জেরুজালেম প্রশ্নে মার্কিনীদের ভ্রান্তনীতি
লিখেছেন লিখেছেন সৈয়দ মাসুদ ২৭ ডিসেম্বর, ২০১৭, ০৩:৪৯:০৫ দুপুর
সম্প্রতি মার্কিন প্রেসিডেন্ট ঐতিহাসিক জেরুজালেম শহরকে ইসরাইলী রাজধানী হিসেবে স্বীকৃতি এবং সেখানে মার্কিন দূতাবাস স্থানান্তরের ঘোষণা দিয়েছেন। বিষয়টি বিশে^র শান্তিকামী মানুষ কোনভাবেই কাঙ্খিত ও যৌক্তিক মনে করছেন না। মূলত মার্কিন প্রশাসনের এমন দায়দায়িত্বহীন ঘোষণা পুরো মধ্যপ্রাচ্য পরিস্থিতিকে জটিল থেকে জটিলতর করে তুলবে বলেই মনে করা হচ্ছে। বস্তুত পুরো মধ্যপ্রাচ্য পরিস্থিতিকে স্থিতিশীল রাখতে এবং স্থায়ী শান্তি প্রতিষ্ঠায় যেখানে সকল পক্ষকেই দায়িত্বশীল আচরণ জরুরি ছিল সেখানে মার্কিন প্রশাসনের এমন অনাকাঙ্খিত ঘোষণা জ¦ালানো আগুণে ঘি ঢেলে দেয়ার সমতুল্য বলেই মনে করছেন আন্তর্জাতিক পর্যবেক্ষক মহল। যা শুধু মধ্যপ্রাচ্য নয় বরং বিশ^শান্তির জন্যও মোটেই সহায়ক নয়।
মূলত মার্কিন প্রেসিডেন্ট ডোনাল্ড ট্রাম্প বিশ^জনমতকে উপেক্ষা করেই এমন নেতিবাচক ঘোষণা দিয়েছেন। যা বিশ^বাসীকে সংক্ষুব্ধ করে তুলেছে। এমনকি এই ইস্যুতে দীর্ঘদিন বিচ্ছিন্ন থাকা মুসলিম বিশ^ও এক প্লাটফরমে দাঁড়াতে সক্ষম হয়েছে। ওআইসি এই ইস্যুতে প্রায় সর্বসম্মত প্রস্তাব গ্রহণে সক্ষম হয়েছে। অতীতে এ ধরনের ইস্যুতে ওআইসি সহ মুসলিম রাষ্ট্রগুলোকে এভাবে সর্বসম্মত সিদ্ধান্তে পৌঁছতে দেখা যায়নি। এমনকি বিশে^র প্রায় সকল রাষ্ট্রই জেরুজালেম ইস্যুতে সোচ্চার হয়েছে এবং জাতিসংঘ গৃহীত ভোটাভুটিতে মার্কিন প্রস্তাবের বিরুদ্ধে ভোট প্রদান করেছে। যা মার্কিন প্রশাসনকে মারাত্মকভাবে বেকায়দায় ফেলেছে। এমনকি বিষয়টি এখন মার্কিনীদের জন্য রীতিমত পেজটিস ইস্যু। কারণ, ইতোপূর্বে মার্কিন প্রশাসন কোন ইস্যুতে এ ধরনের বিব্রত পরিস্থিতির মুখোমুখী হয়নি। তাই সৃৃষ্ট বিব্রতকর পরিস্থিতি এড়ানোর জন্যই মার্কিন প্রশাসনকে বেশ কঠোর তৎপরতা চালাতে লক্ষ্য করা গেছে। কিন্তু এতেও সুবিধা করতে পারেনি মার্কিন প্রশাসন।
