অর্থপাচারের মহোৎসব ও আমাদের গন্তব্য
লিখেছেন লিখেছেন সৈয়দ মাসুদ ২৭ জুন, ২০১৬, ০২:৫৯:২৮ দুপুর
রাষ্ট্রের কার্যাবলী সম্পর্কে অধ্যাপক উইলোবী ( Willoughby) বলেন, ( It is admitted by all that the state should possess powers sufficiently extensive for the maintenance of its own continued existence against foreign interference, to provide the means whereby its national life may be preserved and developed and to maintain internal order including the protection of life, liberty and property.)
অর্থাৎ এটি সর্বজন স্বীকৃত যে, রাষ্ট্রের আয়ত্বে প্রচুর ক্ষমতা থাকা উচিত, যার দ্বারা রাষ্ট্র বৈদেশিক হস্তক্ষেপ প্রতিহত করে স্বীয় অস্তিত্ব বজায় রাখতে পারে, জাতীয় জীবনের সংরক্ষণ ও বৃদ্ধি করার সুযোগ দিতে পারে এবং জীবন, স্বাধীনতা ও সম্পতি রক্ষাসহ অভ্যন্তরীণ শৃঙ্খলা বিধান করতে পারে।
আমাদের দেশের প্রেক্ষাপটে রাষ্ট্র বোধহয় ক্ষেত্র বিশেষেই সাফল্যের পরিচয় দিয়েছে। সরকার রাষ্ট্র ক্ষমতার ব্যবহার করে বিরাজনীতিকরণের ষোলকলা পূর্ণ করতে পেরেছে বলেই আপাত মনে করার যথেষ্ঠ কারণ রয়েছে। রাষ্ট্রক্ষমতা দেশকে বৈদেশিক আক্রমণ থেকে রক্ষা করতে পারেনি বা রক্ষার চেষ্টা করা হচ্ছে না। ভারতের সীমান্তরক্ষীরা প্রতিনিয়ত পাখির মত বাংলাদেশী নাগরিকদের গুলী করে হত্যা করলেও আমাদের দেশের সীমান্তরক্ষীরা শুধুই নিরব দর্শকের ভূমিকা পালন করছে। সরকারের পক্ষেও তেমন প্রতিক্রিয়া দেখা যাচ্ছে না। কয়েকদিন আগে ২জন বাংলাদেশী নাগরিক হত্যা করলো বিএসএফ। কিন্তু উভয় দেশের সিমান্তরক্ষীদের বৈঠকের পর লাশ হস্তান্তরের যে ছবি গণমাধ্যমে প্রকাশিত হয়েছে, তাতে আমাদের লজ্জা রাখার মত কোন জায়গা আছে বলে মনে হয় না। বিজিবি জওয়ানরা হর্ষোৎফুল্ল ও উৎসবের আমেজে বাংলাদেশী নাগরিকের লাশ গ্রহণ করেছেন। যা আত্মসচেতন মানুষের জন্য রীতিমত মর্মপীড়াদায়ক ও আত্মপ্রতারণা বৈ কিছু নয়।
জনগণের জানামালের নিরাপত্তার দায়িত্ব রাষ্ট্রের হলেও সরকারের ভূমিকা এখন রীতিমত প্রশ্নবিদ্ধ। দেশে গুপ্তহত্যা আশঙ্কাজনকভাবে বেড়েছে। কিন্তু সরকার রাজনৈতিক প্রতিপক্ষের ঘাড়ে দোষ চাপিয়ে দায় এড়ানোর চেষ্টা করছে। পুলিশের কর্মকর্তার স্ত্রী মিতু হত্যার পর দায়ভার জঙ্গীদের উপর চাপিয়ে সারাদেশে সাঁরাশি অভিযান চালিয়ে হাওয়ার সাথে যুদ্ধ করে তেমন কোন ফল পাওয়া গেছে বলে মনে হয় না বরং বিরোধী দলীয় নেতাকর্মীসহ সাধারণ মানুষকে গ্রেফতার বিকারগ্রস্থতার পরিচয় দেয়া হয়েছে। এখন ‘হাওয়া থেকে পাওয়া’ খবরে যা জানা যাচ্ছে তাতে ‘ডাল মে কুচ কালা হ্যাঁয়’ বলেই কিছুটা হলেও প্রতীয়মান। তাই সাঁড়াশি অভিযানের যৌক্তিকতা ও সার্থকতা এখন পুরোপুরি প্রশ্নবিদ্ধ।
