ডিভোর্সের নেপথ্য কারণ
লিখেছেন লিখেছেন মুফতি মুহাম্মাদ শোয়াইব ১৩ এপ্রিল, ২০১৬, ১২:৫৯:৪৩ রাত
বিকারগ্রস্ত মানুষ সবসময় ছিল এখনও আছে। সময়ের প্রয়োজন ও প্রযুক্তির বিকাশের সঙ্গে সঙ্গে এসব মানুষ বাড়ছে বৈ কমছে না। বিকারগ্রস্ত সমাজের একটি বড় ব্যাধি হলো ডিভোর্স। সামান্য থেকে সামান্যতম কারণে একটি সাজানো সংসার ভেঙ্গে খান খান। অতি তুচ্ছ ঘটনাকে কেন্দ্র করে আশঙ্কাজনক ভাবে বাড়ছে ডিভোর্সের হার। ঢাকার একটি প্রভাবশালী দৈনিকের পক্ষ থেকে ডির্ভোসের প্রবণতা নিয়ে পরিচালিত এক জরিপে উঠে এসেছে এরকম চাঞ্চল্যকর তথ্য।
সেই জরিপের ভিত্তিতে দেখা যায়, অধিকাংশ ডিভোর্সের ঘটনা ঘটছে মেয়েদের পক্ষ থেকে। শতকরা ৬৬ ভাগ ডিভোর্সেই দেয়া হচ্ছে স্ত্রীদের পক্ষ থেকে। ডিভোর্সের ঘটনা বেশি ঘটছে উচ্চবিত্ত ও নিম্মবিত্ত পরিবারে। সিটি করপোরেশনের হিসাব অনুযায়ী গত বছর রাজধানীতে ডিভোর্সের ঘটনা ঘটেছে ৮২১৪ দম্পতির। এর আগে ২০১২ সালে ৭৬৭২ দম্পতির মধ্যে ডিভোর্সের ঘটনা ঘটেছে। চলতি বছরের জানুয়ারি মাসে ৬১০ দম্পতির ডিভোর্স হয়েছে। তার মধ্যে ৪২৬ ডিভোর্সই ঘটেছে স্ত্রী কর্তৃক। ঢাকা সিটি করপোরেশনের উত্তরের গুলশান, বনানী, মহাখালী, বাড্ডা, মগবাজার, রামপুরা নিয়ে অঞ্চল-৩। এ এলাকায় গত বছরে ৫৯৮ দম্পতির মধ্যে ডিভোর্স হয়েছে। এর মধ্যে স্বামী ডিভোর্স দেয় ২৩৫ এবং স্ত্রী দেয় ৩৬৩টি। রাজধানী সূত্রাপুর, বংশাল, নবাবপুর, কাপ্তান বাজার, নাজিরাবাজার ও লালবাগের অর্ধেক নিয়ে গঠিত ঢাকা সিটি করপোরেশন দক্ষিণের অঞ্চল-৪। এই এলাকায় গত বছরের জানুয়ারি থেকে আক্টোবর পযর্ন্ত ২৫৮ দম্পতির মধ্যে ডিভোর্স হয়েছে। এর মধ্যে স্ত্রীর পক্ষ থেকে ১৭৩ এবং ৮৫টি ডিভোর্স হয়েছে স্বামীর পক্ষ থেকে। তার আগের বছর একই এলাকায় ২৯১ দম্পতির মধ্যে ডিভোর্স হয়েছে। এর মধ্যে ১৮৪টি ডিভোর্স হয়েছে স্ত্রীর পক্ষ থেকে।
নারীরা কেন অত সহজেই ডিভোর্স দিয়ে একটি সাজানো সংসারকে ভেঙ্গে খান খান করে দিচ্ছেন বিষয়টি নিয়ে গবেষণা করলে বেরিয়ে আসে নানা তথ্য। আশ্চর্যের বিষয় হলো এর অধিকাংশই ধর্ম পালন ও নৈতিকতার চর্চার সঙ্গে জড়িত। যে সব পরিবারে ধর্ম ও নৈতিকতার চর্চা কম হয় সেখানেই এধরনের বিপত্তি বেশি ঘটে বলে গবেষণায় বেরিয়ে আসে।
ইসলাম অর্থই শান্তি। শান্তি বিনষ্ট হতে পারে এধরনের কোনো বিধান রাখা হয়নি ইসলামে। তাই শান্তির ধারা অব্যাহত রাখতেই ইসলামে তালাক প্রথা বৈধ বলে স্বীকৃতি দিয়েছে। যদি তালাক প্রথা না থাকত তাহলে দেখা যেত, অনেক স্বামী-স্ত্রীর জীবনই দুর্বিসহ হয়ে গেলেও তারা আমৃত্যু অবিচ্ছেদ্য বন্ধনে আবদ্ধ থাকতে বাধ্য হত। যেমন মনে করুন, একজন পুরুষ বিবাহ করার পরপরই দেখল যে, তার নব বিবাহিতা স্ত্রী স্বামী, শ্বশুড়, শাশুড়ি, ভাসূর কাউকেই মান্য করছে না; বরং সে নিজের খেয়াল খুশিমতো চলাফেরা করছে, অথবা কোনো নারী বিবাহের পরপরই লক্ষ্য করল, তার স্বামী উচ্ছৃঙ্খল, মাতাল অথবা অসৎ চরিত্রের লোক। এ অবস্থায় যদি তালাক-প্রথা না রাখা হত তাহলে স্বামী-স্ত্রী দু’জনের জীবনই অতিষ্ঠ হয়ে উঠত। এ থেকে পরিত্রাণের জন্যই ইসলাম তালাকের বিধান রেখেছে। যেহেতেু ইসলাম একটি পূর্ণাঙ্গ জীবন ব্যবস্থার নাম।
তবে দুঃখের বিষয় হলো আজকাল তালাক ও ডিভোর্সের বিষয়ে স্বামী-স্ত্রীর মাঝে সঠিক জ্ঞানের অভাবে অধিকাংশ স্বামী-স্ত্রী অপাত্রেই প্রয়োগ বেশি করে। অনেকে এ সংক্রান্ত মাসআলা-মাসায়িল জিজ্ঞেস করতেও সংকোচবোধ করে থাকেন। কেউ আলোচনা করলে ভদ্রতা ও শালীনতা পরিপন্থী মনে করে থাকেন। এ কারণেই স্বামী-স্ত্রী তালাক বা ডিভোর্সের ব্যাপারে বড় বড় ভুল করে থাকে।
‘তালাক’ আরবি শব্দ। এর বাংলা অর্থ হচ্ছে বর্জন, প্রত্যাখ্যান, বিবাহ-বিচ্ছেদ ইত্যাদি। ইসলামি আইন মতে সহজ কথায়, স্বামী-স্ত্রীর মধ্যে বিচ্ছেদ ঘটানোকে তালাক বলা হয়। তালাক হলো- আবগাজুল মুবাহাত তথা নিকৃষ্টতম বৈধ কাজ। তাই এর ব্যবহার একেবারেই নিয়ন্ত্রিত হওয়া জরুরি। এই জন্যই শরীয়ত তালাকের অধিকার দিয়েছে পুরুষকে। যাতে সাধারণ তুচ্ছাতিতুচ্ছ ঘটনাকে কেন্দ্র করে ব্যাপকভাবে তালাকের ছড়াছড়ি না হয়। কেননা চিন্তাশক্তি, বিচার-বিবেচনার সামর্থ্য ও ধৈর্যের গুণ নারীদের তুলনায় পুরুষদের মাঝে অনেক বেশি। তবে কোনো স্বামী যাতে স্ত্রীদেরকে আটকে রেখে তার ওপর জুলুম-নির্যাতন করতে না পারে সেজন্য ইসলামি শরীয়ত ‘তাফয়ীজুত তালাক’ এর নিয়ম প্রবর্তন করেছে। তাফয়ীজুত তালাকের অর্থ হলো স্বামী কর্তৃক স্ত্রীকে নিজ নফসের ওপর তালাক গ্রহণের অধিকার দেয়া। ইংরেজিতে যাকে ডিভোর্স (উরাড়ৎপব) বলা হয়। কাবিন নামার ১৮ নং ধারাটি মূলত এই উদ্দেশ্যেই রাখা হয়েছে, যাতে স্ত্রী তার অধিকার হতে বঞ্চিত না হয়। এই অধিকার শর্তসাপেক্ষেও হতে পারে, আবার বিনা শর্তেও হতে পারে। যদি শর্ত সাপেক্ষে হয় তাহলে সেই শর্ত পাওয়া গেলেই কেবল স্ত্রী তালাক গ্রহণের অধিকারী হবে। অন্যথায় নয়।
