মুসলিম বিশ্বের হানাহানিকে দীর্ঘ করতে নতুন তত্ত্ব মাসুম খলিলী
লিখেছেন লিখেছেন awlad ২২ এপ্রিল, ২০১৬, ০৪:০৩:০২ রাত
মুসলিম বিশ্বের হানাহানিকে দীর্ঘ করতে নতুন তত্ত্ব
মাসুম খলিলী
২১ এপ্রিল ২০১৬,বৃহস্পতিবার, ১৮:২২ | আপডেট: ২১ এপ্রিল ২০১৬,বৃহস্পতিবার, ১৮:২৭
মাসুমুর রহমান খলিলী
মাসুমুর রহমান খলিলী
প্রিন্ট
10
0
0
Google
0
10
মুসলিম বিশ্বে হানাহানিকে দীর্ঘায়িত করার মতো নীতি-কৌশলের আভাস পাওয়া যাচ্ছে পাশ্চাত্যের গুরুত্বপূর্ণ নীতি-পরামর্শকদের লেখালেখিতে। যুক্তরাষ্ট্রসহ কয়েকটি প্রভাবশালী দেশের কর্মকাণ্ডে তার প্রতিফলনও লক্ষ করা যাচ্ছে। কমিউনিজমের পতনের পর পাশ্চাত্যের আলোচিত চিন্তাবিদ স্যামুয়েল হান্টিংটন ‘সভ্যতার দ্বন্দ্ব’ তত্ত্ব দিয়ে পাশ্চাত্য সভ্যতার সামনে ইসলামকে চ্যালেঞ্জ হিসেবে তুলে ধরেছেন। এর বিরুদ্ধে পাল্টা তত্ত্বও দিয়েছেন এডওয়ার্ড সাঈদসহ আরো অনেকে। কিন্তু গত দুই দশকের বৈশ্বিক ঘটনাবলিতে হান্টিংটনের ‘সভ্যতার দ্বন্দ্ব’ তত্ত্বের ব্যাপক প্রভাব দৃশ্যমান হয়ে ওঠে। আরব দুনিয়াসহ পুরো মুসলিম বিশ্বে যে অস্থিরতা ও হানাহানি চলছে তার সাথে এর বিশেষ সম্পর্ক দেখা যাচ্ছে। নতুন পরিস্থিতিতে আমেরিকা ও তার মিত্রদের সঙ্ঘাতমুখর মুসলিম অঞ্চলে ব্যাপকভিত্তিক লক্ষ্য নির্ধারণ করে তা অর্জন না হওয়া পর্যন্ত সেসব দেশে লড়াই চালিয়ে যাওয়ার পরামর্শ দেয়া হচ্ছে। এ লড়াইয়ের নতুন তাত্ত্বিক ভিত্তি দিয়ে বলা হচ্ছে, ইসলামি বিশ্বে এখন যা চলছে তা সভ্যতার সঙ্ঘাত নয়, এটি হলো সভ্যতার অভ্যন্তরীণ সঙ্ঘাত। এই সঙ্ঘাতে চরমপন্থাকে উসকে দিয়ে সেটিকে অজুহাত বানিয়ে ইসলামিস্টদের সাথে শাসক এলিট এবং সেকুলারদের মুখোমুখি করে ইসলামের মৌলিক চেতনাকে পরাস্ত করার একটি সূক্ষ্ম প্রচেষ্টা স্পষ্ট হয়ে উঠছে। এ জন্য একেবারে স্বল্পসংখ্যক সন্ত্রাসীর কর্মকাণ্ডকে ‘ইসলামের বিপদ’ হিসেবে তুলে ধরার চেষ্টা হচ্ছে বিশ্বের সামনে।
২০১১ থেকে ২০১২ সাল পর্যন্ত আমেরিকান গোয়েন্দা সংস্থা সিআইএর পরিচালক হিসেবে দায়িত্ব পালনকারী কেকেআর গ্লোবাল ইনস্টিটিউটের চেয়ারম্যান, অবসরপ্রাপ্ত জেনারেল ডেভিড পেট্রাউস ইসলামিক চরমপন্থার বিরুদ্ধে দীর্ঘ যুদ্ধের জন্য গাইড লাইন হিসেবে পাঁচটি ‘মহাধারণা’ উপস্থাপন করেছেন অতি সম্প্রতি। তিনি ইরাকে ২০০৭ থেকে ২০০৮ এবং আফগানিস্তানে ২০১০ থেকে ২০১১ সাল পর্যন্ত মার্কিন নেতৃত্বাধীন জোট বাহিনীর কমান্ডার হিসেবে দায়িত্ব পালন করেছিলেন। সরকারের বাইরে থাকলেও স্বাভাবিকভাবে তার লেখার বিশেষ গুরুত্ব রয়েছে নীতিনির্ধারকদের মধ্যে। জেনারেল ডেভিড পেট্রাউস ১৫ এপ্রিল বিশ্বে শীর্ষস্থানীয় মত গঠনকারী অন লাইন পোর্টাল ‘5 ‘big ideas’ to guide us in the Long War against Islamic extremism’ শীর্ষক এক বহুল আলোচিত নিবন্ধ লিখেছেন। আমেরিকার প্রেসিডেন্ট নির্বাচনে দলীয় মনোনয়ন যুদ্ধের অনেকটা পরিপক্ব-পর্যায়ে এসে মার্কিন পররাষ্ট্রনীতি ও কৌশল নিয়ে যখন ব্যাপক বিতর্ক উঠেছে, তখনই তিনি এ লেখা প্রকাশ করেন। এ সময়ে আমেরিকার সন্ত্রাসবিরোধী লড়াই ও বিশ্বনীতি নিয়ে দেশে-বিদেশে বিপুল বিতর্ক ও উদ্বেগ উচ্চারিত হচ্ছে। সহনশীল রাষ্ট্রগুলোতেও ইসলামভীতি এত দ্রুত বিস্তার লাভ করছে যে, একজন বিতর্কিত ব্যবসায়ী ডোনাল্ট ট্রাম্প উল্লেখযোগ্য কোনো রাজনৈতিক বা সামরিক পটভূমি ছাড়াই মুসলিমবিরোধী উগ্র বক্তব্য দিয়ে রিপাবলিকান মনোনয়ন পাওয়ার কাছাকাছি পৌঁছে গেছেন। সর্বশেষ নিউ ইয়র্কের দলীয় প্রাইমারিতে ট্রাম্প ৯৫টি ডেলিগেটের মধ্যে ৮৯টিতেই জয়ী হয়েছেন। তার নিকটতম প্রতিদ্বন্দ্বী টেড ক্রুজ পৃথিবীর রাজধানী হিসেবে খ্যাত এই বিশ্বনগরীতে একটি ডেলিকেটও পাননি। শুধু ট্রাম্পই নন, রিপাবলিকান দলের অন্য মনোনয়নপ্রত্যাশীদের বক্তব্যও মুসলিমদের ব্যাপারে প্রায় কাছাকাছি।
ইসলামোফোবিয়ার এই বিস্তার কেবল যে, যুক্তরাষ্ট্রে সীমিত এমন নয়। আমেরিকার চেয়েও ইউরোপে আরো বেশি ছড়িয়ে পড়ছে ইসলামভীতি। বাবা ভাঙ্গা নামে এক অখ্যাত ভবিষ্যদ্বক্তার ‘ইউরোপে মুসলিমরা আক্রমণ করবে এবং এই মহাদেশটি মুসলিমদের করতলগত হবে আর এর রাজধানী করা হবে রোমকে’ মর্মে বলা ভবিষ্যদ্বাণীকে ছড়িয়ে দেয়া হচ্ছে। এই সময়টাতেই দেখা যাচ্ছে, ইউরোপের গুরুত্বপূর্ণ একেকটি শহরে সন্ত্রাসী হামলার সাথে সাথেই এর দায় স্বীকার করছে আইএস। এসব ন্যক্কারজনক ঘটনার জন্য সার্বিকভাবে ইসলাম ও মুসলিমদের দায়ী করার প্রবণতা দেখা যাচ্ছে। ফ্রান্সের প্যারিসে ও বেলজিয়ামের ব্রাসেলসে সন্ত্রাসী হামলার পর আবার ফেরত পাঠানো হচ্ছে প্রাণ বাঁচাতে নজিরবিহীন দুর্ভোগ পোহানোর পর সিরিয়ার রণক্ষেত্র থেকে ইউরোপে চলে যাওয়া মুসলিম শরণার্থীদের অনেককে। তাদের অনেকে এর আগে ঝুঁকিবহুল যাত্রায় ইউরোপে পাড়ি দেয়ার পথে নৌকা ডুবে প্রাণ হারিয়েছে। এখন জোর করে ফেরত পাঠানোর পথে আবার সাগরে প্রাণ হারাচ্ছে অনেকে।