বিচারবহির্ভূত হত্যাকান্ডও চলছে যুগপৎভাবে। কয়েক দিন আগেই পুলিশি হেফাজতে রিমান্ডে থাকা অবস্থায় ফাহিমকে কথিত ক্রসফায়ারে নির্মম ও নিষ্ঠুরভাবে হত্যা করা হয়েছে। পুলিশ এই ঘটনায় দেশের মানুষকে ‘আষাঢ়ে গল্প’ শুনিয়েছে বলেই প্রতীয়মান। আসামী পুলিশি হেফাজতে থাকা অবস্থায় কীভাবে কথিত বন্দুকযুদ্ধের ঘটনা ঘটলো তা খোদ স্বরাষ্ট্রমন্ত্রী মহোদয় সদুত্তর দিতে পারেন নি। ফলে দেশে আইনের শাসন সম্পূর্ণ অনুপস্থিত একথা মোটামোটি নিশ্চিতভাবেই বলা যায়। আর সে সুযোগই কাজে লাগাচ্ছে সুযোগ সন্ধানীরা। সরকার যেমন দেশের শান্তি-শৃঙ্খলা বিধানে ব্যর্থ হয়েছে, ঠিক তেমনিভাবে রাষ্ট্রীয় সম্পদ রক্ষায় তারা দায়িত্বশীলতা ও যোগ্যতার পরিচয় দিতে পারেনি।
সাম্প্রতিক সময়ে আমাদের দেশের সবচেয়ে বেশী অরক্ষিত সেক্টর হচ্ছে অর্থনৈতিক সেক্টর। মনে হয় দেশের সম্পদ রক্ষায় কারো কোন দায়-দায়িত্ব নেই। যে যেভাবে পারছে একেবারে লুটেপুটে খাচ্ছে রাষ্ট্রীয় সম্পদ। কিন্তু এসব দেখার কেউ নেই। দেশের শেয়ার মার্কেট থেকে লক্ষ কোটি টাকা চুরি হয়ে গেল। এ নিয়ে বর্র্ষীয়ান অর্থমন্ত্রীর কোন মাথাব্যথা নেই। কিন্তু বিনিয়োগকারীরা এর প্রতিবাদ করেই ‘ফটকাবাজ’ অভিধায় অভিহিত হলেন। হলমার্ক কেলেঙ্কারীর মাধ্যমে সোনালী ব্যাংকের হাজার হাজার কোটি টাকা লোপাট করা হলো। কিন্তু অর্থমন্ত্রী তো তাকে তো আমলযোগ্যই মনে করলেন না। বললেন, ৪ হাজার কোটি টাকার দুর্নীতি তেমন কিছু না।
এছাড়াও ডেসটিনি, বিসমিল্লাহ গ্রুপ, বেসিক ব্যাংক, জনতা ব্যাংক, অগ্রণী ব্যাংকের অর্থ কেলেঙ্কারীর এখন পর্যন্ত কোন কুলকিনারা হলো না। সর্বোপরি রাষ্ট্রীয় ব্যাংকের রিজার্ভ চুরির অনেকটাই ধামাচাপার পথে। শোনা যাচ্ছে রিজার্ভ চুরির ঘটনায় বাংলাদেশ ব্যাংকের কিছু কর্মকর্তা নাকি চাকুরী হারাচ্ছেন। আসলে কিছু লোককে চাকুরী থেকে বাদ দিয়েই এ সমস্যার সমাধান খোঁজা হচ্ছে বলে মনে হয়। কিন্তু জনগণের কষ্টার্জিত টাকা উদ্ধারের কোন চেষ্টায় করা হচ্ছে বলে মনে হচ্ছে না। বাস্তবে কি হতে যাচ্ছে তা বলাও বেশ কষ্টসাধ্য। কারণ, রিজার্ভ চুরির পর অনেক গরম গরম ওয়াজ-নসিহত শোনা গেলেও তা ‘বজ্র আঁটুনি, ফসকা গেরো’ হিসাবে প্রমাণিত হয়েছে। কাজের কাজ কিছুই হয়নি বরং অপরাধীদের দায়মুক্তি দেয়ার একটা অশুভ প্রবণতায় দেখা গেছে। যা আমাদের জন্য দুর্ভাগ্যজনকই বলতে হবে।