এখানে উল্লেখ্য যে, শরীয়তের দৃষ্টিতে তালাক দানের ক্ষমতা একমাত্র স্বামীর। স্ত্রী তালাক দানের ক্ষমতা সংরক্ষণ করে না। স্ত্রী হচ্ছে তালাকের পাত্রী। তাই স্ত্রী স্বামী কর্তৃক প্রদত্ত ক্ষমতা বলে নিজের নফসের ওপর তালাক গ্রহণ করবে। সে স্বামীকে তালাক দিবে না। আমাদের সমাজে অনেককে তালাক নামায় লিখতে দেখা যায়, ‘স্বামী কর্তৃক প্রদত্ত ক্ষমতা বলে স্বামীকে তালাক দিলাম’ এভাবে লেখা সঠিক নয়। এই পদ্ধতিতে লিখলে তার ওপর তালাক পতিত হবে না; বরং সে যথারীতি তার স্ত্রী হিসেবেই থাকবে। মহিলা যদি অন্যত্র বিবাহ বসে তাহলে তার দ্বিতীয় বিবাহও শুদ্ধ হবে না। দ্বিতীয় স্বামীর সঙ্গে থাকাটা তার জন্য যিনা বা ব্যভিচারের গুনাহ হবে। তাই এভাবে লিখতে হবে যে, ‘আমি কাবিন নামার ১৮নং ধারায় স্বামী কর্তৃক প্রদত্ত ক্ষমতা বলে নিজ নফসের ওপর তালাক গ্রহণ করলাম’। ইসলামের দৃষ্টিতে তালাক বা ডিভোর্স অত্যন্ত নিন্দনীয়। দু’জন অপরিচিত নর-নারী যেমন হাজারো আশা-আকাঙ্কা ও রঙ্গিন স্বপ্ন নিয়ে আমৃত্যু একত্রে থাকার লক্ষ্যে পবিত্র বিবাহ বন্ধনে আবদ্ধ হয় ইসলামও চায় তাদের এই পবিত্র বন্ধন অটুট থাকুক। তারপরও বিভিন্ন প্রয়োজনে স্বামী-স্ত্রী অনেক সময় তালাক বা ডিভোর্সের দ্বারস্ত হয়ে থাকে। তবে বিবাহ বিচ্ছেদ তালাকের মাধ্যমে হোক বা ডিভোর্সের মাধ্যমে হোক, ইসলামি শরীয়ত তা অপছন্দ করেছে। ইসলাম চায় স্বামী-স্ত্রীর মধুর সম্পর্ক চিরদিন অটুট থাকুক। তাই ইসলাম তালাক ও ডিভোর্সকে নিরুৎসাহিক করেছে। পবিত্র কুরআনের একটি বাণী বা হাদীসের একটি উদ্বৃতিও এমন পাওয়া যাবে না যা তালাক বা ডিভোর্সের প্রতি উৎসাহিত করে। তালাক দেয়া জায়েজ হলেও তা জঘন্য ঘৃণিত কর্ম। নিম্মের কয়েকটি হাদীস দ্বারাই পাঠক তা উপলব্ধি করতে পারবেন।
১. রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম ইরশাদ করেন, ‘তালাক ইসলামের বৈধ প্রথার মধ্যে সবচেয়ে নিকৃষ্ট প্রথা।’ [আবু দাউদ : হা. ২১৭৪]
২. জনৈক ব্যক্তি একই সাথে তার স্ত্রীকে তিন তালাক দেয়ার কথা রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লামকে শুনালে তিনি ক্রুদ্ধ হয়ে বললেন, আমি তোমাদের মাঝে এখনও জীবিত আছি, অথচ তোমরা কুরআন নিয়ে খেলা করছ ?
৪. রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম ইরশাদ করেন, ‘তোমরা বিবাহ কর; কিন্তু তালাক দিয়ো না। যে পুরুষ বা নারী বিভিন্ন স্থানের স্বাদ গ্রহণ করে তাকে আল্লাহ তাআলা পছন্দ করেন না।’ [ইবনে আবি শায়বা, কাবীর লিত্তাবরানী]
৫. রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম আরও ইরশাদ করেন, ‘যে স্ত্রী বিশেষ কারণ ছাড়া স্বেচ্ছায় স্বামীর কাছে তালাক চাইবে তার জন্য বেহেশত হারাম।
এ ধরনের অসংখ্য হাদীস আছে। যেগুলো দ্বারা মূলত তালাক প্রথাকে নানাভাবে নিরুৎসাহিত করা হয়েছে। তারপরও প্রয়োজনের সময় তালাক দেয়া একটি অপরিহার্য বিষয় হয়ে দাঁড়ায়। তবে মেয়েদের পক্ষ থেকে যে হারে ডিভোর্সের ঘটনা ঘটছে তা রীতিমত উদ্বেগজনক। কী কী কারণে মেয়েরা সাধারণত ডিভোর্স দিয়ে থাকে, এ প্রবন্ধে আমরা তা ক্ষতিয়ে দেখার চেষ্টা করব।
যে সব কারণে মেয়েরা সাধারণত ডিভোর্স দিয়ে থাকে-
১. স্বামী-স্ত্রীর যে কোনো একজনের পরকীয়া আসক্ততা।
২. স্বামী কর্তৃক স্ত্রী শারীরিক ও মানসিক নির্যাতনের শিকার হওয়া
৩. স্ত্রীদের অবাধ্যতা, বেপরোয়া চলেফেরা ও ধর্মীয় অনুশাসনের তোয়াক্কা না করায় স্বামীদের পক্ষ থেকে অবহেলার শিকার হওয়া।
৪. প্রেমিকের সঙ্গে বিয়ে না দিয়ে পারিবারিক সিদ্ধান্তে অন্যত্র বিয়ে দেয়া।
৫. পেশাগত ব্যস্ততা ও সাংসারিক কাজ একসঙ্গে সামাল দিতে গিয়ে অত্যধিক চাপে পড়া
৬. স্বামী দীর্ঘদিন দেশের বাইরে অবস্থান করা।
৭. স্বামীর পক্ষ থেকে মোটা অঙ্কের যৌতুক দাবি করা বা যৌতুক দিতে অসম্মতি জানালে শরীরিক ও মানসিকভাবে নির্যাতনের শিকার হওয়া।
৮. স্বামীর পক্ষ থেকে দুর্ব্যবহার বা একাধিক স্ত্রী থাকলে বৈষম্যমূলক আচরণের শিকার হওয়া।
৯. প্রেমে ব্যর্থ হয়ে অন্য স্বামী গ্রহণ করলেও প্রেমিকের প্রতি আকর্ষণ থাকার কারণে স্বামীর সঙ্গে মানসিক দূরত্ব সৃষ্টি হওয়া।
১০. স্বামীর পরিবারে ভালোবাসাপূর্ণ পরিবেশ না থাকা বা স্বামীর আত্মীয়-স্বজনদের পক্ষ থেকে বিভিন্ন রকম চাপ আসা।
১১. দাম্পত্য কলহ অব্যাহত থাকা।
১২. একে অপরের প্রতি সন্দেহপ্রবণ হয়ে ওঠা।
স্বামী স্ত্রীর যে কোনো একজনের পরকীয়া আসক্ততা