সম্প্রতি জেরুজালেম ইস্যুতে মার্কিন ঘোষণার প্রেক্ষাপটে মার্কিন অবস্থানের পক্ষে-বিপক্ষে সাধারণ পরিষদের ভোটাভুটি হয়ে গেল। আর এই ভোটাভুটির ফলাফলটা যাতে নিজেদের পক্ষে নেয়া যায় এজন্য মার্কিন প্রশাসন কোন কুটনৈতিক শিষ্টাচারের ধার ধারেনি বরং সদস্য রাষ্ট্রগুলোকে রীতিমত হুমকী দিয়ে বসেছে। প্রাপ্ততথ্য মতে, জাতিসংঘে নিযুক্ত যুক্তরাষ্ট্রের স্থায়ী প্রতিনিধি নিকি হ্যালি জাতিসংঘের সাধারণ পরিষদের সদস্য রাষ্ট্রগুলোকে তাদের অবস্থানের বিরুদ্ধে ভোট না দিতে সতর্ক করে দিয়ে বলেছিলেন, ‘প্রেসিডেন্ট ট্রাম্প এই ভোটাভুটিকে ব্যক্তিগতভাবে নিয়েছেন। প্রেসিডেন্ট এই ভোটাভুটি নিবিড়ভাবে পর্যবেক্ষণ করবেন। যারা যুক্তরাষ্ট্রের বিরুদ্ধে ভোট দেবে আমার ওপর নির্দেশ আছে যাতে ওই দেশগুলোর নাম সংগ্রহ করে তাঁর (ট্রাম্প) কাছে একটা প্রতিবেদন দিই। আমরা জেরুজালেম প্রশ্নে প্রত্যেকটা ভোটের হিসাব রাখব।’
এর আগে জাতিসংঘের নিরাপত্তা পরিষদে জেরুজালেম প্রশ্নে একটি খসড়া প্রস্তাব উত্থাপন করে মিশর। নিরাপত্তা পরিষদের ১৪ সদস্য দেশ ওই প্রস্তাব পক্ষে ভোট দেয়। স্থায়ী সদস্য যুক্তরাষ্ট্র ওই প্রস্তাবে ভেটো দেওয়ায় ওই প্রস্তাব বাতিল হয়ে যায়। যুক্তরাষ্ট্রের বিপক্ষে ১৪ দেশের ভোট ওয়াশিংটনের জন্য ‘অপমানজনক’ বলে মন্তব্য করেন হ্যালি। এই নামগুলো যুক্তরাষ্ট্র ভুলে যাবে না বলেও হুঁশিয়ার করেন তিনি। এরপর আরব ও মুসলিম দেশগুলোর অনুরোধের পরিপ্রেক্ষিতে জাতিসংঘের সাধারণ পরিষদ জেরুজালেম ইস্যুতে জরুরি বিশেষ অধিবেশনের আয়োজন করেছে। ওই অধিবেশনের আগেই যুক্তরাষ্ট্রের স্থায়ী দূত নিকি হ্যালি ওই সতর্কবার্তা দিয়েছিলেন। মূলত ফিলিস্তিন ও ইসরায়েল জেরুজালেমকে তাদের রাজধানী হিসেবে বিবেচনা করে। ৬ ডিসেম্বর যুক্তরাষ্ট্র জেরুজালেমকে ইসরায়েলের রাজধানী হিসেবে স্বীকৃতি দেয়। যুক্তরাষ্ট্রই প্রথম দেশ, যে এই স্বীকৃতি দিল। দেশটির প্রেসিডেন্ট ডোনাল্ড ট্রাম্পের এই সিদ্ধান্তের তীব্র নিন্দা জানায় আরব বিশ্ব ও আন্তর্জাতিক সম্প্রদায়। কিন্তু মার্কিন প্রেসিডেন্ট তার সিদ্ধান্তে অটল থাকেন।