জেনারেল পেট্রাউসের প্রণীত ‘মহা ধারণা’ গ্রহণ করা হলে দীর্ঘ মেয়াদি লক্ষ্য অর্জন না হওয়া পর্যন্ত মুসলিম বিশ্বকে পুনঃ অবয়ব দেয়ার কাজ চলতে থাকবে। সুস্পষ্টভাবে উল্লেখ না করলেও বোঝা যায়, এই দীর্ঘ মেয়াদি লক্ষ্য হলো- মুসলিম দেশগুলো থেকে ইসলামের রাজনৈতিক চেতনা ও প্রভাব মুছে দেয়া। এ জন্য প্রত্যক্ষ সামরিক হস্তক্ষেপের বাইরে এজেন্সির মাধ্যমে বিশেষ অপারেশন চালিয়ে মুসলিম সমাজে ব্যাপকভিত্তিক বিভক্তি এনে এক পক্ষকে আরেক পক্ষের বিরুদ্ধে লাগিয়ে দেয়া হচ্ছে। মুসলিম দেশগুলোর প্রশাসনকে এমন পর্যায়ে নিয়ে যাওয়া হবে, যাতে স্বয়ংক্রিয়ভাবে তারা ইসলামিস্টদের বিরুদ্ধে নির্মূলকাজ চালিয়ে যেতে পারে।
জেনারেল পেট্রাউস বলেছেন, “যথাযথ জাতীয় নীতি প্রণয়নের জন্য প্রয়োজন সঠিক ধারণার অন্বেষণ। আরব বসন্ত-উত্তর পূর্ববর্তী ধারণার ওপর ভিত্তি করে তৈরি করা নীতি ও কৌশল বাতিলের পর নতুন ‘মহাধারণা’ এখন সবিশেষ গুরুত্বপূর্ণ।” ইরাকে তার অভিজ্ঞতার কথা উল্লেখ করে তিনি বলেছেন, দেশটিতে প্রথমত নিষ্পত্তিমূলক ভূখণ্ড ছিল মানবিক ভূখণ্ড এবং মানুষের নিরাপত্তা সুরক্ষিত করা ছিল সেখানে সবার আগের কাজ। এ ক্ষেত্রে অগ্রগতি ছাড়া, অন্য কোনো কিছুই অর্জন করা সম্ভব ছিল না। দ্বিতীয়ত, আমরা মানুষকে নিরাপত্তা দিতে পারি শুধু তাদের সাথে বসবাস করার মধ্য দিয়ে, বড় ঘাঁটিগুলোতে কেন্দ্রীভূত না করে স্থানীয়দের বসতির এলাকাগুলোর মধ্যে আমেরিকান বাহিনী মোতায়েন করে। তৃতীয়ত, আমরা কোনোভাবেই বিপর্যয়কর বৃহদাকার অন্তর্ঘাতী চক্রকে হত্যা বা আটক করতে পারব না। তাদের হত্যা কিংবা আটক করার পরিবর্তে অধিক প্রয়োজন হলো অন্তর্ঘাতী চক্রের শীর্ষ নেতৃত্বপর্যায়ের ব্যক্তিদের মধ্য থেকে যত বেশি সংখ্যকের সাথে সম্ভব সমঝোতা বা বোঝাপড়া করা। চতুর্থত, আমরা বিদ্রোহীদের এলাকাগুলোকে পুরোপুরি পরিষ্কার করে ইরাকি বাহিনীর কাছে নিয়ন্ত্রণ হস্তান্তর করতে পারতাম না। এর পরিবর্তে মোটামুটি এক প্রকার নিয়ন্ত্রণে রাখার মতো অবস্থায় এনে ইরাকিদের কাছে কর্তৃত্ব হস্তান্তর করেছি। এই কৌশলকে সব ক্ষেত্রে সামনে রাখা উচিত।
