নবাব বেগম মহীয়সী লুৎফুন্নিসা

লিখেছেন লিখেছেন সৈয়দ মাসুদ ৩০ নভেম্বর, ২০১৭, ১০:১৯:৫১ রাত



কোন ব্যক্তির ইতিহাস খ্যাত হয়ে ওঠার ক্ষেত্রে পাশে থেকে প্রেরণা ও উদ্বুদ্ধকরণের প্রয়োজন হয়। ইতিহাস বিখ্যাত ব্যক্তিদের জীবনী পর্যালোচনা করলে এমনটিই স্পষ্ট হয়ে ওঠে। ইতিহাসের মহানায়ক শহীদ সিরাজউদ্দৌলার ক্ষেত্রেও তার ব্যত্যয় ঘটেনি। অতিঅল্প সময়ের শাসনামলে বাংলার শেষ স্বাধীন নবাব সিরাজউদ্দৌলাকে অনেক বাধা-প্রতিবন্ধকতার মোকাবেলা করতে হয়েছে। তিনি ছিলেন ৪ টি যুদ্ধের সফল অধিনায়ক। মাত্র ১ টি যুদ্ধ নামের প্রহসনে তিনি হেরে গিয়ে নির্মম পরিণতির শিকার হন এবং তাকে শাহাদাতকে আলিঙ্গন করতে হয়েছে।

পলাশীর পরাজয়ে দেশের নিয়ন্ত্রণভার চলে যায় ইষ্ট ইন্ডিয়া কোম্পানীর হাতে। মীর জাফর ও তার উত্তরসূরীরা পুতুল নবাবে পরিণত হন। নবাব আলীবর্দী খানের বৈমাত্রেয় বোন শাহ খানমের গর্ভজাত এবং মীরজাফরের ঔরসজাত সন্তান মীর সাদেক আলী খান মীরনকে ইংরেজরা গভীর অরণ্যে হত্যা করে বজ্রপাতে মৃত্যু হয়েছে বলে অপপ্রচার চালায়। ফলে সুবে বাংলায় শুরু হয়-বাঈজী বংশের শাসন। মীরজাফরের ঔরসজাত এবং বাঈজী মুন্নী বাঈর গর্ভজাত নজমউদ্দৌলা (১৭৬৫-৬৬ খ্রিঃ)-কে কোম্পানী বাংলার নবাব বানায়। বাঈজী বংশের দ্বিতীয় নবাব হন মুন্নী বাঈর অপর সন্তান সাইফউদ্দৌলা। বাঈজী বাবু বাঈও ভাগ্যবতী রমণী ছিলেন। সুবে বাংলায় পরবর্তী নবাব হন বাবু বাঈর গর্ভজাত সন্তান মোবারক উদ্দৌলা (১৭৭১-৯৩)। পরবর্তীতে তারই পুত্র ও পৌত্রগণ ধারাবাহিকভাবে বাংলার পুতুল নবাব হন।

সিরাজুদ্দৌলার পতন ও শাহাদাত এবং ইষ্ট ইন্ডিয়া কোম্পানীর দয়া দাক্ষিণ্য ও করুণায় বিশ^াসঘাতক মীর জাফরের সিংহাসন আরোহণের মধ্য দিয়ে স্বাধীন নবাবী শাসনের অবসান ঘটে। নবাবী নিমন্ত্রণ নিয়ে নেয় বিদেশী শাসকচক্র। তাই স্যার যদুনাথ সরকার যথার্থই বলেন-`Thusended muslim rule in bengla, the forign master of the sward had became its king maker.’