সাধারণত আমাদের সমাজে অধিকাংশ ডিভোর্সের ঘটনা ঘটে পরকীয়া সম্পর্ককে কেন্দ্র করে। মোবাইল-ফোনের সহজলভ্যতার কারণে ছেলে-মেয়েরা জড়িয়ে পড়ে পরকীয়া অবৈধ সম্পর্কে। মোবাইল ফোনে প্রেমের ফাঁদে পড়ে বা অন্য কোনো প্রলোভনে পড়ে মেয়েরা সহজেই ডিভোর্স দিয়ে বিবাহ-বিচ্ছেদ করে। অনেকে তো সরাসরি না দেখে শুধু মোবাইল-ফোনের ওপর ভিত্তি করে প্রেম করে দীর্ঘদিন। আবার প্রেমিকের পক্ষ থেকে বিবাহের প্রলোভন পেয়ে ধ্বংস করে দেয় সুখের সংসার। এরপর একের পর এক নানা অনৈতিক কাজ-কর্মে লিপ্ত হয়ে পড়ে। বাংলাদেশ একটি রক্ষণশীল ইসলামি দেশ। এদেশে কোনো বাবা-মা-ই সন্তানের অবৈধ প্রেমের সম্পর্ক বা পরকীয়া আসক্তিকে মেনে নিতে পারেন না। ফলে অনেক বিয়েতেই অভিবাবকগণ ছেলে-মেয়ের কথাকে উপেক্ষা করে পারিবারিক সিদ্ধান্তে অন্যত্র বিবাহ দিয়ে দেন। আর তখনই ঘটে বিপত্তি। মেয়েরা ডিভোর্স দিয়ে বৈবাহিক সম্পর্কের ইতি টানে। বলার অপেক্ষা রাখেনা যে, ইসলামি শরীয়ত পরকীয়া সম্পর্ককে কোনো অবস্থাতেই বৈধ বলে স্বীকৃতি দেয় না; বরং ইসলামের দৃষ্টিতে বিবাহবহির্ভূত যে কোনো যৌন সম্পর্ক হারাম ও সমাজ ধ্বংসের কারণ। এ ধরনের নোংরা যৌন সম্পর্কই সমাজে নষ্টামি ছড়ায়।
স্বামী কর্তৃক শারীরিক ও মানসিক নির্যাতনের শিকার হওয়া
একথা অস্বীকার করার জো নেই যে, অনেক স্ত্রীই স্বামী কর্তৃক মানসিক ও শারীরিক নির্যাতনের শিকার হয় এবং এক পর্যায়ে তারা স্বামীর সংসারের প্রতি এমনকি নিজের গর্ভের সন্তানের প্রতিও অতিষ্ঠ হয়ে ওঠে। উপায়ান্তর না পেয়ে তারা ডিভোর্স দিয়ে বৈবাহিক সম্পর্ক ছিন্ন করে। ইসলাম স্ত্রীকে নির্যাতন করতে কঠোরভাবে নিষেধ করেছে। স্ত্রী হিসেবে ইসলাম নারীজাতিকে অধিকার ও মর্যাদা দিয়েছে। স্বামীকে নির্দেশ দিয়েছে স্ত্রীর সঙ্গে ভালো আচরণ করার। আল কুরআনে বলা হয়েছে, ‘আর তোমরা স্ত্রীদের সঙ্গে বসবাস কর সদাচারের সাথে। আর যদি তোমরা কোনো কারণে তাদেরকে অপছন্দ কর তাহলে হয়ত তোমরা এমন একটি বস্তুকে অপছন্দ করলে যাতে আল্লাহ তাআলা প্রভূত কল্যাণ রেখেছেন। (সুরা নিসা : ১৯) এক হাদীসে আল্লাহর রাসূল সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম ইরশাদ করেন, ‘কোনো মুমিন পুরুষ যেনো কোনো মুমিন নারীকে অপছন্দ না করে।’ [সহিহ মুসলিম ঃ হাদীস নং ১৪৬৯, সুনানে ইবনে মাজা ঃ হাদীস নং ১৯৭৯]
এই হাদীসে আল্লাহর রাসূল সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম দাম্পত্য জীবনের কলহ নিরসন ও নারীর প্রতি সহিংসতা দূরীকরণের একটি মূলনীতি বলেছেন। স্ত্রীর সব আচরণ স্বামীর কাছে ভালো লাগবে, এটা অসম্ভব। আবার স্বামীর সব আচরণ স্ত্রীর কাছে ভালো না লাগাই স্বাভাবিক। কারণ আল্লাহ তাআলা কাউকেই পূর্ণতা দান করে সৃষ্টি করেননি। প্রত্যেকের ভেতরেই কিছু না কিছু মন্দ স্বভাব থাকবে। ভালো ও মন্দ মিলেই মানুষ। কাজেই স্ত্রীর কোনো স্বভাব স্বামীর কাছে অপছন্দ হলে সে যেনো ধৈর্য ধারণ করে এবং ক্ষমাসুন্দর দৃষ্টিতে দেখে। স্ত্রীর ভালো গুণগুলোর দিকে লক্ষ্য করে আল্লাহর শোকর আদায় করে এবং তার প্রশংসা করে।
এ ক্ষেত্রে প্রত্যেক স্বামীর জন্য রাসূল সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লামের জীবনই উত্তম আদর্শ। রাসূল সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম যখন ঘরে যেতেন স্ত্রীদের সঙ্গে ঘরের কাজে শরীক হতেন। তাদের সাথে সদাচার করতেন। স্ত্রীদের সঙ্গে খোশ-গল্প করতেন। তাদের সঙ্গে হাসিমুখে কথা বলতেন। রাসূল সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম কখনো কোনো স্ত্রীকে প্রহার করেননি। তিনি যখন তাহাজ্জুদের সময় উঠতেন তখন খুব আস্তে দরজা খুলতেন, যাতে ঘরের লোকদের ঘুমে ব্যাঘাত না হয়। তিনি ইরশাদ করেন, ‘তোমরা স্ত্রীদের সঙ্গে উত্তম আচরণ কর। [তিরযি : হা.১১৬৩] অন্য হাদীসে আছে তোমাদের মধ্যে সেই উত্তম, যে তার স্বামীর কাছে উত্তম।’ [জামে তিরমিযি:হা.১১৬২]
স্ত্রীদের অবাধ্যতা, বেপরোয়া চলেফেরা ও ধর্মীয় অনুশাসনের তোয়াক্কা না করায় স্বামীদের পক্ষ থেকে অবহেলার শিকার হওয়া