সিআইএর এই সাবেক পরিচালক আরো বলেছেন, গত এক দশকের উন্নয়ন থেকে পাঁচটি মহা ধারণার পাঠ গ্রহণ করতে হবে। তার এগুলোর মধ্যে প্রথমটিতে বলা হয়েছে, এটা ক্রমেই স্পষ্ট হচ্ছে যে, পশ্চিম এশিয়া থেকে মধ্যপ্রাচ্য ও মধ্য এশিয়ার বড় একটি অঞ্চলের অশাসিত এলাকায় ইসলামি চরমপন্থীদের অভয়ারণ্য তৈরি হয়েছে যেখান থেকে তারা ইসলামের চরমপন্থী রূপের বাস্তবায়ন ঘটাতে চায়; আর যেখান থেকে তারা চালাতে পারে সন্ত্রাসী হামলা।
দ্বিতীয়ত, এটা স্পষ্ট, চরমপন্থীদের আক্রমণ ও অন্যান্য কার্যক্রম তাদের অবস্থানের এলাকায় সীমাবদ্ধ থাকবে না। বরং সিরিয়ার ক্ষেত্রে যেমন অস্থিরতা, চরমপন্থা, সহিংসতা ও শরণার্থীদের প্রবাহ তাদের প্রতিবেশী এলাকা ছাড়িয়ে অনেক দূরে ছড়িয়ে পড়েছে এবং এই অঞ্চলের আমেরিকার অংশীদারদের জন্য, ইউরোপীয় মিত্র এবং এমনকি আমেরিকার জন্য ক্রমবর্ধমান কঠিন চ্যালেঞ্জরূপে আবির্ভূত হয়েছে, তেমনটি দেখা যাবে অন্য ক্ষেত্রেও।
তৃতীয়ত, এটিও ক্রমাগতভাবে স্পষ্ট হচ্ছে, এসব চ্যালেঞ্জে সাড়া দেয়ার ক্ষেত্রে আমেরিকান নেতৃত্ব একান্ত আবশ্যকীয়। যুক্তরাষ্ট্র নেতৃত্বে না থাকলে, এটা অন্য যেকোনো দেশে চলে যাবে। তবে এ অবস্থায় কোনো গ্রুপ বা দেশ সম্মিলিতভাবে যুক্তরাষ্ট্রের সক্ষমতা নিয়ে এগিয়ে আসতে পারবে না। এর অর্থ এই নয় যে, যুক্তরাষ্ট্রকে প্রতিটি ক্ষেত্রে চরমপন্থী গ্রুপ মোকাবেলার জন্য বিরাট প্রচেষ্টা নিয়ে এগোতে হবে। এর বিপরীতে, যুক্তরাষ্ট্রকে শুধু যা অত্যাবশ্যক সেটি করতে হবে। আর যতটা সম্ভব অন্য অংশীদারদের সাথে নিয়েই সেটা করতে হবে। চার্চিল যথার্থই বলেছিলেন, ‘মিত্রদের নিয়ে যুদ্ধ করার চেয়ে একটি জিনিসই আছে আরো খারাপ, সেটি হলো তাদের ছাড়াই লড়াইয়ে অবতীর্ণ হওয়া।’ আর মালিতে ফ্রান্স যেভাবে (ইসলামিস্ট দমনে) এগিয়েছে, সেভাবে একজন অংশীদার যদি গন্তব্যে যেতে চায় তাহলে তাকে সমর্থন করা দরকার। এটি স্বীকার করা উচিত যে, এখনো আমেরিকার যথেষ্ট অবদান রাখার অবকাশ রয়েছে।
পেট্রাউস জোর দিয়ে বলেছেন, ‘ইসলামি বিশ্বের অংশীদারদের রয়েছে বিশেষ গুরুত্ব। বস্তুত, এ প্রচেষ্টার সাথে তাদের মধ্যে যারা যুক্ত হবে তাদের জন্য বিশাল ইনসেনটিভ থাকতে হবে। মনে রাখতে হবে, এখানকার সঙ্ঘাত সাধারণভাবে সভ্যতার সঙ্ঘাত নয়, বরং আমরা ইসলামি বিশ্বের মধ্যে যা দেখছি, তা আরো সঠিকভাবে বললে দাঁড়াবে- একই সভ্যতার ভেতরের সঙ্ঘাত। আর প্রধান ইসলামি দেশগুলোতে সেসব দেশের নেতাদের চরমপন্থার বিস্তারে যে ক্ষতি, তার চেয়ে বেশি হারানোর কিছু নেই। এই বাস্তবতাকে কাজে লাগাতে হবে।