আগেই উল্লেখ করেছি যে, অতি অল্প সময়ের শাসনামলে নবাব সিরাজউদ্দৌলাহকে নানা প্রতিকুলতার মোকাবেলা করতে হয়েছে। আর তাকে পাশে থেকে সার্বিক সহযোগিতা ও উৎসাহ-উদ্দীপনা দিয়ে সফল ও সার্থক করে তুলেছিলেন বাংলার সকল মানুষের কাছে ‘বেগম আম্মা’ খ্যাত লুৎফুন্নিসা বেগম। তিনি সুখে-দুঃখে সব সময়ই নবাবের সব সময়ই সঙ্গিনী ছিলেন। পলাশীর পরাজয়ের পর নিকটজনরা যখন নবাবের ওপর থেকে মুখ ফিরিয়ে নিয়েছিলেন, এই সংকটময় সন্ধিক্ষণেও এই বিদুষী ও মহীয়সী রমনী নবাবকে ত্যাগ করেন নি বরং হীরাঝিল প্রাসাদ ত্যাগ করে রাতের অন্ধকারে নবাবের অনুগামী হয়েছিলেন। যা ইতিহাসে তাকে অম্লান, অমর ও মৃত্যুঞ্জয়ী করে রেখেছে।

বেগম লুৎফুন্নিসা ছিলেন অনন্য বৈশিষ্ট ও আকর্ষণীয় ব্যক্তিত্বের অধিকারিনী। সিরাজের স্বপ্নের বাগিচা ‘হীরাঝিল’-এর নাম করণ করেছিলেন তারই প্রিয়তমা স্ত্রী বেগম লুৎফুন্নিসা। সিরাজউদ্দৌলার অনেক দিনের সাধ ছিলো দৃষ্টি নন্দন একটি মহল দাঁড় করাবেন বাংলায়। তার সেই স্বপ্ন রঙে আঁকা প্রাসাদটির নাম রাখতে চেয়েছিলেন স্ত্রী লুৎফার নামে। লুৎফুন্নিসার বাধাতে সেটি সম্ভব হয়নি। লুৎফুন্নিসা বলেছিলেন, “আমি ঝিল হতে চাই না। আমি নির্জলা লুৎফা থাকতে চাই। ...... আমি চাই না, তুমি আর আমি লুৎফা ঝিলের মাঝে বেঁচে থাকি। তার চেয়ে তুমি এমন একজন নওয়াব হও, যাতে তোমাকে কেউ কোনদিন না ভুলে। তুমি যদি সেভাবে অমর হও, তাহলে আমিতো তোমার সঙ্গেই বেঁচে থাকবো প্রতি যুগে। আমি যে তোমার প্রাণের আধখানা।”

আসলে নওয়াব সিরাজরে চরিত্রের ওপর লুৎফা বেগমের বিরাট প্রভাব পড়েছিল। সিংহাসনে আরোহনের পর থেকেই সিরাজউদ্দৌলা যে সব সমস্যার সম্মুখীন হন তার মোকাবেলার জন্য দৃঢ় এবং শক্তিশালী পদক্ষেপ নেবার পিছনে তার চরিত্রিক বৈশিষ্টের পরিচয় পাওয়া যায়। লুৎফুন্নিসা খোশবাগে সিরাজের কবরের কাছে একখানি কুঁড়েঘর তৈরি করে বাকি জীবনটা সেখানেই কাটিয়ে দেন। কতবড় বিদূষী ও মহিয়সী নারী,জীবনের সব লোভ ও আয়েশ পরিত্যাগ করে তিনি জীবনের বেশিরভাগ সময়টি প্রাণাধিক প্রিয় স্বামী সিরাজউদ্দৌলার ধ্যানে কাটিয়ে দেন। তিনি মাসিক যে মাসোহারা পেতেন তা দিয়ে প্রতিদিন কাঙালিভোজের ব্যবস্থা করতেন। বেগম লুৎফুন্নিসার একনিষ্ঠ প্রেম ভালবাসা ও ত্যাগ বাংলাদেশের ইতিহাসে সর্বকালে সমুজ্জ্বল হয়ে থাকবে।