সম্প্রতি গণমাধ্যমে দেশের অর্থপাচার বিষয়ক সংবাদ প্রকাশিত হয়েছে। বিষয়টি অবগত হওয়ার পর আত্মসচেতন কোন মানুষ স্তম্ভিত না হয়ে পারেন না। প্রাপ্ত তথ্যে জ্ঞাত হওয়া গেছে, গত ১০ বছরে বাংলাদেশ থেকে পাচার হয়েছে ৫ হাজার ৫৮৭ কোটি ৬০ লাখ ডলার। টাকার অঙ্কে যা ৪ লাখ ৪১ হাজার ৪২০ কোটি টাকা। এই অর্থ এবারের বাজেটের চেয়েও ১ লাখ কোটি টাকা বেশি। স্বল্পোন্নত দেশগুলোর (এলডিসি) মধ্যে অর্থ পাচার সবচেয়ে বেশি হয়েছে বাংলাদেশ থেকেই।
এর বাইরে গত দুই অর্থবছরে সুইস ব্যাংকসমূহে বাংলাদেশি নাগরিকদের ব্যাংক হিসাবের সংখ্যা দ্বিগুণ বেড়েছে। এই অর্থও পাচার করা। আবার মালয়েশিয়ায় ‘মাই সেকেন্ড হোম’ কর্মসূচিতে গত ১৩ বছরে ৩ হাজার ৬১ জন বাংলাদেশি অর্থ পাঠিয়েছেন। এ ক্ষেত্রে বাংলাদেশের অবস্থান তৃতীয়। এর চেয়ে বেশি মানুষ গেছে চীন ও জাপান থেকে। এর বাইরে অস্ট্রেলিয়া, কানাডা ও যুক্তরাষ্ট্রে বিনিয়োগ করে নাগরিকত্ব নেওয়ার সুযোগ নিচ্ছেন অসংখ্য বাংলাদেশি।
বাংলাদেশ থেকে টাকা পাচারের এসব তথ্য সমন্বয় করেছে বেসরকারি গবেষণা সংস্থা সেন্টার ফর পলিসি ডায়ালগ (সিপিডি)। সংস্থাটি ‘বাংলাদেশের পরিপ্রেক্ষিতে অবৈধ অর্থ পাচার’ শিরোনামে একটি প্রতিবেদন তৈরি করেছে। প্রতিবেদনে টাকা পাচারের পরিসংখ্যানটি নেওয়া হয়েছে ওয়াশিংটনভিত্তিক গবেষণা প্রতিষ্ঠান গ্লোবাল ফাইন্যান্সিয়াল ইনটিগ্রিটির (জিএফআই) তৈরি করা একটি গবেষণা থেকে। সিপিডি বলছে, বিভিন্ন ধরনের ঘটনা থেকে বোঝা যাচ্ছে বাংলাদেশ থেকে অবৈধভাবে উল্লেখযোগ্য পরিমাণ অর্থ অন্য দেশে পাঠানো হচ্ছে। বর্তমান সময়ে কেবল বাংলাদেশই নয়, সারা বিশ্বেই অর্থ পাচার অন্যতম আলোচিত বিষয়ে পরিণত হয়েছে।
সূত্র মতে, কয়েকটি সময়ে এখান থেকে টাকা পাচারের পরিমাণ বাড়ে। যেমন, নির্বাচনের প্রাক্কালে টাকা পাচারের পরিমাণ বাড়ে, এ ছাড়া দেশের ভেতরে অনিশ্চয়তা ও অস্থিতিশীলতা থাকলে এবং বিনিয়োগের সুযোগ না থাকলে তখনো টাকা পাচার বাড়ে। ঘটনাক্রমে এই তিনটি কারণই ধারাবাহিকভাবে বাংলাদেশে বিদ্যমান। এ কারণেই অব্যাহতভাবে বছরের পর বছর টাকা পাচারের পরিমাণ বেড়ে চলেছে।