ইতিহাসের চুলচেরা বিশ্লেষণে দেখা যায়, জেরুজালেম অতি প্রাচীন শহর। আধুনিক জেরুজালেম শহরের অভ্যন্তরে অবস্থিত ০.৯ বর্গ কিমি. (০.৩৫ বর্গ মাইল) আয়তন বিশিষ্ট দেয়াল ঘেরা অঞ্চল। ১৮৬০ সালে মিশকেনট শানানিম নামক ইহুদি বসতি প্রতিষ্ঠিত হওয়ার আগ পর্যন্ত এই অঞ্চলটি নিয়েই জেরুজালেম শহর গঠিত ছিল। পুরনো শহরটি ধর্মীয়ভাবে গুরুত্বপূর্ণ বেশ কিছু স্থানের অবস্থানস্থল, যেমন মুসলিমদের কাছে ডোম অব দ্য রক ও আল-আকসা মসজিদ, ইহুদিদের কাছে টেম্পল মাউন্ট ও পশ্চিম দেয়াল এবং খ্রিষ্টানদের কাছে চার্চ অব দ্য হলি সেপালচার গুরুত্বপূর্ণ স্থান হিসেবে পরিগণিত হয়। ১৯৮১ সালে এই অঞ্চলটি ইউনেস্কোর বিশ্ব ঐতিহ্যবাহী স্থান হিসেবে তালিকাভুক্ত হয়।
প্রথাগতভাবে পুরনো শহরটি চারটি অসমান অংশে বিভক্ত। তবে বর্তমান অবস্থাটি ১৯ শতক থেকে চালু হয়েছে।] বর্তমানে শহরটি মোটামোটিভাবে মুসলিম মহল্লা, খ্রিষ্টান মহল্লা, ইহুদি মহল্লা ও আর্মেনীয় মহল্লা নামক ভাগে বিভক্ত। ১৯৪৮ সালের আরব-ইসরাইল যুদ্ধের পর পুরনো শহরটি জর্ডান কর্তৃক অধিকৃত হয়। ১৯৬৭ সালে ছয় দিনের যুদ্ধে টেম্পল মাউন্টের উপর দুপক্ষের মধ্যে হাতাহাতি লড়াই হয়। এসময় ইসরাইল পূর্ব জেরুজালেমের বাকি অংশসহ পুরনো শহর দখল করে নেয় এবং পশ্চিম অংশের সাথে একীভূত করে পুরো এলাকাকে ইসরাইলের অন্তর্গত করে নেয়া হয়।
বর্তমানে পুরো এলাকাটি ইসরাইলের নিয়ন্ত্রণাধীন রয়েছে এবং তারা একে ইসরাইলের জাতীয় রাজধানী হিসেবে বিবেচনা করে। ২০১০ সালে জেরুজালেমের সর্বপ্রাচীন লেখার নমুনা পুরনো শহরের দেয়ালের বাইরে পাওয়া যায়। ১৯৮০ সালের জেরুজালেম আইন নামক আইন যেটিতে পূর্ব জেরুজালেমকে কার্যকরভাবে ইসরাইলের অংশ ঘোষণা করা হয় তা জাতিসংঘ নিরাপত্তা পরিষদ প্রস্তাব ৪৭৮ দ্বারা বাতিল ঘোষণা করা হয়। আন্তর্জাতিক সম্প্রদায় পূর্ব জেরুজালেমকে অধীকৃত ফিলিস্তিনি অঞ্চলের অংশ হিসেবে গণ্য করে।
বাইবেলের বর্ণনা মতে, খ্রিষ্টপূর্ব ১১শ শতকে রাজা দাউদের ( মুসলমানরা যাকে নবী হযরত দাউদ (আ.) বলে স্বীকৃতি দেয়) জেরুজালেম জয়ের পূর্বে শহরটি জেবুসিয়দের বাসস্থান ছিল। বাইবেলের বর্ণনা মতে এই শহর মজবুত নগরপ্রাচীর দ্বারা সুরক্ষিত ছিল। রাজা দাউদ কর্তৃক শাসিত শহর যেটি দাউদের শহর বলে পরিচিত তা পুরনো শহরের দেয়ালের দক্ষিণ পশ্চিমে