তিনি নবাব ও তার পরিবারের করুণ পরিণতিরও প্রত্যক্ষদর্শী। ঘাতকরা নবাবকে নির্মম ও নিষ্ঠুরভাবে শহীদ করেই ক্ষান্ত হয়নি বরং তার মৃতদেহের ওপর চালানো হয় পৈশাচিক নির্মমতা। নবাবের লাশকে খন্ড-বিখন্ড করে ফেলা হয় এবং গোটা মুর্শিদাবাদ শহর ঘুরে ফেলানো হয় ময়লার স্তুপে। সে সময় নবাব বেগমের আহাজারী-আর্তনাদ করা ছাড়া আর কিছুই ছিল না। ফলে এই মহিয়সী রমনীর মনে প্রতিশোধ পৃহা জাগ্রত হওয়া খুবই স্বাভাবিক ছিল। হয়েছিলও তাই। ঞড়ঢ়ড়মৎধঢ়যু ড়ভ উধপপধ গ্রন্থের গ্রন্থকার জেমস টেলর উল্লেখ করেছেন, স্বামী ও অন্যান্য আত্মীয়-স্বজনদের হত্যার প্রতিশোধ নেওয়ার জন্য লুৎফুন্নিসা বেগম প্রথম দিকে গোপনে শক্তি সঞ্চয়ে ব্রতী হয়েছিলেন। তিনি আবদ হাদী খান নামের শক্তিমান রাজপুরুষের মাধ্যমে মীর জাফরকে মসনদ থেকে সরিয়ে বাংলার স্বাধীনতা রক্ষা ও জনসাধারণের দুর্দশা মোচনের চেষ্টা করেছিলেন। কিন্তু মীর জাফর গুপ্তচর মারফত ঐ সংবাদ জানতে পারলে লুৎফুন্নিসা বেগমের সকল সু-নিপুণ প্রচেষ্টা ব্যর্থতায় পর্যবসিত হয়। একজন বিপর্যস্ত রমনীর পক্ষে এমন সাহসী উদ্যোগ ইতিহাসে তাকে বীরঙ্গনা হিসেবে স্বীকৃতি দেয়।

১৭৩৪ সালের ১৯ সেপ্টেম্বর জন্মগ্রহণ করেন ইতিহাসখ্যাত এই মহীয়সী রমণী। লুৎফুন্নিসা যৌবনের শুরু থেকে সিরাজের মৃত্যু পর্যন্ত তাঁর সুখে-দুঃখে ছায়ার ন্যায় তাঁর পাশে ছিলেন। এমনকি সিরাজের মৃত্যুর পরেও, যে দীর্ঘদিন তিনি বেঁচে ছিলেন এই সময়ে তিনি তাঁর প্রিয়তম সিরাজের কবরের পরিচর্যা করে কাটিয়েছেন। জন্মের অল্প কয়েক বছরের মধ্যেই তিনি ধীর, স্থির ও মৃদু স্বভাব সম্পন্না ও সুন্দরী হিসেবে সকলের প্রিয়-পাত্রী হয়ে ওঠেন। তাঁর সৌন্দর্যে মুগ্ধ হয়ে সিরাজ তাঁকে ভালোবেসে ফেলেন। লুৎফুন্নিসার প্রণয়-মিশ্রিত সম্ভাষণ, স্নেহপূর্ণ তিরস্কার ও ভালবাসার গভীরতা ও আন্তরিকতা দেখে পারিবারিক সম্মতি নিয়ে সিরাজ তাঁকে স্ত্রীর মর্যাদা দিতে বিন্দুমাত্র কার্পণ্য করেন নাই।