অনেক স্ত্রীদের ব্যাপারে স্বামীদের অভিযোগ আছে যে, তারা স্বামীদের কথা মান্য করে না। বেপরোয়া, অশালীন ও উচ্ছৃঙ্খল চলাফেরা করে। এতে স্বামীরা ক্রমেই তাদের প্রতি আকর্ষণ হারিয়ে ফেলে। স্বামীদের কাছে অবহেলার শিকার হয়ে তারা একপর্যায়ে ডিভোর্সকেই সমস্যার সমাধান হিসেবে বেছে নেয়। আবেগপ্রবণ হয়ে ডিভোর্স দিলেও অধিকাংশ স্ত্রী পরবর্তীতে এর জন্য অনুতপ্ত হয়। কিন্তু নারীরা যদি পর্দাসহ ইসলামি শরীয়া পরিপালনের প্রতি যত্মবান হত তাহলে এ ধরনের বিপত্তি তো ঘটতই না, উপরন্তু তারা স্বামীদের কাছেও প্রিয়পাত্র থাকত। একটি অপ্রিয় বাস্তবতা হলো, আমাদের সমাজের কিছু মেয়ের উগ্র, অশালীন, যৌন সুড়সুড়িমূলক চলাফেরা সমাজের অন্যান্য মেয়েদেরকেও পরোক্ষভাবে ধ্বংসের পথে নিয়ে যাচ্ছে। অনেক মেয়ে এত টাইট পোশাক পরে যে, তাদের দেহের স্পর্শকাতর অঙ্গগুলো স্পষ্ট হয়ে ফুটে ওঠে। আবার অনেক মেয়ে এত পাতলা পোশাক পরিধান করে যে, তাদের পোশাক পরা আর না পরা একই কথা। আমাদের সমাজের মেয়েরা খুবই অনুকরণপ্রিয়। যে কোনো নতুন কিছু বের হলেই তারা তার অনুসরণ করবে। সেটা ভালো হোক বা খারাপ হোক সে চিন্তা করার সুযোগ নেই। বিজাতিদের অনুকরণ করতে গিয়ে অনেক নারী এতটাই উচ্ছৃঙ্খল হয়ে ওঠেন, যা কোনো সুস্থ রুচিশীল স্বামীর পক্ষে মেনে নেয়াটা অসম্ভব হয়ে দাঁড়ায়। তাছাড়া অনেক দ্বীনদার পুরুষ আছেন নিজেদের স্ত্রীদেরকে পর্দায় রাখতে চান। কিন্তু স্ত্রীরা পর্দা রক্ষা করে না চলার কারণে স্বামী-স্ত্রীর মাঝে মনোমালিন্য সৃষ্টি হয়। মনোমালিন্য থেকে ঝগড়া-বিবাদ, একপর্যায়ে তা বিবাহ বিচ্ছেদ পর্যন্ত গড়ায়।
এ ক্ষেত্রে আমাদের সমাজের মেয়েরা যদি ইসলামের বিধান মেনে চলে তাহলে এধরনের অনেক সমস্যা আপনা থেকেই দূরীভুত হয়ে যায়। নারীদের মনে রাখতে হবে, নারীর নারীত্ব, সতীত্ব কোটি টাকা মূল্যের মাণিক্যের চেয়েও অধিক মূল্যবান। এ সম্পদের রক্ষণাবেক্ষণের জন্য স্বয়ং নারীকেই প্রধান দায়িত্ব গ্রহণ করতে হবে। তাই ইসলামি শরীয়ত পর্দার বিধান দিয়েছে। সুরায়ে নুরের ৩১ আয়াতে মহান আল্লাহ তাআলা ইরশাদ করেন, ‘হে নবী ! মুমিন নারীদেরকে বলে দিন, তারা যেন তাদের চক্ষুকে সংযত রাখে। লজ্জাস্থান হেফাজত করে এবং যা সাধারণত প্রকাশমান তা ছাড়া অন্য কোনো অঙ্গ যেন প্রকাশ না করে। তারা যেন তাদের বক্ষদেশের ওপর ওড়না টেনে নেয়।’
প্রেমিকের সঙ্গে বিয়ে না দিয়ে পারিবারিক সিদ্ধান্তে অন্যত্র বিয়ে দেয়া
অনেক ছেলে-মেয়ে বিবাহপূর্ব প্রেমে জড়িয়ে পড়ে। বিবাহপূর্ব অবৈধ প্রেমের এক পর্যায়ে পরস্পরকে বিবাহ করার অঙ্গিকারও করে থাকে। অনেক সময় ভালোবাসা এতটাই গভীরে গড়ায় যে, একজন অপরজন ছাড়া জীবনধারণের কল্পনাও করতে পারে না। ইসলাম কখনোই এটা স্বীকৃতি দেয় না যে, প্রথমে ভালোবাসা হবে এরপর বিয়ে। এটা এমন একটি পথ যার শুরুটা অকল্যাণকর এবং শেষটাও অধিকাংশ ক্ষেত্রে অতৃপ্তিকর। যৌবনের জোশে যে প্রেম হয় তা মূলত বুদ্ধি-বিবেকসম্পন্ন ও দূরদর্শী কোনো সিদ্ধান্ত নয়; বরং অনেকটাই আবেগ নির্ভর। তাই কিছুদিন পরে যখন আবেগের মধ্যে ভাটা পড়ে তখন ছেলে-মেয়ের সামনে তাদের মাঝে বিদ্যমান বংশীয় বৈষম্য ও অন্যান্য প্রতিবন্ধকতাগুলো প্রকটভাবে ধরা পড়ে। ফলে তাদের বৈবাহিক জীবনে নেমে আসে অশান্তি ও অতৃপ্তি। তাই বিবাহের ক্ষেত্রে মূলত ছেলে-মেয়ে প্রত্যেকে একে অপরকে জেনে বুঝে নেবে। প্রত্যেকে চিন্তা করে নেবে যে, তাদের পবিত্র সম্পর্কে প্রতিবন্ধক হতে পারে এমন বিষয় নেই তো! এরপরই বিবাহের সিদ্ধান্ত গ্রহণ করবে।
সবচেয়ে বড় কথা হলো, ছেলে- মেয়ের মাঝে যদি ভালোবাসা থাকে এবং তারা বিয়ের প্রতীক্ষায় থাকে সেক্ষেত্রে অভিভাবকদের উচিত ছেলে-মেয়ের সেই সম্পর্ককে গুরুত্ব দেয়া। ছোট-খাটো বিষয় বিবেচনায় না এনে তাদের মাঝে বিচ্ছেদ না ঘটিয়ে বিবাহ দিয়ে দেয়াই উত্তম। হাদীস শরীফে রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম ইরশাদ করেন, ‘ভালোবাসায় আবদ্ধ দুজন পুরুষ-মহিলার মাঝে বিয়ের চেয়ে উত্তম কোনো ব্যাপার নেই।’ এই হাদীসটির প্রেক্ষাপটের দিকে দৃষ্টিপাত করলে আমাদের কাছে বিষয়টি আরও স্পষ্ট হয়ে যায়। এক ব্যক্তি রাসূল সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লামের নিকট এসে বলল, আমার যতেœ একটি ইয়াতিম বালিকা আছে। দুজন ব্যক্তি তাকে বিয়ে করতে চায়। একজন দরিদ্র, অন্যজন ধনী। কিন্তু ইয়াতিম বালিকাটি দরিদ্র লোকটিকে ভালোবাসে এবং তাকেই বিয়ে করতে চায়। তার কথা শুনে রাসূল সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম বলেন, ‘ভালোবাসা আবদ্ধ দুজনের মাঝে বিয়ের চেয়ে আর কী উত্তম হতে পারে।’
অভিভাবকদেরকে মনে রাখতে হবে যে, ইসলাম একটি প্রায়োগিক ধর্ম। কারো সঙ্গে ভালোবাসা হয়ে যাওয়াটা একটি স্বভাবগত বিষয়। ইসলাম এই স্বভাবগত বিষয়টিকে শরীয়তসম্মত রূপদানের প্রতি উদ্বুদ্ধ করে। যাতে ছেলে-মেয়ে অবৈধ কোনো কর্মে লিপ্ত না হতে পারে। বেশির ভাগ বাবা-মা সামান্য কোনো কারণ দেখিয়ে বা নিজেদের বংশমর্যাদা রক্ষার অজুহাতে ভালোবাসায় আবদ্ধ দুজন ব্যক্তির মাঝে প্রাচীর হয়ে দাঁড়ান। ফলে তারা নিজেরাও বিপদে পড়েন, সন্তানদেরকেও বিপদে ফেলেন। অনেক সন্তান জেদি হয়ে থাকে। তারা বাবা-মায়ের সিদ্ধান্ত মেনে নিতে না পেরে অন্য জীবন বেছে নেয়। বাবা-মায়ের সিদ্ধান্তের প্রতি বিদ্রোহ ঘোষণা করে তারা ডিভোর্সের মতো ঘটনাও ঘটায়। তাছাড়া বাবা-মা যখন জোর করে তাদের পারিবারিক সিদ্ধান্তকে সন্তানের ওপর চাপিয়ে দেয় তখন সন্তান পরিবারে নিজেকে নিঃস্ব ও অসহায় ভাবে। পরিবার থেকে বিচ্ছিন্ন হয়েই পরবর্তীতে সে আত্মহত্যারমত আরও জঘন্য কোনো পথ বেছে নেয়। মোদ্দাকথা পরিবারের কোনো সন্তানের প্রতি যখন জোরপূর্বক কোনো বিষয় চাপিয়ে দেয়া হয় অথবা তাদের সিদ্ধান্ত ও আবেগকে পূর্ণরূপে অবজ্ঞা করা হয়, তখন তাদের মাঝে জেদ, হিংসা-বিদ্বেষ, নিষ্ঠুরতার মতো ভয়ংকর অমানবিক দোষগুলো তাদের অবচেতন মনেই আয়ত্ত হয়ে যায়। আর এগুলো নিজের বাবা-মা, ভাইবোন এমনকি নিজের জীবনের প্রতি প্রয়োগ করতেও দ্বিধাবোধ করে না।