অবস্থিত। তার পুত্র রাজা সুলায়মান ( হযরত সোলাইমান আ.) শহরের দেয়াল সম্প্রসারিত করেন। এরপর ৪৪০ খ্রিষ্টপূর্বের দিকে পারস্য আমলে নেহেমিয়া ব্যবিলন থেকে ফিরে আসেন ও এর পুনঃনির্মাণ করেন। ৪১-৪৪ খ্রিষ্টাব্দে জুডিয়ার রাজা আগ্রিপ্পা “তৃতীয় দেয়াল” নামক নতুন নগরপ্রাচীর নির্মাণ করেন।
ঈসায়ী ৭ম শতকে (৬৩৭ সালে) খলিফা উমর ইবনুল খাত্তাবের শাসনামলে মুসলিমরা জেরুজালেম জয় করেন। খলিফা উমর (রা.) একে মুসলিম সাম্রাজ্যের অন্তর্ভুক্ত করে নেন। তিনি শহরের বাসিন্দাদের নিরাপত্তার প্রতিশ্রুতি দিয়ে চুক্তিবদ্ধ হন। জেরুজালেম অবরোধের পর সফ্রোনিয়াস খলিফা উমর (রা.)কে স্বাগতম জানান। কারণ জেরুজালেমের চার্চের কাছে পরিচিত বাইবেলের একটি ভবিষ্যতবাণীতে “একজন দরিদ্র কিন্তু ন্যায়পরায়ণ ও শক্তিশালী ব্যক্তি” জেরুজালেমে খ্রিষ্টানদের রক্ষক ও মিত্র হিসেবে আবির্ভূত হবেন – এমন উল্লেখ ছিল। সফ্রোনিয়াস বিশ্বাস করতেন যে সাদাসিধে জীবনযাপনকারী বীর যোদ্ধা উমর এই ভবিষ্যতবাণীকে পূর্ণ করেছেন।
আলেক্সান্দ্রিয়ার পেট্রিয়ার্ক ইউটিকিয়াসের লেখা, উমর (রা) চার্চ অব দ্য হলি সেপালচার পরিদর্শন করেন ও উঠোনে বসেন। নামাজের সময় হলে তিনি চার্চের বাইরে গিয়ে নামাজ আদায় করেন যাতে কেউ তার নামাজের কারণকে ব্যবহার করে কেউ পরবর্তীকালে এই চার্চকে মসজিদে রূপান্তর না করে। তিনি এও উলেœখ করেন যে উমর (রা.) একটি আদেশনামা লিখে তা পেট্রিয়ার্ককে হস্তান্তর করে। এতে উক্ত স্থানে মুসলিমদের ইবাদাত করতে নিষেধ করা হয় বলে ইউটিকিয়াস উল্লেখ করেন।
১০৯৯ সালে প্রথম ক্রুসেডের সময় ইউরোপীয় খ্রিষ্টান সেনাবাহিনী জেরুজালেম দখল করে এবং ১১৮৭ সালের ২ অক্টোবর সুলতান সালাহউদ্দিন আইয়ুবী কর্তৃক তা বিজিত হওয়ার আগ পর্যন্ত এতে তাদের কর্তৃত্ব বহাল ছিল। তিনি ইহুদিদেরকে শহরে বসবাসের অনুমতি দেন। ১২১৯ সালে দামেস্কের সুলতান মুয়াজ্জিম নগরের দেয়াল ধ্বংস করেন। ১২৪৩ সালে মিশরের সাথে চুক্তি অনুযায়ি জেরুজালেম জার্মানির দ্বিতীয় ফ্রেডেরিখের হস্তগত হয়। ১২৩৯ সালে তিনি দেয়াল পুনঃনির্মাণ করেন। কিন্তু কেরাকের আমির দাউদ সেগুলোকে ধ্বংস