উল্লেখ্য, ১১৫৯ হিজরীতে (ইংরেজি ১৭৪৫) সিরাজউদ্দৌলা ও ইকরামউদ্দৌলার একই দিনে পৃথক সময়ে বিয়ে হয়। কিন্তু ইকরাম উদ্দৌলার বিয়ে আগে সম্পন্ন হয়। সিয়ারুল মুতাখখারিনের ১৯ পৃষ্ঠায় উল্লেখ আছে যে, আতাউল্লাহ খানের প্রথম কন্যার সাথে সিরাজউদ্দৌলার বিয়ে স্থির করা ছিল। কিন্তু উক্ত কন্যার অকাল মৃত্যু হলে তখন ইরাজ খানের কন্যার সাথে সিরাজের বিয়ের কথা পাকাপোক্ত হয় এবং আতাউল্লাহ খানের দ্বিতীয় কন্যার সাথে ইকরামউদ্দৌলার বিয়ে ঠিক হয়। কিন্তু আতাউল্লাহ খানের স্ত্রীর পিড়াপীড়িতে তাঁর কন্যার বিয়ে প্রথমেই সম্পন্ন করতে হয়। তাই সিরাজের ভাই ইকরামউদ্দৌলার বিয়ে তাঁর আপন ফুপু ফয়জুন্নিসা ওরফে রাবেয়া বেগম ও আতাউল্লাহ খানের ছোটকন্যার সাথে এবং সিরাজের বিয়ে হয় সম্ভ্রান্ত বংশীয় ইরাজ খানের কন্যা লুৎফুন্নিসার সাথে।

লুৎফুন্নিসা সর্বদা শরফুন্নিসা বেগম, আমিনা বেগম ও স্বামীর একান্ত অনুগতা ছিলেন। শাশুড়ী-স্বামী পরিবার-পরিজন লুৎফুন্নিসাকে বিশেষ স্নেহ ও সম্মানের দৃষ্টিতে দেখতেন। তিনি সহৃদয়তা ও দয়ার উজ্জ্বল প্রতীক হিসেবে ইতিহাস পাঠকের নিকট চির স্মরণীয় হয়ে থাকবেন। এ প্রসঙ্গে একটি ঘটনার উল্লেখ করা যেতে পারে। ইংরেজদের ইস্ট ইন্ডিয়া কোম্পানী দিল্লীর বাদশাহের প্রদত্ত সনদের শর্তাবলী লঙ্ঘন করে উদ্ধত ব্যবহার করলে, নওয়াব ইংরেজদের কাশিম বাজারস্থ কুঠি অধিকার করে নেন। কাশিম বাজারের ইংরেজ প্রতিনিধি ওয়াটস সপরিবারে নওয়াবের হাতে বন্দী হয়। ওয়াটস-পতœী অবস্থা বেগতিক দেখে বেগম লুৎফুন্নিসার শরণাপন্না হন। বেগমের অনুরোধক্রমে সিরাজ জননী আমিনা বেগম ওয়াটসের স্ত্রী ও পুত্র-কন্যাদের হীরাঝিল প্রাসাদে মাসাধিককাল বিশেষ যতœ সহকারে রক্ষা করেন।

ওয়াটস পতœীর করুণ ক্রন্দনে লুৎফুন্নিসার কোমল হৃদয় এমনি বিচলিতা হয়ে ওঠে যে, স্বামীর অসন্তুষ্টির কথা স্মরণ করেও ওয়াটস পরিবারকে সিরাজের অজ্ঞাতসারে চন্দননগরে ফরাসীদের নিকট পাঠিয়ে দেন। কোমলহৃদয়া লুৎফুন্নিসার অনুরোধে নওয়াব শেষ পর্যন্ত ওয়াটসকেও মুক্তি দিতে দেন। অথচ এ নিমকহারাম ওয়াটসই পরবর্তীকালে দেশীয় ষড়যন্ত্রকারী ও ইংরেজদের মধ্যে গোপন যোগাযোগ রক্ষা করতো।