পরিবারে যদি ভালোবাসা ও হৃদ্যতাপূর্ণ পরিবেশ বিরাজিত থাকে তাহলে সে পরিবারের সন্তানেরা মানবীয় জঘন্য প্রবৃত্তিগুলোর উর্ধ্বে উঠে নৈতিকতা চর্চা করতে পারে। তখন পারস্পরিক সমঝোতার মাধ্যমে কোনো সিদ্ধান্ত গ্রহণ করা সহজ হয়। অনেকে প্রিয় মানুষকে না পেয়ে মানসিক চাপ সহ্য করতে না পেরে মাদকাসক্ত হয়ে যায়। সেই সঙ্গে বিভিন্ন অপরাধমূলক কর্মকান্ডেও জড়িয়ে যায়। বিভিন্ন মাদক নিরাময় কেন্দ্রে খোঁজ নিয়ে জানা যায়, মাদকাসক্তদের অনেকেই প্রেমে ব্যর্থ হয়ে অথবা পছন্দের মানুষের সঙ্গে বিবাহ না হওয়ার কারণে প্রাথমিক অবস্থায় মাদক গ্রহণ করে। ধীরে ধীরে তা নেশায় পরিণত হয়। নেশার টাকা জোগাড় করতে গিয়ে কেউ কেউ ছিনতাই, চাঁদাবাজির মতো ঘটনাও ঘটায়। এইজন্য উচিত হচ্ছে, বংশমর্যাদা বা সচ্ছলতা ও অসচ্ছলতাকে মূল মানদন্ড না বানিয়ে; বরং দ্বীনদারিকে মানদন্ড বানানো। উভয়ের মাঝে চরিত্রগত দ্বীনদারির দিক থেকে বড় ধরনের পার্থক্য না থাকলে সেই সম্পর্ককে প্রত্যাখ্যান না করে বিবাহের ব্যবস্থা করাই শ্রেয়। রাসূল সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম ইরশাদ করেন, ‘যখন তোমাদের কাছে এমন প্রস্তাব আসবে যাদের দ্বীনদারির ব্যাপারে তোমরা সন্তুষ্ট ও নিশ্চিত- তাহলে তোমরা তাদেরকে বিবাহের জন্য নির্ধারিত করে নাও। যদি এমন না কর তাহলে পৃথিবীতে বিপুল ফেতনা ফাসাদ ও নৈরাজ্য ছড়িয়ে পড়বে।’
পেশাগত ব্যস্ততা ও সাংসারিক কাজ একসাথে সামাল দিতে গিয়ে অত্যধিক চাপে পড়া
অনেক নারী চাকুরি করেন। সারাদিন বাহিরের পেশাগত কাজ সামাল দিয়ে আবার ঘরে এসে যখন ঘরের কাজও করতে হয় এবং স্বামী বা অন্য কাউকে সহযোগী হিসেবে না পায় তখন নারী অতিষ্ঠ হয়ে স্বামীর সংসার ছেড়ে একাকি বসবাস করাকেই ভালো মনে করেন। ফলোশ্রুতিতে তারা ডিভোর্স দিয়ে নিজেকে স্বামীর সংসার থেকে মুক্ত করার মতো জঘন্য সিদ্ধান্ত গ্রহণ করেন। ইসলাম নারী-পুরুষের মাঝে কোনো বৈষম্য সৃষ্টি করেনি। পুরুষ-নারী জীবন ধারণের ক্ষেত্রে সমান। যদিও নারী-পুরুষের কর্মক্ষেত্র আলাদা। নারীর আসল কর্মক্ষেত্র হলো ঘর। ঘরের যাবতীয় কাজ আঞ্জাম দিয়ে আদর্শ ঘরণী হিসেবে গড়ে ওঠাই নারীর কাজ। তবে জীবিকার প্রয়োজনে অপরাগতার সময় নারী বাহিরে গিয়ে নিজের জীবিকা অর্জন করার অধিকার সংরক্ষণ করে। সেই অধিকার ইসলাম তাকে দিয়েছে। তবে আমাদের সমাজে নারীদের চাকুরি করাটা যেন ফ্যাশন হয়ে গেছে। প্রয়োজনে অপ্রয়োজনে নারীরা চাকুরির অজুহাত দিয়ে ঘরের বাইরে যান। স্বভাবতই ঘরের বাইরের পরিবেশ নারীদের জন্য উপযোগী নয়। সেখানে তারা পুরুষ কর্তৃক যৌন নির্যাতন, ইভটিজিং ইত্যাদির শিকার হন। আবার তাদেরকে বাহিরে দীর্ঘ সময় কাজ করার পর ঘরকন্যার কাজও সামাল দিতে হয়। যা কোমল স্বভাবের নারীদের জন্য একটি বোঝা বৈ কিছুই নয়। এই বোঝা তারা বইতে না পেরে অনেক সময় ডিভোর্স দিয়ে স্বামীর সংসার থেকে নিস্কৃতি পাওয়ার চেষ্টা করে। সুতরাং ইসলামের দৃষ্টিতে নারী অত্যধিক প্রয়োজন ছাড়া ঘরের বাইরের কজ-কর্ম করতে যাবে না। এটাই শরীয়তের মূলনীতি। হ্যা, একদম বাধ্য হলে সেটা ভিন্ন কথা।
আমাদের সমাজের একশ্রেণীর বুদ্ধিজীবি বলতে চান যে, নারীদেরও পুরুষদের কাঁধে কাঁধ মিলিয়ে চাকুরি করা দরকার। কারণ নারীরা চাকুরি করলে জাতীয় সম্পদ বৃদ্ধি পায়। তাদেরকে ঘরকন্যার কাজে সীমিত রাখলে দেশ বিপুলভাবে ক্ষতিগ্রস্ত হয়। এছাড়াও নারীদের মধ্যে অলাভজনক কাজে সময় নষ্ট করার অভ্যাস গড়ে ওঠে। আলসেমি অভ্যাস সৃষ্টি হয়। তাছাড়া তারা বাইরের কাজকর্ম না করার কারণে অত্যধিক মোটা হয়ে যায়। পাশ্চাত্যের যে সব নারী ঘরের বাইরে কাজ করে তারা মুটিয়ে যাওয়ার সমস্যা থেকে অনেকটা নিরাপদ। এই সব চটকদার যুক্তি গভীরভাবে পর্যালোচনা করলে বাস্তবে হালে পানি পায় না।