করে দেন। ১২৪৩ সালে জেরুজালেম পুনরায় খ্রিষ্টানদের দখলে আসে এবং দেয়ালগুলো সংস্কার করা হয়। ১২৪৪ সালে খোয়ারিজমিয় তাতাররা শহরটি দখল করে এবং সুলতান মালিক আল-মুয়াত্তাম নগরপ্রাচীর ভেঙে ফেলেন। ফলে শহর আবার প্রতিরক্ষাহীন হয়ে পড়ে এবং শহরের মর্যাদা হুমকির মুখে পড়ে।
বর্তমান দেয়ালগুলো ১৫৩৮ সালে উসমানীয় সাম্রাজ্যের সুলতান প্রথম সুলাইমান কর্তৃক নির্মিত হয়। দেয়ালগুলো প্রায় ৪.৫ কিমি. (২.৮ মাইল) দীর্ঘ ও ৫ থেকে ১৫ মিটার (১৬ থেকে ৪৯ ফুট) পর্যন্ত উঁচু এবং ৩ মিটার (১০ ফুট) পুরু)। সব মিলিয়ে পুরনো শহরে মোট ৪৩টি প্রহরা টাওয়ারও ১১ টি গেট আছে। এদের মধ্যে সাতটি বর্তমানে উন্মুক্ত।
পুরনো শহরটিকে ইউনেস্কো বিশ্ব ঐতিহ্যবাহী স্থান হিসেবে তালিকাভুক্ত করার জন্য ১৯৮০ সালে জর্ডান প্রস্তাব করে। প্রস্তাব অনুযায়ি ১৯৮১ সালে এটিকে তালিকাভুক্ত করা হয়। ১৯৮২ সালে জর্ডান একে ঝুঁকিপূর্ণ বিশ্ব ঐতিহ্যবাহী স্থান হিসেবে গণ্য করার অনুরোধ জানায়। জর্ডানের এখতিয়ার নেই উলেœখ করে যুক্তরাষ্ট্র এই অনুরোধের বিরোধিতা করে। সে সাথে এও উল্লেখ করে যে এক্ষেত্রে ইসরাইলের সম্মতি প্রয়োজন কারণ তারা প্রত্যক্ষভাবে ইসরাইল নিয়ন্ত্রণ করছে। ২০১১ সালে ইউনেস্কো বিবৃতি দেয় যে তারা পূর্ব জেরুজালেমকে অধীকৃত ফিলিস্তিনি এলাকার অংশ বলে গণ্য করে এবং জেরুজালেমের অবস্থান স্থায়ী ভিত্তিতে সমাধান করতে হবে।
ইতিহাসের চুলচেরা বিশ্লেষণে জেরুজালেমকে ইসরাইলের রাজধানী ঘোষণার কোন যৌক্তিকতা প্রমাণিত হয় না বরং তা মুসলমানদের অবস্থানকেই অনুমোদন করে। কারণ, মধ্যপ্রাচ্যে ইসরাইলীরাই দখলদার। তাই জেরুজালেমে কোন দখলদার শক্তির রাজধানী বানানো যৌক্তিক নয়। এ বিষয়ে বিশ^ জনমতও ইসলাইল ও মার্কিন অস্থানের পুরোপুরি বিপক্ষে। কিন্তু বিশ^জনমতকে অগ্রাহ্য করে জেরুজালেমকে ইসরাইলের রাজধানী হিসেবে স্বীকৃতি দিয়েছেন যুক্তরাষ্ট্রের প্রেসিডেন্ট ডোনাল্ড ট্রাম্প। যা মধ্যপ্রাচ্য পরিস্থিতিতে আরও অগ্নিগর্ভ করে তুলেছে। ডোনাল্ড ট্রাম্পের এমন ঘোষণার পর রাজপথে নেমেছে হাজারো ফিলিস্তিনি। এতে শান্তি প্রতিষ্ঠার প্রক্রিয়াও বাধাগ্রস্থ হওয়ার শঙ্কা দেখা দিয়েছে।