চতুর্থত, এটা স্পষ্ট হয়ে উঠছে যে, শুধু একটি সঙ্কীর্ণ সন্ত্রাসবাদবিরোধী পদ্ধতির পরিবর্তে যুক্তরাষ্ট্র ও তার অংশীদারদের ব্যাপকভিত্তিক পন্থার সন্ধান করতে হবে। সুনির্দিষ্ট আঘাতের চেয়েও বেশি কিছু এবং ‘বিশেষ অভিযান’ চালানোর প্রয়োজন রয়েছে। এর অর্থ এই নয় যে, যুক্তরাষ্ট্র প্রচলিত স্থলবাহিনী এর সাথে যুক্ত করবে না, রাজনৈতিক সমন্বয়সাধনের উপকরণ অথবা জাতি গঠনের কাজ প্রয়োজনীয় ক্ষেত্রে গ্রহণ করবে না। উদাহরণস্বরূপ ইরাকের কথা বলা যায়। বর্তমানে শুধু ওই উপাদানসহায়তা সেখানে দিলে হবে না, তাদের টিকিয়ে রাখতে যুক্তরাষ্ট্রের নেতৃত্বাধীন জোট থেকে ‘সুনির্দিষ্ট ফলাফল’ পাওয়া যেতে পারে- এমন উল্লেখযোগ্য সহায়তার দরকার হবে।
পঞ্চমত এবং সবশেষে এটা স্পষ্ট, যুক্তরাষ্ট্রের নেতৃত্বাধীন প্রচেষ্টার সময়সীমা যেকোনো মেয়াদ পর্যন্ত বিস্তৃত হতে পারে এবং সুনির্দিষ্ট সময়ের পরিবর্তে মাঠের বাস্তব অবস্থার ওপর তা নির্ভরশীল হতে হবে। এই কার্যক্রম সীমিত করার কিছু ইতিবাচক দিক থাকলেও ৯/১১-উত্তর প্রশাসনের অধীনে আমাদের অভিজ্ঞতা থেকে স্পষ্ট যে, অকাল ট্রানজিশন ও প্রত্যাহার আমেরিকানদের ত্যাগের বিনিময়ে আগের অর্জনকে নষ্ট করতে পারে এবং মার্কিন স্বার্থের বিপত্তি এড়াতে আবার সে দেশে ফিরে যাওয়ার প্রয়োজন হতে পারে।
পাঁচ মহা ধারণা উপস্থাপন করে এই জেনারেল উল্লেখ করেছেন, বর্ণিত লক্ষ্য অর্জনের সহজ কোনো পথ নেই। সব ধরনের প্রচেষ্টায় সাফল্য নির্ভর করে টেকসই অঙ্গীকারের ওপর। এ সাফল্য শুধু সামরিক বাহিনীর ওপর নয়, অধিকন্তু (সিআইএ এবং এফবিআইয়ের মতো) অন্যান্য বিভাগ ও সংস্থার সক্ষমতার ওপরও নির্ভর করে। একটি ব্যাপকভিত্তিক কর্মপদ্ধতি গ্রহণ ও বাস্তবায়ন যেমন সহজ নয়, তেমনি কম খরচে পাওয়ার বিষয়ও নয়। তবে এটিও সত্য, অপর্যাপ্ত শাসন একপর্যায়ে অশাসনে রূপ নেয়। আর বহুজাতিক চরমপন্থীরা এর সুযোগ গ্রহণ করে।
পেট্রাউস তার লেখার শেষে বলেছেন, দীর্ঘ যুদ্ধ এখন একটি অতি শ্লথগতির যুদ্ধে রূপ নিচ্ছে। আর আমরা সেটাকে স্বীকৃতি দিচ্ছি। কিন্তু মহা ধারণা অনুযায়ী, আমাদের এবং আমাদের অংশীদারদের চিন্তাশীল ও বিচক্ষণ পদ্ধতিতে সৃষ্ট পরিস্থিতির সাড়াদানের সক্ষমতা আছে। এর চেয়ে কম কিছু আমাদের কর্মকাণ্ডকে অপর্যাপ্ত প্রমাণ করবে।