জিএফআইয়ের প্রতিবেদন বাংলাদেশ থেকে অর্থ পাচারের তথ্য রয়েছে ২০০৪ সাল থেকে ২০১৩ সাল পর্যন্ত। এর মধ্যে সবচেয়ে বেশি অর্থ পাচার হয়েছে ২০১২ ও ২০১৩ সালে। এর মধ্যে ২০১৩ সাল ছিল নির্বাচনের আগের বছর। এই সময়ে অর্থ পাচারের পরিমাণ ছিল ৯৬৬ কোটি ৬০ লাখ ডলার এবং ২০১২ সালে পাচার হয়েছে ৭২২ কোটি ৫০ লাখ ডলার। এ ছাড়া ২০০৪ সালে পাচার হয় ৩৩৪ কোটি ৭০ লাখ ডলার, ২০০৫ সালে ৪২৬ কোটি ২০ লাখ ডলার, ২০০৬ সালে ৩৩৭ কোটি ৮০ লাখ ডলার, ২০০৭ সালে ৪০৯ কোটি ৮০ লাখ ডলার, ২০০৮ সালে ৬৪৪ কোটি ৩০ লাখ ডলার, ২০০৯ সালে ৬১২ কোটি ৭০ লাখ ডলার, ২০১০ সালে ৫৪০ কোটি ৯০ লাখ ডলার এবং ২০১১ সালে পাচার হয় ৫৯২ কোটি ১০ লাখ ডলার।
সিপিডির হিসাবে, ২০১৩ সালে পাচার হওয়া অর্থ দেশের শিক্ষা বাজেটের তুলনায় ৩ দশমিক ৬ গুণ বেশি, আর স্বাস্থ্য বাজেটের তুলনায় বেশি ৮ দশমিক ২ গুণ। পাচার হওয়া ওই অর্থের ২৫ শতাংশ হারে যদি কর পাওয়া যেত তাহলে স্বাস্থ্য বাজেট তিন গুণ এবং শিক্ষা বাজেট দ্বিগুণ করা সম্ভব হতো। সিপিডি তুলনা করে আরও দেখিয়েছে, ওই সময়ে পাচার হওয়া অর্থ বাংলাদেশের মোট দেশজ উৎপাদনের (জিডিপি) সাড়ে ৫ শতাংশ এবং ওই সময়ে বাংলাদেশের পাওয়া মোট বৈদেশিক সাহায্যের ৩৪০ শতাংশের সমান।
গবেষণায় প্রাপ্ত পরিসংখ্যানে মোট পাচার হওয়া অর্থের ৮৫ থেকে ৯০ শতাংশই হয় আন্তর্জাতিক বাণিজ্যের আড়ালে। বেশির ভাগ ক্ষেত্রেই আমদানি করা পণ্যের দাম বেশি দেখিয়ে অর্থ বাইরে পাচার করা হয়। সিপিডি এ বিষয়ে গবেষণা করে বাণিজ্যের ক্ষেত্রে এ ধরনের কিছু উদাহরণ দিয়েছে। যেমন, ২০১৪ সালের মার্চে সাড়ে ৫৪ শতাংশ আমদানি বৃদ্ধি পেয়েছিল, যা একটি রেকর্ড। এ সময়ে কেবল পুঁজি যন্ত্রপাতি আমদানি হয়েছে ৭৩ কোটি ডলারের, যা আগের বছরের একই সময়ের তুলনায় পাঁচ গুণ বেশি। আবার এ সময়ে ফ্রান্স থেকে কেবল ক্রেন (পণ্য ওঠানো-নামানোর যন্ত্র) আনা হয়েছে ৪৩ কোটি ৩০ লাখ ডলারের। পুঁজি যন্ত্রপাতি হিসেবে এর শুল্ক মাত্র ২ শতাংশ। ২০১৫ সালেও পুঁজি যন্ত্রপাতির দাম বেশি দেখানো হয়েছে।
সিপিডির দেওয়া আরেকটি উদাহরণ হচ্ছে ২০১৩-১৫ সময়ের মধ্যে বাংলাদেশে যত চাল বিদেশ থেকে আনা হয়েছে, তার আমদানি মূল্য ছিল টনপ্রতি ৮০০ থেকে ১ হাজার ডলার। অথচ এ সময়ে আন্তর্জাতিক বাজারে চালের গড় মূল্য ছিল টনপ্রতি প্রায় ৫০০ ডলার। সিপিডির প্রতিবেদনে উল্লেখ করা হয়েছে অনুসন্ধানী সাংবাদিকদের উদ্যোগে তৈরি ইন্টারন্যাশনাল কনসোর্টিয়াম ফর ইনভেস্টিগেটিভ জার্নালিস্টস (আইসিআইজি)-এর হিসাবও। ২০০৩ সালে ফাঁস করা তথ্য অনুযায়ী, অফসোর ব্যাংকিংয়ের সুবিধা নিয়ে অন্য দেশে ব্যাংক হিসাব খোলার সংখ্যা ৩৪টি। আর চলতি বছর ফাঁস করা পানামা পেপারস অনুযায়ী, বাংলাদেশের নাগরিকদের ব্যাংক হিসাবের সংখ্যা ২৭টি।