প্রথমত: নারীরা চাকুরি করলে দেশের অর্থনৈতিক জীবনের ওপর এর ক্ষতিকর প্রভাব পড়ে। নারীরা তাদের স্বাভাবিক গন্ডির বাইরে গিয়ে যখন চাকুরি ইত্যাদি করে তখন পুরুষদের কর্মক্ষেত্রে স্বাভাবিক বিচরণ বাধাগ্রস্ত হয়। পুরুষদের বেকারত্ব ব্যাপক আকার ধারণ করে। তাই দেখা যায়, যে সব দেশে নারীরা চাকুরি শুরু করেছে সে সব দেশে পুরুষরা ক্রমেই বেকার হয়ে পড়ছে। মাধ্যমিক, উচ্চ মাধ্যমিক ও গ্রাজুয়েট তো বটেই এমনকি বড় বড় ডিগ্রিধারীরাও বেকার হয়ে অফিসে অফিসে চাকুরির জন্য ধর্ণা দিচ্ছে। অপর দিকে তাদের স্থানগুলো দখল করে রেখেছে এমন সব নারী যারা যোগ্যতা, অভিজ্ঞতা ও কর্মদক্ষতায় পুরুষদের সমকক্ষ নয়। ইদানিং এই সমস্যা মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রসহ পাশ্চাত্যের বেশ কয়েকটি রাষ্ট্রে সৃষ্টি হচ্ছে বলে বিভিন্ন পরিসংখ্যানে উঠে এসেছে। এমনকি আমাদের দেশেও।
দ্বিতীয়: যখন প্রমাণিত হলো যে নারীদের চাকুরি পুরুষদের বেকারত্বের কারণ হয়ে দাঁড়ায়। তখন এমন হওয়া বিচিত্র নয় যে, একটি কর্মজীবী নারী তার নিজের স্বামী, বাবা বা ভাইয়ের বেকারত্বের কারণ হচ্ছে। আর যে পরিবারে নারী সদস্যের চাকুরির কারণে পরিবার প্রধান বা অন্যান্য পুরুষরা চাকুরি বঞ্চিত হচ্ছে এবং বেকারত্বের গ্লানি বহন করছে সে পরিবারে অর্থনৈতিক ভিত কতটুকু মজবুত হবে তা ভেবে দেখা দরকার।
তৃতীয়: জাতির উন্নতি ও সমৃদ্ধি সবসময় অর্থনৈতিক উন্নতির মাপকাঠিতে মাপা যায় না। আমরা দেখতে পাচ্ছি নারীর চাকুরিতে জাতীয় অর্থনৈতিক সমৃদ্ধি ঘটলেও এর দ্বারা জাতির অপূরণীয় সামাজিক ও নৈতিক ক্ষতিসাধিত হচ্ছে। পাশ্চাত্যের নারীরা চাকুরি করার কারণে তাদের পারিবারিক কাঠামো ভেঙ্গে গেছে। ছেলে-মেয়েদের চরিত্র ধ্বংস হয়ে গেছে। পারিবারিক ও সামাজিক শান্তি বিনষ্ট হয়ে গেছে। সুতরাং ভেবে দেখা উচিত এতসব ক্ষতি মেনে নিয়ে কি আমরা শুধু অর্থনৈতিক উন্নতির কথা ভাবব না নৈতিকতার দিকটির প্রতিও গুরুত্ব দিতে হবে?
আরেকটি বিষয় আমাদেরকে মনে রাখতে হবে, কোনো মানবসমাজ যদি নৈতিক, আধ্যাত্মিক ও পারিবারিক মূল্যবোধকে দ্বিতীয় পর্যায়ের গুরুত্ব দেয় তাহলে সেখানে সুখ-সমৃদ্ধি ও কল্যাণ কিছুতেই নিশ্চিত হতে পারে না। কম্যুনিষ্ট সভ্যতা ও পাশ্চাত্য সভ্যতা পরিবার, সমাজ ও নারীদেরকে যেভাবে দেখে একটি ইসলামি সমাজের জন্য সে দৃষ্টিতে তাকালে হবে না। তাছাড়া সমাজের প্রত্যেক সদস্যকে সমাজের বা দেশের উৎপাদক যন্ত্র ভাবলে চলবে না; বরং সমাজের বা দেশের কোনো কোনো সদস্যকে অর্থনৈতিক সমৃদ্ধির চেয়ে উত্তম কর্মকান্ডে লিপ্ত থাকার কারণে উৎপাদন কর্মকান্ডে অংশগ্রহণ করার বাধ্য-বাধকতা থেকে অব্যাহতি দিতে হবে। যেমন দেশের সেনাবাহিনীকে দেশের নিরাপত্তার স্বার্থে অন্য সব কাজ থেকে মুক্ত রাখা হয়। কারণ তারা অর্থনৈতিক উপার্জনের চেয়ে অধিক মূল্যবান স্বার্থ রক্ষায় নিয়োজিত আছে। সুতরাং আমাদেরকেও দেখতে হবে যে, নারীরা সমাজ কাঠামো বিনির্মানের মতো গুরুত্বপূর্ণ কাজটির আঞ্জাম দিচ্ছেন। কাজেই তাদেরকে অর্থনৈতিক সমৃদ্ধির কথা বলে তাদের আপন ক্ষেত্র থেকে বের করে আনা কোনো জ্ঞানীর কাজ নয়।
একে অপরের প্রতি সন্দেহপ্রবণ হয়ে ওঠা
আমাদের সমাজের অধিকাংশ স্বামী-স্ত্রীর মাঝে অহেতুক নানা সন্দেহ করার একটা প্রবণতা লক্ষ্য করা যায়। অকারণেই প্রিয় মানুষটির প্রতি প্রশ্নবোধক চিহ্নের উদয় হয়। তার কথার প্রতি গুরুত্ব দেয়া হয় না। যোগাযোগ কমে যায়। প্রত্যেকেই কল্পনার পাহাড় বানিয়ে তার প্রিয় মানুষের ব্যাপারে নানা নেতিবাচক ভাবনা ভাবতে থাকে। অহেতুক একজন অপরজনের সততাকে প্রশ্নবিদ্ধ করে। এইজন্য অপরকে দোষারোপ করার আগে নিজেকে ভাবা উচিত যে, আমি কতটা সৎ ও নিষ্ঠাবান। তার স্থলে আগে নিজেকে বসানো উচিত। ভেবে দেখা উচিত, তার স্থলে আমি হলে এবং আমাকে প্রশ্নবানে জর্জরিত হতে হলে কেমন হতো। অন্যথায় পরবর্তীতে যখন ভুল ভেঙ্গে যাবে তখন নিজেকেই অপরাধবোধে ভুগতে হবে।
দাম্পত্য কলহ
অনেক সময় দাম্পত্য কলহ দীর্ঘায়িত হলে তাও ডিভোর্সের কারণ হয়ে দাঁড়ায়। দুঃখের বিষয় হলো, আমাদের সমাজে দাম্পত্য কলহ আশঙ্কাজনক হারে বাড়ছে। দাম্পত্য কলহের সূত্র ধরে তালাক, ডিভোর্সের ঘটনাও ঘটছে দেদারছে। স্বামী-স্ত্রীর চলার পথে মান-অভিমান, ভুল-ভ্রান্তি স্বাভাবিক বিষয়। তবে এই স্বাভাবিক বিষয় যখন কলহে রূপ নেয় এবং তা দীর্ঘদিন অব্যাহত থাকে তখনই বিপত্তি ঘটে। স্বামী-স্ত্রী একে অপরের আজীবন সঙ্গী। শরীয়ত সম্মত পন্থায় দুজন নারী-পুরুষের মাঝে যে সম্পর্ক সৃষ্টি হয় তাই দাম্পত্য সম্পর্ক। এই সম্পর্ককে অটুট রাখার প্রতি ইসলাম অত্যন্ত গুরুত্ব দিয়েছে। তাই দাম্পত্য কলহ নিরসনে প্রয়োজনীয় দিক নিদের্শনা দিয়েছে ইসলাম। আসলে আমাদের যাবতীয় সমস্যার মূল কারণ হলো আমরা ইসলামের সুমহান আদর্শ ত্যাগ করে আল্লাহ প্রদত্ত বিধানকে জলাঞ্জলি দিয়ে শান্তি খুঁজি নিজেদের মনগড়া বানানো মতবাদে। দাম্পত্য কলহ নিরসনে ইসলামের ছায়াতলে ফিরে আসার বিকল্প নেই। স্বামী-স্ত্রীর মাঝে সাধারণত যে কলহ দেখা দেয় তার মূল কারণ হলো প্রত্যেকেই নিজের অধিকার সম্পর্কে ষোলআনা সচেতন, অন্যের অধিকার আদায়ের ব্যাপারে চরম অসচেতন। প্রত্যেকে যদি অন্যের অধিকার আদায়ের ব্যাপারে সচেতন থাকে তাহলে দাম্পত্য কলহের কোনো সুযোগ থাকে না।