পেট্রাউস যে মহাধারণা দিয়েছেন, সেটি তিনি ইরাকে অনুসরণের কথা উল্লেখ করেছেন। এই মহাধারণার অনেক কিছু মিসর, ইয়েমেন, সিরিয়া, আফগানিস্তান এমনকি বাংলাদেশেও অনুসৃত হয়েছে কিংবা হওয়ার আলামত দেখা যাচ্ছে। তার মূল ইঙ্গিত হলো, ইসলামকে সভ্যতার দ্বন্দ্বের তত্ত্ব দিয়ে মোকাবেলা করা যাবে না। এটি হলে ইসলামি শক্তি এবং পাশ্চাত্য বা খ্রিষ্টীয় শক্তি ক্রুসেড আমলের মতো মুখোমুখি হবে। এর পরিবর্তে, ইসলামের সভ্যতার অভ্যন্তরীণ দ্বন্দ্বের তত্ত্ব গ্রহণীয় করা গেলে মুসলিমদের নিজস্ব শক্তিতে বিভক্তি এনে তাদের একপক্ষকে অন্য পক্ষের বিরুদ্ধে ব্যবহার করা যাবে। সুবিধামতো পক্ষকে মদদ দেয়া যাবে বিশেষ গোপন কর্মসূচির মাধ্যমে। এটি ইরাক ও আফগানিস্তানে বিশেষভাবে দেখা গেছে। এখন দেখা যাচ্ছে সিরিয়া, ইয়েমেন ও লিবিয়ায়। আরব বসন্ত এবং এর পরবর্তী পরিস্থিতির প্রতিও এ ক্ষেত্রে বিশেষ দৃষ্টি দেয়ার অবকাশ রয়েছে।
আরব বসন্তকালে মধ্যপ্রাচ্যের কোনো কোনো দেশের নির্বাচনে জয়ী হওয়া অথবা সরকারে যাওয়ার সুযোগ করে দিয়ে পুরো মধ্যপন্থী ইসলামি শক্তির প্রকাশের ব্যবস্থা করা হয়েছে। অন্য দিকে, তাদের অগ্রগতিকে ক্ষমতায় থাকা শাসকদের ক্ষমতা হারানোর ঝুঁকি হিসেবে উপস্থাপন করা হয়েছে বেন আলি, হোসনি মোবারক বা আলি সালেহর সরকারের পতনের মধ্য দিয়ে। একই সাথে বিকাশমান মধ্যপন্থী ইসলামি শক্তির সামনে প্রতিষ্ঠিত শাসক এলিট ও সেকুলার শক্তিকে মুখোমুখি করার পর তাদের দিয়েই নিয়মতান্ত্রিক ইসলামিস্টদের দমনের ব্যবস্থা করা হয়েছে। ঠিক এ সময়ে দেশে দেশে চরমপন্থী একেকটি গ্রুপের এমন রহস্যজনক উত্থান ঘটানো হয়েছে যে, তাদের সন্ত্রাস ও অনিয়মতান্ত্রিক তৎপরতাকে নিয়মতান্ত্রিক ইসলামিস্টদের দমনের অজুহাত বানানো হয়েছে। মিসরে মুসলিম ব্রাদারহুডের অহিংস আন্দোলনের সময় রহস্যজনকভাবে কিছু অন্তর্ঘাতী কাজে পুলিশ হত্যার ঘটনা ঘটেছে, অ্যাটর্নি জেনারেলকে হত্যার ঘটনা ঘটেছে। আর এর সব দায় ব্রাদারহুডের ওপর চাপিয়ে তাদের রাজনৈতিক, অর্থনৈতিক ও সামাজিক স্থাপনাকে নির্মূল করার চেষ্টা করা হয়েছে। মিসরে একনায়ক সিসির বিচারমন্ত্রী ব্রাদারহুড দমনে একটি হত্যাকাণ্ডের বিপরীতে চার লাখ ব্রাদারহুড হত্যার কথা বলার একপর্যায়ে প্রকাশ্য টেলিভিশনে এমন চরম ঔদ্ধত্যপূর্ণ কথাও বলে বসেন যে, ‘হজরত