দেশ থেকে নানাভাবে অর্থ পাচারের এই বিষয়টি অর্থমন্ত্রী আবুল মাল আবদুল মুহিত নতুন বাজেট বক্তৃতায়ও উল্লেখ করেছেন। ২ জুন বাজেট বক্তৃতায় অর্থমন্ত্রী বলেছেন, ‘বিদেশে অর্থ পাচার এখন নিয়মিত আন্তর্জাতিক আলোচনার বিষয় হয়ে দাঁড়িয়েছে। ট্রান্সফার প্রাইসিংয়ের অপব্যবহার বন্ধ করে আন্তসীমান্ত কর ফাঁকি রোধকল্পে ইতিমধ্যে জাতীয় রাজস্ব বোর্ডের ট্রান্সফার প্রাইসিং সেল কাজ করছে। কিন্তু মনে হচ্ছে যে, এই বিষয়টিকে অধিকতর গুরুত্বসহকারে বিবেচনা করা প্রয়োজন। সেই উদ্দেশ্যে যথাযথ পরীক্ষা-নিরীক্ষার পর ট্রান্সফার প্রাইসিং, বিদেশি নাগরিকের কাছ থেকে কর আদায় এবং অর্থ পাচারের বিষয়টি বিবেচনার জন্য একটি স্বতন্ত্র ইউনিট জাতীয় রাজস্ব বোর্ড সৃজন করা হবে।’ কিন্তু দুঃখজনক হলেও সত্য যে, অর্থপাচারের বিষয়ে মাননীয় অর্থমন্ত্রীর আত্মস্বীকৃতি থাকলেও তা রোধ করার জন্য কোন ফলপ্রসূ বা কার্যকর ব্যবস্থা গ্রহণ করা হয়নি। ফলে জনমনে সন্দেহের সৃষ্টি হয়েছে যে, এসব পাচারের সঙ্গে এমন সব চক্র জড়িত যাদের কাছে সরকারও অসহায় অথবা সরকারের উদাসীনতা বা পৃষ্ঠপোষকতায় এসব হচ্ছে। আবার কেউ কেউ বলছেন সরকার দলীয় লোকজনই এসব পাচারের সাথে বেশী জড়িত।
অর্থ পাচার সম্পর্কে তত্ত্বাবধায়ক সরকারের সাবেক অর্থ উপদেষ্টা ড. আকবর আলি খান বলেছেন, শুধু কর ফাঁকি দিতে টাকা পাচার হয়ে যাচ্ছেÑবিষয়টিকে এতটা সহজ করে দেখলে চলবে না। বাংলাদেশের সর্বত্রই সুশাসনের ঘাটতি রয়েছে। আর করের হারও বেশি না। আসলে এ দেশে মানুষ টাকা রাখতে ভয় পায়। এ কারণেই অর্থ পাচার বাড়ছে।
তত্ত্বাবধায়ক সরকারের আরেক সাবেক অর্থ উপদেষ্টা মির্জ্জা আজিজুল ইসলাম বলেন, দেশের ভেতরে জীবন ও সম্পদের নিরাপত্তার অভাব থাকায় অনেকেই টাকা পাচারে উৎসাহিত হচ্ছে। অনেকে ব্যাংক থেকে ঋণ নিয়ে সেই ঋণও বিদেশে পাচার করে দিচ্ছে। বাংলাদেশ ব্যাংকের সাবেক গভর্নর ড. ফরাসউদ্দিন বিনিয়োগের পরিবেশ না থাকা এবং রাজনৈতিক অস্থিরতাকে অর্থ পাচারের অন্যতম কারণ হিসেবে উল্লেখ করে বলেন, দেশে বিনিয়োগবান্ধব পরিবেশ থাকলে অর্থ পাচার হতো না।