ইসলামি বিধানে স্ত্রীর ওপর স্বামীর যেসব হক বা অধিকার রয়েছে তার মধ্যে কয়েকটি হচ্ছে-
ক- স্বামীর আনুগত্যে থাকা তার খেদমত করা।
খ- স্বামীর অনুমতি ব্যতীত কাউকে ঘরে প্রবেশ করতে না দেওয়া, নিজে স্বামীর অনুমতি ছাড়া ঘর থেকে বের না হওয়া।
গ- স্বামীর সাধ্যের বাইরে কোনো কিছুর আবদার না করা।
ঘ- স্বামীর সম্পদ বিশ্বস্ততার সঙ্গে হেফাজত করা এবং নিজের সতীত্বকেও হেফাজত করা
ঙ- শরীয়তসম্মত ওজর না থাকলে স্বামীর আহ্বানে তাৎক্ষণিকভাবে সাড়া দেয়া।
স্বামীর ওপর স্ত্রীর যে সব হক বা অধিকার রয়েছে ত হলো-
ক- স্ত্রীর ভরণপোষণের ব্যবস্থা করা।
খ- তার মহর আদায় করে দেয়া।
গ- বসবাসের জন্য বাসস্থানের ব্যবস্থা করে দেয়া।
ঘ- সম্ভব হলে কাজের লোকের ব্যবস্থা করা।
ঙ- একাধিক স্ত্রী থাকলে ভরণ-পোষণ ও রাত্রি যাপনে সমতা রক্ষা করা।
এসব অধিকারের দিকে যদি স্বামী-স্ত্রী যত্মবান হয় তাহলে দাম্পত্য জীবন হবে কলহমুক্ত।
স্বামীর পরিবারে ভালোবাসাপূর্ণ পরিবেশ না থাকা বা স্বামীর আত্মীয়-স্বজনদের পক্ষ থেকে বিভিন্ন রকম চাপ আসতে থাকা-
স্বামীর পরিবারে ভালোবাসাপূর্ণ পরিবেশ না থাকা, স্বামীর পরিবারের বিভিন্ন রকম চাপ সহ্য করতে না পারাও ডিভোর্সের অন্যতম কারণ। পারিবারিক কলহ বলতে সাধারণত বউ-শাশুড়ির দ্বন্ধই আমরা বুঝে থাকি। বউ-শাশুড়ির দ্বন্ধের কথা আমাদের সমাজে প্রায়ই শুনা যায়। শাশুড়ির প্রতি বউয়ের এক বস্তা অভিযোগ, শাশুড়ি ভালো না, শুধুু জ্বালাতন করে, দোষ খুঁজে বেড়ায়। বউয়ের প্রতি শাশুড়ির অনুযোগ, বউ অলস, অকর্মা, মান্যতা নেই ইত্যাদি। মোটকথা বউ শাশুড়ির দ্বন্ধ আমাদের সমাজের চিরায়ত চিত্র। অথচ একটি সংসার আনন্দময়, সুখময় ও ফলপ্রসূ হওয়ার জন্য বউ শাশুড়ির মিল- মোহাব্বত অত্যন্ত জরুরি। বউ শাশুড়ির মাঝে যদি মিল-মোহাব্বত থাকে তাহলে সংসারে সুখ-সমৃদ্ধির জোয়ার আসে। সংসার হয়ে ওঠে জান্নাতের টুকরা। আর যদি সংসারের এই দুটি গুরুত্বপূর্ণ স্তম্ভের মাঝে বিরূপ সম্পর্ক থাকে তাহলে সংসারের শান্তি হয়ে যায় সোনার হরিণ। জীবন তখন হয়ে ওঠে দুর্বিসহ। সংসারটা হয়ে যায় জাহান্নামের টুকরা। একটি সংসারকে সুখ-সমৃদ্ধ ও প্রাণবন্ত করার জন্য যেমনি প্রয়োজন শাশুড়ির সুনিপুন পরিচালনা, তেমনি প্রয়োজন বউয়ের আন্তরিকতা ও সদিচ্ছা। তাদের দু’জনের সম্মিলিত প্রচেষ্টায় সংসারে প্রবাহিত হতে পারে সুখ-শান্তির নির্মল হাওয়া। সে জন্য বউ-শাশুড়ির সংঘাত নিরসনে তাদের উভয়েরই মানসিকতা পরিবর্তন করতে হবে। উভয়েরই পরস্পরকে ছাড় দেয়ার মানসিকতা সৃষ্টি করতে হবে। আমাদের সমাজে দেখা যায়, বউ শাশুড়ি দু’জনের কেউই বিন্দুমাত্র ত্যাগ স্বীকার করতে রাজি নয়। উভয়েই পূর্ণ পাওয়ার খাটাতে চায়। যার অনিবার্য ফল হিসেবে সংঘাতের সৃষ্টি হয়। এ ক্ষেত্রে উভয়ে যদি একে অপরকে ছাড় দেয়ার মানসিকতা সৃষ্টি করে তাহলে অতি সহজেই এ সংকট নিরসন করা সম্ভব।
বউ তার শাশুড়িকে শ্রদ্ধা করবে। মনে করবে তার শাশুড়ি তার জন্য জননীতুল্য শ্রদ্ধার পাত্র। শ্বশুরকে মনে করবে পিতাতুল্য। পরিবারের অন্যান্য সদস্যদের সঙ্গে তার আচরণ হবে হৃদ্যতাপূর্ণ। অপর দিকে শাশুড়িকে মনে করতে হবে, নব অতিথি বউ তার সংসারের সৌন্দর্য। তার বাড়ির শোভা। বাড়ির প্রত্যেক সদস্য যেন তাকে আপন করে নেয়, তার সঙ্গে আপন জনের ন্যায় আচরণ করে, সেদিকে শাশুড়িকেই খেয়াল রাখতে হবে। একে অপরের প্রতি পূর্ণ সহমর্মিতা প্রদর্শন করতে হবে। অনেক শাশুড়ি আছেন, বউয়ের ওপর মাত্রারিক্তি বোঝা চাপিয়ে দেন। এমন কাজকর্মও পুত্রবধুর কাঁধে চাপিয়ে দেন যা মূলত তার দায়িত্বের অন্তর্ভুক্ত নয়। আবার সেই কাজটি সম্পাদন করা তার জন্য দুরূহ ও দুঃসাধ্য হয়ে পড়ে।
আমাদের সমাজের অধিকাংশ বউ-শাশুড়ির দ্বন্ধের প্রকৃত কারণ হলো, বউ শাশুড়ি কেউই স্ব স্ব দায়িত্ব ও অধিকার সম্পর্কে ওয়াকিফহাল নন। বরং তারা একতরফাভাবে অধিকার ভোগ করতে চান। ইসলামি শরীয়ত কর্তৃক বউ শাশুড়ির জন্য যে সব বিধি-বিধান প্রদান করা হয়েছে, শরীয়তের সেসব বিধান পালনে তারা চরম অমনোযোগী।
