক্রেতা ওই মাল নিজ জিম্মায় নিয়ে পুনরায় সমিতির কাছেই কমমূল্যে নগদে বিক্রি করে দেয়। এতে সমিতির সম্পদ সমিতির কাছেই ফিরে যায় এবং বাকি-বিক্রি ও নগদ-বিক্রির আড়ালে সমিতির কিছু মুনাফা অর্জিত হয়। আর ঋণপ্রার্থীর প্রয়োজনও মিটে যায়। উদাহরণস্বরূপ বলা যায়, আবুল হোসেন সমিতির কাছে ঋণ চাইলে সমিতি তাকে নগদ অর্থ না দিয়ে তার কাছে একটি ফ্রিজ বিক্রি করল ৪০ হাজার টাকায় ছয় মাসের মেয়াদে। আবুল হোসেন ওই ফ্রিজ গ্রহণ করে পুনরায় সমিতির কাছেই বিক্রি করে দিলেন ৩০ হাজার টাকায়। এতে আবুল হোসেনের প্রয়োজন মিটল, আবার সমিতিরও লাভ হলো ১০ হাজার টাকা।
এই পদ্ধতিটি যদিও বাহ্যিকভাবে বেচাকেনা মনে হয় কিন্তু বাস্তবে তা বেচাকেনা নয়। আর বেচাকেনা মাকসাদও নয়। কারণ বেচাকেনা মাকসাদ হলে একটু আগে ক্রয়কৃত বস্তুটি আবার বিক্রি করার কোনো মানে হয় না। স্পষ্টত বোঝা যায় যে, এ ধরনের লেনদেন দ্বারা একপক্ষের ঋণ গ্রহণ করা ও অপরপক্ষের ঋণের ওপর অতিরিক্ত মুনাফা গ্রহণ করাই উদ্দেশ্য হয়ে থাকে। এরই নাম সুদ। বিষয়টি পরিষ্কারভাবে বোঝার জন্য নিচে একটি প্রশ্ন ও তার উত্তর দেয়া হলো।
প্রশ্ন: আমাদের একটি সমিতি রয়েছে। সমিতি থেকে আমরা মানুষকে ঋণ প্রদান করে থাকি। আমাদের ঋণ প্রদানের পদ্ধতি হলো, আমরা প্রথমে দোকান থেকে পণ্য (যেমন চাল, ডাল ইত্যাদি) ক্রয় করি। দোকানদার ইশারায় আমাদের পণ্য বুঝিয়ে দেয়। তারপর আমরা ওই পণ্য দোকানে রেখেই ঋণপ্রার্থীর কাছে বাকিতে বিক্রি করি। ঋণপ্রার্থী তা গ্রহণ করে পুনরায় দোকানদারের কাছে নগদে বিক্রি করে টাকা বুঝে নেয়। এ বিষয়টি তারা আগে থেকেই অবগত থাকে। জানার বিষয় হলো, এ পদ্ধতির লেনদেন শরিয়তসম্মত কিনা? উল্লেখ্য, এ ধরনের লেনদেনের ক্ষেত্রে আমাদের সমিতি ও ওই দোকানদারের মধ্যে কোনো চুক্তি বা পূর্ব আলোচনা থাকে না।
উত্তর : প্রশ্নের বিবরণ অনুযায়ী যেহেতু দোকানদার এ বিষয়টি অবগত থাকে যে, বিক্রীত পণ্য পুনরায় তার কাছে ফেরত আসবে, তাই এ পদ্ধতির লেনদেন নাজায়েজ। এটি সুদ গ্রহণের প্রসিদ্ধ হিলা বা অপকৌশল 'বাইয়ে ঈনা'র অন্তর্ভুক্ত। হ্যাঁ, ঋণগ্রহীতা ক্রয়কৃত পণ্য অন্য কারও কাছে বিক্রি করে টাকা নিয়ে নেয় অথবা এমন কোনো দোকানদারের কাছে বিক্রি করে যে তাদের উদ্দেশ্য সম্পর্কে অবগত নয়, তাহলে তা সাধারণ ক্রয়-বিক্রয়ের মতোই। ক্রয়-বিক্রয়ের বিধিনিষেধ মেনে লেনদেন হলে তা জায়েজ হবে।
(ফাতহুল কাদীর : ৭/১৯৯; রদ্দুল মুহতার : ৫/৩২৬, বাদায়েউস সানায়ে ৫/১৯৮, মাওয়াহিবুল জালীল ৪/৩৯১, আল উম্ম ৩/৭৮, ই'লামুল মুয়াক্কিয়ীন ৩/১৬৬)।
বাইয়ে ঈনার নিষিদ্ধতা
বাইয়ে ঈনার এসব পদ্ধতি এসেছে মূলত ইহুদি সমাজ থেকে। তারা সুদের প্রতি লোভ সামলাতে না পেরে বাইয়ে ঈনার বিধান প্রবর্তন করে। রাসুল (সা.) একাধিক হাদিসে বাইয়ে ঈনাকে নিষিদ্ধ ঘোষণা করেন। হাদিস শরিফে এরশাদ করা হয়েছে_
'হজরত ইবনে ওমর (রা.) বলেন_ আমি নবী করিম (সা.) কে বলতে শুনেছি, তিনি বলেন যে, যখন তোমরা 'ঈনা' পদ্ধতির কেনাবেচায় জড়িয়ে পড়বে, গরুর লেজ ধরবে আর ক্ষেতখামার নিয়েই সন্তুষ্ট থাকবে, আর আল্লাহর রাস্তায় জিহাদ ছেড়ে দেবে, তখন আল্লাহ তায়ালা তোমাদের ওপর লাঞ্ছনা-গঞ্জনা চাপিয়ে দেবেন। তিনি তোমাদের এই লাঞ্ছনা থেকে মুক্তি দেবেন না, যতক্ষণ তোমরা তোমাদের ধর্মে ফিরে না আসবে।' (আবু দাউদ ২/৪৯০, ৩৪৬২, মুসনাদে আহমাদ ২/২৮), ইমাম তবারী (রহ.) 'মুসনাদে ইবনে উমর' ১/১০৮-এ আল্লামা ইবনে তাইমিয়া (রহ.) 'মাজমুউল ফাতাওয়া' ২৯/৩০-এ আল্লামা নাসিরুদ্দীন আলবানী (রহ.) 'আস্সিল্সিলাতুস সাহীহা' হাদিসটিকে সহিহ সাব্যস্ত করেছেন।
লেখক : খতিব, বাইতুন নূর জামে মসজিদ, মধ্যপাড়া গোপালপুর, টঙ্গী, গাজীপুর
বিষয়: বিবিধ
১০৯২ বার পঠিত, ০ টি মন্তব্য
পাঠকের মন্তব্য:
মন্তব্য করতে লগইন করুন