রাজনৈতিক অস্থিরতা ও সহিংসতার বিনিয়োগ বান্ধব পরিবেশ না থাকায় শুধু অর্থ পাচার নয় বরং বিদেশী বিনিয়োগেও ভাটার টান লেগেছে। সম্প্রতি বাংলাদেশে নিযুক্ত ইউরোপীয় দেশগুলোর রাষ্ট্রদূতরাও বিষয়টি নিয়ে এমনই মন্তব্য করেছেন। তাদের মতেÑবাংলাদেশে বিদেশি বিনিয়োগ না আসার অন্যতম কারণই হচ্ছে নিরাপত্তার অভাব। তারা ক্ষমতাসীন সরকারকে সরাসরিই বলেছে, বাংলাদেশে বহু ধরনের নৃশংসতা ঘটছে, বিদেশিদেরও হত্যা করা হচ্ছে। এগুলোর কোনো ব্যাখ্যা নেই, বিচারও নেই। নিরাপত্তার অভাবে দেশীয় উদ্যোক্তারাই যেখানে বিনিয়োগ না করে টাকা পাচার করে দিচ্ছে বিদেশে, সেখানে বিদেশি উদ্যোক্তারা আসবেন কেন? তবে নিরাপত্তাহীনতার কারণ কেবল একের পর এক দেশি-বিদেশি হত্যাকান্ড কিংবা আইনশৃঙ্খলার চরম অবনতি তা কিন্তু নয়।
আসলে মানুষ দেশে টাকা রাখতে ভয় পাচ্ছে। টাকা রাখার জায়গা ব্যাংক। সেই ব্যাংক এই সরকারের আমলে সবচেয়ে নিরাপত্তাহীন বা অনিরাপদ। দেশের ব্যাংকিং খাত থেকে গত সাত বছরে হাজার হাজার কোটি টাকা লুট হয়ে গেছে। কেন্দ্রীয় ব্যাংক পর্যন্ত এখন নিরাপদ নয়। সেটাও চুরি বা লুটপাটের শিকার। ফলে মানুষ টাকা রাখবে কোথায়! এ অবস্থায় যাদের সুযোগ আছে তারা টাকা বিদেশে পাচার করে দিচ্ছে।
মূলত দেশে সুশাসন ও রাজনৈতিক অস্থিরতার কারণেই দেশ থেকে ব্যাপকহারে মুদ্রা পাচারের ঘটনা ঘটছে। এক্ষেত্রে প্রাতিষ্ঠানিক উদাসীনতা ও অব্যবস্থাপনা অনেকাংশেই দায়ি। তাই মুদ্রাপাচারের সম্ভাব্য রুটগুলোতে প্রাতিষ্ঠানিক নজরদারী সময়ের সবচেয়ে বড় দাবি। তবে কেবল প্রাতিষ্ঠানিক ব্যবস্থা নিয়ে টাকা পাচার বন্ধ করা যাবে না বলে মনে করেন অর্থনীতিবিদরা। তাদের বিবেচনায়, এ জন্য সবচেয়ে বেশি প্রয়োজন রাজনৈতিক সদিচ্ছা, চলমান রাজনৈতিক সংকটের একটা গ্রহণযোগ্য ও শান্তিপূর্ণ সমাধান। রাজনৈতিক সদিচ্ছা না থাকলে যে সমস্ত কারণে ব্যাংকের খেলাপি ঋণ আদায় হয় না, পুঁজিবাজার লুটপাটের কোনো বিচার হয় না, ঠিক একই কারণে টাকা পাচারেরও কোনো সমাধান হবে না।
আসলে শাসন বিভাগের পৌণপৌণিক ব্যর্থতার কারণে দেশের অর্থবিভাগসহ কোন সেক্টরের স্থিতিশীলতা ফিরিয়ে আনা সম্ভব হচ্ছে না। অধ্যাপকের গার্নারের মতে, শাসন বিভাগের কার্যাবলীকে মোটামোটি পাঁচ ভাগে বিভক্ত করা যায়ঃ (এক) অভ্যন্তরীণ শান্তি ও শৃঙ্খলা বিষয়ক (Adminidtrative), (দুই) পররাষ্ট্রীয় ক্ষমতা ও বৈদেশিক সম্বন্ধ ( Diplomatic), (তিন) সামরিক ব্যবস্থা(Military), (চার) বিচার বিষয়ক ক্ষমতা( Judicial) ও (পাঁচ) আইন বিষয়ক ক্ষমতা (Lagislative).