শত্রু পক্ষ থেকে বাংলার মসনদ পুনরুদ্ধার করার জন্য মুর্শিদাবাদ ছেড়ে আজীমাবাদ যাবার সময়েও নবাব সিরাজউদ্দৌলার সঙ্গে ছিলেন চিরসাথী প্রিয়তমা বেগম লুৎফুন্নিসা ও শিশুকন্যা উম্মে জোহরা। পথিমধ্যে তিনি মীর জাফরের লোকজনদের হাতে আটক হন। নবাবকে হাতকড়া পড়িয়ে সড়ক পথে মুরশিদাবাদে আনা হয়। রাস্তার দু’ধারে দাঁড়িয়ে উৎসুক জনতা নবাবের এই করুণ পরিণতি প্রত্যক্ষ করেছিলেন। পেছনেই ছিলেন অসহায় লুৎফুন্নিসা ও শিশুকন্য উম্মে জোহরা। তাকে স্ত্রী কণ্যা থেকে আলাদা করে মীর জাফরের জাফরগঞ্জ প্রাসাদে এনে একটি নির্জন কক্ষে রাখা হয়। ২ জুলাই গভীর রাতে আঘাতের পর আঘাত হেনে ষড়যন্ত্রকারীরা হত্যা করে বাংলার শেষ স্বাধীন নওয়াব সিরাজউদ্দৌলাকে।

মীরণ সিরাজের আপনজনদের অনেককেই হত্যা করেও চুপ থাকলেন না। তিনি নিহত নবাবের বিধবা বেগম ধর্মপরায়ণা লুৎফুন্নিসাকে বিয়ে করতে প্রস্তাব দিলেন। একথা শুনে লুৎফুন্নিসা সদম্ভে বলেছিলেন, “যে নারী চিরকাল হাতীর পিঠে চড়ে অভ্যস্ত, সে কি কখনও গাধার পিঠে চড়তে চাইবে”? নবাব আলিবর্দী খানের পরিবারের সকল মহিলাসহ লুৎফুন্নিসাকে মীরণ ঢাকায় পাঠিয়ে দিলেন। ঢাকার নায়েবে নাজিম জসরত খান তাদের বুড়িগঙ্গার ওপারে জিঞ্জিরা প্রাসাদে বন্দী করে রাখেন। এই সম্মানিত বেগমগণের মধ্যে ছিলেন আলিবর্দী খানের বেগম শরফুন্নিসা, সিরাজ-মাতা আমিনা বেগম, কন্যা উম্মে জোহরা সহ অন্যান্য পুরনারীগণ।

বন্দী অবস্থায় সম্মানিত সিরাজ পরিবারের উপরোক্ত নারীদের ওপর শারীরিক ও মানসিকভাবে নির্যাতন করা হত। কোন কোন দিন খাওয়া ও পানি পান করা থেকে বঞ্চিত করা হত। শরীরের কিছু অংশে ছুড়ে ফেলা হত গরম পানি। সকলকে রাখা হত ভয় ভীতি আতঙ্কের মধ্যে। এরই মধ্যে দুঃখ কষ্টের মধ্যে ইবাদত-বন্দেগী করে তাঁদের এই সুদীর্ঘ সময় কাটতে থাকল এই জিঞ্জিরা প্রাসাদেই; বিনা দোষে বন্দিনীর মত জীবনযাপন করে। ১৭৬৬ সালে অনেক আবেদন নিবেদনের পর ইংরেজ কর্তৃপক্ষ লুৎফাসহ পর্যায়ক্রমে একই পরিবারের সকলকে মুর্শিদাবাদে নিয়ে যান এবং খোশবাগে বসবাসের ব্যবস্থা করেন। সিরাজ বেগম ও দুহিতার ব্যয় নির্বাহের জন্য নির্দিষ্ট একটি মাসিক ভাতাও বরাদ্দ করা হয়।