বউয়ের দায়িত্ব হলো শাশুড়িকে সম্মান করা। যৌথ পরিবার হলে তার নির্দেশ মতো সংসার চালানো। শাশুড়িকে নিজের প্রতিপক্ষ বা শত্রু না ভাবা। বউয়ের চিন্তা করা উচিত যে, শাশুড়ি যদি তার প্রতিপক্ষ বা শত্রু হত তাহলে তাকে ছেলের বউ করে ঘরে তুলত না। অনেক বউ আছেন, শাশুড়ি বা ননদের কথা তিলকে তাল বানিয়ে স্বামীর কাছে মায়া কান্না করে স্বামী ও তার মা-বোনদের মধ্যে বিবাদ সৃষ্টি করে দেয়। স্বামী বেচারাও ধূর্ত স্ত্রীর প্রতারণায় পড়ে মা বোনদের বিরুদ্ধে উত্তেজিত হয়ে ওঠেন। এতে মা-ছেলের মায়া জড়ানো সম্পর্ক বিনষ্ট হয়ে যায় এবং মা বেচারী খুবই অপমানবোধ করেন। বউয়ের মনে রাখা উচিত যে, যে স্বামীর খেদমত করা মহান আল্লাহ তাআলা তার ওপর ফরজ করে দিয়েছেন। তার জন্মদাতা মাকে খুশি করলে সে নিশ্চয় খুশি হবে। এতে তার স্বামীর জান্নাতের রাস্তা ও যেমন সুগম হবে তেমনি তারও দুনিয়া আখেরাত কল্যাণকর হবে।
শাশুড়ির জন্য উচিত, বউকে নিজ সন্তানের ন্যায় আপন করে নেয়া। শাশুড়িকে ভাবতে হবে যে, বউ তার বাবা-মা, ভাই-বোন, আত্মীয়-স্বজনের মায়া ত্যাগ করে স্বামীর হাত ধরে শ্বশুরালয়ে চলে এসেছেন। তার আত্মীয়-স্বজনকে সে আপন করে নিয়েছেন। যার সাথে জীবনে কখনো দেখা সাক্ষাৎ নেই, পরিচয় নেই, এমন একজন অপরিচিত পুরুষ ও মহিলাকে নিজের অন্তরে সে বাবা-মার স্থান দিয়েছেন। সেই অপরিচিত পুরুষকে সে বাবা বলে ডাকছেন। আর অপরিচিত মহিলাকে মা বলে ডাকছেন। সুতরাং তার সঙ্গে আদর-সোহাগের সাথে সুন্দর আচরণ করতে হবে। বউয়ের সাধারণ ভুল-ত্রুটিগুলো ক্ষমা করে দিতে হবে। মারাত্মক কোনো অন্যায় করলে স্নেহ-মমতা দিয়ে তা শোধরাতে হবে। এতে মেজাজী বউও আস্তে আস্তে পোষ মানতে বাধ্য হবে। পক্ষান্তরে কর্কশ আচরণ করা হলে বউ বিগড়ে গিয়ে অযাচিত আচরণ করতে থাকবে। একপর্যায়ে তুমুল ঝগড়া-বিবাদ এমনকি ছাড়াছাড়ির পর্যায়ে চলে যেতে পারে। শাশুড়িকে মনে রাখতে হবে যে, চোখ রাঙ্গিয়ে রুঢ় আচরণ করে যা করা যায় না, তা করা যায় মধুর আচরণ দ্বারা।
ঘর-সংসার করা বউয়ের কাছে নতুন অভিজ্ঞতা, সে কখনো এ কাজ করে আসেনি। সবকিছু তার জন্য নতুন। সুতরাং ঘর গোছানো, রান্নাবান্না করা, অতিথিদের আদর-–আপ্যায়ন করা মোটকথা সবকিছুতেই তার ভুলত্রুটি হতে পারে। এই ভুলত্রুটিগুলো শাশুড়িও হয়ত কোনো একসময় করেছিলেন। তার শ্বাশুড়িও তা মেনে নিয়েছিলেন। সুতরাং এখন তাকে তার পুত্রবধুর সাথে সে আরচরণটাই করতে হবে, যে আচরণ সে অন্যের পুত্রবধুু থাকাবস্থায় তার শ্বাশুড়ির কাছ থেকে কামনা করেছিলন।
শ্বাশুড়িকে মনে রাখতে হবে, তার নিজের শরীরের যেমন আরাম-আয়েশের অনুভূতি হয়, তার বউয়েরও তেমনি গোস্ত-মাংসে গড়া শরীর। তারও প্রয়োজন হয় একটু আরামের, একটু বিশ্রামের। সুতরাং তাকে বিশ্রামের যথেষ্ট সুযোগ দিতে হবে। তার ছেলের বউ তো তার ক্রয় করা দাসী নয়। সুতরাং তার ওপর সংসারের সমস্ত কাজ চাপিয়ে দিয়ে শাশুড়ি তার ছেলে-মেয়েদেরকে নিয়ে আম গাছের নিচে বসে দখিনা হাওয়া খাবে, ওই দিকে বউ বেচারীর কাজের চাপে প্রাণ প্রায় ওষ্ঠাগত হয়ে যাবে, এটা অবশ্যই অমানবিক। তার ওপর যেমন স্বামীর অধিকার রয়েছে, তেমনি তার স্বামীর ওপর ও তার অধিকার রয়েছে। তাছাড়া শ্বাশুড়িও একদিন বউ ছিল। তখন সে তার শাশুড়ির কাছ থেকে যেমন আচরণ কামনা করেছিল তার পুত্রবধু ও তার কাছে তেমন আচরণই কামনা করে। তিনি যখন যৌবনে ছিলেন তখন যেমন তার সমস্ত কামনা-বাসনা ও যাবতীয় সখ পূরণ করে নিয়েছিলেন, এখন তার বউয়ের পালা। তার বউও তার যাবতীয় কামনা বাসনা পূরণ করে নিতে চাইবে, এটাই স্বাভাবিক। তাই পুত্রবধু কোনো অন্যায় করে ফেললে তাকে সুন্দর করে বুঝিয়ে দিতে হবে। পুত্রবধুর সঙ্গে স্নেœহের কন্যা সুলভ আচরণ করবে। সামান্য ক্ষুদ্র কোনো বিষয়ে তাকে তিরস্কার করা উচিত নয়।
অনেক সময় শ্বাশুড়িদের মনে এমন ধারণা আসে, আমার ছেলেটাকে এত দুঃখ-কষ্ট সহ্য করে শরীরের রক্ত পানি করে খাইয়ে দাইয়ে বড় করে তুললাম। এখন নতুন একটা মেয়ে এসে তার ওপর রাজত্ব করবে, আমার কলিজার টুকরাকে আমার হাত ছাড়া করবে, এটা কিভাবে মেনে নেয়া যায়? তখন শাশুড়িকে চিন্তা করতে হবে যে, বাবা-মা সন্তানকে লালন পালন করে বড় করে অন্যের হাতে তুলে দেয়। এটাই মহান আল্লাহ তাআলার অমোঘ বিধান। তিনি নিজের মেয়ের দিকে তাকাতে পারেন। এত কষ্ট করে মেয়েকে বড় করেছেন। পড়া-লেখা করিয়েছেন। অতঃপর অন্যের ছেলের হাতে তুলে দিয়েছেন। সেখানে তার মেয়ে রাণীর হালতে থাকুক, এটাই তার কামনা। ঠিক তার পুত্রবধু ও কোনো না কোনো মায়ের সন্তান। তার মাও কামনা করে তার মেয়ে শ্বশুরালয়ে রাণীর হালতে থাকুক। নিজের মেয়ের বেলায় যেমনটি কামনা করা হয়, পুত্রবধুর ব্যাপারেও তেমনি আচরণ করতে হবে। তাহলেই সংসারে সুখ আসবে। আল্লাহ তাআলা আমাদের সকলকে বুঝার তাওফিক দান করুন। আমীন।
সম্পাদক, মাসিক আরবি ম্যাগাজিন ‘আলহেরা’।
বিষয়: বিবিধ
১১০০ বার পঠিত, ০ টি মন্তব্য
পাঠকের মন্তব্য:
মন্তব্য করতে লগইন করুন