বার্তা সংস্থা রয়টার্সের প্রতিবেদনে বলা হয়, কয়েক দশকের মার্কিন নীতি পাল্টে জেরুজালেমকে ইসরাইলের রাজধানী হিসেবে স্বীকৃতি দিলেন ট্রাম্প। বক্তব্য দেয়ার সময় তার সঙ্গে উপস্থিত ছিলেন ভাইস প্রেসিডেন্ট মাইক পেন্স। ট্রাম্প বলেন, যুক্তরাষ্ট্রের স্বার্থ এবং ইসরাইল ও ফিলিস্তিনিদের মধ্যে শান্তি প্রতিষ্ঠার কথা মাথায় রেখেই এ সিদ্ধান্ত নিয়েছেন তিনি। ট্রাম্প দা্বি করেন, এটাই সঠিক সিদ্ধান্ত। আর এটা বাস্তবতার স্বীকৃতি দেয়া বৈ কিছুই না। সকল পক্ষকে তিনি জেরুজালেমের পবিত্র ভূমিতে স্ট্যাটাস কো বজায় রাখার আহ্বান জানান। যা বিগত ৭০ বছরের মার্কিন প্রশাসনের জেরুজালেম নীতির সুষ্পষ্ট লঙ্ঘন।
মার্কিন প্রেসিডেন্টের এমন নেতিবাচক ঘোষণার প্রতিক্রিয়ায় ফিলিস্তিনি এক কূটনীতিক বলেন, মার্কিন প্রেসিডেন্টের এ সিদ্ধান্ত মধ্যপ্রাচ্যে যুদ্ধ ঘোষণার সামিল। হামাস বলেছে, ট্রাম্পের সিদ্ধান্তে নরকের দরজা খুলে দেবে। দলটির এক মুখপাত্র বলেন, ‘এতে করে এ বাস্তবতা পাল্টাবেনা যে জেরুজালেম আরব মুসলিমদের ভূখন্ড। উল্লেখ্য, ট্রাম্পের এ সিদ্ধান্তের বিরোধীতা করে আগে থেকেই সতর্কবার্তা দিয়েছিলেন অনেক বিশ্বনেতা।
ফিলিস্তিনি কর্তৃপক্ষের প্রেসিডেন্ট মাহমুদ আব্বাসের মুখপাত্র ট্রাম্পকে সতর্ক করে বলেছিলেন, তার এই পদক্ষেপে অঞ্চলটিতে ভয়াবহ পরিণতি ডেকে আনবে। ইরানের সর্বোচ্চ নেতা আয়াতুল্লাহ খোমেনি বলেছিলেন, যুক্তরাষ্ট্রের এ সিদ্ধান্তের কারণ হলো তাদের অযোগ্যতা ও ব্যর্থতা। আর সিরিয়ার পররাষ্ট্রমন্ত্রী এক বিবৃতিতে বলেন, এই পদক্ষেপ হলো ফিলিস্তিনকে জবরদখল করা এবং ফিলিস্তিনি জনগণকে উৎখাত করার অপরাধের চুড়ান্ত অধ্যায়। পোপ ফ্রান্সিসও সতর্ক করে বলেন, জেরুজালেমের আল আকসা মসজিদে বিদ্যমান স্ট্যাটাস কো’র প্রতি সম্মান প্রদর্শন করা উচিত। কিন্তু, ট্রাম্প সেসব গায়ে মাখেন নি।