সব ঐতিহাসিক নওয়াব সিরাজের প্রিয়তমা স্ত্রী লুৎফুন্নিসাকে মর্যাদার আসন দিয়ে এসেছেন এবং বাংলার জনগণও তাকে সব সময়ে সম্মান দেখিয়ে আসছে। সিরাজের মৃত্যুর পর ঢাকার জিঞ্জিরা প্রাসাদের বন্দিজীবন শেষে ইংরেজরা লুৎফাকে মুর্শিদাবাদে আনয়ন করে নবাব আলিবর্দী ও সিরাজের সমাধি খোশবাগের তত্ত্বাবধানের দায়িত্ব দেয়। লুৎফুন্নিসা বেগম আজীবন কন্যা সহ খোশবাগে অবস্থান করে রোজ সন্ধ্যায় আলিবর্দী খান ও সিরাজের মাজারে মোমবাতি, আগরবাতি জ্বালিয়ে কোরআন পাঠ করতেন। সিরাজ শহীদ হওয়ার পর লুৎফুন্নিসা বেগম আরো ৩০ বছর জীবিত ছিলেন এবং প্রতিদিনই স্বামীর কবরে গিয়ে কান্নাকাটি করতেন। স্বামীর কবরে মাথা রেখে অশ্রু বিসর্জন করতে করতেই একদিন মৃত্যুর কোলে ঢলে পড়েন।

মূলত লুৎফুন্নিসা বেগমকে নানাবিধ প্রতিকুলতা অতিক্রম করেই জীবন যাপন করছে হয়। তাকে আত্মসম্মান ও সম্ভ্রম রক্ষায় প্রতিনিয়ত বৈরি পরিস্থিতির সাথে মোকাবেলা করতে হয়েছে। একবার লম্পট মীরণ বেগম মহলের ঐশ্বর্যের লোভ দেখিয়ে লুৎফুন্নিসাকে পরিণয়ের প্রস্তাব পাঠায়। লুৎফুন্নিসা এ প্রস্তাবের উত্তর অতি ঘৃণাভরে প্রত্যাখ্যানই শুধু করেননি, তাকে গাধা অপেক্ষাও নিকৃষ্ট প্রাণীর সঙ্গে তুলনা করেছিলেন। এ মীরণের পশু প্রবৃত্তি এমনি বৃদ্ধি পেয়েছিলো যে, সে বেগম লুৎফুন্নিসার সম্ভ্রমহানীর চেষ্টা করে। কিন্তু ওয়াটসের বাধার কারণে তা সম্ভব হয়নি। উল্লেখ্য যে, সিরাজের নওয়াবী আমলে বেগম লুৎফুন্নিসা ওয়াটসসহ তার পরিবার-পরিজনকে প্রাণ ভিক্ষা দিয়েছিলেন। তাই ওয়াটস লুৎফুন্নিসা বেগমের শ্লীলতাহানির চেষ্টাকে ব্যর্থ করে দেয়।

মীর জাফর ও ইস্ট ইন্ডিয়া কোম্পানী নবাব ও তার নিকটাত্মীয়দের হত্যা করেই ক্ষান্ত হয়নি বরং নবাব পরিবারের মহিলাদের সাথেও অমানবিক আচরণ করেছে। নবাব সিরাজুদ্দৌলার সহধর্মিণী বেগম লুৎফুন্নেসাকে তার ও পরিবারবর্গের ব্যক্তিগত ধনসম্পদ, টাকা-পয়সাও ফেরত দেয়া হয়নি। বেগম লুৎফুন্নেছা তাঁর নিজের এবং একমাত্র কন্যা সন্তান উম্মে জোহরার ভরণপোষণের জন্য নিজ ধনসম্পদ ফেরত চাইলেও তা তাকে দেয়া হয়নি। খোশবাগের শাহী কবরস্থানের মোতাওয়ালী হিসাবে তিনি তিনশ পাঁচ টাকা ভাতায় কবর পরিচর্যার দায়িত্বভার গ্রহণ করেন। অষ্টাদশ শতাব্দীতে বঙ্গীয় এক মুসলিম নারী যে উন্নত নৈতিকতা ও ধর্মীয় মূল্যবোধের পরিচয় দিয়েছিলেন তা প্রশংসনীয়।