সার্বিক দিক বিবেচনায় শাসন বিভাগের কোন অঙ্গই যথাযথাভাবে ক্রিয়াশীল নয়। আর এই নিষ্ক্রিয়তার কারণেই আমাদের দেশে আইনের শাসন এখ পর্যন্ত প্রতিষ্ঠিত হতে পারেনি। সঙ্গত কারণেই রাষ্ট্রের সকল ক্ষেত্রেই একটা অনাকাঙ্খিত নৈরাজ্য চলছে। দেশের অভ্যন্তরীণ শান্তি ও শৃঙ্খলা অনেক আগেই বিদায় নিয়েছে। একদেশদর্শী পররাষ্ট্রনীতির কারণেই বেশ এখন প্রায় বন্ধুহীন। দেশের সামরিক বিভাগও এখন প্রশ্নবিদ্ধ। বিচারবিভাগ ও আইন বিভাগের উপর সরকারের অনাকাঙ্খিত খবরদারিও সুষ্পষ্ট। মূলত শাসন বিভাগকে আইনের আওতায় নিরপেক্ষভাবে কাজ করতে না দিলে রাষ্ট্রের কোন ক্ষেত্রেই শৃঙ্খলা প্রতিষ্ঠিত হয় না বা আশাও করা যায় না। ফলে আমাদের জাতীয় জীবনের মহাসর্বনাশটা হয়েছে। দেশে সৃষ্টি হয়েছে হ-য-র-ল-ব অবস্থার। আর এ অবস্থা থেকে উত্তরণের আপাতত কোন পথ দেখা যাচ্ছে না।
সুশাসন ও রাজনৈতিক স্থিতিশীলতার অভাবে দেশের সকল সেক্টরে যে নৈরাজ্যকর পরিস্থিতির সৃষ্টি হয়েছে তা থেকে উত্তরণ ঘটাতে না পারলে আগামী দিনে আমাদের গন্তব্য নির্ধারণ করা খুবই কঠিন। নিরাপত্তার, রাজনৈতিক অস্থিতিশীলতা বা যে কারণেই হোক দেশের অর্থ যদি বিদেশে পাচার করা অব্যাহত থাকে আর বিনিয়োগ বান্ধব পরিবেশের অভাবে যদি বিদেশী উদ্যোক্তারাও পুঁজি গুটিয়ে নেন, তাহলে আমাদের ধবংসের পারমাণবিক বোমার বিষ্ফোরণ প্রয়োজন হবে না বরং দেশের অর্থনৈতিক সেক্টরে নৈরাজ্যের কারণে জাতির জীবনী শক্তির ক্রমেই দুর্বল থেকে দুর্বলতর তর হয়ে পড়বে। এক সময় তা জাতির অস্তিত্ব সংকটের রূপ নেবে। আর একথা বোঝার জন্য খুব বেশী পান্ডিত্য অর্জনের প্রয়োজন আছে বলে মনে হয় না।
বিষয়: বিবিধ
১১১৯ বার পঠিত, ০ টি মন্তব্য
পাঠকের মন্তব্য:
মন্তব্য করতে লগইন করুন