বিশ^জনমতকে উপেক্ষা করে জেরুজালেম বিষয়ে মার্কিন প্রেসিডেন্টের ঘোষণা জাতিসংঘেও প্রত্যাখ্যাত হয়েছে। এমনকি সদস্য রাষ্ট্রেগুলোকে হুমকী দিয়ে মার্কিন যুক্তরাষ্ট্র ভোটাভুটির ফলাফলটা নিজের পক্ষে আনতে পারেন নি। ফলে মার্কিন প্রেসিডেন্ট ডোনাল্ড ট্রাম্পের হুমকি উপেক্ষা করে জাতিসংঘের সাধারণ পরিষদে জেরুজালেম প্রস্তাব পাস হয়েছে সম্প্রতি। ফিলিস্তিনের বায়তুল মুকাদ্দাস ইস্যুতে আমেরিকার সিদ্ধান্তের বিরুদ্ধে জাতিসংঘ সাধারণ পরিষদে প্রায় সর্বসম্মতভাবে এ প্রস্তাব পাস হয়। গত ৬ ডিসেম্বর বায়তুল মুকাদ্দাসকে ইহুদিবাদী ইসরাইলের রাজধানী হিসেবে স্বীকৃতি দিয়ে মার্কিন প্রেসিডেন্ট ডোনাল্ড ট্রাম্প যে ঘোষণা দিয়েছিলেন তা বাতিল করার আহ্বান জানানো হয়েছে এ প্রস্তাবে।
গত ২১ ডিসেম্বর ভোটাভুটিতে অধিকাংশ সদস্য দেশ প্রস্তাবের পক্ষে ভোট দেয়। যদিও এর আগে প্রেসিডেন্ট ট্রাম্প হুমকি দিয়েছিলেন যারা প্রস্তাবের পক্ষে ভোট দেবে তাদের মার্কিন সহায়তায় কাটছাঁট করা হবে। জানা যায়, প্রস্তাবের পক্ষে ভোট পড়ে ১২৮টি এবং বিপক্ষে মাত্র ৯টি পড়ে। ৩৫টি দেশ ভোটদানে বিরত থাকে। আরব এবং মুসলিম দেশগুলোর অনুরোধে সাধারণ পরিষদের জরুরি অধিবেশন বসে। জাতিসংঘের ১৯৩টি সদস্য দেশ রয়েছে। এর আগে ১৮ ডিসেম্বর নিরাপত্তা পরিষদের (স্থায়ী-৫ ও অস্থায়ী-১০টি রাষ্ট্র) ভোটেও সবাই মিসরের জেরুজালেম প্রস্তাবের পক্ষে ভোট দেয়, কেবল যুক্তরাষ্ট্র ছাড়া। গৃহীত প্রস্তাবে যুক্তরাষ্ট্রের নাম উল্লেখ না করে জেরুজালেমকে ইসরাইলের রাজধানী ঘোষণা দেওয়ার নিন্দা জানানো হয়।
কুটনৈতিক বিশ্লেষকরা বলছেন, গৃহীত ভোটাভুটির ফলাফলের মাধ্যমে ফিলিস্তিন জেরুজালেম ইস্যুতে আন্তর্জাতিক বৈধতা পেল। যদিও প্রস্তাবটি পাস হওয়ায় ফিলিস্তিন আইনগতভাবে কোনো সুবিধা পাবে না। কিন্তু যুক্তরাষ্ট্রের স্বীকৃতি যে ভ্রান্তনীতির ফল ও আন্তর্জাতিক আইনের লঙ্ঘন সাধারণ পরিষদের ভোটে তা প্রমাণিত হলো। কারণ, গৃহীত প্রস্তাবে উল্লেখ করা হয়েছে, ইসরাইল পূর্ব জেরুজালেম দখল করতে পারে না, সেখানে নিজেদের জনগণ নিয়ে আসতে পারে না বা বসতি গড়তে পারে না। এরপরও যদি মার্কিন যুক্তরাষ্ট্র ও দখলদার ইসরাইল জেরুজালের নীতির পরিবর্তন না করে তাহলে তা কোন পক্ষের জন্যই সুফল বয়ে আনবে না।
বিষয়: বিবিধ
৯৫৬ বার পঠিত, ০ টি মন্তব্য
পাঠকের মন্তব্য:
মন্তব্য করতে লগইন করুন