বেগম লুৎফুন্নিসা বেতন ও বৃত্তি বাবদ যে অর্থ পেতেন তার অতি সামান্য ভরণ-পোষণের জন্য রেখে প্রতিবেশী দীন-দুঃখী নর-নারী ও অভাবগ্রস্থ আলেম-উলামাদের মধ্যে বিলিয়ে দিতেন। লুৎফুন্নিসা সকাল ও সন্ধ্যায় স্বামীর কবরের পার্শ্বে বসে বোরখাবৃত হয়ে পবিত্র কোরআন তেলাওয়াত করতেন। প্রায় সারা বছরই রোযা রাখতেন তিনি। তাঁর চারিত্রিক বৈশিষ্ট্য ও ব্যবহার ছিলো অতীব মধুর। হিন্দু ও মুসলমান নর-নারীগণ তাঁকে সমানভাবে শ্রদ্ধা জানাতো এবং তারা তাকে ‘বেগম আম্মা’ বলে সম্বোধন করতো। জনসাধারণ বিভিন্ন ধর্মীয় উৎসবাদিতে খোশবাগে ‘বেগম আম্মার’ সাক্ষাতের জন্য অপেক্ষা করতো। দূর-দূরান্ত হতে বহু হতাশ রোগী খোশবাগে হাযির হতো বেগম আম্মার দোয়ার জন্য। যা সাধারণ মানুষের তার প্রতি অগাধ শ্রদ্ধাবোধের পরিচয় বহন করে।

বেগম লুৎফুন্নিসা জীবনের শেষ দিকে কারো সঙ্গে বিশেষ কোনো প্রকার আলাপ করতেন না। সর্বদা তাঁর দু'চোখ দিয়ে অশ্রু গড়িয়ে পড়তো। ইন্তিকালের পূর্বে ‘বেগম আম্মা’ তার স্বামী হত্যাকারি ও বিশ্বাসঘাতকদের অতি লাঞ্ছনাকর ও হৃদয়-বিদারক মৃত্যু দেখে গিয়েছেন। মীরণের অত্যাচারে শরফুন্নিসা বেগম, আমিনা বেগম ও বেগম লুৎফুন্নিসা অতি দুর্ভোগের সঙ্গে জীবন যাপন করে দীনাবস্থায় মৃত্যুবরণ করতে বাধ্য হন। প্রকৃতির নির্মম প্রতিশোধে ৩ বছর পূর্বে মীরণ সিরাজকে যে বয়সে যে তারিখে হত্যা করেছিলো মীরণও সেই তারিখেই ইংরেজ প্রভূ কর্তৃক নির্মম হত্যাকান্ডের শিকার হন।

ষড়যন্ত্রকারীরা নবাবের পুত-পবিত্র চরিত্রে কালিমা লেপন করলেও লুৎফুন্নিসার বিরুদ্ধে তা করতে পারেনি। তারা নবাবের সাথে আলেয়া নামীয়া এক কথিত বাঈজীর অনৈতিক সম্পর্ক কল্পকাহিনী প্রচার করেছিল। কিন্তু নিরপেক্ষ পর্যালোচনায় আলেয়া চরিত্রটি নাটকের চরিত্র। এর সাথে বাস্তবতার কোন সম্পর্ক নেই। মূলত ঐতিহাসিকদের প্রায় সকলেই নবাব জায়ার প্রশংসায় পঞ্চমুখ ছিলেন। কিন্তু ষড়যন্ত্রকারীদের ষড়যন্ত্র তার পিছু ছাড়েনি এবং এখনও সে ষড়যন্ত্র অব্যাহত আছে। তারা নবাব বেগমকে হিন্দু গৃহপরিচারিকা হিসেব অপপ্রচার চালিয়ে আসছে। যার সাথে ঐতিহাসিক কোন সত্যতা নেই। ষড়যন্ত্রকারীরা তার বিরুদ্ধে এমন অবপবাদ দিলেও তার বংশ পরিচয় উল্লেখ করতে পারেনি। তাই একথা নিশ্চিত যে, তিনি কখনোই হিন্দু বা গৃহ পরিচারিকা ছিলেন না বরং তিনি সম্ভান্ত্র বংশীয় ইরাজ খানের কন্যা এবং ইরান খানের বোন।