মুহাম্মদও যদি হয় গ্রেফতার করা হবে’। মিসর এবং অন্য কয়েকটি দেশে গোপন হত্যাকাণ্ডকে মধ্যপন্থী নিয়মতান্ত্রিক ইসলামিস্টদের অগ্রগতিকে রুদ্ধ করতে ব্যবহার করা হয়েছে। এ জন্য চরমপন্থী চিন্তা ও তৎপরতার বিস্তৃতি ঘটার সুযোগ করে দেয়া হয়েছে গোপন কর্মসূচির ভিত্তিতে। এসব কাজ করা হয় বিভিন্ন গোয়েন্দা সংস্থার গোপন তৎপরতার মাধ্যমে।
বাংলাদেশে সাম্প্রতিক মাসগুলোতে বিদেশীসহ বেশ কিছু রহস্যজনক হত্যাকাণ্ড ঘটেছে। এরপর তার দায় স্বীকার করেছে আইএস। সর্বশেষ, তথাকথিত আইএসের মুখপত্র ‘দাবিক’ এ প্রকাশিত আইএসের বেঙ্গল শাখার প্রধানের সাক্ষাৎকারে বাংলাদেশে ঘাঁটি করে মিয়ানমার ও ভারতে অভিযান চালানোর হুমকি দেয়া হয়েছে। এর ভবিষ্যৎ দৃশ্যপট যে ভয়াবহ হতে পারে, তা মধ্যপ্রাচ্যের কিছু দেশের ঘটনাবলিকে সামনে রাখলে বোঝা যায়। মিসরের মতো এখানেও ইসলামিস্টদের দমনে চরম ব্যবস্থা নেয়া হয়েছে। এর পাশাপাশি, ইসলামিস্টদের একটা অংশকে উগ্রপন্থী বানানোর উসকানি দেয়া হয়েছে অব্যাহতভাবে। এই ফাঁদে পা দিলে আইএসের মতো অজুহাত তৈরি করে বাংলাদেশকে জঙ্গি দমনের রণক্ষেত্র বানানো সহজ হতো। সেই আশঙ্কা যে কাটেনি, তা দেখা যায় তথাকথিত আইএসের বেঙ্গল প্রধানের সাক্ষাৎকারে। তিনি যেখানে ঘাঁটি গেড়ে যে অঞ্চলে অভিযান চালানোর কথা বলছেন, সেখানে ‘ইঙল্যাং ইসরাইল’ নামে একটি ইহুদি রাষ্ট্র প্রতিষ্ঠার দাবি উঠেছে মনিপুর-মিজোরামের ইহুদিদের পক্ষ থেকে। বাংলাদেশ-ভারত ও মিয়ানমারের এই অঞ্চলে বসবাসরত অনেক উপজাতীয় গোষ্ঠীকে ইহুদিদের হারানো গোত্রের উত্তর-পুরুষ বলে দাবি করা হয়। বলার অপেক্ষা রাখে না, বাংলাদেশের চলমান পরিস্থিতি গভীরভাবে বুঝতে হলে বিশ্ব পরিস্থিতিকে সামনে রেখে সবকিছু অবলোকন করতে হবে। এখানে যে প্রেক্ষাপট সৃষ্টির চেষ্টা হচ্ছে, সেটি আফ-পাক এলাকায় করা হয়েছে অনেক আগেই। এ ক্ষেত্রে পেট্রাউসের ‘সভ্যতার অভ্যন্তরীণ সঙ্ঘাত’ তত্ত্ব হতে পারে বিশেষভাবে গুরুত্বপূর্ণ।
- See more at: http://www.dailynayadiganta.com/detail/news/112089#sthash.Ion4uyQv.dpuf
বিষয়: বিবিধ
১৩৭৭ বার পঠিত, ৩ টি মন্তব্য
পাঠকের মন্তব্য:
নিজের লেখা নিয়ে হাজির হোন।
সেটা যদি লাইনের ' আমি ভালো আছি, আপনারা কেমন আছেন' টাইপের কোন লেখা হয়। তাও ভালো।
আর কপি পেস্টও কিন্তু ভালো হচ্ছেনা!
মন্তব্য করতে লগইন করুন