নবাব সিরাজের শাহাদাতের পরও দীর্ঘদিন জীবিত ছিলেন ‘বেগম আম্মা’ খ্যাত এই মহিয়সী নারী। নবাবের শাহাদাতের পর তিনি লম্পট মীর জাফর ও মীরনের হারেমে যেতে অস্বীকার করলে তাকে তার কন্যাসহ নবাব পরিবারের সম্মানিতা মহিলাদের ঢাকার জিঞ্জিরা প্রাসাদের নির্বাসনে পাঠানো হয়। সেখানে দীর্ঘ আট বছর তাদের অনেক দুঃখ-দুর্দশার মধ্যে দিন কেটেছে। শারিরীক ও মানসিক নির্যাতনেরও শিকার হয়েছেন তারা। অনেক সময় অনাহারে-অর্ধহারেও থাকতে হয়েছে জিঞ্জিরার বন্দীশালায়। চরম বৈরি পরিস্থিতির মধ্যেই ইবাদাত-বন্দেগীর মাধ্যেই সময় কেটেছে ইতিহাসের এই কিংবদন্তী মহিয়সীর। তার আবেদনের প্রেক্ষিতেই ১৭৬৬ সালে তাকে সহ সকলকেই মুর্শিদাবাদে থাকার অনুমতি দেয় কোম্পানী সরকার।

তিনি খোশবাগের শাহী কবরখানার অভ্যন্তরে একটি ঝুপড়ি ঘর তুলে স্বামীর কবরের পরিচর্যার, ইবাদাত-বন্দেগী, সিয়াম পালন, তাসবীহ-তাহলীল ও পবিত্র কুরআন তিলাওয়ারের মাধ্যমে সময় অতিবাহিত করতেন। অবসরে খোশবাগের শাহী বাগানে গোলাপের পাঁপড়ীগুলোর সাথে নিবির সখ্যতা গড়ে তুলে প্রিয়তমকে অনুভব করতেন। রোমন্থন করতেন হিরাঝিল প্রাসাদের হারিয়ে যাওয়া সুখস্মৃতিগুলো। আর সিরাজের সাথে তার আনন্দঘন স্মৃতি, প্রেম-প্রণয়-ভালবাসা, রাগ-অনুরাগের কথা স্মরণে তার গন্ড বেয়ে ফোঁটায় ফোঁটায় অশ্রুধারা গড়িয়ে পড়তো। কে জানতো ১৭৮৬ সালে ১০ নভেম্বরই হবে তার জীবনের শেষ দিন। তার শেষ ইচ্ছানুযায়ি শায়িত হয়েছেন স্বামীর পদপাশে। আজো দেশী বিদেশী দর্শকেরা পতিপ্রাণা লুৎফুন্নিসা বেগমের কবরের পার্শ্বে দাঁড়িয়ে অশ্রুরুদ্ধ কন্ঠে পরম কারুনাময়ের কাছে তাঁর আত্মার মাগফেরাত কামনা করেন। তাইতো ‘বেগম আম্মা’ সকল নারীর অনুকরণীয় ও অনুসরণীয় আদর্শ।

বিষয়: বিবিধ

৮৯২ বার পঠিত, ০ টি মন্তব্য


 

পাঠকের মন্তব্য:

মন্তব্য করতে লগইন করুন




Upload Image

Upload File